হিজরত-সাথি
🖋মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
ধর্ম করতে লুট,
মক্কার যত কাফের-নাকের হলো সবে একজোট।
মিলিত সবাই গোত্রের ভাই; নদওয়ার বৈঠকে,
কুজনের দল ভোজনের পর কল্পনা-চক আঁকে।
‘মুহাম্মদ সে শত্রু মোদের; করেছে ধ্বংস সব
পূজায় অর্ঘ্য দানিতাম সবে ওজ্জা-মানাত রব।
বাপ-দাদার সে ধর্মকর্ম ভুলে গিয়ে লোকজন
মুহাম্মদের প্রভুর নিকটে হয়েছে সমর্পণ।’
জাহেলের সুরে সুর মিলালো গোত্রের যুবাদল,
মুহাম্মদেরে করবে হত্যা রোধিতে মুমিন-ঢল।
সাহাবা সকল বেঁধে দলবল বাড়িঘর সব ছেড়ে
দেশপ্রেম ভুলে নবিপ্রেমে চলে মদিনার পথ ধরে।
ঐশী প্রেরণা পেয়ে নবিরাজ আয়োজন নিলো সেরে,
‘যেতে হবে তাঁর সঙ্গে ওপার’ বলে বকরের তরে।
দুজাহানে সবে কাঁদো কাঁদো রবে সঙ্গ যাঁহার মাগে
‘তাঁহার সঙ্গি’ শুনে বকরের ভাবতেই সুখ জাগে।
পয়গাম কুরানের–
‘সম্বোধিলে আল্লাহ-রাসুল সাড়া চাই সকলের।’
এই ভেবে যায় শ্রেষ্ঠ সাহাবি আবু বকরের দিন
না-শুনিলে বাক, রাসুলের ডাক জন্মে থেকেও লীন।
ডাক দিবে যবে শ্রেষ্ঠ মানবে তখন-ই যেন শোনে
নিদ্রা আহার সবি দিয়ে ত্যাগ কেবলি প্রহর গুনে।
এলো সেই ক্ষণ; রাসুলে আরাবি কড়া নাড়ে দরজায়,
‘লাব্বাইক ইয়া রাসুলাল্লাহ’ সাথে সাথে শোনা যায়।
‘কিহে সিদ্দিক, ঘুমাওনি কি?’ সোয়াল করেন নবি,
সত্যব্রতীর কণ্ঠে ভাসে প্রেমের প্রতিচ্ছবি-
‘ওহে প্রিয়সখা-প্রেমাস্পদ প্রিয়নবি হজরত
ঘুমালেই তব আহ্বানকালে কীসে তবে ইবাদত?
আদেশেতে যাঁর দিবাকর ফেরে, চাঁদ ফাটে ইশারায়,
তাঁর আহ্বানধ্বনি যদি না-শুনি বৃথা এ জনম হায়!
তাই ভেবে এই অধম বকরে সেইদিন হতে আজ
মুদিনি চক্ষু, রাখিনি পৃষ্ঠ ঐ খাটিয়ার মাঝ।’
━━━━━━━━━━━━━━━━
হায়! একি দৃশ্য! দ্যাখ, ওহে বিশ্ব–কী চলে ও-সাহারায়,
দেশ ছেড়ে যায় দেশের মালিক; রাজ করে দাসিরাই।
জগৎসূর্য মরুর মাঝেতে; বকরের কাঁধে হাত,
সাওর-গুহাতেই রাত কাটাবে সরোয়ার-কায়েনাত!
আনন্দে সারা সাওরের গুহা একি ও-কেমন রীতি,
জান্নাত ছেড়ে ধূলির গুহায় জাহানের দুই প্রীতি!
ধূলিতে নুরের দেহ মোবারক; মাথা বকরের কোলে
ক্ষণিকের তরে পর্বত-ঘরে হেলে ঘুমানোর ছলে।
যাঁর তরে ঘুম, ‘ঘুম’ রূপ পায়, তাঁর কীরে ঘুম আর
মুনিবের লীলা দয়ালের খেলা অসাধ্য বুঝিবার।
চেতন বকরে দেখেন নজরে গুহাভরা সাপখাদ;
ভাবে, ওত পেতে বিষধর তাতে লোকে আছে নির্ঘাত।
হাবিব-নবির চাদর-টুকরে কোটর বন্ধ করে
একখানা বাকি রয়েছিল–তাতে আঙুল দিয়াছে পুরে।
দুজাহান-রবি জগতের নবি; নুরি তন তাঁর হায়,
আকর্ষিবে না এমনও প্রাণী আছে কি এ বসুধায়?
যে দেহের ঝরা ঘর্মে বিকাশ লভে গোলাপের ফুল,
সুগন্ধে ভরা ও-তনু মনোহরে কে না-হয় মশগুল?
আপন গর্তে সুঘ্রাণ যবে নাকে যায় ‘হারেসা’র,
উথাল-পাতাল গন্ধে মাতাল করে উঠে মন তার।
ব্যাকুল চিত্তে ছিদ্রান্বেষে; নাহি মেলে তার খোঁজ,
নবির সুরভে মাতোয়ারা মন; কে বা তারে দেয় বুঝ।
বকরের তরে বিষের অধরে ঠোক মেরে চাহে পথ,
প্রেম দরিয়ায় মগ্ন বকর আঙুলি সে বলবৎ।
প্রেমবিষে পায় যাঁরে,
দংশিলে বিষধরে,
যে হয়েছে প্রেমমরা;
কোন বিষে মারে তাঁরে।
প্রেম দেখো বকরের
লা-পরোয়া জীবনের,
বিষে শরীর ছেঁয়ে যায়;
ভাঙে না ঘুম মুনিবের।
অন্তরে প্রেমঝড়
শরীরেতে বিষধর,
জিত কার, কার হার–
ধড় না-কি অন্তর?
তবু,
প্রকৃতির এই রীতি—
ধড়ের ব্যথায় ব্যথিত চক্ষু, বেড়ে যায় তার প্রীতি।
শরীরের কোনো ভাগে
আহা, বেদন যদি গো জাগে,
অঝোরে ঝরায় ঝরনাধারা; নিদারুণ শোকাবেগে।
চোখমণি বকরের–
গড়িয়ে দিলো প্রেমের নহর চেহারায় রাসুলের।
জাগিয়া রাসুল জগত-অতুল দেখে বকরের পানে
জিজ্ঞাসে তথা কোলে নবি-মাথা; কাঁদো বলো কোন টানে?
জান্তা নবির অজানা-প্রশ্নে চেতনা আসলো ফিরে,
সর্প যে তাঁরে মেরেছে ছোবল–আতিকের মনে পড়ে।
হিজরত-সাথি নবির প্রীতি করে যায় ফরমান-
জীবন-মরণ-স্বপন সকল যাঁর তরে কুরবান,
উরুপরে সে শির মোবারক জগতের সরতাজ;
আপনার ব্যথা কী করে প্রকাশ করি গো হেথায় আজ।
নবি ইউসুফের ঝলক-ছোটে পলক না-ফেরে বলে
ব্যাকুল চিত্তে কেটেছে আঙুল মিশরি হুরের দলে।
নবিকুলরাজ ইউসুফেরও তাজ–মুস্তফার চেহারা
সুমুখে আমার চোখের উপরে–তাই দেখে দিশেহারা।
পদতলে যাঁর নতে সবে শির, তাঁর মাথা মোর কোলে
ও-শিরের আরামে ব্যাঘাত ঘটাই কোন ক্ষমতা-বলে?
হেন পাপ নাই নরকুলে।
‘বকরের উক্তি–রাসুলে ভক্তি’ দেখে নবি বলে উঠে
‘‘সাহেবুল গার’ সিদ্দিক আমার এসো এসো বুকপটে।’
আলতো ছোঁয়াতে বকরের আঙুলে মাখে মোবারক থুথু
বিষের মাত্রা করিলো যাত্রা ঠিক যেন ধূমকেতু।
আবু বকর! ওহে,
আখেরি নবির উত্তর বাহু; এসো ফের ধরণীতে,
প্রেম বিলাতে অসার-নিঠুর-প্রেমহীন মানবেতে।