ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

রাহমাতুল্লিল আলামীন সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনকে কেন্দ্র করে মিলাদ-মাহফিল উদ্যাপন করা জগতখ্যাত আল্লামা ও মনীষীদের দৃষ্টিতে শুধু বৈধ নয় বরং অন্যতম ইবাদত।

এটি এ মহাদেশের বা এ শতাব্দীর উদ্ভাবিত নয় বরং প্রায় আটশত বছর পূর্ব থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদ্যাপিত হয়ে আসছে এবং বিশ্বের সর্বজন গ্রহণযোগ্য ওলামা-মাশায়েখ ও সর্বস্তরের মুসলমানগণ তা পালন করে আসছেন। বর্তমানেও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন এবং অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত।

ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতে- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই নিজের মিলাদ উদ্যাপন করেছেন, আর তা হলো তিনি নুবূয়ত প্রকাশের পর নিজের আক্বীকা নিজেই করেছেন অথচ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর আক্বীকা সম্পন্ন করেছেন তাঁর জন্মের পরেই। তাই এটা ছিল মূলত তাঁর মিলাদ উদ্যাপন। [বায়হাক্বী ও মুসনাদে বাজ্জার খ-১০, পৃ.১৩, তাবরানী, আর রাজ্জাক, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী, আল-হাভী লিল ফাতাওয়া, খ-১, পৃ. ১৮৯]

আবার অনেক মুহাক্কিক বলেছেন- প্রিয়নবীর প্রতি সোমবার রোযা পালন করা এবং উম্মতদেরকে ঐ দিন রোযা রাখার পরামর্শই প্রমাণ করে তিনি নিজের মিলাদ নিজেই উদ্যাপন করেছেন। শাইখে মক্কা আল্ মুর্কারমা আল্লামা আলাভী মালেকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর কিতাব حول الاحتفال بالمولد النبى الشريف এ এবং আল্লামা হাসান সানদুভী তাঁর تاريخ الاحتفال بالمولد النبى من عصر الاسلام الاول الى عصر الفاروق الاول নামক কিতাবে প্রিয় নবীর যুগ থেকে আইয়ুবী ও উসমানীসহ অন্যান্য ইসলামী খেলাফতামলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যেভাবে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন হতো তার একটি বিস্তারিত তালিকা সন সহ উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি আল্লামা আলভী তাঁর কিতাবে মিলাদুন্নবীর সমর্থনে এ পর্যন্ত যত কিতাব লেখা হয়েছে তার একটি তালিকাও উল্লেখ করেছেন।

ওদিকে ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁরحسن المقصد فى عمل المولد নামক কিতাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বপ্রথম মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপনকারী হিসেবে, সুলতান সালাহউদ্দিন আল আইয়ূবীর শাসনকালে ‘ইরবিল’ এর প্রসিদ্ধ ন্যায় বিচারক শাসক ও প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন বাদশাহ্ মুজাফ্ফর আবু সায়ীদ কুকারবী বিন জাইনুদ্দিন আলী বিন বক্তগীনকে আখ্যায়িত করেছেন। যা ছিল ৬০৪হিজরীতে। [ইমাম সুয়ূতী: হুসনুল মাকছিদ ফি আমানিল মাওলিদ]

যাঁকে ইমাম ইবনে কাছীর একজন অত্যন্ত খোদাভীরু আলেম ও ন্যায় বিচারক শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (ইবনে কাছীর, বিদায়া নিয়াহা, খ-১৩, পৃ. ১৩৬) এবং ইমাম যাহাভী তাঁকে একজন মুহাদ্দিস ও ফকিহ্ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর জন্ম- ৫৪৯হি., ১১৫৩খৃ. এবং ইন্তিকাল-৬৩০হি.,১২৩২খৃ. ইরবিল- ইরাকের একটি শহর, বর্তমানে তা কুর্দী অধ্যুষিত এলাকা। )ইমাম যাহাবী, سير أعلام النبلاء (সিয়ারু আ’লামিল নুবালা) খ.-২২, পৃ. ৩৩৬]

ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকানও তাঁকে নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন- ‘যখন ইমাম আবুল খাত্তাব ইবনে দিহ্য়া যখন মিলাদুন্নবীর এ মহা আয়োজনকে দেখতে পেলেন তখন তিনি তার সমর্থনে একটি স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করে বাদশাহকে উপহার দেন এবং কিতাবটির নামকরণ করেন- التنوير فى البشير النذير, বাদশাহ্ তা পাঠ করে খুশী হয়ে লেখককে এক হাজারটি স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন। [ইবনে খাল্লিকান, تاريخ خلكان]

নিম্নে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জগতখ্যাত কয়েকজন আল্লামার (মহাজ্ঞানী) অভিমত পেশ করা হলঃ

* ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি (ইন্তিকাল ৯১১হি, ১৫০৫খৃ.)
——————————————————————
السيوطي، حيث قال: ” عندي أنَّ أصلَ عَمَل المولد الذي هو اجتماعُ النَّاس وَقراءَة ما تيسَّرَ منَ القُرآن وَروايةُ الأَخبارِ الواردة في مبدَإ أمْرِ النبيِّ صَلى الله عليه وَآلهِ وَسلَّم وَمَا وَقعَ في مَولده منَ الآيات ثُمَّ يُمدُّ لَهمْ سماطٌ يأكلونَه ويَنصرفونَ من غير زيادةٍ عَلَى ذلك هو من البدع الحَسنةِ التي يُثاب ُعَليها صاحبُها، لما فيه من تعظيمِ قَدرِ النبيِّ صلَّى الله عليه وآله وسلم وإظهار الفرح والاستبشار بمولدهِ الشريفِ، ” [ حسن المقصد في عمل المولد.، تأليف: جلال الدين السيوطي، ص৪.]
আমার দৃষ্টিতে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মূলে হলো- কিছু লোকের সমবেত হয়ে কোরআন তেলাওয়াত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর জন্মপূর্ব এবং জন্মকালীন বিভিন্ন নিদর্শনাবলী ও সুসংবাদ এবং তৎসংক্রান্ত বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতসমূহ বর্ণনা করা এবং উপস্থিত লোকদের জন্য কিছু খানা-পানির ব্যবস্থা করা। যা এমন একটি উত্তম কাজ যাতে তাদেরকে অনেক পূণ্য বা সাওয়াব দান করা হবে। কেননা এতে রয়েছে- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান এবং তার পবিত্র শুভাগমনে আনন্দ ও খুশী প্রকাশ। [দেখুন ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী রচিত حسن المقصد فى عمل المولد পৃ. ৪, ইমাম ইবনে হাজার আল হাইতামী, تحفة المحتاج فى شرح المنهاج এর نكاح অধ্যায়, الصداق পর্ব, قصل وليمة العرس ,পৃ. ৪৩২, প্রকাশক- دار احياء التراث]

* ইমাম ইবনুল জাওযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, (ইন্তিকাল-৫৯৭ হি.)
——————————————————————————-
ابن الجوزي، حيث قال عن المولد النبوي: ” مِنْ خَوَاصِّه اَنَّه اَمَانٌ فِىْ ذلِكَ الْعَامِّ وَبُشْرى عَاجِلَةٌ بِنَيْلِ الْبُغْيَةِ وَالْمَرَامِ ”
[ السيرة الحلبية، تأليف: علي بن برهان الدين الحلبي، ১/৮৩ – ৮৪.].
মিলাদুন্নবীর উপকারিতাসমূহের অন্যতম হলো- তা ঐ বছরটির জন্য নিরাপত্তা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যপূরণ হবার আগাম সুসংবাদ। [সিরাতে হালাবীয়্যাহ্: ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দিন হালাবী, খ.-১, পৃ.-৮৩-৮৪]

* ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, (ইন্তিকাল- ৮২৫হি.)
———————————————————————————-
ابن حجر العسقلاني، حيث قال الحافظ السيوطي: “وقد سئل شيخ الإسلام حافظ العصر أبو الفضل ابن حجر عن عمل المولد فأجاب بما نصه: أَصْلُ عَمَلِ الْمَوْلِدِ بِدْعَةٌ لَمْ تُنْقَلْ عَنِ السَّلَفِ الصَّالِحِ مِنَ الْقُرُوْنِ الثَّلاَثَةِ، وَلكِنَّهَا مَعَ ذلِكَ قَدْ اشْتَمَلَتْ عَلَى مَحَاسِنَ وَضِدِّهَا، فَمَنْ تَحَرَّى فِيْ عَمَلِهَا الْمَحَاسِنَ وَتَجَنَّبَ ضِدَّهَا كَانَتْ بِدْعَةً حَسَنَةً” وَقَالَ: “وَقَدْ ظَهَرَ لِيْ تَخْرِيْجُهَا عَلَى أَصْلٍ ثَابِتٍ. وهو ما ثبت في الصحيحين من أن النبي صلى الله عليه وآله وسلم قَدِمَ المدينةَ فَوَجَدَ اليَهودَ يَصُومونَ يَومَ عَاشُوراءَ، فسألهم فقالوا هذا يوم أَغرقَ اللهُ فيه فرعونَ وَنـجَّى موسى، فَقالَ “نَحنُ أَولَى بِمُوسَى مِنكُمْ، فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِه”. قَال الحافظ ابن حجر:”يُستَفَادُ منهُ فعلُ شُكرِ اللهِ عَلَى مَا مَنَّ بِه في يَومِ مُعَيَّنٍ مِن إسدَاءِ نِعمةٍ أوْ دَفْعِ نِقمةٍ، وَيُعادُ ذلكَ في نظير ذلك اليوم مِنْ كُلِّ سنةٍ، والشكر يَحصلُ بأنواعِ العِبادَاتِ كالسُّجودِ وَالصيامِ وَالصَّدقةِ وَالتِّلاوةِ. وأي نعمة أعظم من نعمة بروز هذا النبي صلى الله عليه وسلم.. نبي الرحمة في ذلك اليوم، فهذا ما يتعلق بأصل عمله، وأما ما يعمل فيه فَينبغي أنْ نقتصر فيه على مَا يُفهَمُ الشكرُ لله تَعَالَى مِن نَحو مَا تَقدَّمَ ذكرُه منَ التِّلاوة والإطعام وإنشادِ شيءٍ منَ المدائحِ النَّبويةِ والزُّهديةِ المُحرِّكَةِ للقلوبِ إلى فعل الخير والعملِ للآخرةِ ومَا كَانَ مُباحًا بحيثُ يَقتضي السُّرورَ بذلكَ اليَومِ لا بَأسَ بإلحاقِه بِه”ِ. “[ حسن المقصد في عمل المولد، تأليف: جلال الدين السيوطي، ص১]
ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, শাইখুল ইসলাম, যুগের অদ্বিতীয় হাফেজে হাদীস ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হিকে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে- জবাবে তিনি বলেন: মূলত মিলাদুন্নবী হলো নব আবিস্কৃত, প্রথম তিন শতাব্দীতে তা উদ্যাপনের প্রমাণ মিলে না, এরপরও এতে অনেক ভাল ও মন্দ দিকও রয়েছে। সুতরাং যারা তা পালন করতে গিয়ে ভাল ও সুন্দর কাজগুলো করে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে তাহলে তা উত্তম নব আবিস্কৃত (বিদয়াতে হাসানাহ্)। তার বৈধতার বিষয়ে আমার নিকট বিশুদ্ধ প্রমাণ রয়েছে। আর তা হলো বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর দেখতে পেলেন ইয়াহুদীরা আশুরার দিন (মহররমের দশম তারিখ) রোজা পালন করছে। তাদেরকে এর কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, এটা ঐ দিন যেদিনে আল্লাহ্ তায়ালা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরআউন ও তার অনুসারীদেরকে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছেন, তাই আমরা আজকের এ দিনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের লক্ষ্যে রোজা পালন করি।’ [বুখারী ও মুসলিম]

এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়- সুনির্দিষ্ট কোন দিনকে উপলক্ষ করে ঐ দিনে প্রাপ্ত নেয়ামত বা মুছিবত মুক্তিকে স্মরণ করে আল্লাহ্ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা বৈধ ও উত্তম।…….‘‘তাই রাহমাতুল্লিল আলামীন তথা এ মহান নবীর ১২ রবিউল আউয়ালে আগমনের নেয়ামতের চেয়ে সৃষ্টির জন্য আর কোনটি বড় নেয়ামত হতে পারে? অতএব উক্ত হাদিসটি এ আমলটির বৈধতা প্রমাণিত হয়।

সুতরাং এ মাহফিলগুলোতে তাই করা উচিত যা দ্বারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা প্রমাণিত হয়। যেমন কোরআন তেলাওয়াত, আপ্যায়ন, দান-খয়রাত এবং প্রিয়নবীর প্রশংসা গাঁথা না’ত- কবিতা পাঠ করা ও ঐ ধরনের কবিতাদি আবৃত্তি করা যা দ্বারা দুনিয়ার প্রতি অনাকৃষ্ট ও পরকালের কল্যাণময় কাজের প্রতি উৎসাহিত করে। [সূয়ূতী حسن المقصد فى عمل المولد , পৃ. ১০, تحفة المحتام فى شرح المنهام , পৃ. ৪২৩]

* ইমাম সাখাভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, (ইন্তিকাল ৯০২হি.)
————————————————————————–
السخاوي، حيث قال عن المولد النبوي: ” أن عملَ المولدِ حدثَ بعد القرونِ الثلاثةِ ثم لا زَالَ أهلُ الإسلامِ مِنْ سائرِ الأقطارِ في المدنِ الكبارِ يعمَلونَ المولدَ ويتصدَّقُون في لياليهِ بأنواعِ الصدقاتِ ويعتنونَ بقراءةِ مولدِه الكريمِ ويظهرُ عليهم منْ بركاتِه فضلٌ عميم. ([ السيرة الحلبية، تأليف: علي بن برهان الدين الحلبي، ১/ ৮৩-৮৪])
যদিও তা প্রথম তিন শতাব্দীর পরবর্তীতে প্রচলিত হয়েছে, কিন্তু যুগযুগ ধরে বিশ্বের দেশ ও নগরীগুলোতে মুসলমানগণ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাহফিল উদ্যাপন করে আসছেন। তাঁরা এ রাতে দান-খয়রাত করেন এবং তাঁর শুভাগমন ও জীবন-কর্মের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেন, ফলে তাঁদের উপর এ মাহফিলের অফুরন্ত রহমত ও বরকত প্রকাশিত হয়ে থাকে। [ইমাম হালাভী, সিরাতে হালাভীয়্যাহ্, খ–১, পৃ. ৮৩]

* ইমাম ইবনুল হাজ্ব আল মালেকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন (ইন্তিকাল-৭৩৭হি.)
——————————————————————
ابن الحاج المالكي، حيث قال: “فكان يجب أن نزداد يوم الاثنين الثاني عشر في ربيع الأول من العبادات والخير شكرا للمولى على ما أولانا من هذه النعم العظيمة وأعظمها ميلاد المصطفى صلى الله عليه وآله وسلم”[ المدخل عن تعظيم شهر ربيع الأول، تأليف: ابن الحاج:১/৩৬১.].
তাই আমাদের উপর ওয়াজিব হলো, আমরা যেন রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ সোমবারের দিনে অধিকহারে ইবাদত-বন্দেগী, দান-খয়রাত ও পূণ্যের কার্যাদি সম্পাদন করি, মহান মওলা ও মালিকের শুকরিয়া আদায়স্বরূপ। যেহেতু তিনি আমাদেরকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। আর সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন বা মিলাদে পাক। [ইমাম ইবনুল হাজ্ব মালেকী (রহ.) المدخل عن تعظيم شهر ربيع الاول, খ-০১, পৃ. ৩৬১]

তিনি আরও বলেন
وقال أيضا: “ومن تعظيمه صلى الله عليه وآله وسلم الفرح بليلة ولادته وقراءة المولد”[ الدرر السنية، ص১৯০.]
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তাজীম-সম্মানের অন্যতম পরিচায়ক হলো- তাঁর জন্ম রজনীতে খুশি প্রকাশ করা এবং মিলাদ সংক্রান্ত কিতাব থেকে পাঠ করা। [الدرر السنية , পৃ. ১৯০]

* ইবনে আবেদীন শামী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন (ইন্তিকাল-১২২৫হি.)
——————————————————————————————–
ابن عابدين، حيث قال: “اعلم أن من البدع المحمودة عمل المولد الشريف من الشهر الذي ولد فيه صلى الله عليه وآله وسلم”. وقال أيضا: “فالاجتماع لسماع قصة صاحب المعجزات عليه أفضل الصلوات وأكمل التحيات من اعظم القربات لما يشتمل عليه من المعجزات وكثرة الصلوات”[ شرح ابن عابدين على مولد ابن حجر.].
জেনে রাখ যে, প্রশংসিত নব উদ্ভাবন হলো- যে মাসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শুভাগমন করেছেন সে মাসকে উপলক্ষ করে মিলাদ-মাহফিল করা’’ তিনি আরও বলেন, সুতরাং অসংখ্য মু’জেজার ধারক প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনালেখ্য শ্রবণ করা নিঃসন্দেহে অতি মহৎ ও পূণ্যের কাজ। কেননা এ মাহফিলগুলোতে প্রিয়নবীর প্রতি অসংখ্য দুরুদ প্রেরণ করা হয় এবং তাঁর মোজেজাহ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
[ইমাম শামী রহ. ইবনে আবেদীন আলা মাওলেদে ইবনে হাজার আসকালানী]

* ইমাম আবদুর রহীম আল ইরাকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি: (ইন্তিকাল- ৮০৬হি.)
————————————————————————–
الحافظ عبد الرحيم العراقي، حيث قال: “إن اتخاذ الوليمة وإطعام الطعام مستحب في كل وقت فكيف إذا انضم إلى ذلك الفرح والسرور بظهورنوررسول الله صلى الله عليه وسلم في هذا الشهر الشريف ولا يلزم من كونه بدعة كونه مكروها فكم من بدعة مستحبة قد تكون واجبة”[ شرح المواهب اللدنية للزرقاني.]
নিশ্চয় খানা-পিনার আয়োজন করা ও মানুষদেরকে আহার করানো সবসময়ই উত্তম ও মুস্তাহাব। আর যদি তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র নূর মোবারকের প্রকাশকালের আনন্দের সাথে সম্পৃক্ত হয় তাহলে তা কতই না উত্তম। তাই তা নব উদ্ভাবিত বলে অপছন্দনীয় হতে পারে না। কারণ এমন কতেক উত্তম নব উদ্ভাবন রয়েছে যা কখনও ওয়াজিব হয়ে পড়ে।’’ [ইমাম জুরকানী, শরহে মাওয়াহেবুল্লুদুনিয়্যাহ্]

* ইমাম শামসুদ্দিন ইবনুল জুযারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি: (ইন্তিকাল-৮৩৩হি.)
———————————————————————–
الحافظ شمس الدين ابن الجزري، حيث قال الحافظ السيوطي: “ثم رأيت إمام القراء الحافظ شمس الدين ابن الجزري قال في كتابه المسمى (عرف التعريف بالمولد الشريف) ما نصه: قد رؤي أبو لهب بعد موته في النوم فقيل له: ما حالك؟ فقال: في النار إلا أنه يخفف عني كل ليلة اثنين، وأمص من بين أصبعي ماء بقدر هذا- وأشار لرأس أصبعه -، وأن ذلك بإعتاقي لثويبة عندما بشرتني بولادة النبي صلى الله عليه وسلم وبإرضاعها له. فإذا كان أبو لهب الكافر الذي نزل القرآن بذمه جوزي في النار بفرحه ليلة مولد النبي صلى اله عليه وسلم به فما حال المسلم الموحد من أمة النبي صلى الله عليه وسلم يسر بمولده ويبذل ما تصل إليه قدرته في محبته صلى الله عليه وسلم، لعمري إنما يكون جزاؤه من الله الكريم أن يدخله بفضله جنات النعيمة”( [ الباعث على إنكار البدع والحوادث، تأليف: أبو شامة، ص১৩.])
আবু লাহাবকে স্বপ্নে দেখা হলে জিজ্ঞেস করা হলো: তোমার কি অবস্থা? সে বললো: দোজখে, হ্যাঁ তবে প্রতি সোমবার রাতে আযাব হালকা করা হয় এবং সে তার আঙ্গুলের অগ্রভাগের দিকে ইশারা করে বললো- আমার এ আঙ্গুলদ্বয়ের মাঝখান থেকে সামান্য কিছু পানি চুষতে পারি। আর তাহলো- এজন্যই যে, যখন আমার কৃতদাসী ছুয়াইবাহ্ প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জন্ম সম্পর্কে সুসংবাদ দিল তখন আমি তাকে খুশী হয়ে আযাদ বা মুক্ত করে দিই। এ বর্ণনার নিরিখে ইমাম ইবনুল জুযারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আবু লাহাবের মতো ঐ কট্টর কাফির যার তিরস্কার পবিত্র কোরআনে ‘সূরা লাহাব’ নামক একটি স্বতন্ত্র সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। সে যদি প্রিয়নবীর জন্মে খুশী হবার কারণে এ প্রতিদান লাভ করতে পারে, তাহলে ঐ ঈমানদার উম্মতের পুরস্কার কত মহান হতে পারে। যে প্রিয়নবীর মিলাদে বা জন্মে খুশী হয়েছে এবং তাঁর মুহাব্বতে যতটুকু সম্ভব টাকা-পয়সা ব্যয় করেছে আমার এ জীবনের মালিকের শপথ! মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর একমাত্র প্রাপ্তি হবে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে স্বীয় রহমত দ্বারা জান্নাতে নাঈম দান করবেন। [১. ইমাম ইবনুল জুযারী, عرف التعريف بالمولد الشريف , পৃ. ১৩, ইমাম সুয়ূতী, حسن المقصد فى عمل المولد, পৃ. ১০]

* ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলায়হির উস্তাদ শেখ আবু শামা: (ইন্তিকাল-৬৬৫হি.)
___________________________________________
أبو شامة (شيخ النووي)، حيث قال: “وَمِنْ أَحْسَنِ مَا ابْتُدِعَ فِيْ زَمَانِنَا مَا يَفْعَلُ كُلَّ عَامٍ فِي الْيَوْمِ الْمُوَافِقِ لِيَوْمِ مَوْلِدِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الصَّدَقَاتِ وَالْمَعْرُوفِ وَإِظْهَارِ الزِّيْنَةِ وَالسُّرُورِ، فَإِنَّ ذَلِكَ مَعَ مَا فِيْهِ مِنَ اْلإِحْسَانِ لِلْفُقَرَاءِ مُشْعِرٌ بِمَحَبَّةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَعْظِيْمِهِ فِي قَلْبِ فَاعِلٍ ذَلِكَ وَشُكْرِ اللهِ تَعَالَى عَلَى مَا مَنَّ بِهِ مِنْ إِيْجَادِ رَسُوْلِهِ الَّذِيْ أَرْسَلَهُ رَحْمَةً لِلْعَالَمِيْنَ”[ المواهب اللدنية- ১-১৪৮-طبعة المكتب الإسلامي]
প্রিয়নবীর মিলাদকে কেন্দ্র করে বর্তমান যুগের প্রতি বছর যে ধরনের দান-খয়রাত, জনহিতকর কাজ, উত্তম পোষাক পরিধান ও আনন্দ প্রকাশ করা হয় তা কতই না উত্তম। কেননা তা দ্বারা ঈমানদারের অন্তরে প্রিয় নবীর প্রতি ভালবাসা এবং সম্মানের প্রকাশ পায়। পাশাপাশি তাঁর প্রিয় রাসূল রাহমাতুল্লিল আলামীনের শুভাগমনের মহান নেয়ামতের কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার শুকরিয়াও আদায় হয়। [ইমাম আবু শামা; الباعث على إنكار البدع والحوادث, পৃ. ১৩]

