নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বিবিগণের ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদার বিস্তারিত বিবরণ
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান-
يَا نِسَآءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا (৩২)
তরজমা: হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও, যদি আল্লাহকে ভয় করো তা হলে কথায় এমন কোমলতা অবলম্বন করো না যে, অন্তরের রোগী কিছু লোভ করে; হাঁ, ভালো কথা বলো। [সূরা আহযাব: আয়াত-৩২, কান্যুল ঈমান] এ আয়াত শরীফে, পূর্ব ও পরবর্তী আয়াতগুলো সহকারে, বাহ্যত হুযূর-ই আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বিবিগণকে হিদায়ত করা হচ্ছে এবং তাঁদের ফযীলতসমূহ (গুণাবলী) উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এটা হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর না’ত শরীফই। এ’তে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘‘হে আমার পয়গাম্বরের স্ত্রীগণ! তোমরা অন্যান্য নারীর মতো নও! তোমাদের মর্যাদা ও তোমাদের বিধানাবলী অনেকটা ভিন্নতর; কিন্তু এসব মর্যাদা ও ফযীলত কেন হলো? এগুলো এ জন্য যে, তোমরা নবীর স্ত্রী।’’
যে সম্মানিত সত্তার সাথে সম্পর্কের কারণে এ মহত্ব অর্জিত হয়, ওই পবিত্র সত্তার সম্মান ও মহত্ব কেমন হবে, তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ আয়াত শরীফ থেকে নি¤œলিখিত কয়েকটা বিষয় প্রতীয়মান হয়-
এক. হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর স্ত্রীগণ সমগ্র জাহানের স্ত্রীলোকদের চেয়ে উত্তম। কেননা, এখানে نساء (বিবিগণ) নিঃশর্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত মরিয়ম ও হযরত আসিয়া (ফিরআউনের স্ত্রী) এবং হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর মা, রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুন্না আজমা‘ঈন আপন আপন যুগের নারীদের চেয়ে উত্তম ছিলেন; কিন্তু হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর পবিত্র বিবিগণ প্রতিটি যুগের স্ত্রীদের থেকে উত্তম ও অধিকতর ফযীলতমন্ডিত। যেমন- বনী ইসরাঈলের জন্য এরশাদ হয়েছে- اِنِّىْ فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعٰلَمِيْنَ (আমি তোমাদেরকে সমগ্র বিশ্ববাসীর উপর বুযুর্গী বা মহত্ব দিয়েছি।) সুতরাং ওই যুগের লোকদের উপরও বাস্তবিকপক্ষে তাঁরা উত্তম ছিলেন। আর এখন ‘গোলামানে মোস্তফা’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমস্ত উম্মত থেকে উত্তম।
দুই. এ বিষয়ে কথা রয়ে গেছে যে, হযরত ফাতিমা যাহ্রা কি উত্তম, না হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা) উত্তম? কেউ কেউ বলেন, হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ অধিকতর উত্তম, এ আয়াত শরীফের কারণে; বরং হুযূর-ই আক্রামের সমস্ত সাহেবযাদী থেকে হুযূরের পবিত্র বিবিগণ উত্তম। কেননা, এ আয়াতে কারো শর্ত আরোপ করা হয়নি; দ্বিতীয়ত এ সাহেবযাদীগণ হলেন আওলাদ (বংশধর), আর পবিত্র বিবিগণ হলেন মা। বস্তুত মা মাখদূমাহ্ হন, (অর্থাৎ যাঁদের সেবা ও সম্মান করা হয় এমন হয়ে থাকেন।)
তিন. জান্নাতে হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ ও অন্যান্য পবিত্র বিবি হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বসবাস করবেন। আর হযরত ফাত্বিমা যাহ্রা থাকবেন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে। এসব কারণে বুঝা যায় যে, সাহেবযাদীগণ থেকে হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র বিবিগণ উত্তম।
আর কেউ কেউ বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা পবিত্র বিবিগণ অপেক্ষা উত্তম। তাও নি¤œলিখিত কতিপয় কারণে-
এক. তাঁর পবিত্র শরীরের রক্ত ও মাংস রসূলকুল শ্রেষ্ঠ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এরই থেকে; অর্থাৎ তাঁর পবিত্রতা সত্তাগত। কেননা, তিনি হুযূর মোস্তফার অংশ। আর পবিত্র বিবিগণের (শারীরিক উপাদানগুলো) অন্যান্য বান্দার।
দুই. হযরত ফাত্বিমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সমস্ত জান্নাতী নারীর সরদার। এ কারণে তাঁর উপাধি ‘সাইয়্যেদাতুন্নিসা’। আর জান্নাতী নারীগণের মধ্যে উম্মাহাতুল মু’মিনীন (মু’মিনদের মাগণ)ও রয়েছেন।
তিন. হযরত ফাতিমা যাহরা মাহবূবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একই আকৃতির।
চার. হযরত ফাত্বিমা যাহরা ‘হায়েয’ ও ‘নিফাস’ (যথাক্রমে মাসিক ঋতু¯্রাব ও সন্তান প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ) থেকে পবিত্র। [সূত্র. মাদারিজুন্নুবূয়ত] এজন্য তাঁকে ‘যাহরা’ অথবা ‘বাতূল’ অথবা ‘ফাত্বিমা’ বলা হয়। ‘যাহরা’ মানে জান্নাতের ফুলের কলি, ‘ফাতিমা’ ও ‘বাতূল’ মানে দুনিয়ায় অবস্থান করা সত্ত্বেও দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত। যেমন (পংক্তি)
بتول و فاطمه زهراء لقب اس واسطے آيا
كه دنيا ميں رهيں اور ديں پته جنت كى نكهت كا
অর্থ: বাতূল, ফাতিমা ও যাহরা উপাধিগুলো তিনি এজন্যই পেয়েছেন যে, তিনি অবস্থান করেছেন দুনিয়ায়, কিন্তু ঠিকানা বলে দিয়েছেন, জান্নাতের সৌরভের।
ইমাম সারাখসীর ‘কিতাবুল কারাহিয়্যাহ: বাবুল লাম্স’-এ উল্লেখ করা হয়েছে- হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত খাতূনে জান্নাতের শরীর মুবারকের ঘ্রাণ নিতেন। আর বলতেন, ‘‘আমি তার শরীর থেকে জান্নাতের খুশ্বু পাচ্ছি।’’
[সূত্র. দিওয়ান-ই সালিক, কৃত. হাকীমুল উম্মত আল্লামা
আহমদ ইয়ার খান নঈমী আলায়হির রাহমাহ] এতে হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র বিবিগণ ও সন্তানদের অনেক প্রশংসা ব্যাখ্যাসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু ফয়সালা এ যে, প্রথমত এসব বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না, যেমন- ‘ফাতাওয়া-ই শামী: বাবুল কুফূ’তে উদ্ধৃত হয়েছে যে, ‘‘বরং উভয় হযরত আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মুনিব-
এক মহিলা যিনি মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাহবূবাহ। আরেক মহিলা যিনি মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হিস্ সালাম-এর কলিজার টুকরা (কন্যা)। রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা। ক্বিয়ামতে যদি তাঁদের মধ্যে কারো পাদুকাযুগলও হাতে আসে, তবে আমরা অধমদের নৌযান তীরে লেগে যাবে। যদি এ ফয়সালা মনঃপূত হয়, তবে একথাই বলো- কোন কোন দিক দিয়ে হযরত খাতূন-ই জান্নাত উত্তম, আবার কোন কোন দিক দিয়ে হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ উত্তম। রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা।
এ আয়াত শরীফ থেকে একথাও প্রতীয়মান হয় যে, শরীয়তের বিধানাবলীতেও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালামের পবিত্র বিবিগণ অন্যান্য নারীর মতো নন। যেমন-অন্য নারীগণ তালাক্ব কিংবা স্বামীর ওফাতের পর অন্য বিবাহ্ করতে পারে; কিন্তু এ মহীয়সী মহিলাগণ হলেন মুসলমানদের মা। অন্য নারীগণ স্বামীর উত্তরাধিকার পায়। কিন্তু এ মহীয়সীরা পান না। অন্য নারীদের স্বপ্নদোষ হয়; কিন্তু মু’মিনদের মহীয়সী মায়েরা তা থেকে মুক্ত। কেননা স্বপ্নদোষ শয়তানের প্রভাব থেকে হয়; কিন্তু মাহবূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর বিবিগণ পর্যন্ত শয়তান পৌঁছতে পারে না। [সূত্র. মিশকাত: বাবুল গোসল] হযরত উম্মে সালামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা নারীদের স্বপ্নদোষের কথা শুনে আশ্চর্যবোধ করেছিলেন। উম্মাহাতুল মু’মিনীন হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর ওফাত শরীফের পর নিজেদের মাথার চুলগুলো ছেঁটে ফেলেছিলেন।
[সূত্র. মুসলিম শরীফ: গোসলের পানির পরিমাণের বর্ণনা শীর্ষক অধ্যায়] কেননা, এখন তাঁদের সাজ সজ্জার কোন প্রয়োজনই থাকেনি। অথচ অন্য নারীদের চুল ছাঁটা কিংবা মুন্ডানো হারাম। তাঁদের পবিত্র ঘরে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম দাফন হয়েছেন। অন্য নারীদের ঘরে তাদের স্বামী দাফন হয় না। মোটকথা, অনেক বিধানে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
বিশেষভাবে বুঝা যায় যে, সমস্ত পবিত্র বিবি গোটা বিশ্বের নারীদের চেয়ে উত্তম। এতদ্সত্ত্বেও তাঁদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদাগত পার্থক্য বিদ্যমান। হযরত খাদীজাতুল ক্বুবরা, হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা অন্যান্য পবিত্র বিবি অপেক্ষা উত্তম। হযরত আয়েশার শাদী মুবারক হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশ হযরত খাদীজাতুল ক্বুবরা থেকে প্রসার লাভ করেছে। হযরত খাদীজার জীবদ্দশায় হুযূর-ই আক্রাম অন্য শাদী করেননি। সবসময় হুযূর-ই আকরাম হযরত খাদীজাতুল কুবরার পক্ষ থেকে ক্বোরবানী ইত্যাদি করেছেন।
হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ জ্ঞান ও গুণে সমস্ত নারীর মধ্যে অনুপম ও অদ্বিতীয়। সাহাবা-ই কেরামের জ্ঞানগত বিরোধ তিনি মীমাংসা করতেন। তাঁর উপাধি হয়েছে- ‘মাহবূবাহ্-ই মাহবূবে রাব্বুল আলামীন’। তাঁর বিছানা শরীফে হুযূর-ই আক্রামের উপর ওহী এসেছে। তাঁকে হযরত জিব্রাঈল সালাম আরয করেছেন। হুযূর-ই আক্রামের ভেসাল (ওফাত) শরীফ তাঁর কোল ও বক্ষ শরীফের উপর হয়েছে। তাঁর হুজুরা শরীফ ক্বিয়ামত পর্যন্ত ফিরিশ্তা, মানুষ ও জিনদের যিয়ারতস্থল হয়েছে। কেননা, এ হুজুরা শরীফই হুযূর-ই আক্রামের আরামগাহ্ হয়েছে। খোদ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের কন্যা, নবীকুল সরদারের উভয় জগতে স্ত্রী। কবির ভাষায়-
جن كى پهلو هو نبى كى آخرى آرام گاه
جن كے حجرےميں قيامت تك نبى هوں جاگز يں
অর্থ: যাঁর পার্শদেশ হলো নবী করীমের শেষ বিশ্রামস্থল, যাঁর হুজুরা শরীফে ক্বিয়ামত পর্যন্ত নবী করীমের আরামের স্থান হয়েছে।
যখন হযরত আয়েশার বিপক্ষে কিছুলোক অপবাদ দিলো, তখন ‘সুরা-ই নূর’ তাঁর নূরানিয়াত ও চারিত্রিক পবিত্রতা বর্ণনা করেছে। এখনও বরং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যে মুসলমানই ক্বোরআন পড়বে, সে তাঁর পবিত্রতার সাক্ষ্য দেবে। আ’লা হযরত আলায়হির রাহমাহ্ বলেন-
وه جوهےسورۀ نور جن كى گواه ـ ان كى نورانى صورت په لاكواں سلام
অর্থ: ওই মহীয়সী মহিলা, যাঁর চারিত্রিক পবিত্রতার সাক্ষ্য হয়েছে সূরা নূর, তাঁর নূরানী অবয়বের উপর লাখো সালাম।