হজরত হাফসা বিনতে ওমর ফারূক রাদ্বিয়ালাহু আনহা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

জীবন কখনো গলাধঃকরণ করে দুখের গরল, আবার কখনো শরীরে মাখে
সুখের সুরভি। দিবস-বিভাবরী যেমন একে একে পার হয়ে যায়, তেমনি জীবনের
জলে ভেসে চলে অশ্রু ও আনন্দ। আর জীবন মানে ভোগ ও ত্যাগের বিস্ময়কর
এক সমন্বয়ন। বিস্ময় ও রহস্যময়তার সংজ্ঞা মানুষে মানুষে আনে ভিন্ন ভিন্ন
ব্যঞ্জনা। তাই সকল মানুষ থেকে মহাপুরুষগণ হয়ে যান পৃথক ভাবনা-বেদনা-
চেতনার প্রভিভূ। তাঁদের ভোগও ত্যাগের মতো মহিমময়, পবিত্র।

সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল যিনি, তিনি তো মহাবিশ্বের মহাপ্রভুপালকের
প্রিয়তমজন— হাবীব। আলাহ্ পাকই তাঁকে সাজিয়েছেন সকল স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য
দিয়ে। দিয়েছেন নারী, পবিত্র সহধর্মিণী। ধর্ম-কর্ম-মর্ম সব কিছুতেই তাঁরা নবী
জীবনের শান্তি, সান্ত্বনা এবং অনুপ্রেরণা।

একে একে তাঁরা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনে এসেছেন পবিত্র উপহার হিসেবে।
প্রথমে হজরত খাদিজা তাহেরা। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে তিনি পালন করেছেন
পবিত্র সহধর্মিণীর দায়িত্ব। তারপর হজরত সওদা ও হজরত আয়েশা। তারপর
হজরত হাফসা।

হেরাপর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় যখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হন,
তার পাঁচ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মক্কার কুরায়েশেরা তখন ব্যস্ত ছিলো
কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণকর্মে। পিতৃগৃহে বেড়ে ওঠা হজরত হাফসা পিতৃগৃহেই পিতামাতা
ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন।

তিনিও কুরায়েশ কুলোদ্ভবা। তাঁর মাতাও ছিলেন নিষ্ঠাবতী মহিলা
সাহাবী। নাম যয়নব বিনতে মাযউন। আর মামা হজরত ওসমান ইবনে মাযউন
(রাঃ)। তিনিও ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী। আর ছয় বছরের ছোট ভাই আবদুলাহ্
ইবনে ওমর মুহাদ্দিস ও ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী সাহাবী হিসেবে ইতিহাসে
অক্ষয় হয়ে আছেন।

হজরত হাফসা যুবতী হলেন। পিতা-মাতা তাঁকে পাত্রস্থ করতে মনস্থ
করলেন। ভাবনা-আলোচনার পর তাঁকে বিবাহ দিলেন বনী সাহাম গোত্রের
খুনাইস ইবনে হুজাফার সঙ্গে। হজরত খুনাইসও ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয়
সাহাবী।

ছয় বছর ধরে ইসলাম প্রচার করে চলেছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। এই ছয় বছরে
অল্প কিছুসংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করলো। প্রতাপশালী কুরায়েশ গোত্রপতিরা
ছিলো ঘোর বিরোধী ও অত্যাচারপ্রবণ। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার করতে
পারছিলেন না। এমন সময় হজরত ওমর সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর
ইসলাম গ্রহণের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। প্রচারকর্ম চলতে থাকে প্রকাশ্যে। কিন্তু
গোত্রপতিরা বিরোধিতা করতে থাকে আগের চেয়ে তীব্রভাবে। অবস্থার উন্নতি তো
হয়ই না, বরং অবনতি হতে থাকে আরো।

কাফের কুরায়েশদের হাত থেকে বাঁচাতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে
আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দেন। দুই বার দুই দল সাহাবী এ নির্দেশ পালন
করেন। হজরত খুনাইস সস্ত্রীক হিজরত করেন দ্বিতীয় দলের সঙ্গে।
যাঁরা মক্কায় বসবাস করতে থাকেন, তাঁরা হতে থাকেন আরো বেশী
অত্যাচারিত। তাঁরাও হিজরত করতে বাধ্য হন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও হিজরত করে চলে
যান মদীনায়। প্রধান সাহাবীগণও অনুগমন করেন তাঁর। আবিসিনিয়ায়
হিজরতকারীদের কেউ কেউ মক্কায় ফিরে এসেছিলেন। হজরত হাফসা ও
হজরত খুনাইসও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। মক্কাবাস তাঁদের জন্য স্বস্তিকর ছিলো
না। তাই তাঁরা পুনরায় হিজরত করেন। গ্রহণ করেন মদীনার আনসারগণের উষ্ণ
আতিথ্য ও ভালোবাসা।

মদীনা মনোয়ারায় মুসলমানগণ কাফের-মুশরিকদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ অত্যাচার
থেকে মুক্তিলাভ করলেন। ধীরে ধীরে তাঁদের সংখ্যা বেড়ে চললো। শক্তিবৃদ্ধি হতে
লাগলো তাঁদের। এভাবে গত হয়ে গেলো একটি বছর। ইসলামের প্র ম যুদ্ধ
অনুষ্ঠিত হলো বদরে। মুসলমানেরা পেলেন প্র ম বিজয়। কাফেরদের প্রধান
নেতারা নিহত হলো। শহীদ হলেন অল্পকিছু সংখ্যক সাহাবীও। হজরত খুনাইস
আহত হলেন মারাত্মকভাবে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মদীনায় ফিরে আসতে সমর্থ হলেন
বটে, কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠতে পারলেন না। কয়েকদিন পরে পান করলেন
শাহাদতের পেয়ালা।

বদরযোদ্ধাদের ফযীলত অনেক। এক বর্ণনায় এসেছে, একবার হজরত
জিব্রাইল রসুলুলাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের
সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তারা অন্য মুসলমানের চেয়ে
উত্তম। অন্য এক বিবরণে এসেছে, যারা বদর ও হুনাইনে অংশগ্রহণ করেছে, তারা
কখনোই দোজখে প্রবেশ করবে না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বললেন, আলাহ্
আহলে বদর সম্পর্কে জানিয়েছেন, তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো— আমি তোমাদেরকে
ক্ষমা করে দিলাম।

হজরত ওমর তাঁর একান্ত আদরের কন্যা হাফসার পুনঃবিবাহ সম্পর্কে
ভাবতে লাগলেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুগণকে অধিকতর ঘনিষ্ঠ করবার ইচ্ছা হলো তাঁর।
নবীদুলালী হজরত রুকাইয়া কয়েকদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বিপত্নীক
স্বামী হজরত ওসমান বিমর্ষ ও শোকাচ্ছন্ন। প্রথমে তাঁর কথাই মনে হলো। তিনি
তাঁর কাছেই বিবাহের কথাটা পাড়লেন। হজরত ওসমান বললেন, ভেবে দেখি।
হজরত ওমর কয়েকদিন পর আবার কথাটা তুললেন। এবার হজরত ওসমান স্পষ্ট
করেই জানিয়ে দিলেন, এখন বিবাহ করার ইচ্ছা তাঁর নেই।

বিফল মনোরথ অবস্থায় আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। হজরত ওমর এবার
প্রস্তাব উত্থাপন করলেন হজরত আবু বকরের কাছে। তিনি কিছুই বললেন না।
তাঁর মৌনতার আঘাতে হজরত ওমর দুঃখ পেলেন আগের চেয়ে বেশী।
কয়েকদিন পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহান সানিড়বধ্যে উপস্থিত হয়ে তাঁর দুঃখের
কথা খুলে বললেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ওমর! আমি কি তোমাকে ওসমানের চেয়ে ভালো জামাতা এবং ওসমানকে তোমার চেয়ে ভালো শশুরের সন্ধান দিবো না?
হজরত ওমর বললেন, হে আল্লাহর প্রত্যাদেশপ্রচারক! অবশ্যই দান করুন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হাফসাকে আমার সাথে বিবাহ দাও। আর আমি আমার
মেয়ে উম্মে কুলসুমকে বিয়ে দেই ওসমানের সঙ্গে। হজরত ওমর মহাআনন্দিত
হলেন। নিজেই ওলী হলেন। হজরত হাফসার সঙ্গে রসুলুলাহর শুভবিবাহ সম্পন্ন
হলো তৃতীয় হিজরীর শওয়াল মাসে। মোহরানা নির্ধারণ করা হলো চার শত
দিরহাম।

শুভবিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর হজরত আবু বকর হজরত ওমরকে একান্তে
ডেকে নিয়ে বললেন, তুমি তো দুঃখ পেয়েছিলে খুব। আল্লাহর রসুল একদিন
হাফসার কথা উঠিয়েছিলেন। তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
হাফসাকে ঘরণী করতে চান। আমি তাঁর গোপন ইচ্ছাকে প্রকাশ করতে চাইনি।
তাই নীরব ছিলাম।

সংসারজীবনে প্রবেশ করলেন হজরত হাফসা (রাঃ)। তাঁর বয়স তখন বিশ
বছর। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, এ সংসার অন্যের সংসারের মতো নয়।
এ হচ্ছে আল্লাহর হাবীব, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের সংসার, যিনি বলেছেন,
পৃথিবীর সঙ্গে আমার কী বা সম্পর্ক— সম্পর্ক তো শুধু এতোটুকু, যেমন কোনো
পথিক বৃক্ষচ্ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণ করলো, তারপর সে আশ্রয়স্থল ছেড়ে চলে গেলো।
যিনি প্রার্থনা করেন, হে আমার আলাহ্! আমি তোমার কাছে তোমার ভালোবাসা,
তোমাকে যে ভালোবাসে তার ভালোবাসা এবং এমন আমল যাচ্ঞা করি, যা
আমাকে তোমার ভালোবাসায় পৌঁছে দেয়।

হজরত হাফসা আলাহ্ ও আল্লাহর রসুলের ভালোবাসায় নিজেকে
পরিপূর্ণরূপে সমর্পণ করেন। প্রায়শই রোজা রাখেন। রাত জেগে জেগে নামাজ
পড়েন। তাঁর রূপ ও গুণের কারণে, ইবাদতপ্রিয়তার কারণে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে
গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন। হজরত হাফসা পিতার মতোই তীক্ষ্ণ ও উষ্ণ
স্বভাবসম্পন্ন, আবার পিতার মতোই অন্তরে ধারণ করেন আলাহ্
ও রসুলের প্রতি অক্ষয় বিশ্বাস এবং অফুরন্ত ভালোবাসা। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীতে কথা কাটাকাটি
হয়। কিন্তু কখনোই তা মনোমালিন্য পর্যন্ত গড়ায় না।

একদিন হজরত ওমর (রাঃ) তাঁর নিজের বাড়ীতে কী এক বিষয় নিয়ে
গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, কী ভাবছো এতো? হজরত ওমর
(রাঃ) বললেন, তোমাকে অতো ভাবতে হবে না। স্ত্রী বললেন, আমার কথা ভালো
লাগছেনা, না? হাফসাকে গিয়ে দেখো, রসুলুলাহর সঙ্গে সে কেমন কথা কাটাকাটি
করে। হজরত ওমর তক্ষুণি গিয়ে উপস্থিত হলেন হজরত হাফসার ঘরে। জিজ্ঞেস
করলেন, তুমি নাকি রসুলুলাহর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করো? তিনি জবাব দিলেন,
ওরকম তো কখনো কখনো হয়েই যায়। হজরত ওমর বললেন, সাবধান! আর
কখনো কোরো না। আর একথাও কখনো ভেবো না যে, রসুলুলাহ্
তোমার রূপমুগ্ধ। সর্বাবস্থায় মেনে নিয়ো তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টিকে।

আর একদিন তো নিজের চোখেই দেখলেন, তাঁর আদরের কন্যা রসুলুলাহর
সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছে। তিনি রেগে গেলেন। কন্যাকে প্রহার করতে উদ্যত
হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুজনের মাঝখানে দাঁড়ালেন। হজরত ওমর লজ্জিত হলেন
বটে, কিন্তু মেয়েকে শাসালেন এবং একথা বলে দিলেন যে, খবরদার! রসুলুলাহর
কথার পিঠে এভাবে কথা বলবে না। তুমি কি যয়নাবের মতো সুন্দর, না আয়েশার
মতো ভাগ্যবতী?

হজরত ওমর চলে গেলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হাফসা! দেখলে তো,
তোমাকে কীভাবে রক্ষা করলাম।

জ্ঞানচর্চা ছিলো তাঁর প্রিয় একটি বিষয়। তাঁর অন্বেষণপ্রবণ মন কোনো বিষয়
সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ না করা পর্যন্ত শান্ত হতো না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কোনো
বক্তব্য বুঝতে না পারলে তিনি প্রশড়ব করতেন। প্রশেড়বর পর প্রশড়ব করে দ্বিধা-সন্দেহের
অবসান ঘটাতেন। যেমন একবার মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আশাকরি বদর ও
হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণকারীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। হজরত হাফসা
বললেন, তা কেনো হবে। আল্লাহ তো বলেছেন, ‘তোমাদের সবাইকে জাহান্নামে
হাজির করা হবে’। (সুরা র্মাইয়ম, আয়াত ৭১)।

 মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কথাটা ঠিকই। কিন্তু একথাও তো আলাহ্পাক বলেছেন ‘অতঃপর আমি আল্লাহ ভীরুদেরকে নাজাত দান করবো এবং জালেমদেরকে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে উপুড় করে পড়ে থাকা অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।’

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর লেখাপড়া শেখার প্রতি অতি আগ্রহ দেখে তাঁর লেখাপড়ার
সুযোগ করে দেন। লেখাপড়া শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত করেন শিফা বিনতে
আবদুলাহ্ নাম্নী এক সাহাবীয়াকে। তিনি এক প্রকারের ক্ষতরোগ নিরাময়ের মন্ত্র
জানতেন। একদিন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে বললেন, তুমি কি নিরাময়মন্ত্রটি হাফসাকে
শেখাবে না, যেমন তাকে শিক্ষা দিয়েছো লেখা?

জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকার মতোই। তিনি তাঁর
স্বামী মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর পিতা হজরত ওমর ফারুক থেকে শুনে ৬০টি হাদিস
বর্ণনা করেছেন। যাঁরা তাঁর কাছ থেকে হাদিস শুনে প্রচার করেছেন, তাঁদের
সংখ্যা অনেক। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন আবদুলাহ্
ইবনে ওমর (রাঃ) হামযা ইবনে আবদুলাহ্, সাফিয়া বিনতে উবায়দা, মুত্তালিব ইবনে
আবী ওয়াদায়া, উম্মে মুবাশ্শির আল আনসারিয়া, আবদুর রহমান ইবনে হারেস
ইবনে হিশাম, আবদুলাহ্ ইবনে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, শুতাইর ইবনে শাকাল,
মাওয়া আল খুযায়ী, আল মুসাইয়্যেব ইবনে রাফে, আল মাযলায প্রমুখ।

সপত্নীগণের মধ্যে বেশী ভালোবাসতেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকাকে।
দুজনের সম্পর্ক ছিলো সখী-সহচরীর মতো, বোনের মতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে
তাঁরা এক জোট হতেন। হজরত আয়েশা মন্তব্য করেছেন, হাফসা বাপের বেটি।
তার বাপ যেমন প্রতিটি কথায় দৃঢ়সংকল্প, সে-ও তেমনি। আরো বলেছেন,
রসুলুলাহর সহধর্মিণীদের মধ্যে একমাত্র হাফসাই আমার সমকক্ষতার দাবীদার।
সম্ভবত একথাটি তাঁরা ভুলতেন না যে, তাঁদের সম্মানিত পিতৃদ্বয় আল্লাহর
রসুলের সবচেয়ে প্রিয় সহচর ও বন্ধু। তবে তাঁদের পরস্পরের ভালোবাসার স্বচ্ছ
নীল আকাশে ক্বচিৎ কখনো দেখা দিতো নারীসুলভ হিংসা-দ্বেষের ধুসর মেঘ।
আবার তা কেটেও যেতো তাঁদের অমলিন অন্তঃকরণের কারণে।

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনো কখনো তাঁদের দুজনকে তাঁর সফরসঙ্গিনী করতেন।
একবার তো দুজনে উটের হাওদাজ বদল করে জয়-পরাজয়ের খেলায়
মেতেছিলেন। হজরত হাফসা কৌশল করে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে এক মঞ্জিল পথ পর্যন্ত
কাছে পেয়েছিলেন। আর হজরত আয়েশা ঘাসের জঙ্গলে পা প্রবেশ করিয়ে
বলেছিলেন, হে আলাহ্! বিষাক্ত বিচ্ছু, অথবা সাপ পাঠিয়ে দাও, আমাকে দংশন করুক।

তাহরীমের ঘটনাটিও তাঁরা ঘটিয়েছিলেন একজোট হয়ে-  হজরত সওদা ও
হজরত সাফিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। ইতোপূর্বে এ ঘটনার কথা উল্লেখ
করা হয়েছে। এখানে দেওয়া হলো আরেকটি বর্ণনান্তর।

মধু ও মিষ্টি ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয় আহার্য। তাঁর পবিত্র স্বভাব ছিলো,
আসরের পর পত্নীদের প্রকোষ্ঠে কিছুক্ষণ করে সময় কাটানো। আর সময়দানের
ক্ষেত্রেও তিনি মোটামুটি সমতা রক্ষা করেই চলতেন। একদিন ঘটলো কিছু
ব্যতিক্রম। তিনি হজরত যয়নবের কক্ষে একটু বেশী সময় অবস্থান করলেন।
হজরত আয়েশা বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিলেন না। ঈর্ষান্বিত হলেন।
বিলম্বের কারণ জানতে চেষ্টা করলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, কোনো এক
মহিলা হাদিয়া হিসেবে তাঁর কাছে কিছু মধু পাঠিয়েছে। ওই মধুই যয়নাব পান
করতে দিয়েছেন। আর প্রিয় আহার্য পেয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে একটু বেশী সময়
কাটিয়েছেন। পরদিন ঘটলো একই ঘটনা। তার পরদিনও। হজরত আয়েশা ঠিক
করলেন, এর একটা বিহিত তিনি করবেনই। হজরত হাফসাকে ডেকে বললেন,
যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার কাছে আসবেন, তখন বোলো, আপনার মুখে তো
মাগ্ফিরের গন্ধ।

পরদিন পরিকল্পনা মাফিক কাজ করা হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাগ্ফীরের গন্ধ
খুবই অপছন্দ করতেন। তাঁর মনে হলো, তিনি মাগ্ফীরের ফুলের মধুই পান
করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মন্তব্য করলেন, এখন থেকে মধুপান আমার জন্য হারাম।

হজরত আয়েশা এবং হজরত হাফসা বুঝতে পারলেন, কাজটা ভালো হলো না।
ওহীও অবতীর্ণ হলো। বলা হলো, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের মনোতুষ্টির
জন্য আলাহ্ যা হালাল করেছেন, তা কেনো হারাম করে দিলেন।’

মধুপান নিজের জন্য হারাম করার কথাটি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত হাফসাকে গোপন
রাখতে বলেন, যাতে হজরত যয়নাব মনে কষ্ট না পান। কিন্তু হজরত হাফসা
নির্দেশটি মান্য করতে পারেননি। অতি-অন্তরঙ্গতার বশীভূত হয়ে কথাটি তিনি
হজরত আয়েশাকে জানান। তখন অবতীর্ণ হয়— ‘স্মরণ করো— নবী তাঁর স্ত্রীদের
একজনকে গোপনে একটি কথা বলেছিলো। অতঃপর যখন সে তা অন্যদেরকে
বলে দিয়েছিলো, এবং আলাহ্ নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তখন নবী এই
বিষয়ে কিছু ব্যক্ত করলো এবং কিছু অব্যক্ত রাখলো। যখন নবী তা তার সেই
স্ত্রীকে জানালো, তখন সে বললো, ‘কে আপনাকে এটা অবহিত করলো? নবী
বললো, আমাকে অবহিত করেছেন তিনি, যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক অবগত।’

আরো অবতীর্ণ হলো— ‘যদি তোমরা উভয়ে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে
প্রত্যাবর্তন করো তবে ভালো, কারণ তোমাদের হৃদয় তো ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু
তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরের পোষকতা করো তবে জেনে রাখো,
আলাহ্ই তার বন্ধু এবং জিব্রাইল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণও, তা ছাড়া
অন্যান্য ফেরেশতাও তার সাহায্যকারী’।

এখানে ‘যদি তোমরা উভয়ে’ বলে বোঝানো হয়েছে হজরত আয়েশা এবং
হজরত হাফসাকে। বলা হয়, এই ঘটনার পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত হাফসাকে
সতর্ক তালাক (এক তালাক) দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তালাক ফিরিয়েও নিয়েছিলেন
অল্পক্ষণের মধ্যে। কারণ তখনই হজরত জিব্রাইল আবির্ভূত হয়ে বলেছিলেন,
ভ্রাতঃ মোহাম্মদ! এরকম করবেন না। হাফসা অত্যধিক রোজা পালন করেন।

আর রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করেন। জান্নাতেও তিনি আপনার স্ত্রী হবেন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিলো হজরত হাফসার দাম্পত্য জীবনে।

তবে ওই ঘটনায়, তিনি একা নন, জড়িত ছিলেন সকল মুমিনজননী। তাঁরা সকলে
এক জোট হয়ে রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকাশে অধিকতর উন্নত জীবিকা এবং কিছু বিলাস সামগ্রীর দাবি উত্থাপন করেছিলেন। আর রসুলুলাহ্ পণ করেছিলেন, একমাস
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্ত্রীসঙ্গ থেকে পৃথক থাকবেন। তাই করলেন। পৃথক একটি প্রকোষ্ঠে
একা বসবাস করতে লাগলেন। মুনাফিকেরা রটিয়ে দিলো, রসুলুলাহ্
তাঁর সকল স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। এ সম্পর্কে হজরত ওমর নিজে বলেছেন, একবার
রসুলুলাহ্ তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন। লোকমুখে প্রচারিত হলো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
তাঁর সকল স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। আমি হাফসাকে বললাম, শুনলাম, রসুলুলাহ্
তোমার উপর অসন্তুতুষ্ট। আমি না থাকলে তিনি অবশ্যই তোমাকে তালাক দিতেন।
একথা শুনে হাফসা খুব কাঁদলো। রসুলুলাহ্ পাশের ঘরেই ছিলেন। আমি সেখানে
উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আপনার অনুমতি পেলে আমি হাফসার
কলা কেটে আনবো। রসুলুলাহ্ ইশারায় আমাকে শান্ত হতে বললেন। আমি
জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর হাবীব! আপনি কি আপনার পত্নীদেরকে তালাক
দান করেছেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না। একথা শুনেই আমি মসজিদে উপস্থিত
হলাম। লোকদের ভ্রান্তি নিরসনার্থে উচ্চকন্ঠে বললাম, না। আল্লাহর রসুল তাঁর স্ত্রীদেরকে তালাক দেননি।

এই ঘটনার পর আলাহ্তায়ালা রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পত্নীদেরকে এমতো
অধিকার দিয়েছিলেন যে, তাঁরা ইচ্ছা করলে রসুলুলাহর সংসারে থাকতেও পারেন,
চলেও যেতে পারেন। বলাবাহুল্য, আল্লাহর রসুলকে ছেড়ে হজরত হাফসা চলে
যাননি। চলে যাননি অন্যান্য মুমিনজননীগণও।

হজরত হাফসা সপত্নীদের সঙ্গেও সদ্ভাব বজায় রেখে চলতেন। তাঁর
স্বভাবসুলভ উষ্ণতার কারণে কখনো এর ব্যতিক্রমও ঘটতো। কিন্তু সার্বিক অবস্থা
ছিলো প্রীতিময়, সন্ধি-সুন্দর।

একবার রসুলুলাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মুল মুমিনিন হজরত সাফিয়ার ঘরে প্রবেশ করে
দেখলেন, তিনি কাঁদছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কাঁদছো কেনো? হজরত সাফিয়া
বললেন, হাফসা আমাকে ‘ইহুদীর মেয়ে’ বলেছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তক্ষুণি হজরত
হাফসাকে ডেকে এনে বললেন, হাফসা! আলাহ্কে ভয় করো। আর জননী
সাফিয়াকে বললেন, তুমি নবী হারুনের বংশধর। সে সম্পর্কে তিনি তোমার পূর্ব
পিতা! আর নবী মুসা তোমার পূর্ব পিতৃব্য। আর তুমি নবীর স্ত্রী। হাফসা তোমার
চেয়ে কোন দিক থেকে শ্রেষ্ঠ, বলো তো।

জীবন এগিয়ে চলে। দিকে দিকে ঘোষিত হতে থাকে ইসলামের বিজয়
বারতা। আলোকিত হয় আরবভূমি। আলোকিত হতে থাকে আজম-পৃথিবীর
বিভিন্ন ভূখণ্ড। আল্লাহর রসুলের কাজ শেষ হয়। প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয় ‘আজ
তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম’। ডাক আসে মহাপ্রভুপালকের একান্ত
সনিড়বধানের। নিসর্গে নেমে আসে বিদায়ের বিষণড়বতা। মহামমতার অপার পারাবার,
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল মিলিত হন পরম প্রেমময় প্রভুর সঙ্গে। তাঁর শোকাতুরা
সঙ্গিনীগণ অপেক্ষায় থাকেন। গ্রহণ করেন অধিকতর উপাসনাপ্রবণ জীবনকে।
পালন করে চলেন ধর্মপ্রচারের ঐকান্তিক দায়িত্ব।

খলিফা হলেন হজরত আবু বকর। সুকঠিন সতর্কতার সঙ্গে পালন করে
চললেন নতুন ধর্মরাষ্ট্রের শাসনদায়িত্ব। কিন্তু রসুলবিরহের আগুন কখনো স্তিমিত
হয় না। বরং দিন দিন প্রজ্বলতর হতে থাকে। পৃথিবীতে বেশীদিন বাস করা তাঁর
জন্য হয়ে পড়ে অসম্ভব। আলাহ্পাক দয়া করেন। দুই বছর তিন মাস এগারো
দিন পর অবসান ঘটান তাঁর বিরহযন্ত্রণার।

হজরত হাফসার পিতা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব হন পরবর্তী খলিফা। তিনি
কখনো কখনো জনঅনুরোধে খলিফার দরবারে উপস্থিত হন। তুলে ধরেন বিভিন্ন
দাবি-দাওয়া। হজরত ওমর প্রিয়কন্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু
কখনো তাঁর পরামর্শ মেনে নেন। কখনো নেন না।

একবার হজরত ওসমান, হজরত আলী, হজরত তালহা এবং হজরত
যোবায়ের এই মর্মে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন যে, খলিফার জন্য
নির্ধারিত ভাতা নিতান্তই অপ্রতুল। সুতরাং ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
তাঁরা বিষয়টি খলিফার দরবারে উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সাহস
পেলেন না। শেষে জননী হাফসার দ্বারস্থ হলেন। তিনি সুযোগ বুঝে কথাটা
খলিফাকে বললেন। খলিফা বললেন, মা। তুমি মনে হয় আল্লাহর রসুলের অভাব-
অনটন ভরা জীবনের কথা ভুলে গিয়েছো। আল্লাহর শপথ! আমি তো তাঁকেই
অনুসরণ করবো, যেনো পরবর্তী পৃথিবীতে শান্তি লাভ করতে পারি। একথা বলে
তিনি কাঁদলেন। কাঁদলেন জননী হাফসাও।

আরব, ইরান ও রোমের অধিপতি খলিফাতুল মুসলিমীন হজরত ওমর
দুনিয়ার প্রতি ছিলেন অতিমাত্রায় অনাসক্ত। মূল্যবান ও মিহি বস্ত্র তাঁর পরনে দেখা
যেতোই না। ১০/১২টা করে তালি থাকতো জামায়। পাগড়িটি ছিলো ছেঁড়া।
পায়ের জুতা ছেঁড়া ও তালিযুক্ত। এরকম বেশভূষা নিয়ে তিনি রাজকীয় দূতদের
সাক্ষাত দান করতেন। মুসলমানগণ সংকোচবোধ করতেন। কিন্তু তিনি থাকতেন
ভ্রুক্ষেপহীন।

একবার তিনি জামায় তালি লাগাচ্ছিলেন, হজরত হাফসা এসে বাধা
দিলেন। তিনি বললেন, হাফসা! মুসলমানদের অর্থ আমি এর অধিক ব্যয়
করতে পারি না।

খলিফা নিজেকে অতি কঠোরতার মধ্যে নিপতিত রেখেছেন— হজরত
আয়েশা সিদ্দীকারও এরকম মনে হতো। হজরত হাফসা একদিন তাঁকে নিয়ে
হাজির হলেন খলিফাতুল মুসলিমীনের দরবারে। দুজনে মিলে বললেন, আমিরুল
মু’মিনিন! আলাহ্ আপনাকে সম্মান দান করেছেন। রাজদূতগণ আপনার কাছে
আসা-যাওয়া করছেন। এখন আপনার জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়াই সমীচীন।
খলিফা বললেন, আফসোস! তোমরা আল্লাহর রসুলের জীবনসঙ্গিনী হয়েও
আমাকে ভোগ-বিলাসের প্রতি উৎসাহিত করছো। হে আয়েশা! তুমি কি সেদিনের
কথা ভুলে গিয়েছো, যখন রসুলুলাহর ঘরে একখানা মাত্র কাপড় থাকতো। তিনি
দিনে তা বিছিয়ে রাখতেন এবং রাতে সেটাই গায়ে দিতেন। আর হাফসা! তোমার
কি ওই দিনের কথা স্মরণ নেই, যেদিন তুমি রসুলুলাহর বিছানা দুই পরতে ভাঁজ
করে বিছিয়ে দিয়েছিলে। ভোরে শয্যাত্যাগ করে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন, হাফসা!
একি করেছো তুমি! দুই ভাঁজ করে বিছানা পেতেছো। আর আমি সারারাত নরম
বিছানায় শুয়ে কাটালাম। আলস্য আমাকে আরামপ্রিয় করে ফেললো। দুনিয়ার
সঙ্গে আমার কী ই বা সম্পর্ক?

ইসলামী রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়েই চলেছে। হিজরী ২৩ সালে
মুসলমানদের অধিকারভূত হলো কিরমান, সিজিস্তান, মাকরান এবং ইসপাহান।
এভাবে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলো মিসর থেকে বেলুচিস্তান পর্যন্ত। প্রায়শঃই
গনিমত হিসেবে আসতে লাগলো অনেক অর্থ-সম্পদ। একদিন হজরত হাফসা
এসে বললেন, হে বিশ্বাসীদের অধিনায়ক! আলাহ্ নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে
নির্দেশনা দান করেছেন। এ সকল সম্পদে আপনার নিকটাত্মীয়দেরও অধিকার
আছে। খলিফা বললেন, নিকটাত্মীয়দের অধিকার আছে আমার সম্পদে! আরে,
এসকল সম্পদ তো মুসলমানদের। হাফসা! তুমি তোমার পিতাকে কি ধোঁকায়
ফেলতে চাও? যাও। চলে যাও এখান থেকে। হজরত হাফসা চাদরের আঁচল
টানতে টানতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।

নতুন নতুন অভিযানের জন্য এবং রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার জন্য বহু দূরের
এলাকায় সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে হতো। এতে করে কোনো কোনো পরিবার হয়ে
পড়তো অভিভাবকহীন। খলিফা হজরত ওমর তাঁদের খোঁজখবর নেন। এমনকি
কারো কারো প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী ক্রয় করে এনে দেন বাজার থেকে।
সৈন্যদের চিঠিপত্র এলে নিজে ঘুরে ঘুরে বিলি করেন। কোনো গৃহের লোক পড়তে
না পারলে তিনি নিজেই তাদের দরজার চৌকাঠে বসে চিঠি পড়ে শোনান। জবাব
লিখে দেন।

নগরীর নৈশপ্রহরী হন নিজে। কারো কোনো কষ্ট আছে কিনা, তা ঘুরে ফিরে
স্বচক্ষে দেখেন। স্বকর্ণে শোনেন। চেষ্টা করেন সেগুলোর যথাপ্রতিবিধান করতে।
এক রাতে তিনি একটি বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। শুনতে পেলেন নারীকণ্ঠের
করুণ সুরের একটি বিরহসঙ্গীত। দয়িতের মিলনাকাক্সক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকা
চিরন্তন রমণীসত্তার বিধুর বিলাপ—
আহা! সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত এই রজনী কেবল
অন্ধকার। কেবলই তমসা। একা জেগে আছি।
সাথীহীন। প্রিয়তম নেই। আলাপন হবে কার সাথে?
হে অতুলনীয় আলাহ্! তোমাকে ভয় করি।
নয়তো এখনো কি অকম্পিত থাকতো শয্যাপার্শ্ব?

খলিফার অন্তর বিগলিত হলো। তিনি গৃহদ্বারে করাঘাত করলেন। সালাম
দিলেন। সালামের প্রত্যুত্তরের সঙ্গে জানতে চাওয়া হলো পরিচয়। খলিফা পরিচয়
দিলেন। দরজা খুলে গেলো। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার?
নারীকণ্ঠ বললো, হে বিশ্বাসীগণের নেতা! বহুদিন ধরে আমার স্বামী
সেনাবাহিনীতে আছে। তাঁকে আমি কাছে পেতে চাই।

পরদিনই হজরত ওমর কন্যা হাফসার সঙ্গে দেখা করলেন। ঠিক করলেন,
হাফসার মন্তব্য শুনে তিনি একটা বিধান প্রবর্তন করবেন, যাতে সেনাবাহিনী ও
তাদের পরিবার-পরিজন কষ্ট না পায়। জিজ্ঞেস করলেন, কন্যা আমার! লজ্জা
কোরো না। একটি প্রশেড়বর জবাব আমি তোমার কাছে চাই। বলো তো, স্বামীসঙ্গ
বিচ্যুতারা কতোদিন পরে স্বামী-মিলনের জন্য আকুল হয়? হজরত হাফসা লজ্জায়
মাথা নত করে রইলেন। খলিফা বললেন, আলাহ্ সত্যপ্রকাশের ব্যাপারে লজ্জিত
হন না। হজরত হাফসা মুখে কিছু বললেন না। ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, চারমাস।
কথাশুনে খলিফা রাষ্ট্রীয় ফরমান জারী করে দিলেন— কোনো সৈন্যকে কোথাও চার
মাসের অধিক যেনো আটকে রাখা না হয়।

হজরত হাফসা সবধরনের মতোবিরোধকে অপছন্দ করতেন। উটের যুদ্ধের
পক্ষ-বিপক্ষের কোনো দিকেই তিনি ছিলেন না। সকলের শান্তি ও কল্যাণ কামনা
করাই ছিলো তাঁর স্বভাব। তিনি যে সকল বিশ্বাসবানগণের জননী— একথা তিনি
কখনোই ভুলতেন না। সিফ্ফীন যুদ্ধের সময়ও তিনি এমনই করলেন। সৎপরামর্শ
দান করলেন সকলকে। ছোট ভাই হজরত আবদুলাহ্ ইবনে ওমরকে বললেন,
তোমার উচিত জুমাতুল জান্দালে সালিশ ফয়সালার অধিবেশনে যোগদান করা।
এতে তোমার কোনো লাভ নেই ঠিক, কিন্তু জনগণ উপকৃত হবে। তারা তোমার মতামতের অপেক্ষায় থাকবে। এমন হতে পারে, তোমার অনুপস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে নতুন বিরোধ। তুমি হচ্ছো সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের শ্যালক। আবার দ্বিতীয় খলিফার পুত্র।

জননী হজরত হাফসার মনে দাজ্জালভীতি ছিলো প্রবল। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
দাজ্জালের যে সকল আলামত বর্ণনা করতেন, মদীনার ইবনে সাইয়্যাদ নামক এক
ব্যক্তির মধ্যে ছিলো তার কিছুসংখ্যক আলামত। একদিন তিনি তাঁর ছোটভাই
আবদুলাহ্ ইবনে ওমরের সঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে দেখা হলো ওই
লোকটির সঙ্গে। হজরত আবদুলাহ্ তাকে কিছু একটা বলতেই সে ক্ষেপে গেলো
খুব। পথরোধ করে দাঁড়ালো। হজরত আবদুলাহ্ তাঁকে মারতে উদ্যত হলেন।
হজরত হাফসা ভীত হলেন। বললেন, ছেড়ে দাও ওকে। তুমি কি জানো না,
রসুলুলাহ্ বলেছেন, ক্রোধই হবে দাজ্জাল বের হবার কারণ।

হজরত হাফসার ফযীলত অনেক। তাঁর শ্রেষ্ঠমহিমা এই যে, তিনি নবীপ্রিয়া,
তাঁর জীবনসঙ্গিনী। পৃথিবীতে যেমন, তেমনি জান্নাতেও। বিশ্বাসীগণের যথার্থ
জননী— এটাও তাঁর অনন্যসাধারণ মর্যাদা। এ মর্যাদা তাঁকে আলাহ্পাকই
দিয়েছেন। জিব্রাইল আমিনের মাধ্যমে প্রশংসা করেছেন তাঁর— হাফসা খুব বেশী
রোজা পালন করেন। আর নামাজ পড়েন রাত জেগে জেগে।

ইয়ামামার যুদ্ধে বহুসংখ্যক কোরআনে হাফেজ সাহাবী শহীদ হন। সাহাবীগণ
কোরআন সংরক্ষণের বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। সর্বাপেক্ষা বেশী উদ্বিগ্ন হন
হজরত ওমর। তিনি তখনকার খলিফা হজরত আবু বকরকে আল কোরআনের
লিপিবদ্ধ রূপ সংরক্ষণের জন্য তাগিদ দিতে থাকেন। ফলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গৃহীত
হয়। প্রখ্যাত সাহাবী হজরত যায়েদ (রাঃ) আরবের স্বনামধন্য ক্বারী ও হাফেজদের
সঙ্গে নিয়ে অনেক পরিশ্রম করে পবিত্র কোরআনের পাণ্ডলিপি প্রস্তুত করেন। ওই
পাণ্ডলিপিখানা খলিফা হজরত আবু বকরের হেফাজতে থাকে। পরে হেফাজতকারী
হন খলিফা হজরত ওমর। তারপর হজরত হাফসা। সুতরাং কোরআন
সংরক্ষণকারিণী হিসেবেও তাঁর রয়েছে এক অতুলনীয় মর্যাদা।
মানুষের আয়ু কমতে থাকে। বাড়তে থাকে বয়স। মহাকালের দুর্নিরীক্ষ্য
বিলীয়মানতায় হারিয়ে যায় বিবর্তনময় দিবস-রজনী, মাস, বছর। বছরের পর
বছর। সকলকেই হতে হয় অমোঘ মৃত্যুর মুখোমুখি। পাপিষ্ঠরা আতঙ্কিত হয়।
চেষ্টা করে ব্যর্থ পলায়নের। পারে না। আর পুণ্যবানেরা হয় প্রীত। হয় প্রিয়তম
প্রভুপালকের মিলনের জন্য অধীর। তিনি ছোট ভাই আবদুলাহ্কে অসিয়ত
করলেন, গাবাতে তাঁর যে ভূখণ্ডটুকু আছে, তা যেনো আল্লাহর পথে ওয়াকফ করা
হয়।

মহাপুণ্যবতী উম্মতজননী হজরত হাফসা প্রস্তুত হলেন। ৪৫ হিজরীর শাবান
মাস। তাঁর বয়স ৬৩ পূর্ণ হলো। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন
তিনি। ইন্না লিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন।

তখন চলেছে আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) এর শাসনকাল। মুসলমানদের গৃহবিবাদের
অবসান ঘটিয়েছেন রসুলদৌহিত্র জান্নাতের যুবকদের অগ্রনায়ক হজরত ইমাম
হাসান (রাঃ)। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার্থে আমিরুল মুমিনীন বলে মেনে
নিয়েছেন হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কে।

মদীনার প্রশাসক তখন মারওয়ান। তিনি জানাজার নামাজ পড়ালেন। খাটিয়া
বহন করলেন আলে হাযামের বাড়ীর কাছ থেকে হজরত মুগিরার বাড়ী পর্যন্ত।
সেখান থেকে তাঁর কাঁধ থেকে নিজের কাঁধে খাটিয়া তুলে নেন হজরত আবু
হোরায়রা (রাঃ)। জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে তাঁকে কবরে নামালেন ছোটভাই হজরত
আবদুলাহ্ ইবনে ওমর এবং তাঁর ছেলেরা— আসেম, সালেম, আবদুলাহ্
ও হামযা।

বইঃ জননীদের জীবনী কথা
লেখকঃ মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ    

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment