হাদীস নিয়ে মিথ্যাচারের জবাব

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

আমাদের সমাজে এমন কিছু দলের আবির্ভাব হয়েছে যারা নিজেদের আহলে হাদীস তথা হাদীসের অনুসারী বলে দাবী করে। মূলত ওদের কাজ হলো নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসালল্লামার হাদীসকে ঘিরে। অর্থাৎ নতুন নতুন হাদীস বানানো, সহীহ হাদীসকে জাল বলে মানুষের মাঝে কানাঘুষা করা, হাদীসের মূল বক্তব্য পরিবর্তন করে ফেলা, হাদীসে করতে আদেশ করা বিভিন্ন উত্তম কাজকে নিষেধ বানিয়ে চালিয়ে দেয়া বা হাদীসে নিষেধ করতে বলা হয়েছে এমন কাজকে নবীজির সুন্নাত বলে চালিয়ে দেয়া বা এক কথাই হাদীস নিয়ে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। তাদের এমন একটি ঘৃণ্য কাজ কিছুদিন ধরে অনলাইনে বারংবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে কলম ধরেছেন বহু ইসলামিক স্কলারসগণ এটা নতুন নই। তবুও আমি ছোট্ট পরিসরে একটি ছবি নিয়ে আলোকপাত করলাম। আমার বহু পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষীগণও তা ইনবক্সে পাঠিয়েছে একাধিকবার। এই বানোয়াট হাদীসটির বক্তব্য নিচে দেয়া হলো – 

যে ব্যক্তি জন্মদিন, মৃত্যুদিন, কুলখানি বা কোন দিবস পালন করেছে.! ততবার সে বিদআত করেছে। আমার সুপারিশ তাঁর জন্য প্রযোজ্য নই। 

( বুখারি ২৬৯৭, মুসলিম ১৭১৮, মেশকাত ১৪০) 

প্রথমত, এখানে যে বুখারি ২৬৯৭, মুসলিম ১৭১৮ এবং মেশকাত ১৪০ নাম্বার হাদীসের রেফারেন্স দেয়া হলো তার সাথে বিন্দুমাত্র মূল হাদীসের বক্তব্যের মিল নেই। হাদীসটির মূল বক্তব্য নিচে দেয়া হলো,

عن أم المؤمنين‎ ‎عائشة‎ ‎رضي الله عنها قالت : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد (رواه‎ ‎البخاري‎ ‎ومسلم، وفي رواية‎ ‎لمسلم: من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد (

আয়িশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসালল্লাম ইরশাদ করেন,যদি কেউ এমন কিছুর প্রচলন করল যা আমাদের দ্বীনের মৌলনীতির সাথে সামঞ্জস্যহীন, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত”। ( বুখারি ২৬৯৭, মুসলিম ১৭১৮, মেশকাত ১৪০)

অতএব হাদীসে জন্মদিন পালন হারাম, মৃত্যুদিন পালন হারাম, কুলখানি করা হারাম বা কোন দিবস পালন করা হারাম কোথায় লিখা আছে? বা এটাও কোথায় লিখা আছে যে রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য সুপারিশ করবে না..?? 

তাজ্জব হই তখন..! যখন কথিত আহলে হাদীসেরা নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সাফাআত তথা সুপারিশ অস্বীকার করতে দেখি। কিন্তু এখানে নিজেরাই স্বীকার করছে যে নবীজির সাফাআত ছাড়া রেহাই নাই। যাক…সত্য তো বের হওয়ারই। কিন্তু হাদীস বানোয়াটকারীর জন্য কোন সুপারিশকারী থাকবেনা। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে – 

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من كذب علي متعمدا فاليتبوؤ مقعده من النار

অর্থ: রাসুলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি অামার বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার করলো,( মিথ্যা হাদীস এবং তথ্য প্রচার করল) সে যেন পরকালে জাহান্নামকে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।

সূত্র:অাবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং-৩৬৫১

ইবনে মাজাহ শরীফ, হাদীস নং-৩০

তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-২৬৬১

নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং-৫৯১৫

বুখারী শরীফ, হাদীস নং-১০৬

মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-৪

* অর্থাৎ এমন কোন হাদীস বা তথ্য যা নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামার বলে চালিয়ে দেয়া প্রিয় নবীজির উপর মিথ্যাচার করার শামিল। এবং এটি নবীজির ফয়সালা যে, মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী এবং হাদীসের মতন তথা বক্তব্য পরিবর্তনকারী তথা খেয়ানতকারী যাতে তাঁর স্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। যদি বলা হয় যে, মিলাদ, কিয়াম, ফাতেহা ইত্যাদি পালন করা বিদআত তবেঁ বলবো মিলাদ, কিয়াম, ফাতেহা বা অন্যান্য আহকাম পালনে শরীয়তে যথেষ্ট দলিল বিদ্যমান। সুতরাং কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আহকামকে বিদআত বলাও চরম গুমরাহিতা। 

