আমি কেনো মাযহাব মানবো?

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

বিষয়ঃ আমি কেনো মাযহাব মানবো?

🖋*মাওলানা মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর

অতি সাম্প্রতিক আহলে হাদিস নামক একটি ভ্রান্ত মতবাদ প্রবল বেগে গজিয়ে উঠেছে। তাদের ভ্রান্ত আক্বিদার অন্যতম হলো মাযহাব মান্য না করা। তাই তারা যে প্রশ্নগুলো হানাফি মাযহাবের সাধারণ অনুসারী কাছে প্রতিনিয়তই হয়রানির উদ্দেশ্যে করে থাকে সে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। 

এ ধরনের অসংখ্য প্রশ্নের জবাবে আমি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছি, যার নাম দিয়েছি ‘আমি কেনো মাযহাব মানবো?’ গ্রন্থটিতে আহলে হাদিসদের প্রত্যেকটি আপত্তির দীর্ঘ জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছি, সে জন্য সহজে পাঠকদের বুঝার জন্য সংক্ষেপে একটি পর্যালোচনা লিখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এ কলামটি লিখি। 

(১) মাযহাব কি ?

একজন মুজতাহিদ ফকিহ্ এর উদ্ভাবিত মূলনীতির আলোকে বের হওয়া মাসআলার নাম মাযহাব। মাযহাব অর্থ পথ, মত। আর মুজতাহিদের গবেষণার উপরে ভিত্তি করে কোন দলিল প্রমাণ অন্বেষণ করা ছাড়া তার সে ফাতওয়ার উপর আমল করার নামই হল তাকলীদ। যিনি এ তাকলীদ করেন তাকে মুকাল্লিদ বলে।

ইমাম গাযযালী (রহ.) ‘কিতাবুল মুস্তফা’ এর ২/৩৮৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- 

التَّقْلِيْد هُوَ قَبُوْل قَوْل بِلَا حُجَّة

-‘‘তাক্বলীদ হলো কোনো (মুজতাহিদ ইমামমের)উক্তিকে বিনা দলিলে গ্রহণ করা।’’

নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, হাফেজুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহ.) তার বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থ (مُعْجَمُ مقاليد العُلُوْم فِي الحُدُوْدِ وَالرَّسُوْم) এর ৬৭ পৃষ্ঠায় লিখেন-

التَّقْلِيدُ: قبُول قَول الْغَيْر بِلَا مُطَالبَة حجَّة.

-‘‘তাকলীদ হলো কারো (মুজতাহিদের) কথাকে দলিল তালাশ না করে গ্রহণ করা।’’

উল্লেখিত সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে ওঠে, মুকাল্লিদ-তাকলীদকারী তার ইমামের বক্তব্যকে শরীয়তের উৎস মনে করে না। কারণ, শরয়িতের মূল উৎস তো কেবল কুরআন ও সুন্নাহ (অবশ্য ইজমা কিয়াস এই কুরআন-সুন্নাহরই অধীন)। যেহেতু ইমাম কোরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে স্পষ্ট পরিচ্ছন্ন ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী তাই মুকাল্লিদ তাঁর কথার উপর আমল করে। সে মনে করে গভীর জ্ঞান-পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁর কথার উপর আমল করে। সে মনে করে গভীর জ্ঞান-পাণ্ডিত্যের ফলে কুরআন-সুন্নাহ’র মর্ম ও অর্থ নির্ধারণে তাঁর বক্তব্যই ভরসা ও বিশ্বাসযোগ্য। 

এবার আপনিই একটু ইনসাফের সাথে চিন্তা করে দেখুন, এতে এমন কী বিষয়টা আছে যাকে ‘পাপ’ কিংবা ‘শিরক’ বলা যায়!

(২) কেনো মাযহাব মানতে হবে?

প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ বিবেকের অধিকারী মুসলমানকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা যায়; মুজতাহিদ ও গায়রে মুজতাহিদ। মুজতাহিদ হলো- এমন মুসলমান যিনি নিজ জ্ঞান ও যোগ্যতায় কুরআনী ইঙ্গিত ও রহস্যাবলী বুঝতে পারেন, কালামের উদ্দেশ্য অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখেন, গবেষণা করে মাসাইল বের করতে পারেন, নাসিখ ও মানসুখ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন, ‘ইলমে সরফ, নাহব, বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন, যাবতীয় আহকামের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত আয়াত ও হাদিসসমূহ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখেন, সর্বোপরি যিনি মেধা, প্রজ্ঞা ও বোধশক্তির অধিকারী হন। (তাফসীরাতে আহমদীয়া ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থ দেখুন)

আর যে ব্যক্তি ঐ স্তরে পৌঁছতে পারে নি যার মধ্যে উল্লেখিত যোগ্যতা নেই, সে হলো গায়র-মুজতাহিদ বা মুকাল্লিদ (অনুসারী)। গায়রে-মুজতাহিদের জন্য মুজতাহিদের তাকলীদ একান্ত জরুরী। 

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) লিখেন-

بَذْلُ الْوُسْعِ لِلتَّوَصُّلِ إِلَى مَعْرِفَةِ الحُكْم الشَّرْعِيّ

-‘‘ইজতিহাদ হলো, শরীয়তের হুকুম সম্পর্কে জানা বা জানার জন্য একজন ফকীহ কঠোর চেষ্টা চালানো।’’ (ইবনে হাজার, ফতহুল বারী, ১৩/২৯৯ পৃ.) 

ইজতিহাদ যিনি করেন তাকেই মুজতাহিদ বলা হয়। বুঝা গেল মুজতাহিদের গবেষণাকে বিশ্বাস করে তার মত অনুসারে আমল করার নাম মাযহাব।

(৩) কুরআনে কি মাযহাব মানতে বলা হয়েছে?

পবিত্র কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যেখানে এমন কোন বিষয় নেই যার বর্ণনা নেই, তবে যারা উদ্ধার করতে জানেন তারাই বের করতে পারেন। যেমনঃ 

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ-

-‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ প্রধানকারী (মুজতাহিদ ফকিহ) রয়েছেন তাদের আনুগত্য কর। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৫৯)

এ আয়াতে মহান রব তায়ালা যাদের আনুগত্যের আদেশ করেছেন তারা হলেন 

(১) আল্লাহর (কুরআনের) আনুগত্য, 

(২) রাসূলের (সুন্নাহের) আনুগত্য এবং 

(৩) আদেশ দাতাগণের অর্থাৎ ফিক্হবিদ মুজতাহিদ আলিমগণের আনুগত্য।

ইমাম মুনযিরী (ওফাত. ৩১৯হি.) তার তাফসিরে বর্ণনা করেন-

عَنْ جَابِرٍ:  {وَأُولِي الأَمْرِ مِنْكُمْ} ، قَالَ: الْفُقَهَاءُ

-‘‘হযরত জাবের (রা.) বলেন, আয়াতের (উলিল আমরে মিনকুম)হলেন দ্বীনের ফকিহগণ।’’  

(তাফসিরে ইবনে মুনযির, ২/৭৬৬ পৃ.)

ইমাম বাগভী (রহ.) তার তাফসিরে বলেন-

قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ وَجَابِرٌ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ: هُمُ الْفُقَهَاءُ وَالْعُلَمَاءُ الَّذِينَ يُعَلِّمُونَ النَّاسَ مَعَالِمَ دِينِهِمْ

-‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, উক্ত আয়াতের (وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ) দ্বারা দ্বীনের ফকিহ এবং উলামাদের কথা বুঝিয়েছেন যারা মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দিবেন।’’ 

(ইমাম বাগভী, শরহে সুন্নাহ, ১/৬৫০ পৃ.) 

এ আয়াত থেকে বুঝা গেল কুরআন সুন্নাহের পরেও মুজতাহিদ ফকীহদের অনুসরণ করতে হবে।

মহান রব অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন-

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

-‘‘হে লোক সকল! তোমাদের যদি জ্ঞান না থাকে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা করো।’’ (সূরা নাহল, আয়াত নং ৪৩)

এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, যে বিষয়ে অবহিত নয়, সে যেন সে বিষয়ে জ্ঞানীদের নিকট থেকে জেনে নেয়। যে সব গবেষণালব্ধ মাসাইল বের করার ক্ষমতা আমাদের নেই, ঐগুলো মুজতাহিদগণের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হবে। 

ইমাম যাকারিয়া বাগদাদী (রহ.) {ওফাত.৩৯৩ হি.} এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একজন তাবেয়ীর বক্তব্য এভাবে উল্লেখ করেন-

قالَ: حدثنا أبوبدرٍ قالَ: سمعتُ عَمرو بنَ قيسٍ المُلائيَّ يقولُ في قولِ اللهِ {فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُون} [النحل: ৪৩] قالَ: أهلُ العلمِ

-‘‘তাবে-তাবেয়ী আবু বদর (রহ.) বলেন, আমি আমর বিন কায়েস মুলায়ী (রহ.) কে সুরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলতে শুনেছি, তোমরা যে বিষয়ে না জান তা আহলে ইলম তথা পরিপূর্ন মুজতাহিদদের থেকে জেনে নাও।’’ (আল্লামা আবু যাকারিয়া মুখাল্লাস বাগদাদী, মুখাল্লিসিয়াত, ২/৩১১ পৃ. ক্রমিক. ১৬০৪)

(৪) রাসূল (দ.) কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন?

আমাদের আধুনিক কতিপয় লোক এ ধরনের কুফুরী প্রশ্ন করেই চলছেন। এদের অধিকাংশই আহলে হাদিস এবং ডা. জাকির নায়েকের অনুসারী। অথচ তারা মাযহাব বা তাকলীদের সংজ্ঞা ভাল করে না জানার কারণে এই প্রশ্নগুলো করে থাকেন। একজন বোকাও বুঝেন যে কোন নবী তার উম্মতকে অনুসরণ করেন না, বরং উম্মত নবীকে অনুসরণ করেন। আল্লাহর নাবী (দ.) এক মাত্র তাঁর মহান প্রতিপালককেই অনুসরণ করেন। তিনি তাঁর হুকুম ছাড়া কিছুই করেন না। 

মহান রব বলেন-

وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى

-‘‘তিনি নিজ প্রবৃত্তি থেকে কিছুই বলেন না।’’ (সূরা নাজম, আয়াত, ৩)

এখন তারা যদি প্রশ্ন করতে চান যে, ইমামগণ রাসূল (দ.)-এর অনুসারী ছিলেন কি না? তবে আমরা বলবো, ইমামগণ শত ভাগ রাসূল (দ.)-এর অনুসারী ছিলেন। রাসূল (দ.)-এর সুন্নাহ অনুসরণের প্রতি তাঁরা কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা তাঁদের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আমার লিখিত ‘আমি কেনো মাযহাব মানবো?’ গ্রন্থটি দেখতে পারেন। 

(০৫) সাহাবীরা কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন?

প্রথমে বুঝতে হবে যে, মাযহাব কী এবং কেন মাযহাব মানতে হবে; যা আমি ইতোপূর্বে আলোকপাত করেছি। আর সে অনুসারে যে সমস্ত সাহাবীরা রাসূল (দ.)-এর কাছে ছিলেন তাদের অন্য কারও মাযহাব অনুসরনের প্রয়োজন নেই। আর সাহাবায়ে কিরাম (রা.) যারা সরাসরি রাসূল (দ.) এর ব্যাখ্যা অনুসরণ করা ছিল তাদের জন্য আবশ্যক, এছাড়া কারো ব্যাখ্যা নয়। তাই সাহাবীরা যে কোন সমাধানে রাসূল (দ.) এর জাহেরী হায়াতে সরাসরি রাসূল (দ.) থেকেই নিজেদের যে কোন সমাধান জেনে নিতেন। কিন্তু যে সকল সাহাবারা ছিলেন নবীজী (দ.) থেকে দূরে তারা সেই স্থানের বিজ্ঞ মুজতাহিদ সাহাবীর মাযহাব তথা মত অনুসরণ করতেন। 

ইমাম আহমদ (রহ.) ও ইমাম আবু দাউদ (রহ.) সংকলন করেন, হযরত মুআয বিন জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত। তাকে যখন রাসূল (দ.) ইয়ামান দেশে প্রেরণ করলেন তখন রাসূল (দ.) মুআয ইবনে জাবাল (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যখন তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত করা হবে তখন তুমি কিভাবে ফয়সালা করবে? অতঃপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কিতাব দ্বারা’। রাসূল (দ.) বললেন, যদি সে বিষয়ে কিতাবুল্লাহ এ না পাও? তিনি বললেন, ‘তাহলে রাসুলুল্লাহ (দ.) এর সুন্নাহ দ্বারা ফয়সালা করবো। রাসূল (দ.) বললেন, ‘যদি রাসুলুল্লাহ (দ.) এর সুন্নাহে না পাও’? তখন তিনি বললেন, ইজতিহাদ তথা উদ্ভাবণ করার চেষ্টা করবো। তারপর রাসূল (দ.) বললেন, যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তাঁর প্রতিনিধিকে এমন পন্থা অবলম্বনের তাওফিক দান করেছেন যে ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (দ.) সন্তুষ্ট আছেন।

এ হাদিস থেকে বুঝা গেল তখন ইয়ামেনের লোকদের উপর হযরত মুআযের মত তথা মাযহাব অনুসরণ যে আবশ্যক এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট। এ হাদিসের দুটি সূত্র রয়েছে, একটি যঈফ, আরেকটি সহীহ, আমাদের কতিপয় খিয়ানতকারী শায়খগণ যঈফটি বলেন, সহীহ সনদের কথা কৌশলে অস্বীকার করেন। 

(ধারাবাহিক চলবে ইনশাআল্লাহ)

(৬) হাদিসের ইমামগণ কি মাযহাব মেনেছেন?

