প্রশ্নঃ নফ্স ও রূহ্ কি এক জিনিস- নাকি দুই ভিন্ন জিনিস?
জওয়াবঃ বিষয়টি খুবই জটিল। কেননা, কোরআন ও হাদীসের বিভিন্নস্থানে নফ্স দ্বারা বিভিন্ন অর্থ বুঝানো হয়েছে এবং রূহ্ দ্বারাও বিভিন্ন অর্থ বুঝানো হয়েছে। তাই শরিয়তপন্থী ও তরিকতপন্থীদের বিভিন্ন মতামত নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১। জম্হুর উলামাগণ বলেছেন- নফ্স ও রূহ্ দুটি নাম হলেও মূলতঃ উহাদের মুছাম্মা বা নামীয় জিনিস একটিই। রূহ্ অর্থ নফ্স এবং নফ্স অর্থ রূহ্।
২। অন্য একদল কালাম বিশারদ বলেছেন- নফ্স এবং রূহ্ দুটি ভিন্ন জিনিস।
নফ্স অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেঃ
(ক) জাওহারী বলেন- নফ্স অর্থ রূহ্। যথা,
خرجت النفس
অর্থাৎ- রূহ্ বের হয়েছে। এখানে নফ্স অর্থ রূহ্।
(খ) কোরআন মজিদ বলেঃ নফ্সের অর্থ হলো ব্যক্তি বা যাত। যথা,
فَسَلِّمُوا عَلَى أَنفُسِكُمْ
অর্থাৎ “তোমরা পরস্পরের মধ্যে ছালাম বিনিময় কর। এখানে- أَنفُسِكُمْ -এর একবচন হচ্ছে نفُس এবং অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি।
(গ) নফ্স অর্থ রূহ্। এর প্রমাণ হলো-
یا أَیَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعی إِلى رَبِّکِ
অর্থাৎ “হে প্রশান্ত রূহ্, তুমি তোমার প্রভূর দিকে ফিরে চলো”। এখানে শরীর হতে বহির্গত রূহ্কেই নফ্স বলা হয়েছে। বুঝা গেল- নফ্সই রূহ্।
(ঘ) রূহ্ শুধু ব্যক্তি বা শরীরকেই বলা হয় না এবং নফ্সের সাথেও রূহের উল্লেখ করা হয় না। সুতরাং দুটি দু’জিনিস।
(ঙ) কোন কোন স্থানে কোরআনকেও রূহ্ বলা হয়েছে। যেমন-
وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا
অর্থাৎ “হে প্রিয় নবী, আমি পূর্ববর্তীদের ন্যায় ঐভাবেই আপনার কাছে আমার আদেশ স্বরূপ ‘রূহ্’ -তথা কোরআন নাযিল করেছি”। এখানে- রূহ্ অর্থে কোরআনকে বুঝানো হয়েছে।
(চ) কোন কোন স্থানে ওহীকেও রূহ্ বলা হয়েছে। যথা-
ینزل الملائکۃ بالروح من امرہ علی من یشاء من عبادہ ان انذروا انہ لا الہ الا انا فاتقون۔
অর্থাৎ- ”ফিরিস্তাগণ আল্লাহর ‘রূহ্’ নিয়ে তাঁর খাস বান্দাদের কাছে এই আদেশ পাঠান যে, তোমরা লোকদেরকে সতর্ক করো যে- আমি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, অতএব তোমরা আমাকে ভয় করো”।
এখানে ‘রূহ্’ অর্থ ওহী। ওহীকে রূহ্ বলার কারণ হলো- ওহীর দ্বারা মানুষ ঐভাবেই উপকৃত হয়- যেভাবে রূহের দ্বারা সর্বদা উপকৃত হয়। ওহী না হলে মানুষের জীবন চতুষ্পদ জন্ত হতেও নিকৃষ্ট প্রমাণিত হতো। রূহ্কে এজন্য রূহ্ বলা হয়- যেহেতু রূহের মাধ্যমেই শরীরে জীবন বা হায়াত বিদ্যমান থাকে। অনুরূপভাবে ريح বা বায়ুকেও রূহ্ বলা হয়। কেননা, বায়ু ব্যতিত রূহ্ টিকেনা।
নফ্সকে রূহ্ বলার কারণ হলো- নফ্স ব্যতিত মানুষের জীবন টিকেনা। নফ্সকে আবার নফ্স বলার কারণ হলো- نفس শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে- نفیس অর্থাৎ- উত্তম ও শরীফ। আর একটি ধাতু হচ্ছে- تنفس الشئی অর্থাৎ- শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করা- যা ঘনঘন শরীরে প্রবেশ করে ও বের হয়। অন্য একটি ধাতু হতে نفس শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে- তা হলো- النفس بالتحریک অর্থাৎ- ঘনঘন স্থানচ্যুত হওয়া। মানুষ যখন ঘুম যায়- তখন নফ্স তার থেকে বের হয় সুতার মত লম্বা হয়ে যায়। যার গোড়া থাকে শরীরে- আর মাথা চলে যায় আমেরিকা, লন্ডন, আসমান ও যমীনের বিভিন্ন স্থানে। নাড়াচাড়া পেলে যখন নিদ্রাভঙ্গ হয়- তখন নফ্স গুটিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। যখন মানুষের মৃত্যু হয়- তখন একেবারে বের হয়ে যায়-যার বর্ণনা ছুরা জুমার -এর ৪২ নং আয়াতের মধ্যে রয়েছে। ওখানে বর্ণনা করা হয়েছে- اللّٰہ یتوفی الا نفس حین موتھا۔
“আল্লাহ্ নফ্স বা আত্মা সমূহকে হরণ করে নিয়ে যান মৃত্যুর সময়”।
অতএব, নফ্স ও রূহের পার্থক্য হলো সিফ্াত বা অবস্থার পার্থক্য-যাতের বা বস্তুর পার্থক্য নয়। অতএব’ যাহা নফ্স- তাহাই রূহ্। ব্যবধান শুধু অবস্থা ও পারিপার্শিকতার।
রূহ্ ও নফ্স সম্পর্কে ফকিহ্’ হাদিস বিশারদ ও তাসাউফ পন্থীদের মতামতঃ
হাদীস বিশারদ, মাযহাবপন্থী ফকিহ্ এবং তাসাউফপন্থী একদল বিশেষজ্ঞ বলেছেন- “হায়াত, রূহ্ও নফ্স- তিনটি পৃথক জিনিস”।
(১) মোক্বাতিল ইবনে সুলায়মান (রহঃ) বলেন- “মানুষ যখন নিদ্রা যায়- তখন তার নফ্স শরীর থেকে এভাবে বের হয়- যেমন সুতা নাটাই থেকে বের হতে থাকে- কিন্তু সুতার গোড়া বাধা থাকে নাটাইয়ের সাথে। তদ্রূপ- নফ্স শরীর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সুতার ন্যায় দীর্ঘায়িত হতে থাকে। জ্ঞান-বুদ্ধিও তার সাথে থাকে। তার মধ্যে একটি জ্যোতি থাকে। নফ্সের মাধ্যমে ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে অনেক দেশ ও স্থান ভ্রমণ করে। কিন্তু নিদ্রাবস্থায় হায়াত এবং রূহ্ শরীরে অবস্থান করতে থাকে। এজন্যই শরীর নড়াচড়া করতে পারে এবং শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে। যখন শরীরে নাড়া দেয়া হয়- তখন ভ্রমণরত নফ্স চোখের পলকে গুটিয়ে শরীরে ফিরে আসে। আল্লাহ্ যদি তার মৃত্যুর ইচ্ছা করেন- তখন ঐ বহির্গত নফ্সকে ধরে রাখেন- শরীরের ভিতরে ঢুকতে দেন না”।
মোক্বাতিল আরো বলেন- “যখন মানুষ ঘুমায়- তখন নফ্স বের হয়ে উপরের দিকে প্রলম্বিত হতে থাকে। যখন স্বপ্ন দেখে- তখন নফ্স পূনরায় দেহে ফিরে আসে এবং রূহ্কে সংবাদ জানায়। রূহ্ চিৎকার দিয়ে উঠে এবং বুঝতে পারে যে, সে অমুক অমুক ভয়ঙ্কর জিনিস দেখেছে।
(২) তাসাউফপন্থী উলামা প্রমুখ বলেন- নফ্সের স্বভাব হলো মাটি সহজাত অগ্নিশিখার ন্যায়- আর রূহের স্বভাব হলো নূরের সহজাত রূহানী শক্তি।
(৩) সুফীগণের কেউ কেউ বলেন- রূহ্ হলো লাহুতী বস্তু বা উলুহিয়াতী সত্বা- যার সম্পর্ক ইলাহ্- এর সাথে এবং নফ্স হলো নাছুতী বস্তু বা জড় জগতের বস্তু নিচয়। নাছুতী বস্তুর সাথে লাহুতী বস্তুর সংযোগ হলেই তার উপর আমলের দায়িত্ব আসে এবং তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষার সম্মূখীন হতে হয়।
(৪) হাদীসপন্থীরা বলেন- রূহ্ হলো এক জিনিস- আর নফ্স হলো অন্য জিনিস। কিন্ত রূহ্ ছাড়া নফ্সের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। রূহের উপরই নফ্সের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। নফ্স হলো বাহ্যিক সুরত বা শরীর- যার সাথে আশা, আকাংখা এবং কামনা ও বাসনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বনী আদমের শত্র“দের মধ্যে সবচেয়ে বড় শত্র“ হলো নফ্স। নফ্স শুধু দুনিয়া কামনা করে এবং দুনিয়াকেই সে ভালবাসে। অপর দিকে- রূহ্ আখেরাতমুখী এবং পরকালের দিকে আহ্বানকারী। কাম, ক্রোধ, মদ, মাৎসর্য, লোভ, হিংসা- ইত্যাদি নফ্সের অনুসারী।
নফ্স এবং ষড়রিপুকে শয়তান তার অধীনে রাখে। অপরদিকে- ফিরিস্তা থাকে রূহ্ এবং বিবেকের পক্ষে। আল্লাহ্তায়ালা বিবেক ও রূহ্কে গোপন ইল্হামের মাধ্যমে সাহায্য করে থাকেন।
৫। অপর একদল হাদীস বিশারদ উলামা বলেন- “রূহ্ হচ্ছে আল্লাহর আদেশ। উহার প্রকৃত রহস্য ও হাকীকত তাঁর প্রিয় বন্ধু ছাড়া অন্য বান্দার কাছে প্রকাশ করা হয়নি।
৬। অন্য একদল সুফী বুযর্গ বলেন- ”রূহ্ হচ্ছে আল্লাহর খাস নূর সমূহের একটি অন্যতম নূর এবং আল্লাহর সৃষ্ট জীবনীশক্তির মধ্যে একটি অন্যতম জীবনীশক্তি”।
রূহের মৃত্যু নেইঃ
=======
(১) একদল তাসাউফপন্থী বুযর্গ বলেন- “রূহের মৃত্যু হয়না- শুধু প্রস্থান হয়। মৃত্যু হয় শরীরের ও নফ্সের। অর্থাৎ- মৃত্যু রূহের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না- প্রভাব বিস্তার করে নফ্স ও শরীরের উপর। রূহ্ পঁচেনা, গলেনা, নষ্ট হয়না। শরীরে এসে কিছুকাল অবস্থান করে আবার বের হয়ে চলে যায়”।
(২) অন্য একজামাত সূফীদের অভিমত হলো- ”রূহ্ অন্যান্য দেহধারী বা সূরতধারী সৃষ্টির ন্যায় একটি সৃষ্টি। তার গোপন হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা- সব কিছুই আছে”।
(৩) অন্য একদল বলেন- ”মুমিনের রূহ্ তিন প্রকার। যথা- রূহে হায়ওয়ানী, রূহে সোলতানী, রূহে রূহানী। কাফির আর মুনাফিকের রূহ্ শুধূ একপ্রকার। কিন্তু নবীগণের ও সিদ্দীকগণের রূহ্ পাঁচ প্রকার।
(৪) যে রূহ্ নির্ধারিত সময় ও বয়স শেষ হলে বের হয়ে যায়- তার নাম নফ্স। আর যে রূহের মাধ্যমে আল্লাহ্পাক তাঁর বন্ধু ও আউলিয়াগণকে সাহায্য করেন- সেটা অন্য রূহ। আল্লাহ্পাক সুরা মুজাদালাহ্ ২২ আয়াতে এরশাদ করেছেন-
اولئک کنب فی قلوبھم الایمان وایدھم بروح منہ ۔
অর্থাৎ “নবী বিরোধীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষনকারী নবীপ্রেমিক লোকদের অন্তরে আল্লাহ্পাক ঈমানের সীলমোহর মেরে দেন এবং তাদেরকে ‘রূহের’ মাধ্যমে সাহায্য করেন”। এখানে ‘রূহ্’ অর্থ অন্য জিনিস- শরীরের রূহ্ নয়। (ঐ রূহ্ হলো রুহুল আমীন হযরত জিবরাঈল)। প্রমাণ স্বরূপ-
হযরত ইছা (আঃ) কে আল্লাহ্পাক রূহুল কুদ্ছ বা জিবরাঈল দ্বারা সব সময় সাহায্য করতেন। জিবরাঈল ছিলেন তাঁর নিত্যসঙ্গী।
(৫) এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন শক্তিকেও রূহ্ বলা হয়। যেমন- রূহুল বাছির, রুহুস সামী। এসব বাহ্যিক রূহ্ শরীরের মৃত্যুর সাথে সাথে মরে যায়। বাহ্যিক শ্রবণশক্তি, বাহ্যিক দর্শন শক্তি মৃত্যুর সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যায়। আর অন্তরের দৃষ্টি ও দর্শনশক্তি বেড়ে যায়।
(৬) আর একটি খাস রূহ্ রয়েছে-যাকে ”মা’রেফাত শক্তি” বলা হয়। এটা সব রূহের মধ্যে উত্তম। আল্লাহর মা’রেফাত, আল্লাহর সান্নিধ্য, আল্লাহর মহব্বৎ, আল্লাহর সন্ধানে হিম্মত সৃষ্টি- এগুলো হলো সবচেয়ে উত্তম রূহ্। এই রূহের তুলনা শরীরের রূহের সাথে এভাবে করা যায়- যেভাবে শরীরের সাথে রূহের তুলনা হয়। ম’ারেফাতের রূহের তুলনাও শরীরের রূহের সাথে ঐরূপ। অর্থাৎ- রূহ্ না হলে যেমন শরীরের কোন মূল্য নেই- তদ্রুপ মা’রেফাত ও সান্নিধ্যের রূহ্ না হলে শরীরের রূহেরও কোন মূল্য নেই- মা’রেফাতের রূহ্ বা শক্তি দ্বারা আল্লাহর ওলীদেরকে সাহায্য করা হয়। তাঁদের অন্তর্দৃর্ষ্টি খোলা থাকে।
ইলেমের রূহ্ আছে, ইখলাছের রূহ্ আছে, মহব্বৎ ও ইনাবাতের রূহ্ আছে, সত্যবাদিতা ও তাওয়াক্কুলের রূহ্ আছে। এই রূহানী শক্তি যার মধ্যে যত বেশী- তিনি ততবেশী রূহানী হয়ে যান। আর- যার মধ্যে এসব রূহানী শক্তি মোটেই নেই- সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়।