আল্লাহ তাআলার নির্দেশ – 

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَانَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا

“রাসুল (সাঃ) তোমাদের যা দিয়ে গিয়েছেন তা গ্রহন কর। আর যা থেকে নিষেধ করেছেন তা বর্জন কর “(সুরা হাঁশর আয়াত ৭)

* নব্যসৃষ্ট ভালো কাজ বা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রিয় নবী সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হাদীসে বলেন – 

ﻣَﻦْ ﺳَﻦَّ ﻓِﻲ ﺍْﻹِﺳْﻼَﻡِ ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ﻓَﻠَﻪُ ﺃَﺟْﺮُﻫَﺎ ﻭَﺃَﺟْﺮُ ﻣَﻦْ ﻋَﻤِﻞَ ﺑِﻬَﺎ ﺑَﻌْﺪَﻩُ، ﻣِﻦْ ﻏَﻴْﺮِ ﺃَﻥْ ﻳَﻨْﻘُﺺَ ﻣِﻦْ ﺃُﺟُﻮْﺭِﻫِﻢْ ﺷَﻲْﺀٌ . ﻭﻣَﻦْ ﺳَﻦَّ ﻓِﻲ ﺍْﻹِﺳْﻼَﻡِ ﺳُﻨَّﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔً ﻛَﺎﻥَ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭِﺯْﺭُﻫَﺎ ﻭَﻭِﺯْﺭُ ﻣَﻦْ ﻋَﻤِﻞَ ﺑِﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﻩِ ﻣِﻦْ ﻏَﻴْﺮِ ﺃَﻥْ ﻳَﻨْﻘُﺺَ ﻣِﻦْ ﺃَﻭْﺯَﺍﺭِﻫِﻢْ ﺷَﻲْﺀ

হযরত যারির ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামে কোন উত্তম বিষয় বা আমলের প্রচলন করলো, তার জন্য প্রতিদান বা ছওয়াব রয়েছে এবং তার পরে যারা এই আমল করবে তাদের জন্য ছওয়াব বা প্রতিদান রয়েছে, অথচ এতে তাদের ছওয়াব থেকে কোন পরিমাণ কম করা হবে না; এবং যারা ইসলামে মন্দরীতি প্রচলন করে, এর জন্য তাদের পাপ হবে এবং যারা এর উপর আমল করবে, তাদেরও পাপ হবে, তবে তাদের পাপের বেলায় কোন পরিমাণ কম করা হবে না।

(মুসলিম বাব ৫, হাদিস ২২১৯;মুসলিম বাব ৩৪, হাদিস ৬৪৬৬,নাসাঈ হাদিস ২৫৫৪,ইবন মাযাহ হাদিস ২০৩, ২০৬, ২০৭;আহমাদ – খ. ৪ পৃ.-৩৫৮) 

* হাদীসে দু’টি শব্দ বিদ্যমান ” ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ” সুন্নাতে হাসনাহ অপরটি ” ﺳُﻨَّﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔ ” সুন্নাতে সাইয়্যিয়াহ।

* ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً  – 

সুন্নাতে হাসনাহ যেটিকে শরেহীন মুহাদ্দেসীনদের তাহকীকে ” বিদআতে হাসনাহ ” হিসেবেও জানা হয়। অর্থাৎ এই উত্তম রীতি বা পদ্ধতি দ্বারা ঐ সকল নতুনত্ব কাজকে নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম নির্দেশ করেছেন, হাদীসের ভাষায় যে সকল কাজ বা পদ্ধতি দ্বারা দ্বীন, মিল্লাত বা মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হতে পারে। যা করলে সোয়াবও রয়েছে। হাদীসের এই বাক্যাংশ – 

ﻣَﻦْ ﺳَﻦَّ ﻓِﻲ ﺍْﻹِﺳْﻼَﻡِ ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ﻓَﻠَﻪُ ﺃَﺟْﺮُﻫَﺎ ﻭَﺃَﺟْﺮُ ﻣَﻦْ ﻋَﻤِﻞَ ﺑِﻬَﺎ ﺑَﻌْﺪَﻩُ، ﻣِﻦْ ﻏَﻴْﺮِ ﺃَﻥْ ﻳَﻨْﻘُﺺَ ﻣِﻦْ ﺃُﺟُﻮْﺭِﻫِﻢْ ﺷَﻲْﺀٌ 

সুন্নাতে হাসনাহ তথা বিদআতে হাসনাহ তথা দ্বীনের মাঝে নতুন সৃষ্ট উত্তম রীতি পদ্ধতির বৈধতার সাক্ষ্য বহন করে। যা করলে সোয়াবেরও ঘোষণা দিয়েছেন প্রিয় নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। 

*  ﺳُﻨَّﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔ – 

সুন্নাতে সাইয়্যিয়াহ। যেটিকে শরেহীন মুহাদ্দেসীনদের তাহকীকে ” বিদআতে সাইয়্যিয়াহ ” হিসেবে জানা হয়। অর্থাৎ এটি এমন একটি রীতি যে সম্পর্কে হাদীসে প্রিয় নবী সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন – 

ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﻋﻤﻼ ﻟﻴﺲ ﻋﻠﻴﻪ ﺃﻣﺮﻧﺎ ﻓﻬﻮ ﺭﺩ

“যে এমন আমল বা কাজ করল যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।”(মুসলিম, হা: ১৭১৮) অন্যদিকে মন্দ রীতি প্রচলন করার ব্যাপারেও হাদীসে সাবধাণ করা হয়েছে। 

* অনেকেই আবার আপত্তিজ্ঞাপন করে যে হাদীসটিতে ”  ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ” ( সুন্নাতে হাসনাহ) বলতে প্রিয় নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামার ” সুন্নাত ” বুঝানো হয়েছে। তাদের জবাবে বলবো। ” সুন্নাত ” শব্দটি  দেখলেই ভাবে যে এটি নবীজির সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু নই। সুন্নাত মানে তরিকা বা পন্থা বা রীতি। যদিওবা বেশিরভাগ হ্মেত্রেই এটি প্রিয় নবীজি সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামার কর্মপরিধি বা আদর্শকে নির্দেশ করে। তাই সুন্নাত মানেই আমরা একমাত্র নবীজির দেখানো তরিকাকে মনে করি। যদি হাদীসে ”  ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ” সুন্নাতে হাসনাহ তথা উত্তম রীতি পদ্ধতি শব্দটি থাকলে ধরে নেয়া হয় যে এটি নবীজির সুন্নাতের কথা বলেছে! তবেঁ হাদীসটিতে ” ﺳُﻨَّﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔ ” সুন্নাতে সাইয়্যিয়াহ তথা মন্দ রীতি পদ্ধতি দ্বারা কার মন্দ কাজ বা মন্দ সুন্নাত নির্দেশ করা হয়েছে.? মাআজাল্লাহ তবেঁ ধরে নিতে হবে যে রাসূলে পাক সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামা ”  ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ” সুন্নাতে হাসনাহ তথা ভালো কাজের পাশাপাশি ” ﺳُﻨَّﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔ ” সুন্নাতে সাইয়্যিয়াহ তথা মন্দ রীতি তথা খারাপ কাজও করতেন.! আল্লাহর পানাহ……! আহলে সুন্নাতের অন্যতম আকিদা নবীগণ গুনাহখাতা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। যথায় আল্লাহ পাক স্বয়ং তাদের পবিত্রতার দায়িত্ব নিয়েছেন তথায় তাঁদের হতে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রকাশ হওয়া এক্কেবারে অসম্ভব। 

অতএব কুরআন হাদীসের লেশমাত্র জ্ঞান নেই বলে তাঁরা হাদীস নিয়ে মিথ্যাচার করে। বানোয়াট হাদীস প্রচলন করে। সুতরাং যারা বিদআত বিদআত বলে লাফালাফি করে তাদের উচিত আগে ” বিদআত ” নিয়ে স্টাডি করা। বিদআত শব্দের অপব্যাখ্যা হতে দূরে থাকা। কারণ ইসলামে এমন কিছু পদ্ধতির সাহারা নিয়ে চলতে হয় যা রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবী রাযি:গণ করেননি। তাঁরা কোন কাজ না করলে সেটাকে বিদআত বলে শরয়ীতের বাইরে নিক্ষেপ করাটা পাক্কা জেহালতি। 

আল্লাহ পাক আমাদের হাদীস বানোয়াটকারীদের ফেতনা হতে হেফাজত করুন। আমীন।

______________________

Sifat Sultan Alif.

Researcher – Ala Hazrat Research Academy.

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment