প্রশ্নঃ মৃত্যুর পর কেয়ামত পর্য্যন্ত রূহ্ কোথায় থাকে- আসমানে না যমীনে? জান্নাতে না জাহান্নামে? পৃথিবীর দেহ ব্যাতিত অন্য কোন দেহে থাকে কিনা? ঐ অবস্থায় শাস্তি ভোগ করে কিনা? নাকি-আযাবমুক্ত থাকে?
জওয়াবঃ
(১) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাযকিরাহ্ গ্রন্থে মৃত্যুর পর রূহের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আবুল হাসান কাবেছীর উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন- “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত-এর বিশুদ্ধ মতামত হচ্ছে- মুমিন কাফের নির্বিশেষে সকলের রূহ্ ফিরিস্তারা বহন করে উপরের দিকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রথমে পেশ করে। আল্লাহ্তায়ালা ঐ রূহ্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যদি মৃত ব্যক্তির রূহ্ নেককার হয়- তাহলে ফিরিস্তাদেরকে বলেন- তাকে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার জান্নাতের অবস্থান দেখাও। অতঃপর ফিরিস্তারা চোখের পলকে ঐ রূহ্কে নিয়ে জান্নাতে ভ্রমণ করেন। মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাতে যত সময় লাগে-ততটুকু সময় ভ্রমণ করেন। যখন গোসল ও কাফন পরানোর কাজ সমাধা হয়- তখন রূহ্ ফেরত দেয়া হয় এবং কাফনও শরীরের মধ্যখানে রূহ্ অবস্থান নেয়। যখন লাশ খাটে উঠানো হয়- তখন সে মানুষের কথাবার্তা শুনতে শুরু করে। কে তাকে ভাল বল্ছে, কে তাকে খারাপ বল্ছে- তা সে শুনতে পায়। যখন জানাযার পর তাকে কবরে রাখা হয়- তখন রূহ্ শরীরে প্রবেশ করে। তাকে জীবিত হিসাবে বসানো হয় এবং দুই পরীক্ষাকারী ফিরিস্তা তার কবরে প্রবেশ করে”।
(২) আমর ইবনে দীনার (রহঃ) বর্ণনা করেন- “যখন কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তখন তার রূহ্ একজন ফিরিস্তার হাতে থাকে। তার রূহ্ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে- তাকে কিভাবে গোসল দেয়া হচ্ছে, কিভাবে কাফন পরানো হচ্ছে, কিভাবে তাকে কবরে নেয়া হচ্ছে এবং কিভাবে তাকে কবরে বসানো হচ্ছে”।
(৩) মোহাদ্দেস দাউদ উপরের বর্ণনার সাথে হাদীসের অন্য অংশ যোগ করে বলেছেন- খাটের মধ্যে থাকা অবস্থায় লাশকে বলা হয়- শুন, লোকেরা তোমার কিভাবে প্রশংসা করছে”।
(৪) আবু হামেদ গাযালী (রহঃ) তাঁর “কাশফে উলুমিল আখিরাহ্” গ্রন্থে রেওয়ায়াত করেছেন-“যখন আযরাঈল ফিরিস্তা নেককার লোকের রূহ্ কবজ করেন-তখন দুজন উত্তম চেহারার ফিরিস্তা ঐ রূহ্ গ্রহণ করেন। তাদের গায়ে থাকে উত্তম পোষাক ও পবিত্র সুগন্ধি। ঐ ফিরিস্তাদ্বয় নেককারের রূহ্কে বেহেস্তী রেশমী রুমালে আবৃত করে নেন। ঐ রেশমী রুমালখানা মধু মক্ষিকার সম পরিমান। ঐ রূহের মধ্যে আকল ও ইলম- যা সে দুনিয়াতে অর্জন করেছিল- তা তার সাথে থাকবে। সে সবকিছু দেখবে ও বুঝবে। অতঃপর ফিরিস্তারা তার রূহ্ নিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। পথিমধ্যে পূর্ববর্তী মৃত লোকদের মধ্য দিয়ে সে গমন করতে থাকবে। ঐ সমস্ত পূর্ববর্তী লোকদের সংখ্যা হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায়। এভাবে তারা প্রথম আকাশে পৌছাবে। যিম্মাদার ফিরিস্তা দরজা নাড়া দেবে। উপর থেকে বলা হবে- তুমি কে? যিম্মাদার বলবে-আমি ছালছায়ীল। আমার সাথে অমুকের পুত্র অমুক। ফিরিস্তা বলবে-হাঁ সে এরকমই ছিল। তাদের আক্বিদা ছিল সন্দেহাতীত বিশুদ্ব। এরপর ঐ মোমিন রূহ্কে দ্বিতীয় আকাশে নিয়ে যাওয়া হবে। দরজার ফিরিস্তারা বলবে- মারহাবা, সে নামাযের ফরয ঠিকভাবে আদায় করতো। এমনিভাবে তৃতীয় আকাশের ফিরিস্তারা দরজা খুলে দিয়ে তার পরিচয় জেনে নিয়ে বলবে-মারহাবা, সে তার মালের যাকাত দিত আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য এবং যাকাতের কোন অংশ নিজের কাছে ধরে রাখতো না। চতুর্থ আকাশে নিয়ে গেলে ফিরিস্তারা অভ্যর্থনা জানিয়ে বলবে- সে উত্তমরূপে রোযা রাখতো এবং অশ্লীল কাজ ও হারাম খাদ্য থেকে বেঁচে থাকতো। এরপর পঞ্চম আকাশের ফিরিস্তারা দরজা খুলে দিয়ে পরিচয় নিয়ে বলবে- আহ্লান ছাহ্লান, সে লোক দেখানো বা সুনামের আশা না করে ফরয হজ্ব আদায় করতো। ষষ্ঠ আকাশে রূহ্কে নিয়ে গেলে ফিরিস্তারা পরিচয় নিয়ে দরজা খুলে দিবে এবং বলবে- মারহাবা, ইনি উত্তম ব্যক্তি এবং পবিত্র আত্মার অধিকারী। সে পিতামাতার সাথে সৎ ব্যবহার করতো। এভাবে সপ্তম আকাশে নিয়ে গেলে নিয়োজিত ফিরিস্তারা দরজা খুলে দিয়ে বলবে- মারহাবা, সে অতি ভোরে উঠে ক্ষমা প্রার্থণা করতো এবং গোপনে দান খয়রাত করতো, ইয়াতিমদের লালন পালন করতো।
তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হবে “ছুরাদিকাতুল জালাল” নামক স্থানে। দরজা খুলে দেয়ার পর তথাকার নিয়োজিত ফিরিস্তা বলবে- মারহাবা, সে নেককার বান্দা এবং পবিত্র আত্মার অধিকারী। সে বেশীবেশী ক্ষমা প্রার্থণাকারী এবং উত্তম কাজের আদেশকারী ও মন্দ কাজ থেকে বারণকারী, গরীব মিছকিনদের সাহায্যকারী। এমনিভাবে- উক্ত পবিত্র রূহ্ সামনে অগ্রসর হতে থাকবে এবং ফিরিস্তারা তার সাথে মুসাফাহা করে তাকে সুসংবাদ দিতে থাকবে। এভাবে রূহ্কে নিয়ে ছিদ্রাতুল মোন্তাহায় পৌঁছবে এবং দরজা খুলে দেয়ার জন্য নাড়া দিবে। অতঃপর ফিরিস্তা পরিচয় নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করাবে। তারপর অভ্যর্থনা জানিয়ে বলবে- সে বড় নেককার ও আল্লাহর সন্তষ্টি লাভকারী ব্যক্তি ছিল। অতঃপর ঐ রূহ্ আগুনের সাগর, নূরের সাগর, অন্ধকার সাগর, পানির সাগর, বরফের সাগর ও শীতল সাগর অতিক্রম করবে। প্রত্যেক সাগরের দৈর্ঘ হবে এক হাজার বছরের রাস্তা। এরপর চিহ্নিত পর্দাসমূহ ভেদ করে আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছাবে। ঐ পর্দা সমূহের জানালা হবে আশি হাজার। দীর্ঘ স্তরসমুহ ভেদ করে অবশেষে রূহ্ পৌঁছবে আল্লাহর দরবারে। পর্দার অভ্যন্তর হতে ডাক দেয়া হবে- কার এই পবিত্র রূহ্? জওয়াব দেয়া হবে- অমুকের পুত্র অমুকের। তখন আল্লাহ্ জালালুহু বলবেন- নিকটে নিয়ে আস। হে বান্দা! তুমি ছিলে আমার উত্তম বান্দা! তারপর তার ক্ষমা ঘোষণা করা হবে”। (তাযকিরাহ্ ৬৫-৬৬ পৃষ্ঠা)।
(৫) ইবনে নুবাতা- যিনি ১২ চাঁদের আরবী খুতবা লিখেছেন- তাঁকে স্বপ্নে দেখে কেউ জিজ্ঞাসা করলো- আপনার সাথে আল্লাহ্ কিরূপ ব্যবহার করেছেন? জওয়াবে ইবনে নুবাতা বললেন-
”আমাকে দুই করিমের (আল্লাহ্-রাসুল) মধ্যখানে বসিয়ে আল্লাহ্ বললেন- তুমি অত্যন্ত নিবেদিত প্রাণে খুতবা লিখেছো, কত সুন্দর তোমার কালাম। আমি বললাম- হে মাবুদ! খুতবার মধ্যে তোমারই সিফাত বর্ণনা করেছি। আল্লাহ্ বললেন- বলো, তুমি দুনিয়াতে কি বলতে? ইবনে নুবাতা জবাব দিলেন- তোমার সিফাত এভাবে বর্ণনা করেছি- “যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন- তিনিই তাদেরকে মৃত্যু দিয়েছেন। যিনি তাদেরকে বাকশক্তি দিয়েছিলেন। তিনিই তাদেরকে বাকশূন্য করেছেন। যিনি তাদেরকে ধবংস করেছিলেন তিনিই তাদেরকে পুনরায় জীবিত করবেন, যিনি তাদেরকে পৃথক পৃথকভাবে দুনিয়াতে প্রেরণ করে পুণরায় কবরে পৃথক করে রেখেছিলেন- তিনিই পুনরায় তাদেরকে হাশরে একত্রিত করবেন”। ইবনে নুবাতা বলেন- আল্লাহ্তায়ালা আমার খুৎবা শুনে বললেন-তুমি সত্য বলেছো। যাও- আমি তোমাকে পূর্ণ ক্ষমা করে দিলাম”। (তাযকিরাহ)।
[ইবনে নূবাতা ৬৭১ হিজরীর পূর্বের লোক ছিলেন এবং তিনি উঁচু স্তরের বুযুর্গ ছিলেন। তাই তাঁর খুত্বা এখনো মসজিদে মসজিদে পাঠ করা হয়। ইহা লিখিত খুত্বাসমূহের মধ্যে বিশুদ্বতম। ]
বুঝা গেল- নেককারদের রূহ্ প্রথমে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে- তারপর কবরে আসে।
আরো বুঝা গেল- “আল্লাহ্ তাদের রূহের সাথে কথা বলে, পরে কবরে প্রেরণ করবেন বা শরীরের সাথে সংযুক্ত করবেন।
(৭) কাফিরদের রূহের অবস্থান ও অবস্থাঃ
কাফিরদের রূহ্ দেহ থেকে এভাবে টেনে বের করা হবে- যেভাবে শরীর থেকে কাঁটা বের করা হয়। মালাকুত মউত তাকে উদ্দেশ্য করে বলবে- ”হে খবিছ রূহ্! খবিছ দেহ হতে বের হয়ে আস্। তখন তার চিৎকার হবে গাধার চিৎকারের মত। আযরাঈল রূহ্ বের করে যাবানিয়া নামক ফিরিস্তাদের নিকট অর্পন করবে। তাদের চেহারা হবে বিভৎস, পোষাক হবে কালো এবং দুর্গন্ধময়। তাদের হাতে থাকবে পশমের সূর্গন্ধময় রুমাল। ঐ দুর্গন্ধময় পশমী রুমাল দিয়ে রূহ্ পেঁচিয়ে নেয়া হবে। সহীহ বুখারীতে আছে-“ জাহান্নামে কাফেরের দাঁত হবে ওহোদ পাহাড়ের মত বড় বড়”।
কাফেরের রূহ্ নিয়ে ফিরিস্তা প্রথম আকাশে গিয়ে দরজা খুলতে ডাক দিবে। উপর থেকে প্রশ্ন করা হবে- কে তুমি? জবাব দিবে- আমি দাক্ইয়াঈল ফিরিস্তা। পুনরায় প্রশ্ন করা হবে- তোমার সাথে কে? বলবে- ফলানার ছেলে ফলানা। তখন ঐ খবিছ রূহ্ না পাবে অভ্যর্থনা- না পাবে মারহাবা ধ্বনী। আল্লাহ্পাক কাফেরদের ব্যাপারে ঘোষণা করেছেন-
لاَ تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاء وَلاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ
“কাফেরদের জন্য আকাশের রহমতের দরজা খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করবেনা” (সুরা আ’রাফ ৪০ আয়াত)।
যখন যাবানিয়া ফিরিস্তা এই বাণী শুনবে- তখন কাফেরের রূহ্ হাত থেকে নিক্ষেপ করে ফেলে দিবে। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন-
وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاء فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ
অর্থ-”যারা আল্লাহর সাথে ইবাদতে অন্যকে শরীক করেছে-তারা যেন আকাশ থেকে আছাড় খেয়ে নিচে পড়ে গেলো এবং মৃতভোজী পাখীরা তাদেরকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো- অথবা বাতাস তাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করলো” (ছুরা হজ্ব ৩১ আয়াত)।
যখন খবিছ রূহ্ জমীনে এসে পড়বে। যাবানিয়া ফিরিস্তা তাকে শীঘ্র ধরে নিয়ে ছিজজীনে বন্দী করবে। ছিজজীন হলো বিরাট পাথর সদৃশ বদকারদের বন্দীশালা। ইহুদী নাসারাগণকে আকাশের কুরছি থেকে তাদের কবরে নিক্ষেপ করা হবে। মুশরিক ও মুনাফিকদের রূহ্গুলো ইহুদী নাছারাদের ন্যয় কবরে নিক্ষিপ্ত হবে।
আর যেসব মুমিন অপরাধী ছিল- তাদেরকে শ্রেণীভেদে শাস্তি দেয়া হবে। যারা নামাযে ত্র“টি করতো- তাদের নামায তাদেরকে ফেরত দেয়া হবে। কারণ, এরা নামাযে চুরি করেছে। ছেড়া কাপড় যেভাবে নিক্ষিপ্ত হয়- তাদের ত্রুটিযুক্ত নামাযও সেভাবে নিক্ষিপ্ত হবে। এমনিভাবে লোক দেখানো যাকাত দানকারী, অশ্লীল কথাবার্তা বলে রোযা পালনকারী, নাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হজ্ব আদায়কারী অথবা হারাম উপার্জিত মাল দ্বারা হজ্ব আদায়কারী, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী, পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, প্রমুখ ব্যক্তিদের রূহ্ তাদের মুখে ও শরীরে নিক্ষিপ্ত হবে। এভাবে কবরে প্রাথমিক শাস্তি ভোগ করবে। ফাইনাল শাস্তি হবে হাশরে। (তাযকিরাহ)





Users Today : 250
Users Yesterday : 767
This Month : 14672
This Year : 186543
Total Users : 302406
Views Today : 17219
Total views : 3593962