হাদিসের ইমামদের মধ্যে দুটি দল ছিল, একদল মুজতাহিদ, আরেক দল ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন না। তাই তাদের একদল মাযহাবের অনুসরণ করেছেন, আরেকদল অনুসরণ করেননি। 

ইমাম বুখারী (রহ.) মুজতাহিদ ছিলেন, তাই তার কারো মাযহাবের অনুসরণ অপরিহার্য ছিল না। তারপরও তিনি শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন বলে অনেক মত ব্যক্ত করেছেন। (আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, আল-ইনসাফ, ৭৬ পৃ., ইমাম তাজুদ্দীন সুবকী, তবকাতুশ শাফিয়্যাহ, ২/২১২ পৃ. ক্রমিক. ৫০)

এমনিভাবে ইমাম মুসলিম (রহ.) এবং ইমাম তিরমিজি (রহ.) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। (নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী, আল-হিত্তা, ১৯৮ পৃ.)

সুনানে নাসাঈ শরীফের সংকলক ইমাম আন-নাসাঈ (রহ.) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) তাঁর জীবনীতে লিখেন-

قَالَ ابْنُ الأَثِيْرِ فِي أَوَّلِ جَامِعِ الأُصُوْلِ :كَانَ شَافِعِيّاً لَهُ مَنَاسِكٌ عَلَى مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّ وَكَانَ وَرِعاً مُتَحَرّياً.

-‘‘ইমাম ইবনে আছির (রহ.) বলেন, তিনি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারে তার হজ্জ সংক্রান্ত মাসআলা বর্ণনা রয়েছে। তিনি ছিলেন পরহেজগার গবেষক। 

(ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪/১৩০ পৃ. ক্রমিক. ৬৭, ইমাম নাসাঈ রহ. এর জীবনী) 

ইমাম আবু দাউদ (রহ.)ও ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (১১৭৬হি.) লিখেন-

وَأما أَبُو دَاوُد وَالتِّرْمِذِيّ فهما مجتهدان منتسبان إِلَى أَحْمد وَإِسْحَاق

-‘‘ইমাম আবু দাউদ (রহ.) এবং ইমাম তিরমিযি (রহ.) ছিলেন মুজতাহিদ। তাঁদেরকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ও ইমাম ইসহাক (রহ.)-এর প্রতি সম্পর্কযুক্ত করা হয়।(আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, আল-ইনসাফ, ৭৬ পৃ.)

ইমাম তাহাভী (রহ.) ছিলেন হানাফী মাযহাবের অনুসারী। যা তার সংকলিত ‘শরহে মা‘আনিল আছার’ পড়লেই যে কেউ বুঝতে পারবেন। ইমাম ইবনে মাযাহ (রহ.) তিনি নিজেই মুজতাহিদ ফকিহ ছিলেন। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (১১৭৬হি.) তাকে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী বলে উল্লেখ করেছেন।(আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, আল-ইনসাফ, ৭৬ পৃ.)

এছাড়াও বাকি সকল মুহাদ্দিস হয়তো মুজতাহিদ ছিলেন, নতুবা ছিলেন মুকাল্লিদ কোন-না কোন ইমামের।এ বিষয়ে বিশদ আকারে জানতে আমার লিখিত গ্রন্থটি দেখতে হবে। 

(৭) চার মাযহাব অনুসরণের বিষয়ে ইজমা হয়েছে?

এ প্রসঙ্গে ইমাম আমিরুল হাজ্জ (ওফাত.৮৭৯হি.) বলেন-

)مَا ذَكَرَ بَعْضُ الْمُتَأَخِّرِينَ) وَهُوَ ابْنُ الصَّلَاحِ (مَنَعَ تَقْلِيدَ غَيْرِ) الْأَئِمَّةِ (الْأَرْبَعَةِ) أَبِي حَنِيفَةَ وَمَالِكٍ وَالشَّافِعِيِّ وَأَحْمَدَ – رَحِمَهُمُ اللَّهُ –

-‘‘মুতায়াখ্খিরীনগণ বলেন, যেমন ইমাম ইবনে সালাহ (রহ.) বলেন, চার মাযহাবের চার ইমাম অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর ব্যতীত কারও মাযহাব অনুসরণ করা নিষেধ।’’ (আমিরুল হাজ্ব, তাক্বরীর ওয়াল তাহবীর, ৩/৩৫৪পৃ.)

ইমাম সাভী আল-মালেকী (রহ.) সূরা কাহাফ আয়াত-২৪ এর ব্যাখ্যায় বলেন-

وَلَا يَجُوْزُ تَقْلِيْدُ مَا عَدَا الْمَذَهِبِ الْاَرْبَعَةِ وَلَوْ وَافَقَ قَوْلَ الصَحَّابَةِ وَالْحَدِيْثِ الصَّحِيْحِ وَالْاَيَةِ فَالْخَارِجُ عَنِ الْمَذَاهِبِ الْاَرْبَعَةِ ضَالٌّ مُضِلٌّ وَرُبَمَا اَدَّاهُ ذَالِكَ اِلَي الْكُفْرِ لِاَنَّ الْاَخْذَ بِظَوَاهِرِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنْ اُصُوْلِ الْكُفْرِ 

-‘‘চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাকলীদ বা অনুসরন জায়িয নয়। যদিও সে মাযহাব সাহাবিদের উক্তি, সহীহ হাদিস ও কুরআনের আয়াতের সহিত সাঙ্গতি পূর্ণ হয়। যে এ চার মাযহাবের কোন একটির অনুসারী নয়, সে পথভ্রষ্ট এবং পথ ভ্রষ্টকারী। কেননা হাদিস ও কুরআনের কেবল বাহ্যিক অর্থ গ্রহণই হলো কুফরীর মূল।’’ (তাফসিরে সাভী, ৪/১৫ পৃ.) 

পৃথিবীতে আরও অনেক মুজতাহিদদের মাযহাব ছিল, কিন্তু তাদের অনুসারী না থাকায় এবং ফিকহের প্রত্যেকটি বিষয়ে তাদের লিখিত কিতাব বিদ্যমান না থাকায় অন্যান্য মাযহাবের কোন অস্তিত্ব নেই, তাই চার মাযহাব ব্যতিত অন্য কোন মাযহাব মানা বর্তমানে নিষেধ।যেমন এ বিষয়ে জগৎ বিখ্যাত আলেম, 

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) লিখেন-

وَاسْتَفْتَى مِنْ عُلَمَاءِ عَصْرِهِ الْمَوْجُودِينَ فِي مَكَّةَ مِنَ الْمَذَاهِبِ الْأَرْبَعَةِ،

-‘‘আমাদের এ যুগেও মক্কা শরীফে চার মাযহাবের আলেমগণই ফাতওয়া দেয়ার ক্ষেত্রে মওজুদ আছে।’’ (মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ৮/৩৪৪৩ পৃ. হা/৫৪৫৬-এর আলোচনা।)

(৮) তথা কথিত মাযহাব বিরোধী আহলে হাদীসরাও কী মাযহাব মানে?

মূলত আহলে হাদীসরাও মাযহাব পালন করে। তবে তারা ৪ মাযহাবের একটিও নয়, বরং আলবানী সহ কতিপয় কিছু উক্ত সম্প্রদায়ের তথাকথিত করছে। অথচ এটা র্সবজনসিদ্ধ মাসয়ালা যে, ইসলামে ৪ মাযহাব ব্যতিত অবশিষ্ট সব ভ্রান্ত ও গোমরাহী। যার আলোচনা আমি ইতোপূর্বে করেছি। 

আহলে হাদিসদের ইমাম ইবনে তাইমিয়াও মাযহাব মানতেন। তার শিষ্য আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লিখেন-

اشْتَغَلَ عَلَى مَذْهَبِ الْإِمَامِ أَحْمَدَ

-‘‘তিনি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর মাযহাব নিয়ে গবেষণা বা মশগুল থাকতেন।’’ (ইবনে কাসির, বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩/১২৮ পৃ. ইবনে তাইমিয়ার জীবনী) 

সুতরাং পঞ্চম মতবাদের উৎপত্তির মাধ্যমে আরো সু-স্পষ্ট করে দিল তারা জঘন্য পাপী এবং ইসলামের চরম  শক্র। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আমি আমার লিখিত ‘আমি কেনো মাযহাব মানবো?’ গ্রন্থের ৩৫২ পৃষ্ঠার সারাংশ তথা সূচিপত্রের সামান্য ব্যাখ্যা বললেও চলে এখানে উল্লেখ করেছি, কারো বিস্তারিত জানতে আগ্রহ থাকলে আমার লিখিত গ্রন্থটি অধ্যায়ন করতে পারেন। মহান রব সকলকে মুজতাহিদদের ইমামদের প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment