মাযহাব কি ও কেন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মাযহাব শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পথ, মত, ধর্ম, বিশ্বাস ইত্যাদি।মাযহাব, ইজতিহাদ, তাকলীদ শব্দগুলো আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত। বিশেষ করে মাযহাব শব্দটিই সর্বাধিক পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। ইজতিহাদ শব্দটি আরবী। অর্থ হল চেষ্টা করা, উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। পরিভাষায় ইজতেহাদ বলা হয়, যে সকল হুকুম-আহকাম কুরআন ও হাদীসের মধ্যে অস্পষ্ট রয়েছে।মুজতাহিদ স্বীয় মেধা ও গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো আহরণ করবেন। আর সে আহরণকারীকে বলা হয় মুজতাহিদ বা গবেষক। আর মুজতাহিদদের মত ও পথকেই বলা হয় মাযহাব। মুজতাহিদ গবেষণার মাধ্যমে যা অর্জন করেছেন এবং সে অনুযায়ী আমল করেছেন, তাঁর সেই আমল অনুসরণ করার নামই হল মাযহাব। মাযহাব অনুসরণ কারার নাম হল তাকলীদ। আর যিনি অনুসরণ করেন তিনি হলেন মুকাল্লিদ।

তাক্বলীদের আভিধানিক অর্থ হল ইত্তেবা বা অনুসরণ। পারিভাষিক অর্থ হল,যিনি কুরআন ও হাদিস গবেষণা করে তা থেকে হুকুম-আহকাম গ্রহণ করতে অক্ষম, তার জন্য এমন ব্যক্তি থেকে হুকুম-আহকাম জেনে নেয়া যে ব্যক্তি এ বিষয়ে অধিক জ্ঞানী তথা পারঙ্গম। আর এ ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী হলেন ফুক্বাহায়ে কেরাম তথা মুজতাহিদ। উদ্দেশ্য হল সেই ব্যক্তির কাছ থেকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের হুকুম জেনে নিয়ে সঠিকভাবে দ্বীনের আনুগত্য করা তথা আমল করা।তবে বিষয়টি আবার এমনও নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিবর্তে ঐ ব্যক্তিকে বিধানদাতা রূপে গ্রহণ করা। অতএব, তাক্বলীদ শিরক নয়, বরং ওয়াজিব একটি বিধান।

তাক্বলীদ হচ্ছে, ধর্মীয় অনুসরণের যোগ্য মুত্তাক্বী খাঁটি কোন বুযুর্গ তথা প্রসিদ্ধ মুজতাহিদগণের কথা ও কাজকে এই অবস্থার ভিত্তিতে গ্রহণ করা যে, তিনি কথা বা কাজ অবশ্যই কুরআন ও হাদিসের আলোকেই বলেছেন। সেই মুজতাহিদদের কথা মেনে নেয়া তথা সে অনুযায়ি আমল করাই হল তাকলীদ। (শরহে হুসামী)।

কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে তাকলীদঃ রাসূলের যুগেও তাক্বলীদ ছিল। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের কাছ থেকে তাকলীদ গ্রহণ করেছেন। তাঁরা একে অন্যের তাক্বলীদ করেছেন। সাহাবাদের তাক্বলীদ গ্রহণ করেছেন তাবেয়ীগণ। আর তাবেয়ীগণের তাক্বলীদ গ্রহণ করেছেন তবে-তাবেয়িগণ।ব

র্তমানেও আমরা তবে-তাবেঈগণের তাক্বলীদ অনুসরণ করছি। পবিত্র কুরআন-কারীমেও তাক্বলীদের কথা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধে যারা উলিল আমর তথা জ্ঞানী”। (সূরা নহল, আয়াত-৪৩)।

এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ও রাসূল (সা.)এর আনুগত্যের সাথে উলিল আমর তথা জ্ঞানীদের আনুগত্য করার কথাও উল্লেখ করেছেন। ‘উলিল আমর’ শব্দটির দ্বারা কুরআন সুন্নাহর ইলমের অধিকারী, ফক্বিহ ও মুজতাহিদ ইমামগণকেই বুঝানো হয়েছে। রইসুল মুফাসিস্রীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.)সহ সকল মুফাস্সিরে কেরাম এ মতের স্বপক্ষে রয়েছেন।

মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, যদি তোমরা না জান, তবে যারা জানে, অর্থাৎ- জ্ঞানী তথা মুজতাহিদদের কাছে জিজ্ঞাসা কর। (সুরা নাহল, আয়াত- ৪৩ এবং সূরা আম্বিয়া- ৭)। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, শরীয়তের বিধি-বিধান জানে না এরূপ মুর্খ ব্যক্তিদের উপর আলেমগণের অনুসরণ করা ওয়াজিব। আর এই অনুসরণ করাকেই তাক্বলীদ বলে। (তাফসিরে কুরতবী)।

হযরত হুযায়ফা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, জানি না আর কত দিন আমি তোমাদের মাঝে থাকবো; তবে আমার পরে তোমরা হযরত আবু বকর (রাযি.) ও হযরত ওমর (রাযি.) এ দু’জনকে ইত্তেবা (অনুসরণ) করে যাবে। (তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ)।

সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে মাযহাব শব্দটির প্রচলন হলেও তাঁরা মুজতাহিদ সাহাবীদের কাছ তাক্বলীদ করতেন এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে। (আহসানুল ফতওয়া- ১/৪১৫ পৃষ্ঠা)।

ইমাম দারেমী রচিত ‘সুনান’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর (রাযি.) এ আইন জারী করেন,যে মাসয়ালায় রাসূলুলাহ (সা.)এর হাদীস পাওয়া যাবে না, সে ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর (রাযি.)এর ফাতওয়ার ওপর আমল করতে হবে। যদি আবু বকর (রাযি.)এর ফাতওয়ায় না পাওয়া যায়, তাহলে আলেমদের পরামর্শের দ্বারা যে রায় গৃহীত হবে সে রায় কার্যকর করতে হবে। অথচ হযরত ওমর (রাযি.)ও ছিলেন একজন মুজতাহিদ এবং যাবতীয় গুণাবলীর পরিপূর্ণ অধিকারী। তা সত্ত্বেও জীবনভর আবু বকর (রাযি.)এর তাক্বলীদ করেছেন এবং তাঁর ফাতওয়া মোতাবেক রায় দিয়েছেন।উক্ত উদহারণ দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম ইজতিহাদী মাসয়ালা-মাসাইলের ক্ষেত্রে সমকালীন খলীফাদের মাযহাব মেনে চলতেন।

মাযহাবের সংখ্যাঃ সারা দুনিয়া জুড়ে প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের অনুসারীদের অস্তিত্বই বেশী পাওয়া যায়। মাযহাবের মধ্যে প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মাযহাব হল চারটি। যথা-

১. ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)এর মাযহাব। (মৃত্যু- ১৫০ হিজরী, বাগদাদ করাগারে)।

২. ইমাম মালিক (রাহ.)এর মালেকী মাযহাব। (মৃত্যু- ১৭৯ হিজরী, মদীনায়)।

৩. ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)এর শাফেয়ী মাযহাব। (মৃত্যু- ২০৪ হিজরী, মিশরে)।

৪. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)এর হাম্বলী মাযহাব। (মৃত্যু- ২৪১ হিজরী, বাগদাদে)।

এই চার মাযহাবই উৎসারিত হয়েছে কুরআন সুন্নাহ থেকে। কুরআন এবং হাদীসের মধ্যে যে মাসআলা-মাসায়িলগুলো সরাসরি উল্লেখ নেই, সেই সমস্ত মাসআলা-মাসায়িল

গুলোকে মূল উসূলের ওপর ভিত্তি করে কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন মাযহাবের ইমাম তথা মুজতাহিদগণ। যেহেতু এই চারটি মাযহাব-ই কুরআন এবং হাদিস থেকে উৎপত্তি হয়েছে, তাই চরটিকেই সঠিক ও হক মনে করতে হবে। চার মাযহাবের যে কোন একটিকে অনুসরণ করলেই মাযহাব মানা হয়ে যাবে। চার মাযহাবকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা কুরআন এবং হাদিস অস্বীকারের-ই নামান্তর।

আমলের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মাযহাবকে অনুসরণ করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেভাবে আমরা কোন নির্দিষ্ট ডাক্তারের কাছে যাই এবং শুধু তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ি তার দেয়া ঔষধ গ্রহণ করি, তেমনি রুহের চিকিৎসার জন্যও অনেক আলেমের মধ্য থেকে একজন আলেমকেই নির্বাচন করতে হবে। তাই মাযহাব মানার ক্ষেত্রে যার মাযহাবই অনুসরণ করবো, সর্বদা তাঁর মাযহাবই অনুসরণ করতে হবে। সাহবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)এর ইন্তিকালের পরে ইজতিহাদী মাসয়ালার ক্ষেত্রে এক খলীফারই তাক্বলীদ করেছেন। হাকিমুল ইসলাম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) বলেন, একাধিক মাযহাব মানলে বা মানার অনুমতি দিলে মানুষের ধর্ম পালন একটা খেলনার বস্তুতে পরিণত হয়ে যেত। কারণ, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সুবিধামত এক এক বিষয়ে এক এক মাযহাব অনুসরণ করবে।

যেমন- হানাফী মাযহাবের এক ব্যক্তি প্রচন্ড শীতের সময় ঠান্ড পানি দিয়ে ফজরের সময় ফজরের নামায পরার জন্য ওযু করে আসলো। নামায আদায়ের আগেই হঠাৎ তার শরীরের ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় আমাদের মাযহাব তথা ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)এর মতে তার ওযু নষ্ট হয়ে যাবে। পুণরায় ওযু করে এসে নামায পড়তে হবে। তখন সেই ব্যক্তি বললো, আমি এখন ইমাম শাফেয়ী (রাহ.)এর মাযহাব অনুসরণ করবো। অতএব আর ওযুর দরকার নেই।কিছুক্ষণ পরে ব্যক্তিটি আবেগে কোন মহিলার শরীর স্পর্শ করলো। তাকে বলা হলো, এবার তো শাফেয়ী মাযহাব অনুযায়ীই আপনার ওযু ভেঙ্গে গেছে। তখন সেই ব্যক্তি জবাব দিলেন, এখন আমি আবার হানাফী মাযহাব অনুসরণ করবো। সুতরাং এখনও আমার জন্য নতুন ওযুর প্রয়োজন নেই।

এ ধরণের সুবিধাবাদি লোকদের দিক বিবেচনা করেই ফুক্বাহায়ে কেরাম যে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (তিরমিযি ও ইসলাহুর রুসুম-২১)।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা শফি (রাহ.) বলেন, এটা প্রকৃতপক্ষে একটা শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য দ্বীনি ক্ষেত্রে নিয়ম ঠিক রাখা এবং মানুষকে আত্মপ্রবৃত্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখা।

হাদিস বিশারদ ও ইমামগণও মাযহাব অনুসরণ করেছেনঃ ইমাম বুখারী (রাহ.) শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণ করেছেন। ইমাম মুসলিম (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম নাসাই (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম আবু দাউদ (রাহ.) হাম্বলী, পরে শাফেয়ী, মিশকাত প্রণেতা শাফেয়ী, ইমাম নববী (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম বগভী (রাহ.) শাফেয়ী, ইমাম ত্বাহাভী (রাহ.) হানাফী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) হাম্বলী, শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.) হানাফী, ইমাম ইবনে কাইয়্যিম (রাহ.), ইমাম আবদুল বার ও ইমাম বাত্বাল (রাহ.) মালেকী, ইমাম হালাবী ও ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রাহ.) হানাফি মাযহাবী ছিলেন।

শেষ কথাঃ তাক্বলীদ তথা মাযহাব মানা ওয়াজিব। কাজেই কুরআন-হাদীস মানতে হলে মাযহাব মানতে হবে। মাযহাব মানা মানেই কুরআন মানা, হাদীস মানা। মাযহাব অস্বীকার করা মানেই কুরআন-হাদীস অস্বীকার করা। নব্য সালাফী ও লা-মাযহাবী ভাইদের বলবো, আপনারা মাযহাব নিয়ে সরলমনা মুসলমানদের ধোঁকা না দিয়ে নিজেরা মাযহাব মেনে চলার চেষ্টা করুন এবং অপর মুসলমানদেরকে মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদেরকে মাযহাব মানার জন্য উৎসাহিত করুন। লা-মাযহাবী এবং নব্য সালাফীসহ আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মাযহাব অনুসরণ করে চলার তাওফীক দান করুন। আমিন

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment