(১) ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন,
عن علقمة قال قال عبد الله بن مسعود رضى الله عنه الا اصلى بكم صلوة رسول الله فصلى فلم يرفع يديه الا فى اول مرّة قال ابو عيسى حديث ابن مسعود حديث حسن وبه لقول غير واحد من اهل العلم من اصحاب النبى صلى الله عليه وسلم والتابعين –
“হযরত আলকামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূল (ﷺ) ’র ন্যায় নামায পড়াবো না? অতঃপর তিনি নামায পড়ালেন। এতে শুধু প্রথমবার হাত উঠালেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) বলেন, ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)’র হাদিস হাসান এবং রাসূল (ﷺ) ’র অসংখ্যা সাহাবী ও তাবেয়ীদের মতও অনুরূপ।”
➥ ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) (২৭৯ হিঃ) জামে তিরমিযী, পৃষ্ঠাঃ ৬৪-৬৫
উক্ত হাদিসটি ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তাহাভী, ইমাম ইবনে আবি শায়বা ও ইমাম আব্দুর রাযযাকও রেওয়ায়েত করেছেন।
(২) ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন-
عن البراء ان رسول الله كان اذا افتتح الصلوة رفع يديه الى قريب من اذنيه ثم لا يعود
“হযরত বারা ইবনে আযিব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) যখন নামায আরম্ভ করতেন তখন কানের নিকট পর্যন্ত হাত উঠাতেন। এরপর আর হাত উঠাতেন না।
➥ ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) আবু দাউদ শরীফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ১০৯, লাহোর
উক্ত হাদিসখানা ইমাম তাহাভী। দারে কুতনী এবং ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) বর্ণনা করেন।
(৩) ইমাম তাহাভী (رحمة الله) বর্ণনা করেন-عن الاسود قال رأيت عمر بن الخطاب رضى الله عنه يرفع يديه فى اوّل مرة ثم لايعود ورائت ابراهيم والشعبى يفعلان ذالك- “হযরত আসওয়াদ (رحمة الله) বলেন, আমি হযরত ওমর (رضي الله عنه) কে দেখেছি যে, তিনি শুধু প্রথমবার হাত উত্তোলন করতেন। এরপর আর করতেন না।” হযরত ইব্রাহীম ও শা’বী (رحمة الله) ও অনুরূপ করতেন।
➥ ইমাম তাহাভী (رحمة الله) (৩২১ হিঃ) শরহে মাআনিউল আসার, খন্ড ১ম, পৃষ্ঠাঃ ১৩৩, পাকিস্তান
(৪) ইমাম দারেকুতুনী (رحمة الله) বর্ণনা করেন,
-عن علقمة عن عبد الله قال صليت مع النبى صلى الله عليه وسلم مع ابى بكر ومع عمر رضى الله عنهما فلم يرفعوا ايديهم الا عند التكبير الاولى فى افتتاح الصلوة
– “হযরত আলকামা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (ﷺ) হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) ও হযরত ওমর (رضي الله عنه)’র সাথে নামায পড়েছি। এরা সবাই নামাযের প্রারম্ভে কেবল একবার প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন।”
➥ ইমাম দারেকুতুনী (২৮৫ হিঃ) সুনানে দারেকুতুনী, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২৯৫, মুলতান
(৫) ইমাম হুমাইদী (رحمة الله) বর্ণনা করেন,
-عن سالم عن عبد الله بن عمر قال رائت رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا افتتح الصلوة رفع يديه خذ ومنكبيه واذا اراد ان يركع وبعد ما يرفع راسه من الركوع فلا يرفع ولابين السجدتين
-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) নামায আরম্ভ করার সময় উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাতেন। রুকুর আগে ও পরে আর হাত উঠাতেন না এবং দুই সিজদার মধ্যখানেও হাত উঠাতেন না।”
➥ ইমাম হুমাইদী (رحمة الله) (২১৯ হিঃ) আল মুসনাদ, খন্ড ২য়, পৃষ্ঠাঃ ২৭৭, বৈরুত
(৬) ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) বর্ণনা করেন,
-عن عاصم بن كليب عن ابيه ان عليا كان يرفع يديه اذا افتتح الصلوة ثم لايعود“
“হযরত আসিম ইবনে কুলাইব স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আলী (رضي الله عنه) নামাযের শুরুতেই হাত উঠাতেন। এরপর আর হাত উঠাতেন না।”
➥ ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) (২৩৫ হিঃ), আল মুসান্নিফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২৩৬, করাচী
(৭) عن الشعبى انه كان يرفع يديه فى اول التكبىر ثم لايرفعهما “ইমাম শা’বী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত, তিনিও শুধু প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন এরপর আর উঠাতেন না।”
➥ ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) (২৩৫ হিঃ), আল মুসান্নিফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২৩৬, করাচী
(৮) عن ابراهيم انه كان يقول اذا كبرت فى فاتحة الصلوة فارفع يديك ثم لاترفعهما فيما بقى “ইব্রাহীম নখঈ (رحمة الله) বলেন, যখন তুমি নামাযের শুরুতে তাকবীর বলবে তখন হাত উঠাবে তবে বাকী নামাযে হাত উঠাবে না।”
➥ ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) (২৩৫ হিঃ), আল মুসান্নিফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২৩৬, করাচী
(৯) عن مجاهد قال ما رائت ابن عمر يرفع يديه الا فى اوّل يفتح “হযরত মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه)কে শুধু প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতে দেখেছি।”
➥ ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) (২৩৫ হিঃ), আল মুসান্নিফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২৩৬, করাচী
(১০) عن جابر عن الاسود وعلقمة انهما كانا يرفعان ايديهما اذا افتتحا ثم لايعودان
“হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, হযরত আসওয়াদ ও আলকামা (رحمة الله) কেবল প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন। এরপর আর উঠাতেন না।”
(১১) عن الاسود قال صليت مع عمر فلم يرفع يديه فى شيئ من صلوته الاحين افتتح الصلوة “ হযরত আসওয়াদ (رحمة الله) বলেন, আমি হযরত ওমর (رضي الله عنه)’র সাথে নামায পড়েছি, তিনি নামাযের প্রারম্ভে ছাড়া হাত উঠান নি।”
➥ ইবনে আবি শায়বা (رحمة الله) (২৩৫ হিঃ), আল মুসান্নিফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২৩৬, করাচী
(১২) ইমাম আবু ইউসূফ (رحمة الله) রেওয়ায়েত করেন-حدثنا ابو حنيفة عن حماد عن ابراهيم انه قال ارفع يديك فى التكبيرة الاولى فى افتتاح الصلوة ولاترفع يديك فيما سواها-
“ হযরত ইব্রাহীম নখঈ (رحمة الله) বলেছেন, নামাযের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমায় হাত উঠাও, এ ছাড়া আর কোন স্থানে হাত উঠাবে না।”
➥ ইমাম আবু ইউসূফ (رحمة الله) (১৮২ হিঃ), কিতাবুল আসার, পৃষ্ঠাঃ ২০-২১
(১৩) عن ابن عباس ان النبى صلى الله عليه وسلم قال لاترفع الايدى الا فى سبع مواطن حين يفتتح الصلوة وحين يدخل المسجد الخ “হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নবী করিম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, শুধু সাতটি স্থানে হাত উঠানো যাবে। তম্মধ্যে প্রথমটি হল নামাযের প্রারম্ভে।” ➥ ইমাম আবু বকর হায়সামী (رحمة الله) (৮০৭ হিঃ), মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খন্ড ৩য়, পৃষ্ঠাঃ ২৩৮
সমাধান:- উল্লেখ্য যে, রুকু’র আগে ও পরে হাত উঠানোর পক্ষে ও বিপক্ষে যথেষ্ট বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে। তবে যখন দুই হাদিসের মধ্যে দ্বন্ধ হয় তখন উভয় হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা একান্ত জরুরী। সমন্বয়টি হলো এভাবে যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিশেষ কারণে হাত উঠানোর বিধান ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে হয়তো সেটিকে রহিত করা হয়েছে। যেমন প্রথমে নামাযে কথা বলা বৈধ ছিল। পরে তা রহিত হয়ে গেল।
এ বিধান রহিত হওয়ার দলীল:
-عن جابر بن سمرة قال خرج علينا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال مالى اراكم رافعى ايديكم كانها اذا ناب خيل شمس اسكنوا فى الصلوة-
“হযরত জাবির ইবনে সামুরাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) আমাদের নিকট তাশরীফ আনলেন এবং বললেন, আমার কী হলো, আমি যে তোমাদেরকে অবাধ্য ঘোড়ার লেজের ন্যায় (ঘনঘন) হাত উঠাতে দেখছি! তোমরা নামায স্থির করে আদায় কর।”
➥ ইমাম মুসলিম (رحمة الله) (২৬২ হিঃ), সহীহ মুসলিম, খন্ড ১ম, পৃষ্ঠাঃ ১৮১, করাচী
সহীহ বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য অনেক গ্রন্থে হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে হাত উঠানোর পক্ষে যে হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা রহিত হয়ে গিয়েছে। কেননা তিনি নিজেই তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত হাত উঠাতেন না। সুতরাং কোন বর্ণনাকারীর আমল যদি তাঁর রেওয়ায়েতের বিপরীত প্রমাণিত হয় তখন ঐ রেওয়ায়েত তাঁর নিকট রহিত বলে সাব্যস্ত হয়। আবার তাঁরা হাদিস বিরোধী আমল করবেন এ কথাও বলা যাবেনা।
তাছাড়া এই নীতি রয়েছে যে, যখন সহীহ হাদিস পরস্পর বিরোধী হয় তখন কিয়াসের মাধ্যমে একটি হাদিসকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিয়াসও সমর্থন করে যে, হাত না উঠানো হোক। কেননা হাত উঠালে নামাযের একাগ্রতা, ভয় ও বিনয়ের মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। অতএব, তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত হাত না উঠানো উচিত।
৯৭ – سُفْيَانُ بنُ عُيَيْنَةَ : قَالَ: اجْتَمَعَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ وَالْأَوْزَاعِيُّ فِيْ دَارِ الْـحَنَّاطِيْنَ بِمَكَّةَ، فَقَالَ الْأَوْزَاعِيُّ لِأَبِيْ حَنِيْفَةَ: مَا بَالُكُمْ لَا تَرْفَعُوْنَ أَيْدِيَكُمْ فِي الصَّلَاةِ عِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ؟ فَقَالَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ: لِأَجْلِ أَنَّهُ لَـمْ يَصِحَّ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ فِيْهِ شَيْءٌ، قَالَ: كَيْفَ لَا يَصِحُّ، وَقَدْ حَدَّثَنِي الزُّهْرِيُّ، عَنْ سَالِـمٍ، عَنْ أَبِيْهِ، عَنْ رَسُوْلِ اللهِ : أَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلَاةَ، وَعِنْدَ الرُّكُوْعِ، وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ.
فَقَالَ لَهُ أَبُوْ حَنِيْفَةَ: وَحَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ إِبْرَاهِيْمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ وَالْأَسْوَدِ، عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ: أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ لَا يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِلَّا عِنْدَ افْتِتَاحِ الصَّلَاةِ، وَلَا يَعُوْدُ شَيْءٌ مِنْ ذَلِكَ، فَقَالَ الْأَوْزَاعِيُّ: أُحَدِّثُكَ عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ سَالِـمٍ، عَنْ أَبِيْهِ، وَتَقُوْلُ: حَدَّثَنِيْ حَمَّادٌ، عَنْ إِبْرَاهِيْمَ!
فَقَالَ لَهُ أَبُوْ حَنِيْفَةَ: كَانَ حَمَّادٌ أَفْقَهَ مِنَ الزُّهْرِيِّ، وَكَانَ إِبْرَاهِيْمُ أَفْقَهُ مِنْ سَالِـمٍ، وَعَلْقَمَةُ لَيْسَ بِدُوْنِ ابْنِ عُمَرَ فِي الْفِقْهِ، وَإِنْ كَانَتْ لِابْنِ عُمَرَ صُحْبَةٌ، وَلَهُ فَضْلُ صُحْبَةٍ، فَالْأَسْوَدُ لَهُ فَضْلٌ كَثِيْرٌ، وَعَبْدُ اللهِ هُوَ عَبْدُ اللهِ، فَسَكَتَ الْأَوْزَاعِيُّ.
৯৭. অনুবাদ: হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (رحمة الله) বলেন, একদা হযরত ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ও ইমাম আওযাঈ (رحمة الله) পবিত্র মক্কায় গম বিক্রির বাজারে একত্রিত হলেন। ইমাম আওযাঈ (رحمة الله) হযরত ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) কে বললেন, তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা নামাযে রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় হাত উঠাও না? ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) বলেন, এর কারণ হলো- রাসূল (ﷺ) থেকে এ বিষয়ে কোন সহীহ হাদিস পাওয়া যায়নি। ইমাম আওযাঈ (رحمة الله) বলেন, কেন সহীহ হাদিস থাকবে না? আমার নিকট ইমাম যুহ্রী বর্ণনা করেছেন, তিনি হযরত সালিম থেকে, তিনি তাঁর পিতা (হযরত ইবনে ওমর রা.) থেকে, তিনি রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি যখন নামায শুরু করতেন এবং রুকু করতেন ও রুকু থেকে উঠতেন, তখন হাত উঠাতেন। তখন ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) তাঁকে বলেন, আমার নিকট হযরত হাম্মাদ বর্ণনা করেন, তিনি হযরত ইব্রাহীম নখঈ থেকে, তিনি হযরত আলকামা থেকে, তাঁরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূল (ﷺ) শুধু নামায আরম্ভ করার সময় হাত উঠাতেন। এছাড়া দ্বিতীয়বার হাত উঠাতেন না। তখন ইমাম আওযাঈ (رحمة الله) বলেন, আমি তোমার নিকট ইমাম যুহ্রী থেকে হাদিস বর্ণনা করছি, তিনি হযরত সালিম থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে (অর্থাৎ উর্ধ্বতন ব্যক্তিগণের হাদিস অধিক গ্রহণযোগ্য) আর তোমরা বলছ, আমার নিকট ইমাম হাম্মাদ হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইব্রাহীম থেকে, (অর্থাৎ তাঁরা পূর্বোক্তদের মত সৌভাগ্য লাভে ধন্য হননি)। তখন ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ইমাম আওযাঈ (رحمة الله)’র মতের বিরোধিতা করে বলেন, হাদিসের প্রাধান্য বর্ণনাকারীর ইলমে ফিকহের দ্বারা হয়ে থাকে, উর্ধ্বতন হওয়া বা মর্যাদার দ্বারা নয়। হাম্মাদ (رحمة الله) যুহ্রী থেকে ইলমে ফিক্হ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, ইব্রাহীম নখঈ (رحمة الله) হযরত সালিম (رحمة الله) থেকে ফিক্হ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী। আর হযরত আলকামা (رضي الله عنه) হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে ইলমে ফিক্হ সম্পর্কে কম জ্ঞানী ছিলেন না। (আদবের কারণে অধিক জ্ঞানী বলেননি)। ইবনে ওমর (رضي الله عنه) যদিও রাসূল (ﷺ) ’র সোহবত হাসিলের সৌভাগ্য অর্জন করে থাকেন, তবে হযরত আলকামা (رحمة الله) অন্য ফযীলত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। অতঃপর হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) (মর্যাদার দিক দিয়ে) হযরত আব্দুল্লাহই ছিলেন। তখন ইমাম আওযাঈ (رحمة الله) চুপ হয়ে গেলেন। (শরহে মা’আনিউল আসার, ১/১২৪/১২৪৪)
ব্যাখ্যা: ইমাম আওযাঈ (رحمة الله) ও ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র এই বির্তক কয়েকটি বিষয়ের আলোচনাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একদিকে এটা খুবই উপকারী ও ফলদায়ক। এর দ্বারা ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র জ্ঞানের গভীরতা ও উন্নত মেধাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, যার আলোকে তিনি নবী করিম (ﷺ) ’র হাদিস সমূহ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে এগুলো থেকে মাসয়ালা সমূহ বের করতেন। ফলে কোন প্রকার দুর্বল বর্ণনা তাঁর তী² দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনি। সুতরাং এই বির্তক একদিকে ইমাম সাহেবের এই গুণাবলী প্রকাশ করে, অন্যদিকে ঐ সমস্ত মিথ্যা বর্ণনাকারীর দাঁত ভাঙ্গা জবাব হয়েছে, যারা তাঁকে ব্যক্তিগণ মত পোষণকারী কিংবা যুক্তিবাদী বলে আখ্যায়িত করে বলে, তাঁর মাযহাব যুক্তি ও কিয়াসের উপর নির্ভরশীল।
বলা বাহুল্য, তিনি কি ইমাম আওযাঈ (رحمة الله)’র বিরোদ্ধে স্বীয় মত ব্যক্ত করেছেন, না রাসূল (ﷺ) ’র হাদিস পেশ করেছেন? আর ঐ হাদিস সনদের দিক দিয়ে আওযাঈ (رحمة الله)’র বর্ণিত হাদিসের মোকাবিলায় অধিক শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য ছিল, না দুর্বল? এই বির্তক বর্ণনাকারীদের মর্যাদা ইলমে ফিক্হের জ্ঞানের উপর নির্ভর করে, উচুঁ মানের সনদ বা ন্যায়-নিষ্ঠার উপর করেনা। এই বির্তকের মাধ্যমে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, ইলমে ফিক্হের জ্ঞান ও অন্যান্য জ্ঞানের গভীরতা সোহবত লাভের ফযীলত থেকে উত্তম। তবে শর্ত হলো- উভয়ই নবী (ﷺ)’র সোহবত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে হবে। তাই তিনি বলেছেন হযরত আলকামা (رحمة الله) হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে কোন অংশে কম নন। মোটকথা এর দ্বারা ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র আদব ও হাদিসের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
98 – أَبُوْ حَنِيْفَةَ: عَنْ طَرِيْفٍ أَبِيْ سُفْيَانَ، عَنْ أَبِيْ نَضْرَةَ، عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْـخُدْرِيِّ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهَ قَالَ: «الْوُضُوْءُ مِفْتَاحُ الصَّلَاةِ، وَالتَّكْبِيْرُ تَحْرِيْمُهَا، وَالتَّسْلِيْمُ تَحْلِيْلُهَا، وَفِيْ كُلِّ رَكْعَتَيْنِ، فَسَلِّمْ وَلَا تُجْزِيْ صَلَاةٌ إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، وَمَعَهَا غَيْرُهَا».
وَفِيْ رِوَايَةٍ أُخْرَىٰ: عَنِ الْـمُقْرِيْ، عَنْ أَبِيْ حَنِيْفَةَ مِثْلُهُ، وَزَادَ فِيْ آخِرِهِ: قُلْتُ لِأَبِيْ حَنِيْفَةَ: مَا يَعْنِيْ بِقَوْلِهِ: «فِيْ كُلِّ رَكْعَتَيْنِ فَسَلِّمْ»؟ قَالَ: يَعْنِيْ: التَّشَهُّدَ، قَالَ الْـمُقْرِيْ: صَدَقَ.
وَفِيْ رِوَايَةٍ: نَحْوُهُ، وَزَادَ فِيْ آخِرِهِ: «وَلَا يُجْزِيْ صَلَاةٌ إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، وَمَعَهَا شَيْءٌ».
৯৮. অনুবাদ: ইমাম আবু হানিফা ত্বারীফ আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি আবি নাদ্বরাহ থেকে, তিনি হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, উযূ হলো নামাযের চাবি, তাকবীর হলো এর তাহরীমা (যাবতীয় দুনিয়াবী কাজকে হারাম করে দেয়), সালাম হলো তাহলীল তথা হালালকারী। প্রতি দু’রাকাতে সালাম ফিরাও অর্থাৎ তাশাহহুদ পাঠ কর এবং কোন নামায সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা মিলানো ব্যতীত পূর্ণ হয়না।
অন্য এক রেওয়ায়েতে মুকরী ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে একই ধরনের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এতে এতটুকু বেশী আছে যে, আমি আবু হানিফা (رحمة الله) কে জিজ্ঞাসা করি, প্রতি দু’রাকাতে সালাম ফিরার অর্থ কি? তিনি বলেন, এর অর্থ হলো তাশাহহুদ পড়া। তখন মুকরী বলেন- সঠিক বলেছেন।
অন্য এক রেওয়ায়েতের শেষ দিকে এতটুকু অধিক রয়েছে যে, কোন নামায ফাতিহাতুল কিতাব তথা আলহামদু এবং এর সাথে কোন সূরা মিলানো ব্যতীত নামায পূর্ণ হয়না। (সুনানে বায়হাকী কুবরা, ২/৩৮০/৩৭৮৭)
ব্যাখ্যা: الْوُضُوْءُ مِفْتَاحُ الصَّلَاةِ “উযূ নামাযের চাবি।” এর দ্বারা অতি সূ²ভাবে একটি মাসয়ালার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, উযূর মধ্যে নিয়্যত ওয়াজিব নয়, বরং সুন্নত। কেননা, উযূ ইবাদতে গাইরে মাকসূদা। এরূপ ইবাদতে নিয়্যত ফরয-ওয়াজিব হয়না। তাছাড়া উযূ ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়, বরং ইবাদতের বাহন হিসেবে গণ্য হয়েছে। আর ইবাদত সহীহ হওয়ার জন্য নিয়্যত শর্ত। কেননা নিয়ত ব্যতীত ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায় না।
وَالتَّكْبِيْرُ تَحْرِيْمُهَا:-
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله)’র মতে ঐ সমস্ত কাজ দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা জায়েয হবে যা আল্লাহর মর্যাদা ও মহত্ব প্রকাশ করে থাকে। তিনি অর্থের দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন, তাকবীর অভিধানে তা’যীমের অর্থে ব্যবহার হয়। সুতরাং যে বাক্য দ্বারা তা’যীম প্রকাশ পাবে, এরদ্বারা তাকবীরে তাহরীমা বলা জায়েয হবে। তাই الله اعظم ، الله اجل ، الله اكبر ইত্যাদি বাক্য দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা বলা জায়েয হবে।
وَالتَّسْلِيْمُ تَحْلِيْلُهَا :- “সালাম নামাযের জন্য তাহলীল।” অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমার সাথে সাথে দুনিয়াবী যেসব কাজ হারাম হয়েছিল সালামের দ্বারা তা পূর্ণ জায়েয বা হালাল হয়ে যায়।
ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমদ (رحمة الله) সালাম ফিরানোকে ফরয বলেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ওয়াজিব বলেছেন। হযরত আলী, হযরত ইবনে মুসাইয়্যেব, হযরত ইব্রাহীম নখঈ, ইমাম সুফিয়ান সওরী এবং ইমাম আওযাঈ (رحمة الله)’র মাযহাব এটাই ছিল।
وَفِيْ كُلِّ رَكْعَتَيْنِ، فَسَلِّمْ :- “প্রতি দু’রাকাতে সালাম ফিরাও” এই বাক্যটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। এক. এটি বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত হলে অর্থ হবে প্রতি দু’রাকাত নফল নামাযে সালাম ফিরাও। তখন এটা নুদুব (ندب) হিসাবে গণ্য হবে। ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله) বলেন, হাদিস الصلوة مثنى مثنى অনুযায়ী নফল নামায দু’-দু’ রাকাত করে পড়া উচিত। দুই. فَسَلِّمْ দ্বারা প্রকৃত সালাম উদ্দেশ্য নয় বরং এর দ্বারা তাশাহহুদ বুঝানো হয়েছে। যেমন এই হাদিসের দ্বারা তা-ই বুঝা যাচ্ছে।
99 – أَبُوْ حَنِيْفَةَ: عَنْ عَطَاءِ بْنِ أَبِيْ رَبَاحٍ، عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ: نَادَىٰ مُنَادِي رَسُوْلِ اللهِ بِالْـمَدِيْنَةِ: «لَا صَلَاةَ إِلَّا بِقِرَاءَةٍ وَلَوْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ».
৯৯. অনুবাদ: ইমাম আবু হানিফা আতা ইবনে আবি রাবাহা থেকে, তিনি হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ’র পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি মদীনায় এই ঘোষণা প্রচার করে যে, কোন সূরা পাঠ করা ব্যতীত কোন নামায সহীহ হবে না। যদিও পঠিত সূরা ফাতিহাতুল কিতাব তথা সূরা ফাতিহা হোকনা কেন। (জামেউল আহাদীস, ১৬/৪১০/১৭১৩০)
ব্যাখ্যা: নামাযে সূরা ফাতিহা ও এর সাথে সূরা মিলানো নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফেঈ ও ইমাম মালিক (رحمة الله)’র মতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয আর এর সাথে সূরা মিলানো সুন্নত। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র মতে উভয়টি ওয়াজিব। তবে নামাযে কিরাত ফরয। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) নামাযে কিরাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কয়েকটি দলীল পেশ করেন। প্রথম দলীল:- পবিত্র কুরআনের আয়াত- فاقرؤا ما تيسرمن القران ‘পবিত্র কুরআন থেকে যতটুকু সহজ বা সম্ভব তিলাওয়াত কর।” (সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত, ২০) এখানে কুরআনের আয়াত কে নিদিষ্ট করা হয়নি তবে কমপক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ আয়াত এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং খবরে ওয়াহিদ দ্বারা কিতাবুল্লাহর عام কে কীভাবে ভঙ্গ করা হবে? তাই ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) পবিত্র কুরআন মতে কিরাত ফরয আর হাদিস মতে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব বলেছেন। ফলে কুরআন ও হাদিস উভয়ের উপর আমল হয়ে যায়।
দ্বিতীয় দলীল হিসেবে তিনি ঐ হাদিস পেশ করেন, যাতে রাসূল (ﷺ) একজন গ্রাম্য ব্যক্তিকে সমস্ত আহকামের সাথে নামাযের তালীম দিয়েছেন কিন্তু এতে সূরা ফাতিহার উল্লেখ নেই। যদি সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয হতো, তাহলে এটা ত্যাগ করা কীভাবে সম্ভব হলো? তবে এতটুকু বলা হয়েছে ثم اقرأ تيسر معك من القران “অতঃপর যতটুকু সম্ভব পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত কর।”
তৃতীয় দলীল হিসেবে তিনি হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস পেশ করেন, যাতে বলা হয়েছে যে, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায পড়লে خداج তথা নাকিস হবে। خداج অর্থ অসম্পূর্ণ। হাদিসে غير تام বলে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সূরা ফাতিহা ফরয হলে নাকিস নয় বরং ফাসিদ হয়ে যেতো। আর ওয়াজিব ত্যাগ করলে নাকিস হয়। সুতরাং নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব।
চতুর্থ দলীল হলো- বর্ণিত হাদিস। এতে বলা হয়েছে ولو بفاتحة الكتاب “যদিও কেবল সূরা ফাতিহা হয়” এতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এখানে ফাতিহার তিলাওয়াতকে নির্দিষ্ট করা হয়নি। অর্থাৎ কুরআনের যে কোন অংশ হোক আর যদি তা সূরা ফাতিহা হোক না কেন।
পঞ্চম দলীল হলো- لاصلوة বলে মূল নামায না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি বরং নফীয়ে কামাল (نفى كمال) এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেভাবে বলা হয়েছে لاوضوء لمن لم يسم الله “বিসমিল্লাহ ছাড়া উযূ পরিপূর্ণ হবেনা।”