* ইমাম কুসতুলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি (ইন্তিকাল-৯২৩হি.)
————————————————————————–
الشهاب أحمد القسطلاني (شارح البخاري)، حيث قال: “فرحم الله امرءا اتخذ ليالي شهر مولده المبارك أعيادا، ليكون أشد علة على من في قلبه مرض وإعياء داء” [ فتاوى شرعية وبحوث إسلامية، تأليف: حسنين محمد مخلوف، ج১، ص১৩১.]
আল্লাহ্ তায়ালা ঐ ব্যক্তির উপর অফুরন্ত রহমত নাযিল করুক, যে প্রিয়নবীর মিলাদের মাসের প্রতিটি রাতকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ ও উদ্যাপন করেছে, তা যেন তাদের রোগ-ব্যধিকে আরও বৃদ্ধি করে দেয় যাদের অন্তরে ব্যাধি ও মড়ক রয়েছে। [ইমাম কুসতুলানী, المواهب اللدنيه, খ–১, পৃ. ১৪৮]

* ইমাম শামসুদ্দিন নাছের আদদামেস্কী রহমাতুল্লাহি আলায়হি: (ইন্তিকাল-৮৪২হি.)
———————————————————————
الحافظ شمس الدين بن ناصر الدين الدمشقي، حيث قال في كتابه المسمى (مورد الصادي في مولد الهادي): “قد صح أن أبا لهب يخفف عنه عذاب النار في مثل يوم الاثنين لإعتاقه ثويبة سرورًا بميلاد النبي صلى الله عليه وسلم”، ثم أنشد:
إذا كان هـذا كافرًا جـاء ذمـه وتبت يـداه في الجحـيم مخـلدًا
أتى أنـه في يـوم الاثنين دائـمًا يخفف عنه للسـرور بأحــمدا
فما الظن بالعبد الذي طول عمره بأحمد مسرورٌ ومات موحـــدًا
[على مائدة الفكر الإسلامي، تأليف: محمد متولي الشعراوي، ص২৯৫.]

তিনি তাঁর মিলাদুন্নবী বিষয়ে লিখিতمورد الصادى فى مولد الهادى صلى الله عليه وسلم কিতাবে উল্লেখ করেন, প্রতি সোমবারে আবু লাহাবের আযাব হালকা হবার কথা বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত। কেননা সে মিলাদুন্নবী খুশীতে তার দাসীকে আযাদ করেছিল।
* যদি এ কাফের যার তিরস্কারে تبيت يدا অবতীর্ণ হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
* প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রিয়নবীর জন্য খুশী হবার কারণে প্রত্যেক সোমবারের দিন তার আযাব হালকা করা হয়।
* সুতরাং কি ধারণা করা যেতে পারে ঐ বান্দা সম্পর্কে যে সারা জীবন প্রিয়নবীকে পেয়ে খুশী-আনন্দিত ছিল এবং ইমানের উপর ওফাত লাভ করেছে। [تحفة المحتاج فى شرح المنهاج, পৃ. ৪২৩]

এ ছিল বিশ্ববরেণ্য কয়েকজন ওলামায়ে কেরামগণের অভিমত যাঁরা ছিলেন স্ব স্ব যুগের ইমাম, বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিছ, মুফাচ্ছির ও ফকীহ্। যাঁদের কাছে বিশ্ব মুসলিম এখনও ঋণী। যাঁরা ছিলেন আজ থেকে প্রায় ৮/৯ শত বছর পূর্বে।
তাই মিলাদুন্নবী আধুনিককালের উদ্ভাবিত কিংবা এ মহাদেশের আবিস্কৃত নয়। মূলত যুগ যুগ ধরে বিশ্বনন্দিত ওলামাগণ তা পালন করে আসছেন এবং তার সমর্থনে অসংখ্য কিতাবাদিও রচনা করে গেছেন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment