ভূমিকা:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করেছেন এবং আমাদেরকে তার অনুসারী বানিয়েছেন। আল্লাহ যদি আমাদেরকে হেদায়াত না করতেন, তাহলে আমরা হেদায়াত পেতাম না। আমি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার প্রশংসা করছি এবং তাঁর নি‘য়ামতের ব্যাপারে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর তাঁর নিকট তাঁর অনুগ্রহ ও করুনা বৃদ্ধির আবেদন করছি। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, যিনি একক, যাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে তিনি হেদায়েত ও সত্য দীনসহ সুসংবাদ বাহক ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি সত্যের দিকে আহ্বান করেছেন এবং কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যে ব্যক্তি তাঁর হেদায়েতের অনুসরণ করবে তার উপর রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।
অতঃপর:
হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তোমাদের রবের নির্দেশকে সমীহ কর, তোমাদের দীন ও আমানতসমূহকে হেফাযত (সংরক্ষণ) কর এবং তোমরা তোমাদের দায়িত্বসমূহ পালন কর; আর তোমরা তোমাদের নিজেদের ব্যাপারে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করে নাও। অনেক মানুষ সৌভাগ্যের অনুসন্ধান করে; আর অন্বেষণ করে শান্তি, স্থিতি এবং দেহ ও মনের প্রশান্তি; যেমনিভাবে সে দুর্ভাগ্য ও অস্থিরতার কারণসমূহ, দুশ্চিন্তার উদ্দীপকসমূহ এবং বিশেষ করে পারিবারিক কলহ থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে চেষ্টাসাধনা করে।
তবে তাদের জানা উচিত যে, এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর উপর ভরসা এবং সকল বিষয় তাঁর প্রতি সোপর্দ করা ব্যতীত এসব বাস্তবায়ন করা যাবে না, আর সাথে সাথে তিনি যেসব নিয়মনীতি ও উপায় প্রণয়ন করেছেন, সেগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।
পরিবার গঠন ও দাম্পত্য জীবনে সৌহার্দ্যের গুরুত্ব:
এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে তা হলো পরিবার গঠন ও তাকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর প্রজ্ঞায় পরিবারকে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষ সকল মানুষের জন্য তৈরি করেছেন প্রত্যাবর্তনস্থল হিসেবে; যাতে সে অবস্থান করবে এবং সেখানে প্রশান্তি অনুভব করবে; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি এ অনুগ্রহ প্রকাশ করে বলেন: “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া; যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং সৃজন করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও সহমর্মিতা। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।”
[সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১]
হ্যাঁ, আল্লাহ বলেছেন: ‘যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়’; তিনি বলেন নি: ‘যাতে সে তার সাথে বাস করে’, সুতরাং আল্লাহর এ বাণীর দাবী হচ্ছে যে, পরিবারের আচার-আচরণ হবে স্থিতিশীল আর অনুভূতি হবে প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে সর্বোচ্চ অর্থে শান্তি ও নিশ্চিন্ততা প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকেই তার সঙ্গীর মধ্যে অস্থিরতার সময় প্রশান্তি এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে আনন্দ অনুভব করবে। দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কের মূলভিত্তি হল: ভালোবাসা, ঘনিষ্টতা ও সখ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত সাহচর্য ও মিলন। এ সম্পর্কের শিকড় অনেক গভীরে, বিস্তৃতি অনেক দূর ব্যপ্ত, স্বয়ং ব্যক্তির সাথে তার আত্মার যে সম্পর্ক, এটা তার সাথে খুব চমৎকারভাবে তুলনাযোগ্য, যা আমাদের প্রতিপালকের কিতাব বর্ণনা করেছে, তিনি বলেছেন: “তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ।”
[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭]
তাছাড়া এই সম্পর্ক ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষা এবং লালনপালন দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে যা গঠন করে, তা স্নেহপূর্ণ মাতৃত্ব ও শ্রমনির্ভর পিতৃত্বের ছায়াতল ছাড়া হতে পারে না। এ সম্মানিত পারিবারিক পরিবেশের চেয়ে আর কোন পরিবেশ অধিক পবিত্র হতে পারে?
মুসলিম পরিবার প্রতিষ্ঠার খুঁটিসমূহ:
সম্মানিত পাঠক: এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার উপর মুসলিম পরিবারের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে; যার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক এবং যা মেনে চললে তা থেকে দূরে থাকে বিচ্ছিন্নতার ঝড়ো হাওয়া ও ভঙ্গ ও কর্তিত হওয়ার তুফান। সে সব খুঁটিসমূহের অন্যতম হচ্ছে:
(১) আল্লাহর উপর পূর্ণ ঈমান ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন: যে সব খুঁটির উপর মুসলিম পরিবার দাঁড়িয়ে থাকে, তন্মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: ঈমানের রশিকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা … আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান; অন্তর যা লুকিয়ে রাখে, সে বস্তু সম্পর্কে যিনি জানেন তাকে ভয় করা; তাকওয়া ও আত্মপর্যবেক্ষণকে অপরিহার্য করে নেয়া; আর যুলুম থেকে এবং সত্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়া থেকে দূরে থাকা। আল-কুরআনের ভাষায়: “… এর দ্বারা তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে, তাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দেবেন, আর তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। …”
[সূরা আত-তালাক, আয়াত: ২ – ৩]
আর এই ঈমানকে শক্তিশালী করবে: আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের ব্যাপারে চেষ্টা করা, তার ব্যাপারে যত্নবান থাকা এবং সে ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা; তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীটি নিয়ে ভেবে দেখ, তিনি বলেছেন: “আল্লাহ রহম করুন এমন পুরুষ ব্যক্তির প্রতি, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্ত্রী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখমণ্ডলের উপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়। আর আল্লাহ রহম করুন এমন নারীর প্রতি, যে রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্বামী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখমণ্ডলের উপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়।” [1]
স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কটি পার্থিব ও বস্তুগত কোনো সম্পর্ক নয়; নয় চতুষ্পদ জন্তুর প্রবৃত্তির মত কোনো সম্পর্ক; বরং তা হল আত্মীক ও সম্মানজনক একটি সম্পর্ক; আর যখন এই সম্পর্কটি নির্ভেজাল ও যথাযথ হবে, তখন তা মৃত্যুর পর পরকালীন জীবন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে; আল-কুরআনের ভাষায়: “স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তারাও।”
[সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৩]
(২) সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন করা: যে জিনিসটি এ পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্ককে হেফাযত ও তত্ত্বাবধান করে, তা হল পরস্পর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন করা; আর এটা ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হবে না, যতক্ষণ না প্রত্যেক পক্ষ তার ভাল-মন্দ সম্পর্কে বুঝতে পারবে। বস্তুত ঘর ও পরিবারের ব্যাপারে সার্বিক পূর্ণতার বিষয়টি সুদূর পরাহত, তাই পরিবারের সদস্য কিংবা অন্যদের মধ্যে সকল বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা লাভ করার আশা করাটা মানব স্বভাবে নাগালের বাইরের বিষয়।
দাম্পত্য জীবন তথা পরিবার সংরক্ষণ ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দর জীবন যাপনে স্বামীর ভূমিকা:
সুস্থ বিবেক এবং পরিপক্ক চিন্তার দাবী হচ্ছে, কতিপয় অসহিষ্ণুতাকে গ্রহণ করা এবং অসুখকর বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার ব্যাপারে মনকে তৈরী করে রাখা। কারণ, পুরুষ হল পরিবারের কর্তা, তার নিজের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা নারীর চেয়ে অধিক হবে এটাই দাবি। কেননা, পুরুষ জানে যে, নারী তার সৃষ্টিগত ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক থেকে দুর্বল; যখন তাকে প্রত্যেক বিষয়ে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হবে, তখন সে সব বিষয়ে জবাব দিতে অক্ষম হয়ে পড়বে; আর তাকে সোজা করার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করার বিষয়টি তাকে ভেঙ্গে ফেলার দিকে নিয়ে যাবে, আর তার ভেঙ্গে যাওয়া মানে তাকে তালাক দেওয়া; নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে কোনো কথা বলেন না, (বরং যা বলেন আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেন) তিনি বলেন: “তোমরা নারীদের ব্যাপারে উত্তম উপদেশ গ্রহণ কর। কারণ, নারী জাতিকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে; আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা; সুতরাং তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলবে; আর যদি এমনি ছেড়ে দাও, তাহলে সব সময় তা বাঁকাই থেকে যাবে; কাজেই নারীদের সাথে কল্যাণমূলক কাজ করার উপদেশ গ্রহণ কর।” [2]
সুতরাং নারীর মধ্যে বক্রতার বিষয়টি মৌলিকভাবেই সৃষ্টিগত; অতএব, আবশ্যক হলো সহজসুলভ আচরণ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা। তাই পুরুষের উপর কর্তব্য হল, তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে অসহিষ্ণু আচরণের প্রকাশ ঘটবে, সে ক্ষেত্রে তার সাথে দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে না পড়া; আর সে যেন তাদের মধ্যকার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকসমূহ থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে চলে এবং তার কর্তব্য হল তাদের মধ্যকার ভাল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা, আর এর মধ্যে সে অনেক ভালো কিছু পাবে। অনুরূপ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “কোন মুমিন পুরুষ কোনো মুমিন নারীকে ঘৃণা ও অপছন্দ করবে না; যদি সে তার কোনো স্বভাবকে অপছন্দ করেও, তাহলে সে তার অপর একটি স্বভাবকে পছন্দ করবে।” [3]
আর সে যেন এ ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করে; সে যদি তার অপছন্দনীয় কোনো কিছু দেখে, তাহলে এটাই শেষ কথা হিসেবে গ্রহণ না করে, কারণ সে জানে না কোথায় রয়েছে কল্যাণের মাধ্যম ও ভালোর উৎস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “… আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।”
[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯]
আর শান্তি কিভাবে হবে? আর প্রশান্তি ও হৃদ্যতা কোত্থেকে আসবে? যখন পরিবারের কর্তা কঠোর প্রকৃতির, দুর্ব্যবহারকারী ও সংকীর্ণমনা হন; যখন তাকে নির্বুদ্ধিতা পরাভূত করে; আর তাড়াহুড়া, সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ধীরতা ও রাগের ক্ষেত্রে দ্রুততার বিষয়টি তাকে অন্ধ করে তুলে; যখন সে প্রবেশ করে, তখন বেশি বেশি খোটা দেয়; আর যখন বের হয়, তখন সে কুধারণা করে? অথচ এটা জানা কথা যে, উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন এবং সৌভাগ্যের উপায়-উপকরণসমূহ কেবল উদারতা এবং ভিত্তিহীন যাবতীয় ধ্যানধারণা ও সন্দেহ থেকে দূরে থাকার মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে। আর আত্মমর্যাদা বা ব্যক্তিত্বের অহংবোধ কখনও কখনও কিছু সংখ্যক মানুষকে কুধারণা পোষণ করার দিকে নিয়ে যায়… তাকে নিয়ে যায় বিভিন্ন কথাবার্তার অপব্যাখ্যা কিংবা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সন্দেহ তৈরী করতে। আর তখন তা কোনো নির্ভরযোগ্য কারণ ছাড়াই ব্যক্তির জীবনকে বিস্বাদ করে দেয় এবং মনকে অস্থির করে তুলে। আল-কুরআনের ভাষায়: “আর তাদেরকে উত্যক্ত করবে না সংকটে ফেলার জন্য।”
[সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৬]
আর কিভাবে এ কাজটি একজন লোক তার স্ত্রী সম্পর্কে করতে পারে, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, তোমাদের মধ্যে যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম; আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীর নিকট উত্তম।” [4]
দাম্পত্য জীবন তথা পরিবার সংরক্ষণ ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দর জীবন যাপনে স্ত্রীর ভূমিকা:
মুসলিম নারীর জেনে রাখা উচিত যে, সৌভাগ্য, ভালোবাসা ও অনুকম্পা তখনই পরিপূর্ণতা লাভ করবে, যখন সে সচ্চরিত্রবান ও দ্বীনদার হবে; সে তার নিজের জন্য উপকারী ইতিবাচক দিকগুলো জেনে নিবে; যাতে সে তার সীমা অতিক্রম ও লঙ্ঘন না করে; সে তার স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিবে; কারণ, তাকে পরিচালনার ব্যাপারে স্বামীর উপর দায়িত্ব রয়েছে, স্বামী তাকে হেফাযত করবে, সংরক্ষণ করবে এবং তার জন্য ব্যয় করবে; সুতরাং স্ত্রীর উপর আবশ্যক হলো, স্বামীর আনুগত্য করা, স্বামীর জন্য সে তার নিজকে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করা; আর স্ত্রী তার নিজের কাজ-কর্ম সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিবে ও তা যথাযথভাবে পালন করবে এবং সে তার নিজের ও সংসারের প্রতি যত্নবান হবে; সে হবে পবিত্রা স্ত্রী, মমতাময়ী মাতা, তার স্বামীর সংসারের রক্ষণাবেক্ষণকারিনী দায়িত্বশীলা, যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। সে তার স্বামীর ভালো ও সৌন্দর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিবে, তার অবদান ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপনের বিষয়টিকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করবে না; এই ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন ও অস্বীকার করার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন, তিনি বলেছেন: “আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়; (তখন আমি দেখি) তার অধিবাসীদের অধিকাংশই স্ত্রীলোক, যারা কুফরী করে। জিজ্ঞাসা করা হল: তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে? তিনি বললেন: “তারা স্বামীর অবাধ্য হয় এবং ইহসান (সদ্ব্যবহার) অস্বীকার করে; তুমি যদি দীর্ঘকাল তাদের কারও প্রতি ইহসান করে থাক, এরপর সে তোমার সামান্য অবহেলা দেখলেই বলে, আমি কখনও তোমার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পাইনি।” [5]
সুতরাং আবশ্যক হল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা এবং অপরাধ বা ভুল-ভ্রান্তির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা … স্বামী উপস্থিত থাকলে তার প্রতি দুর্ব্যবহার করবে না, আর স্বামী অনুপস্থিত থাকলে, স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। এর মাধ্যমেই পারস্পরিক সন্তুষ্টি অর্জিত হবে, সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব স্থায়ী হবে এবং আন্তরিকতা, ভালবাসা ও সহমর্মিতা প্রাধান্য বিস্তার করবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায়: “যে নারীই তার প্রতি তার স্বামী সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় মারা যাবে, সে নারী জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [6]
সুতরাং হে মুসলিম জাতি! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ যে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও একতা অর্জন করার মাধ্যমে সৌভাগ্য পরিপূর্ণতা লাভ করবে, শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ তৈরি হবে এবং তরুণ সমাজ বেড়ে উঠবে এমন এক মর্যাদাবান ঘরে, যা ভালাবাসার দ্বারা পরিপূর্ণ, পারস্পরিক বুঝাপড়ার দ্বারা সমৃদ্ধ … মাতৃত্বের সহানুভূতিশীলতা ও পিতৃত্বের করুণার মাঝে (বিদ্যমান) … তারা অবস্থান করবে অনেক দূরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিতর্কের শোরগোল এবং একে অন্যের সাথে বাড়াবাড়ি থেকে; যাতে করে সেখানে থাকবে না কোনো প্রকার অনৈক্য, মতবিরোধ ও দুর্ব্যবহার, কাছে কিংবা দূরে। আল-কুরআনের ভাষায়: “… হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের জন্য চোখজুড়ানো। আর আপনি আমাদেরকে করুন মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য।”
[সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭৪]
উপসংহার:
পরিশেষে- আমার মুসলিম ভাই ও বোন! আল্লাহ তোমাদেরকে তাওফীক দিন: নিশ্চয়ই পরিবারের সংস্কার হল গোটা সমাজের নিরাপত্তার উপায়; এমন সমাজকে সংস্কার করা অসম্ভব, যাতে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে; কিভাবেই বা সম্ভব, অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পারিবারকে নিয়ামত হিসেবে আমাদের কাছে অনুগ্রহ হিসেবে তুলে ধরেছেন। যে নেয়ামতটি হচ্ছে পরিবারের পরস্পর বন্ধন, মিলন ও চিরাচয়িত সম্পর্ক ..। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন: “আর আল্লাহ তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন; আর তোমাদের যুগল থেকে তোমাদের জন্য পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবণোপকরণ দান করেছেন। তবুও কি ওরা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে এবং ওরা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”
[সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৭২]
নিশ্চয়ই স্বামী-স্ত্রী ও তাদের মধ্যকার মজবুত সম্পর্ক এবং পিতা-মাতা ও তাদের কোলে বেড়ে উঠা সন্তান-সন্ততি- এ বিষয় দু’টি বর্তমান জাতি ও ভবিষ্যৎ জাতি হিসেবে বিবেচ্য। তাই এটা বলা যায় যে, শয়তান যখন পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারে সফল হবে, তখন এর মাধ্যমে সে কেবল একটি সংসারকেই ধ্বংস করবে না, কোনো সীমাবদ্ধ অনিষ্টতাই সংঘটিত করবে না বরং তা গোটা জাতিকে বড় ধরনের ক্ষতি ও দ্রুততর অনিষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। আর বর্তমান বাস্তবতা তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সুতরাং আল্লাহ ঐ পুরুষ ব্যক্তিকে রহম করুন, যিনি প্রশংসনীয় চরিত্র ও উৎকৃষ্ট মনের অধিকারী, উদার, কোমল, দয়ালু, তার পরিবারের প্রতি স্নেহপরায়ণ এবং তার কাজের ব্যাপারে বিচক্ষণ; যিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না, কঠোরতা আরোপ করে যুলুম করেন না এবং দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দেন না। আর আল্লাহ ঐ নারীর প্রতি রহম করুন, যিনি ভুল-ত্রুটি খোঁজে বেড়ান না, বেশি শোরগোল করেন না, সততাপরায়ণা, আনুগত্যপরায়ণা এবং অদৃশ্য অংশের হেফাজতকারিনী, যেভাবে আল্লাহ হেফাজত করেছেন।
সুতরাং হে স্বামী ও স্ত্রীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; আর হে মুসলিমগণ! তোমরাও আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করবে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দিবেন। (আল্লাহ রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের প্রতি; আরও রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর সাহাবীগণ এবং কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যারা তাঁদেরকে উত্তমভাবে অনুসরণ করবে তাদের প্রতি)।
(হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসাসহ তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি; আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার নিকট তাওবা করছি)।
তথ্যসূত্র
[1] হাদিসটি সহীহ, যা বর্ণনা করেছেন: আহমদ, আল-মুসনাদ: ২/২৫০, ৪৩৬; আবূ দাউদ: ১৩০৮; নাসায়ী: ৩/২০৫; ইবনু মাজাহ: ১৩৩৬; আর ইবনু খুযাইমা হাদিসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন (১১৪৮); হাকেম: ১/৩০৯; আর যাহাবী র. তা সমর্থন করেছেন।
[2] বুখারী, আল-জামে‘উস সহীহ (৫১৮৬); মুসলিম, আস-সহীহ (১৪৬৮)
[3] মুসলিম, আস-সহীহ (১৪৬৯);
ফায়দা: হাফেয ইবনু হাজার র. যা বলেছেন, তার সারকথা হল: হাদীসের মধ্যে সহানুভূতির মাধ্যমে স্ত্রীকে পুনর্গঠনের ইঙ্গিত রয়েছে; সুতরাং সে তাতে অতিরঞ্জন করবে না, যাতে সংসার ভেঙ্গে যায়; আর সে তাকে একেবারে ছেড়ে দেবে না; যাতে সে তার বক্রতার উপরেই চলতে থাকবে। আর এর বিধিবদ্ধ নিয়ম হল: যখন স্ত্রী তার স্বভাবগত ত্রুটিটি বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, আর তা তাকে সরাসরি অবাধ্যতাকে গ্রহণ করার দিকে অথবা আবশ্যকীয় বিষয় বর্জন করার দিকে নিয়ে যাবে; এমতাবস্থায় সে তাকে বক্রতার উপর ছেড়ে দেবে না। পক্ষান্তরে যখন তার বক্রতাটি কোনো বৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে হয়, তখন সে তাকে তার উপর ছেড়ে দেবে। – দেখুন: ফাতহুল বারী, ৯/২৫৪।
[4] হাদিসটি সহীহ; তা বর্ণনা করেছেন তিরমিযী (৩৮৯২); ইবনু মাজাহ (১৯৭৭); ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ (১৩১২)
[5] বুখারী, আল-জামে‘উস সহীহ (৫১৯৭)
[6] হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযী (১১৬১) এবং তিনি তাকে ‘হাসান’ বলেছেন; ইবনু মাজাহ (১৮৫৪); হাকেম, ৪/১৭৩ এবং তিনি বলেছেন: হাদিসটির সনদ সহীহ (বিশুদ্ধ)।