বস্তুতঃ ‘তারীখুল ইসলাম’ বইটিতে গাদীরে খুমের ঘটনাটির শিরোনাম ‘হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সান্ত্বনা।’ তাতে লেখা হয়:
‘হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সান্ত্বনা:’
হজ্জ্বের সময় হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কিছু অনুসারী যাঁরা ইয়েমেন অভিযানে তাঁর সাথী হয়েছিলেন, তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে (তাঁর বিরুদ্ধে) অভিযোগ করেন। ইয়েমেনে গমনকারী এই সৈনিকদের কিছু ভুল বুঝাবুঝি অনাস্থার জন্ম দিয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গাদীরে খুমে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র প্রশংসা করে সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে বলেন:
مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ
অর্থ: “আমি যার মওলা/বন্ধু, আলী-ও তার মওলা/বন্ধু।” এই ভাষণের পরে হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হযরত ইমাম (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “আজ হতে আপনি আমার অতি বিশিষ্ট এক বন্ধু।” অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মদীনা মোনাওয়ারায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাঁর পুত্র ইবরাহীম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বেসালপ্রাপ্ত হন। [তারীখ আল-ইসলাম, ১ম খণ্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা
গাদীরে খুম-সম্পর্কিত হাদীস:
হাদীসে গাদীরে খুমের সারসংক্ষেপ: হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র সেনাবাহিনী গনীমত হতে শণবস্ত্র ও উট দিতে অস্বীকার করায় তাঁর প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন; আর তাঁরা এ বিষয়টির ব্যাপারেও খুশি ছিলেন না যে তিনি স্বয়ং খুমস্ তথা গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ হতে বিশেষ একটি অংশ (মঞ্জুরি) প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিশ্চয় খুমস্ হতে অতিরিক্ত অংশের এ সুবিধা গ্রহণের জন্যে তাঁকে দোষারোপ করা যায় না, যে অধিকারটুকু ক্বুরআন মজীদেই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পরিবার সদস্যদের প্রতি দান করা হয়েছে। তথাপি সৈনিকবৃন্দের দৃষ্টিতে ছিলো রোষানল, তাই হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) যখন খুমস্ হতে এক জারিয়া দাসীকে নিজের জন্যে গ্রহণ করেন তখন তাঁরা বিশেষভাবে মনে কষ্ট পান। বস্ত্র ও উট অস্বীকার করে নিজের জন্যে দাসী নারী গ্রহণের দায়ে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ভ্রান্তভাবে কপটতার অভিযোগ উত্থাপন করেন। এই অমূলক সমালোচনার কারণেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর পক্ষ সমর্থন করতে গাদীরে খুমের হাদীসটি ব্যক্ত করেন।
জনৈক ShiaChat সদস্য বলেন: “তোমরা সৌদি (মানে জাযিরাতুল আরবের) বিকৃত যৌনতায় বিশ্বাসী লোকেরা তোমাদের নিজস্ব বিলাসিতায় কারো সম্পর্কে যা কল্পনা করতে চাও করো গিয়ে, কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে এখানে কথা বলার দুঃসাহস দেখিও না…..ওই অভিযোগ (মানে ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু কর্তৃক জারিয়া দাসীর সাথে সহবাস করার বিষয়টি) একটি নির্লজ্জ উমাইয়া প্রপাগান্ডা, যাতে আমাদের মওলা (আলাইহিস্ সালাম)’কে মন্দ হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়।”
প্রথমতঃ সহীহ বুখারী হাদীসগ্রন্থে গাদীরে খুম-বিষয়ক হাদীসটি হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)‘কে মন্দ হিসেবে প্রতীয়মান করার উদ্দেশ্যে লিপিবদ্ধ হয়নি। বস্তুতঃ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত ইমাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কাজটির পক্ষে সমর্থন জানান। এখানে উল্লেখ্য যে, এমন কী হুজূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নিজেও এক জারিয়া দাসীকে গ্রহণ করেছিলেন যা সুন্নী ও শীয়া হাদীসগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। সেই অতীত যুগে দাসত্ব এক সাংস্কৃতিক রীতি হিসেবে প্রচলিত ছিলো, আর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মুসলমানদের প্রতি দাসীদেরকে তাঁদের (আচরণে) স্ত্রীর মর্যাদা দেয়ার জন্যে তাকিদ দিয়েছিলেন। অন্যান্য সময়ে তিনি দাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করার উৎসাহ দান করতেন। এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে লেখা অনেক দীর্ঘ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠকমণ্ডলী ইন্টারনেটে সেগুলো খুঁজে পড়তে পারেন।
দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়টিও এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক জারিয়া দাসী গ্রহণকে অনৈতিক বিবেচনা করার কারণে কিন্তু হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর সমালোচনা করেননি। বরঞ্চ তিনি সমালোচনামুখর হয়েছিলেন এ কারণে যে, হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) খুমস্ থেকে অংশ নিলেও তাঁর সৈন্যদের তিনি তা হতে অংশ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) খুমস্ থেকে জারিয়া দাসী গ্রহণ করেন, নাকি শণবস্ত্র বা উট নেন, সে ব্যাপারটি হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে ধর্তব্য ছিলো না।
তৃতীয়তঃ হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক জারিয়া দাসী গ্রহণের বাস্তবতা শীয়া হাদীসগ্রন্থেও বিবৃত হয়েছে। এমতাবস্থায় শীয়াপন্থীদের এতো উষ্মা প্রকাশ করা কেন উচিৎ হবে, যখন অনুরূপ একটি বর্ণনা সুন্নী হাদীসগ্রন্থে বিবৃত হয়েছে? এটা কপটতা নয় কি? সুন্নী হাদীসে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কর্তৃক জারিয়া দাসী গ্রহণের প্রতি হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যেমন রাগান্বিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি শীয়া হাদীসেও জারিয়া দাসী গ্রহণের দরুন তাঁর প্রতি হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ওই (শীয়া) হাদীসটি শীয়া মতবাদের একজন পূর্বসূরীর বর্ণিত; যাঁর নাম ইবনে বাবাভীহ আল-ক্বুম্মী। এটা একটা প্রসিদ্ধ শীয়া ওয়েবসাইটে বিদ্যমান। এয়া-যাহরা-ডট-ওর্গ বিবৃত করে:
মাজলিসী ‘বিহারুল আনওয়ার’ ৪৩/১৪৭:
عن أبي ذر رحمة الله عليه قال : كنت أنا وجعفر بن أبي طالب مهاجرين إلى بلاد الحبشة فاهديت لجعفر جارية قيمتها أربعة آلاف درهم ، فلما قدمنا المدينة أهداها لعلي عليه السلام تخدمه ، فجعلها علي في منزل فاطمة .
فدخلت فاطمة عليها السلام يوما فنظرت إلى رأس علي عليه السلام في حجر الجارية فقالت : يا أبا الحسن فعلتها ، فقال : لا والله يا بنت محمد ما فعلت شيئا فما الذي تريدين ؟ قالت تأذن لي في المصير إلى منزل أبي رسول الله صلى الله عليه واله فقال لها : قد أذنت لك .
فتجللت بجلالها ، وتبرقعت ببرقعها
অনুবাদ: হযরত আবূ যর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন আল-মাজলিসী; তাঁর থেকে আল-ক্বুম্মী। হযরত আবূ যর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: আমি হযরত জা’ফর তাইয়্যার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সাথে হাবশী দেশে (মানে আবিসিনিয়ায়) হিজরত করি। চার হাজার (৪০০০) দিরহাম মূল্যের এক জারিয়া দাসীকে হযরত জা’ফর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর প্রতি উপহারস্বরূপ দেয়া হয়। আমরা যখন মদীনায় আগমন করি, তখন তাকে (দাসীকে) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কাছে উপহারস্বরূপ প্রদান করি, যাতে সে তাঁর খেদমত করতে পারে। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) তাকে হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র ঘরেই রাখেন। একদিন হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ঘরে প্রবেশ করে দেখেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র শির মোবারক ওই জারিয়া দাসীর কোলে। তিনি জিজ্ঞেস করেন: “হে (ইমাম) হাসানের বাবা! তুমি কি তার সাথে (সহবাস) করেছো?” ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) উত্তর দেন: “হে নবী নন্দিনী! আমি কিছুই করিনি; এমতাবস্থায় তুমি কী চাও?” হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: “তুমি কি আমায় আমার বাবার বাড়ি যাবার অনুমতি দেবে?” তিনি উত্তর দেন: “আমি অনুমতি দেবো।” অতঃপর হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) নিজের জিলবাব পরে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে যান। [সূত্র: ইবনে বাবাভীহ আল-ক্বুম্মী প্রণীত ‘এলাল আল-শারাএ’, ১৬৩ পৃষ্ঠা; আরো বর্ণিত হয়েছে ‘বিহার আল-আনওয়ার’, ৪৩-৪৪ পৃষ্ঠা, ‘আলী (ক:)’র সাথে তাঁর জীবন কেমন ছিলো’ অধ্যায়; বঙ্গানুবাদকের নোট: শীয়া ওয়েবসাইট-টি যথারীতি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই লেখায় প্রদত্ত কোনো রেফারেন্স যাতে না পাওয়া যায় সে উদ্দেশ্যেই হবে]
চতুর্থতঃ – যা এ বিতর্কের অবসান ঘটাবে চূড়ান্তভাবে – তা হলো এই বাস্তবতা যে, এ ঘটনাটি শীয়া ধর্মীয় মতবাদের উৎসগুলোতেও উল্লেখিত হয়েছে। চিরায়ত শীয়া ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ শায়খ মুফীদ লেখেন:
(ইতিপূর্বে) আমীরুল মো’মেনীন (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) বন্দীদের মধ্য হতে একজন জারিয়া দাসীকে পছন্দ করেন। এমতাবস্থায় হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে প্রেরণ করেন। তিনি (হযরত খালেদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: “রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে যাও সেনাবাহিনী সেখানে পৌঁছুবার আগেই। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) খুমস্ (গনীমতের রাষ্ট্রীয় অংশ) হতে নিজের জন্যে জারিয়া দাসী বেছে নিয়ে যে আত্মসম্মানের হানি করেছেন, সে সম্পর্কে তাঁকে জানাও..।”
হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সামনে হাজির হন। তাঁর সাথে ছিলো হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর একটি চিঠি যা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো। তিনি হুজূরের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কাছে তা পড়া আরম্ভ করেন। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র চেহারা মোবারকে পরিবর্তন দেখা দেয়।
হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আপনি যদি মানুষকে এভাবে (করার) অনুমতি দেন, তাহলে তাদের গনীমত অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “হে বোরায়দা, তোমার জন্যে আফসোস। তুমি তো কপটতা সংঘটন করেছো। আমি যে গনীমতের অংশের হক্কদার, তা হতে আলী ইবনে আবী তালেব-ও অংশ পাওয়ার হক্কদার। বোরায়দা, আমি তোমাকে সতর্ক করছি এ মর্মে যে তুমি আলীর প্রতি বৈরীভাব পোষণ করলে আল্লাহও তোমাকে অপছন্দ করবেন।”
হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন: ওই সময় আমার ইচ্ছে হয় যেনো জমিন দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যাক এবং আমি ওর অভ্যন্তরে গ্রাস হয়ে যাই। অতঃপর আমি বলি, “আমি আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর রুদ্ররোষ হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), আমায় ক্ষমা করুন। আমি আর কখনোই হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহূ)’র প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করবো না এবং তাঁর সম্পর্কে শুধু ভালো বলবো।”
প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ক্ষমা করে দেন। [শায়খ মুফীদ প্রণীত ‘কিতা’ব আল-ইরশা’দ’, ১১১-১১২ পৃষ্ঠা;