খুতবাতু গাদীরে খুম (১)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

খুতবাতু গাদীরে খুম (১)

(خطبة غدير خم)

মূল: মাহাজ্জাহ-ডট-কম

অনুবাদক: নাঈম আল-জা’ফরী

بسم الله الرحمن الرحيم

نحمده ونصلي على رسوله الكريم

মহান আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়।

দাবী উত্থাপন করা হয়ে থাকে ১৮ই জিলহাজ্ব ১১তম হিজরীতে

হযরত আলী (কাররামাল্লাহু তা’আলা ওয়াজহাহু) কে গাদির খুম্মের ভাষণে খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

এরই প্রেক্ষাপটে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে,

৫:৬৭ یٰۤاَیُّهَا الرَّسُوۡلُ بَلِّغۡ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ ؕ وَ اِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَهٗ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡصِمُکَ مِنَ النَّاسِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۶۷﴾

“হে রাসূল, পৌছেদিন যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনা প্রতি আপনা রবের নিকট থেকে এবং যদি এমন না হয় তবে আপনি তাঁর বাণী পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষের হাত থেকে।নিঃসন্দেহে আল্লাহ কাফিরদের সুপথ প্রদান করবেন না ।” (সুরা মায়েদা : ৬৭​​) এবং ফলস্বরূপ হজ্জত আল ওয়াদার পর গাদিরে খুম্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

اللَّهُمَّ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ

“মান কুনতো মাওলা ফা’হাযা আলীউন মাওলা। আল্লাহুম্মা ওয়ালি মান ওয়ালা ওয়া ‘আদি মান ‘আদাহ।” অ‍র্থাৎ আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ তার বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব করুন এবং তার শত্রুদের অবমাননা করুন।​​ এখানে আলী সফলতা নিশ্চিত করা হয়েছে, এবং আবু বকর এবং উমর সহ যারা শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তাহারা সকলেই তাঁকে

অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন, এবং তাহারা ইমামকে বলেছিলেন,

هَنِيئًا يَا ابْنَ أَبِي طَالِبٍ أَصْبَحْتَ وَأَمْسَيْتَ مَوْلَى كلَّ مُؤمن ومؤمنة

“সাবাশ, ইবনে আবি তালিব, আপনি রাতারাতি সকল মুমিনদের মাওলা হয়ে যান।”

এ হাদীসখানা ইমাম আহমদ হযরত বারা ইবনে আযিব এবং হযরত যায়দ ইবনে আরক্বাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হরেছে; যেমনটি মিশকাত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। (মাদারিজুননুবূয়ত ও আসাহহুস্ সিয়র ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।)

মহানবী (সাঃ) তাঁর বক্তৃতা শেষ করার পরপরই, কোরানের নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়,

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ

“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন কে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলাম কে হিসেবে দ্বীন মনোনীত করলাম।” (সুরা মায়েদা : ০৩)

প্রতিক্রিয়া

ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা ১৮ই জিলহাজ্ব দুইটি ঘটনা বিশেষ ভাবে দেখতে পাই। একটি ঘটনা হলো ১১তম হিজরীতে হযরত আলী (কঃ) এর ফজিলত সম্পর্কীয় এবং অন্যটি হলো ৩৫ হিজরীতে তৃতীয় খলিফ হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) এর শাহদাত বরণ।

প্রথমত আমরা ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান ইবন আফ্‌ফান (আরবি: عثمان بن عفان‎‎; জন্মঃ আনু. ৫৭৯ – মৃত্যুঃ ১৭ জুন ৬৫৬) সম্পর্কে আলোকপাত করবো। ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। উসমান (রাঃ) আস-সাবিকুনাল আওয়ালুনের (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী) অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি আশারায়ে মুবাশ্‌শারা’র একজন এবং সেই ৬ জন সাহাবীর মধ্যে অন্যতম যাদের উপর মুহাম্মদ (সাঃ) সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি কুরাইশ গোত্রের বিশিষ্ট বংশ বনু উমাইয়ায় গোত্রে জন্মগ্রহণকারী। তিনি কুরআনের আদর্শ সংস্করণ সংকলনের আদেশ দেওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন।

মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,

১/ হযরত মুর্রাহ ইবনে কা’ব (রা:) বর্ণনা করেন:

فذكر فتنة فقربها فمر رجل متقنع فقال هذا يومئذ على الهدى قال فاتبعته حتى أخذت بضبعيه فحولت وجهه إليه وكشفت عن رأسه وقلت: هذا يا رسول الله قال: نعم فإذا هو عثمان بن عفان رضي الله تعالى عنه

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সহসা সংঘটিতব্য (মুসলমানদের অগ্নি) পরীক্ষাসমূহ সম্পর্কে উল্লেখ করছিলেন; সে সময় চাদরে আবৃত জনৈক ব্যক্তি ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মন্তব্য করেন: “সেই (পরীক্ষার) সময় এই ব্যক্তি সত্যের ও হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন।” আমি লাফ দিয়ে উঠে দেখতে গেলাম চাদরে জড়িত ব্যক্তিটি কে। তিনি হযরত উসমান (রাঃ)। আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’এর কাছে গেলাম, সরাসরি তাঁর কাছে আরজ করলাম: “তিনি-ই কি এই ব্যক্তি?” সাইয়্যেদুনা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জবাব দেন: “হ্যাঁ, এ-ই সে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে খুনিরা বিদ্রোহী, বিপথগামী এবং মিথ্যাবাদী হবে।[ (ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ৩৭/৮২, হাদীস নং ১৭৪২৭।

(খ) তাবারানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১৪/৩৩।]

২/

إِنَّكُمْ تَلْقَوْنَ بَعْدِي فِتْنَةً وَاخْتِلَافًا أَوْ قَالَ اخْتِلَافًا وَفِتْنَةً فَقَالَ لَهُ قَائِلٌ مِنْ النَّاسِ فَمَنْ لَنَا يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ عَلَيْكُمْ بِالْأَمِينِ وَأَصْحَابِهِ وَهُوَ يُشِيرُ إِلَى عُثْمَانَ بِذَلِكَ

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (দ:) বলেন: “অনতিবিলম্বে তোমরা একটি (অগ্নি) পরীক্ষা ও মতবিরোধের মুখোমুখি হবে।” সাহাবা (রা:)’দের একজন জিজ্ঞাসা করেন: “সেই সময় আমাদের নেতা কে হবেন, অথবা আপনি আমাদের প্রতি কাকে অনুসরণ করবার আদেশ দেন?” সাইয়্যিদুনা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হযরত উসমান (রা:)’এর দিকে ইশারা করে জবাব দেন: “তোমাদের নেতার সাথে থেকো এবং তারই আনুগত্য করো।”

[ (ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ১৭/২২৭, হাদীস নং ৮১৮৫।

(খ) বায়হাকী : দালায়িলুন নবুওয়াত, ৭/২২৪, হাদীস নং ২৬৮৫।

(গ) আল খতিব : মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩/৩২৫, হাদীস নং ৬০৭৩।

(ঘ) তাবারানী : আল মু‘জামুল আওসাত, ২০/৩০৯, হাদীস নং ১১৫১৪ ]

যদি হযরত উসমান (রা:)’এর আনুগত্য (হাদীস মোতাবেক) বাধ্যতামূলক হয়, তবে সন্দেহ নেই যে তাঁর খুনি ও ফিতনা সৃষ্টিকারী তথা গণ্ডগোলকারীরা বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতকারী হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ হবে।

৩/ একবার রাসূলুল্লাহ (দ:) হযরত উসমান (রা:)’কে সম্বোধন করে বলেন:

يا عُثمانُ، إنَّهُ لعلَّ اللهَ يقمِّصُكَ قميصًا، فإن أرادوكَ على خَلعِهِ فلا تخلعْهُ لَهُم

“আল্লাহ তোমাকে (খিলাফতের) আঙরাখা দ্বারা সম্মানিত করবেন। মুনাফিকরা যদি তোমার ওই আঙরাখা অপসারণের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তবে তা অপসারণ করবে না! তা অপসারণ করবে না! “

[তিরমিযী : আস সুনান, ফি মানাকিবে উসমান (রাঃ), ১২:১৬৬, হাদিস নং : ৩৬৩৮]

৪/ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

ذكر رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّم فتنةً فقال يُقْتَلُ فيها هذا مظلومًا لعثمانَ بنِ عفانَ رَضِيَ اللهُ عنه

“উসমান (রা:) একটি বিবাদ বা পরীক্ষায় শহীদ হবে। সে-ই হবে নির্যাতিত-নিপীড়িত জন।” [তিরমিযী : আস সুনান, ১২/১৬৯, হাদিস নং : ৩৬৪১]

এই বর্ণনাগুলি থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, খলীফা উসমান (রা:)’এর হত্যাকারীরা যেমন ছিলো প্রকৃত দুষ্কৃতকারী ও অত্যাচারী, তেমনি মোনাফেক ও বিদ্রোহীও। কেননা তাদের উদ্দেশ্যই ছিল খলীফা উসমান (রা:)’এর খেলাফতের আঙরাখাটি অপসারণ করা, যা সাইয়্যিদুনা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে অপসারণ বা হস্তান্তর না করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

হযরতে ইমামে আলী (ক:)-ও এ সমস্ত লোককে বিদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং তাদের কে জাহেলিয়াত যুগের (ইসলাম-পূর্ব অজ্ঞতার যুগের) কাফেরদের সাথে তুলনা করেছিলেন। হযরত আলী (ক:)’এর উপরোক্ত খুতবা লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘তারীখ আল-তাবারী’ (৩য় খণ্ড, ৫০৭ পৃষ্ঠা), আল-খুদরী’র ‘সীরাত আল খুলাফা’ (৭৮ পৃষ্ঠা) এবং অন্যান্য গ্রন্থে।

মিসর, বসরা ও কুফা থেকে আগত আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’র অনুসারী বিদ্রোহী গোষ্ঠী একাট্টা হয়ে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় সমবেত হয়ে খলিফার পদত্যাগ দাবি করে। খলিফা পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তারা হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। হযরত ওসমান (রাঃ) রক্তপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মুষ্টিমেয় বিদ্রোহীর কঠোর শাস্তিদানের পরিবর্তে তিনি তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে থাকলেন। অবশেষে ১৮ জিলহাজ ৩৫ হিজরি (১৭ জুন ৬৫৬ খ্রিঃ) ( তারিখে তাবারী, খন্ড ১৫) শুক্রবার আসরের নামাজের পর ৮২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ বিশাল আরব জাহানের খলিফাকে অত্যন্ত বর্বরভাবে পবিত্র কোরআন পাঠরত অবস্থায় হত্যা করা হয়।

আববাসীয় খলীফা মুতী‘ বিন মুক্বতাদিরের সময় তাঁর কট্টর শী‘আ আমীর মুইযযুদ্দৌলা ৩৫১ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখ কে ঈদে গাদীর ঘোষণা করেন। ফলে তখন থেকে এই দিনটি শী‘আদের মধ্যে ইসলামের অন্যতম ইবাদাত, ১০ই যিলহাজ্জের কুরবানীর ঈদ তথা ঈদুল আযহার চাইতেও বেশী গুরুত্ব পায়। বস্তুত ১৮ই যিলহজ্জ হাযরাত উছমান (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের দিবস থেকে মুসলমানদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুড়িয়ে দেওয়ার জন্য শী‘আরা এই দিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে ঘোষণা করে।

চলবে——

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment