দরুদ শরীফও কি বেদাত হতে পারে.! মসজিদে প্রবেশ এবং বের হওয়ার পূর্বে সালাম পেশ করেন তো!
—
আজকাল কিছু তথাকথিত পন্ডিতের মুখে এটা খুব বেশি শোনা যায় যে, নামাজে পাঠ্য দরুদ শরীফ ছাড়া অন্য যেসব দরুদ পড়া হয় সেগুলো বেদাতী দরুদ। অথচ আমরা সকলেই সবসময় যে দরুদ ও সালাম “ﷺ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)” পড়ে থাকি, সেটাও রাসূলে পাক ﷺ এঁর শিখানো দরুদ নয়, মানুষের বানানো দরুদ। নিজের ফতোয়ায় নিজেই বিদাতী হয়ে যাচ্ছেন, সকল মুহাদ্দিসকেও বিদাতী বানিয়ে দিচ্ছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদেরকে দরুদ (সালাত) ও সালাম উভয়টিই পড়ার হুকুম করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ মহান নবীর উপর সালাত (দরুদ) পড়েন। ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরাও নবীর উপর দরুদ পাঠ কর এবং (যথোপযুক্ত) সম্মানের সাথে সালাম জানাও।” (সূরা আহযাবঃ ৫৬)
[আবুল ‘আলীয়া (রহ.) বলেন, আল্লাহর সালাতের অর্থ মালায়িকার সম্মুখে নাবীর প্রতি আল্লাহর প্রশংসা। মালাইকা সালাতের অর্থ- দু‘আ। ইবনু ‘আববাস (রাঃ) বলেন, يُصَلُّوْنَ -এর অর্থ-বরকতের দু‘আ করছেন। لَنُغْرِيَنَّكَ আমি তোমাকে বিজয়ী করব।
(সহীহ বুখারী ৪৭৯৭)]
কিন্তু নামাজের মধ্যে যে দরুদ পড়া হয় তাতে সালাম নেই কেননা তাশাহুদের মধ্যেই সালাম আদায় হয়ে যায়।
আবদুর রহমান ইবনু আবূ লাইলা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কা‘ব ইবনু উজরা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, আমি কি আপনাকে এমন একটি হাদিয়া দেব না যা আমি নবী ﷺ হতে শুনেছি? আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি আমাকে সে হাদিয়া দিন। তিনি বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আপনাদের উপর অর্থাৎ আহলে বাইতের উপর কিভাবে দরূদ পাঠ করতে হবে? কেননা, আল্লাহ তো আমাদেরকে (তাশাহুদের মাধ্যমে) জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা কিভাবে আপনার উপর সালাম (পাঠ) করব (আসসালামু আ’লাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যু)। তিনি বললেন, তোমরা এভাবে বল, (যে দরুদ শরীফ আমরা নামাজের মধ্যে পড়ি) (যার অর্থ)
‘‘হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ﷺ এবং মুহাম্মাদ ﷺ-এঁর বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেরূপ আপনি ইবরাহীম (আঃ) এবং তাঁর বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি অতি প্রশংসিত, অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ ﷺ এবং মুহাম্মাদ ﷺ এঁর বংশধরদের উপর তেমনি বরকত দান করুন যেমনি আপনি বরকত দান করেছেন ইবরাহীম (আলায়হিস সালাম) এবং ইবরাহীম (আলায়হিস সালাম) এঁর বংশধরদের উপর। নিশ্চয়ই আপনি অতি প্রশংসিত, অতি মর্যাদার অধিকারী। (সহীহ বুখারী ৩৩৭০)
[এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, এই দরূদকে কেন দরূদে ইব্রাহিমী বলা হয়!! এটাকে কি আমাদের নবী দরুদে ইব্রাহিমী বলেছেন?? এটা কি হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস সালাম ও উনার বংশধরদের উপর কিভাবে দরুদ পড়া হবে, তা শিখাতে গিয়ে শিখানো হয়েছে??]
স্পষ্টতই প্রমাণ হল, নামাজে যে দরুদ পড়া হয়, তাতে সালাম নেই, কিন্তু আল্লাহর হুকুম উভয়টি আদায় করা। তাই দরুদ ও সালামের শুধু একটি পড়াকে ইমাম নববী রহঃ মাকরূহ বলেছেন, ইবনে হাজর হায়সামী রহঃ মাকরুহে তানযীহী বলেছেন। দরুদ ও সালামের শব্দ সম্বলিত যেকোন বাক্য দ্বারা আদায় করলেই দরুদ ও সালাম আদায়ের সাওয়াব পাওয়া যাবে, সেই ভাষা (শব্দ) রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হওয়া জরুরী নয়। এগুলো আমার কথা নয়, পূর্ববর্তী ইমামগণের মতামতই উল্লেখ করেছি, তাফসীরে জালালাইন শরীফের সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতের হাশিয়াতেও এসব লেখা পাবেন। এজন্যই হাদিসের কিতাবসমূহেও “ﷺ” ব্যবহার করা হয়েছে যাতে সালাত ও সালাম উভয়টিই আদায় হয়। এটা রাসূলের শেখানো দরূদ নয়, অামাদের বানানো দরূদ। সুতরাং দরূদ ও সালামের ক্ষেত্রে বেদাতী দরুদ বলার কোন সুযোগ নেই। নামাজের মধ্যে যে দরুদ শরীফ পড়া হয়, তা নামাজের জন্যই উত্তম কিন্তু ওখানে সালাম নেই কেননা তাশাহুদের মধ্যেই সালাম দেয়া হয়, তাই আমাদের উচিৎ নামাজের বাইরে এমন দরুদ শরীফ পড়া যাতে সালাত (দরুদ) ও সালাম উভয়টিই আদায় হয়। এছাড়াও লক্ষনীয় বিষয় হল শুধু সালাম দিতে বলা হয়নি, যথাযথ সম্মান সহকারে সালাম আদায় করতে বলা হয়েছে (আশা করছি ধরতে পেরেছেন কোনদিকে ইঙ্গিত করলাম)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বেশি বেশি দরুদ ও সালাম আদায় করার তাওফিক দান করুক।
সালাম থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছেন না তো…!
আবূ তালহা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ﷺ একদিন (আমাদের কাছে) আগমন করলেন। তখন তাঁর চেহারায় প্রফুল্লতা দৃষ্টি গোচর হচ্ছিল। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমরা আপনার চেহারায় খুশী লক্ষ্য করছি, যা আগে কখনো দেখিনি। তিনি বললেন, “হাঁ। একজন ফিরিশতা (জিবরীল আলায়হিস সালাম) আমার কাছে এসে বললেন, ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আপনার রব আপনার উদ্দেশ্যে বলেছেন: ‘আপনাকে কি এই সংবাদ খুশি করে না যে, আপনার উম্মতের মধ্য থেকে যদি কোন ব্যক্তি আপনার উপর একবার সালাত (দরুদ) পাঠ করে আমি তাকে দশবার রহমত করব, আর কেউ যদি আপনাকে একবার সালাম পাঠায় আমি তার প্রতি দশবার সালাম পাঠাব।’ তিনি বলেন, “আমি বললাম, হ্যাঁ ।” [সূনান আদ-দারেমী ২৮১১, সূনান নাসাঈ ইফাঃ ১২৮৩, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৯২৮]
اَلصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُول اللّهِ ﷺ
اَلصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا خَاتَمَ النَّبِيينَ ﷺ
এবার একটি অবহেলিত সুন্নাহ নিয়ে কথা বলব।
আর তা হচ্ছে মসজিদে প্রবেশ এবং মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় নবীজির উপর সালাম পেশ করা।
আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, ছোটবেলা থেকেই মসজিদে প্রবেশের এবং বের হওয়ার ছোট্ট দোয়াটুকুই শেখানো হয় এবং অধিকাংশ মসজিদের দেয়ালেও শুধুমাত্র ঐটুকুই লেখা থাকে। কিন্তু হাদিসে পাকে দেখা যায় যে, প্রিয় নবী ﷺ মসজিদে প্রবেশের পূর্বে স্বয়ং নিজের উপর সালাম পাঠ করতেন এবং আমাদেরকেও তাঁর উপর সালাম পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর তিনি দোয়া পড়তেন/ পড়ার নির্দেশ দেন। যেমনঃ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমাদের যে কেউ মসজিদে প্রবেশকালে যেন নবী ﷺ -এঁর প্রতি সালাম পেশ করে, তারপর যেন বলেঃ
اللَّهُمَّ افْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ
এবং বের হওয়ার সময় যেন বলেঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ
(সূনান ইবনে মাজাহ ৭৭২, সূনান আবূ দাউদ ৪৬৫)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমাদের যে কেউ মসজিদে প্রবেশকালে যেন নবী ﷺ এঁর প্রতি সালাম পেশ করে, অতঃপর বলেঃ
” اللَّهُمَّ افْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ “
এবং বের হওয়ার সময়ও যেন নবী ﷺ এঁর প্রতি সালাম পেশ করে, অতঃপর বলেঃ
” اللَّهُمَّ اعْصِمْنِي مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ”
(সূনান ইবনে মাজাহ ৭৭৩)
রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর কন্যা ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মসজিদে প্রবেশকালে বলতেনঃ
“ بِسْمِ اللَّهِ وَالسَّلاَمُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذُنُوبِي وَافْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ ”
তিনি (মসজিদ থেকে) বের হওয়ার সময় বলতেনঃ
” بِسْمِ اللَّهِ وَالسَّلاَمُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذُنُوبِي وَافْتَحْ لِي أَبْوَابَ فَضْلِكَ ”
(সূনান ইবনে মাজাহ ৭৭১, তিরমিযী ৩১৪)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মসজিদে প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার সময় তিনটি আমল লক্ষনীয়-
১. বিসমিল্লাহ পাঠ করা,
২. নবীজির উপর সালাম পেশ করা,
৩. অতঃপর দোয়া পাঠ করা।
সেক্ষেত্রে প্রবেশের সময়ঃ
“বিসমিল্লাহি ওয়াছছলাতু ওয়াসসালামু আলা রসূলিল্লাহি আল্ল-হুম্মাফ তাহলি আবওয়াবা রহমাতিক।”
এবং বের হওয়ার সময়ঃ
‘বিসমিল্লাহি ওয়াছছলাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহি আল্ল-হুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদ্বলিক।’
পড়তে পারি বা তিনটিই (বিসমিল্লাহ পাঠ, সালাম প্রেরণ, দোয়া পাঠ) আলাদা আলাদা ভাবে আদায় করতে পারি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর ফরমানঃ যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। [তিরমিযী ২৬৭৮, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৭৫]
এক্ষেত্রে আরো একটি লক্ষনীয় ব্যাপার এই যে, মসজিদে প্রবেশ কিংবা বের হবার সময় তো দাঁড়িয়েই সালাম পেশ করা হবে কেননা কেউ তো আর বসে বসে মসজিদে প্রবেশ কিংবা বের হয়না, ফলে দাঁড়িয়ে সালাতু সালাম পেশ করলে যাদের দাত অতিক্রম করে বিদাত শব্দটি বের হয়ে যায় তাদের জন্যও এতে শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে।