এই সুরাখানিও অবতীর্ণ হয়েছে মহাপুণ্যের আলয় মক্কায়। এতে আয়াত রয়েছে ৫টি।
বোখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন, রসুল স. এর উপরে যখন অবতীর্ণ হলো ‘আর আপনি আপনার নিকটজনদেরকে ভীতি প্রদর্শন করুন’ তখন তিনি স. তাঁর আত্মীয় স্বজনদেরকে সমবেত করলেন। যথারীতি তাঁদেরকে ভয় প্রদর্শন করলেন আল্লাহ্র। বোখারী প্রমুখের বর্ণনায় এসেছে, তখন রসুল স. একদিন আরোহণ করলেন সাফা পর্বতের চূড়ায়। শংকাজড়িত কণ্ঠে উচ্চস্বরে তাঁর আত্মীয় স্বজনদের নাম ধরে ডাকলেন। কুরায়েশ জনতা জড়ো হলো পর্বতের সানুদেশে। তিনি স. উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, হে জনতা! এখন আমি যদি বলি, পর্বতের অপর প্রান্তে একদল শত্রু সেনা লুকিয়ে আছে। তারা তোমাদেরকে আক্রমণ করবে সন্ধ্যায়, অথবা সকালে, তাহলে তোমরা কি আমার একথা বিশ্বাস করবে? জনতা সমস্বরে জবাব দিলো, নিশ্চয়। তুমি যে আল আমীন (সত্যবাদী)। তিনি স. বললেন, তাহলে শোনো, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে শাস্তি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই তোমরা সাবধান হও। আবু লাহাব বললো, তুমি ধ্বংস হও। এ জন্যই কি তুমি আমাদেরকে এখানে ডেকেছো? একথা বলেই সে একটি প্রস্তরখণ্ড হাতে তুলে নিয়ে রসুল স. এর প্রতি নিক্ষেপোদ্যত হলো। তখনই অবতীর্ণ হলো আলোচ্য সুরার প্রথম তিনটি আয়াত।
সূরা লাহাবঃ আয়াত ১, ২, ৩, ৪, ৫
তাফসীরে মাযহারী/৬৩২
* ধ্বংস হউক আবু লাহাবের দুই হস্ত এবং ধ্বংস হউক সে নিজেও।
* উহার ধন-সম্পদ ও উহার উপার্জন উহার কোন কাজে আসে নাই।
* অচিরে সে প্রবেশ করিবে লেলিহান অগ্নিতে
* এবং তাহার স্ত্রীও যে ইন্ধন বহন করে,
* তাহার গলদেশে পাকান রজ্জু।
প্রথমোক্ত আয়াতত্রয়ের মর্মার্থ হচ্ছে চিরহতভাগ্য আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক। ধ্বংস নেমে আসুক তার নিজের উপরেও। তার অর্থবিত্ত ও উপার্জন তার কোনো উপকারে আসেনি। আসবেও না। দোজখের লেলিহান অগ্নিকুণ্ডে তার প্রবেশের ক্ষণ অত্যাসন্ন।
এখানে ‘তাব্বাত’ অর্থ ধ্বংস হোক। এর ধাতুমূল ‘তাবাব’ যার অর্থ, এমনই এক গহবর, যা সমূহ বিপদ ডেকে আনে। ‘ইয়াদা আবী লাহাব’ অর্থ আবু লাহাবের দুই হস্ত। অর্থাৎ আবু লাহাব স্বয়ং। যেমন বলা হয় ‘ওয়ালা তুলক্বু বিআইদী কুম ইলাত তাহলুকাহ্, (তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না)। এখানেও ‘আইদী’ অর্থ নিজেকে, নিজেদেরকে। কোনো কোনো বিদ্বান বলেছেন, আবু লাহাব রসুল স.কে আঘাত করার জন্য হাতে পাথর তুলে নিয়েছিলো। তাই এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে তার হস্তদ্বয়ের কথা। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এখানে হস্তদ্বয় অর্থ ইহজগত ও পরজগত। অর্থাৎ তার ইহকাল-পরকাল দুই কালই ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত। অথবা এখানে ‘হস্তদ্বয়’ কথাটির দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে তার বিত্ত ও প্রভুত্বকে।
আবু লাহাবের আসল নাম ছিলো আবদুল উজ্জা (উজ্জা দেবীর দাস) মুকাতিল বলেছেন, সে সুদর্শন চেহারার লোক ছিলো বলেই তাকে বলা হতো আবদুল উজ্জা। পরে তার উপনাম হয় আবু লাহাব। আবদুল উজজা নামটা অতি জঘন্য। তাই এখানে তাকে বলা হয়েছে আবু লাহাব, যার অর্থ ধ্বংসের পিতা, চরম ধ্বংসাত্মক। ‘ওয়া তাববা’ অর্থ ধ্বংস হোক সে নিজেও। অর্থাৎ সে তো ধ্বংসই হয়ে গিয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, ‘তাববাত’ শব্দটির মাধ্যমে এখানে তার ধ্বংস কামনা করা হয়েছে এবং ‘তাব্বা’ এখানে এসেছে তার ধ্বংসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের লক্ষ্যে। এভাবে বক্তব্যটি দাঁড়িয়েছে আবু লাহাব বিনাশপ্রাপ্ত হোক, বরং সে তো বিনাশ হয়েই গিয়েছে। অর্থাৎ তার বিনাশপ্রাপ্তির বিষয়টি সুনিশ্চিত। একারণেই এখানে ভবিষ্যতকালজ্ঞাপক ক্রিয়া ব্যবহার না করে ব্যবহার করা হয়েছে অতীতকালবোধক ক্রিয়া।
হজরত ইবনে মাসউদ বলেছেন, রসুল স. যখন তাঁর স্বজনদেরকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন, তখন আবু লাহাব বললো, ভাতিজা! তুমি আমাকে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছো। কিন্তু আমি তো শাস্তির পরোয়াই করি না। প্রয়োজন হলে আমি আমার সন্তান-সন্ততি-ধন-সম্পদ সবকিছুর বিনিময়ে তোমার কথিত শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভ করবো। তখন অবতীর্ণ হয় পরবর্তী আয়াত। বলা হয়
তাফসীরে মাযহারী/৬৩৩
‘মা আগনা আ’নহু মালুহূ ওয়ামা কাসাব’ অর্থ তার ধন সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোনো কাজে আসেনি। অর্থাৎ তার সঞ্চিত বিপুল বিত্ত-বৈভব ও উপার্জিত সম্পদ তাকে আল্লাহ্র শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। অথবা তার পুঞ্জীভূত ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন কি তাকে আল্লাহ্র শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে? পারবে না। ‘ওয়ামা কাসাব’ অর্থ তার উপার্জন। অথবা তার সন্তান-সন্ততি। মাতা মহোদয়া আয়েশা সিদ্দীকা বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, নিজস্ব উপার্জনজাত আহার্য সর্বোত্তম ও পবিত্রতম। তোমাদের সন্তান-সন্ততিও তোমাদের উপার্জন। বোখারী, তিরমিজি।
উল্লেখ্য, আবু লাহাবের জ্যেষ্ঠ পুত্র উতবা যখন বাণিজ্যব্যপদেশে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করেছিলো, তখন তাকে পথিমধ্যে ভক্ষণ করেছিলো একটি নেকড়ে। আর আবু লাহাব মারা গিয়েছিলো বসন্ত রোগে, বদর যুদ্ধের কয়েকদিন পর। কয়েকজন হাবশী ক্রীতদাসের সহায়তায় তাকে বালিচাপা দেওয়া হয়।
‘সা ইয়াস্লা নারান জাতা লাহাব’ অর্থ অচিরে সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে। ‘জাতা লাহাব’ অর্থ লেলিহান অগ্নি। অর্থাৎ সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যখন আবু লাহাব দগ্ধীভূত হতে থাকবে দোজখের লেলিহান আগুনে।
পরের আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে ‘এবং তার স্ত্রীও, যে ইন্ধন বহন করে (৪) তার গলদেশে পাকানো রজ্জু’ (৫)। এখানে ‘ওয়াম্রাআতুহু’ অর্থ তার স্ত্রীও। অর্থাৎ আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলকেও ভোগ করতে হবে একই পরিণতি। উল্লেখ্য, সে ছিলো হরব ইবনে উমাইয়ার কন্যা এবং হজরত আবু সুফিয়ানের ভগ্নি।
‘হাম্মালাতাল হাত্বব’ অর্থ যে ইন্ধন বহন করে। আরবী ভাষায় পরনিন্দুককে বলা হয় কাষ্ঠ, বা ইন্ধন বহনকারিণী। অর্থাৎ পর নিন্দাকারিণী। ইবনে ইসহাক হামাদান খান্দানের জনৈক ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, রসুল স. এর গমনাগমনের পথে আবু লাহাবের স্ত্রী কাঁটা পুঁতে রাখতো। সেদিকে ইঙ্গিত করেই অবতীর্ণ হয় এই আয়াত। জুহাক ও ইকরামা সূত্রে ইবনে মুনজিরও এরকম বর্ণনা করেছেন। আতিয়াও এরকম বর্ণনা করেছেন হজরত ইবনে আব্বাসের উক্তিরূপে। কিন্তু কাতাদা, মুজাহিদ এবং সুদ্দী বলেছেন, ‘হাম্মালাতাল হাত্বব’ অর্থ পর নিন্দুক। উম্মে জামিলের স্বভাবই ছিলো পরনিন্দা করে বেড়ানো, একের বিরুদ্ধে অপরের কথা লাগিয়ে ওই দু’জনের মধ্যে শত্রুতার আগুন জ্বালানো, যেমন কাষ্ঠ খণ্ডের ঘর্ষণে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আগুন। সাঈদ ইবনে যোবায়ের বলেছেন, এখানে ‘হাম্মালাতাল হাত্বব’ অর্থ পাপের গুরুভার বহনকারিণী। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছে ‘তারা তাদের পিঠে বহন করে পাপের বোঝা’।
‘ফী জ্বীদিহা হাবলুম্ মিম্ মাসাদ্’ অর্থ তার গলদেশে পাকানো রজ্জু। ‘জ্বীদ’ অর্থ গলদেশ, গলা। আর ‘মাসাদ’ অর্থ লৌহশৃঙ্খল, যার দৈর্ঘ্য সত্তর হাত। ওই লৌহশৃঙ্খল তার গলায় আটকিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে তার পিঠের উপর দিয়ে
তাফসীরে মাযহারী/৬৩৪
কটিদেশ পর্যন্ত। আবার শব্দটির অর্থ পাকানো মজবুত রজ্জুও হয়, খেজুর গাছের ছালের হোক, অথবা পাট জাতীয় অন্য কোনো তন্তুর। এরকম বলেছেন হজরত ইবনে আব্বাস এবং ওরওয়া ইবনে যোবায়ের। মুজাহিদ সূত্রে আখফাশ বলেছেন, লোহার শিকলকেই ‘মাসাদ’ বলে। শা’বী এবং মুকাতিল বলেছেন, উম্মে জামিল শক্ত রশি দিয়ে তার লাকড়ির বোঝা বাঁধতো। একদিন সে এভাবে বাঁধা একটি লাকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে একটি পাথরের উপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিছলো। এমন সময় একজন ফেরেশতা সেখানে উপস্থিত হয়ে তার লাকড়ির বোঝাটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ফলে তার গলায় ফাঁস লেগে যায় এবং ওই অবস্থাতেই অক্কা পায় সে। ইবনে জায়েদ বলেছেন, ইয়েমেন অঞ্চলে এক প্রকার গাছ জন্মে, তার নাম ‘মাসাদ’। আর তার আঁশ দ্বারা তৈরী রশিকেও বলে ‘মাসাদ’। কাতাদা বলেছেন, ‘মাসাদ’ অর্থ গলার হার। হাসান বসরী বলেছেন, উম্মে জামিলের গলার মোতির মালাকে এখানে বলা হয়েছে ‘মাসাদ’। সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব বলেছেন, রমণীটি সুন্দর একটি কণ্ঠহার ব্যবহার করতো। সেই কণ্ঠহারটিকেই এখানে বলা হয়েছে ‘মাসাদ’। সে বলতো, মোহাম্মদের সাথে শত্রুতার পাথেয় হবে আমার এই গলার হার।
‘মাসাদ’ অর্থ যদি এখানে লোহার শিকল হয়, তবে বুঝতে হবে, এখানে বলা হয়েছে তার পরকালের অশুভ পরিণতির কথা। আর এর অর্থ যদি হয় সাধারণ রশি, তবে বুঝতে হবে, প্রসঙ্গটি ইহজগতের। লক্ষণীয়, ঘটনাটি এখানে বর্ণিত হয়েছে রূপকভাবে। উম্মে জামিলকে লাঞ্ছিত ও হেয় প্রতিপন্ন করাই এখানে উদ্দেশ্য। তবে এখানে শা’বী যে বর্ণনাটি উপস্থাপন করেছেন, তার অর্থ বোধগম্য নয়। কেননা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী তখনকার সমাজে পরিচিত ছিলো কুলীন ও রক্ষণশীল রূপে। সুতরাং উম্মে জামিল যে লাকড়ির বোঝা বহন করতো, এরকম কথা কষ্টকল্পনা বৈ কি।