দোযখের বর্ণনা
জাহান্নামের আগুন কেমন হবে?
আল্লাহ্ তা’আলার আদেশে মালেক ফেরেশতা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় গজবের দ্বারা সাতটি দোযখ সৃষ্টি করেছেন। এর প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্যও প্রস্থ আকাশ ও পাতালের পার্থক্যের সমতুল্য। তা এমনই ভীষণ অগ্নিতে পরিপূর্ণ যে, এর এক সরিষা পরিমাণ অগ্নি যদি দুনিয়ার সর্ববৃহৎ পর্বতের উপরে স্থাপন করা যায়, তবে তা সম্পূর্ণ ভষ্মিভূত হয়ে দোযখের অগ্নি পুনরায় দোযখে চলে আসবে।
সর্বমোট সাতটি দোযখ আছে। এর প্রত্যেকটির ভেতরে ৭০ হাজার করে অগ্নির পর্বত আছে। প্রত্যেকটি পর্বতের সাথে ৭০ হাজার করে দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার ভেতরে ৭০ হাজার করে গৃহ আছে, প্রত্যেক গৃহের ভেতরে ৭০ হাজার করে কোঠা আছে, প্রত্যেক কোঠায় ৭০ হাজার করে বিরাট বিরাট অগ্নির সিন্দুক আছে। প্রত্যেক সিন্দুকের ভেতরে ৭০ হাজার করে বৃহৎ বৃহৎ সাপ ও বিচ্ছু আছে। এই সাপ ও বিচ্ছু কাউকে একবার দংশন করলে হাজার বৎসর পর্যন্ত তার যন্ত্রণা অব্যাহত থাকবে, অথচ ওরা দোযখবাসীদিগকে অনবরত দংশন করতে থাকবে। দোযখের কতগুলো অংশ যেমন অগ্নিতে পরিপূর্ণ, ঠিক তেমনই কতক অংশ বরফে পরিপূর্ণ।
ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! দোযখ প্রতি বৎসর দুবার করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। একটি অগ্নির ও অপরটি বরফের। তারই ফলে দুনিয়াতে শীত ও গ্রীষ্মের আবির্ভাব হয়। দোযখবাসীদিগকে যে পোষাক পরিধান করানো হয়, তার একখণ্ড যদি দুনিয়ার মধ্যস্থানে ঝুলায়ে দেয়া যায়, তবে এর উত্তাপ ও দুর্গন্ধে দুনিয়ার যাবতীয় প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হবে। দোযখবাসীগণ একটু শীতল বায়ুর প্রার্থনা করলে এক প্রকার ভীষণ উত্তপ্ত ও দুর্গন্ধময় বিষাক্ত বায়ু প্রবাহিত করা হবে। সেই বিষাক্ত বায়ু তাদের শরীরে ভীষণ জ্বালা-যন্ত্রণার সৃষ্টি করবে এবং নিঃশ্বাসের সঙ্গে সেই বায়ু উদরে প্রবেশ করা মাত্র উদরেও ভীষণ যন্ত্রণা আরম্ভ হবে।
দোযখবাসীদিগকে এক প্রকার কণ্টক বৃক্ষ আহার করতে দেয়া হবে তা এত তিক্ত যে, তার একখণ্ড যদি কোন সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয় তবে সমুদ্রের যাবতীয় পানি তিক্ত ও বিষাক্ত হয়ে যাবে। দোযখীদিগকে যে জিঞ্জির দ্বারা বন্ধন করা হবে, তার একটি যদি দুনিয়ার কোন পাহাড়ের উপরে স্থাপন করা হয়, তবে পাহাড় তার ভার সহ্য করতে না পেরে সপ্তস্তর মাটির নীচে দাবিয়া যাবে। ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! দোযখের শাস্তির কত বর্ণনা আপনার নিকট বলব। হযরত আদম (আঃ)-এর খাদ্য পাক করার জন্য জিব্রাঈল ফেরেশতা আমার নিকট হতে এক সরিষা পরিমাণ অগ্নি চেয়ে নিয়ে পর্বতের উপরে রেখেছিলেন, তাতেই সে পর্বত ভষ্ম হয়ে দোযখের অগ্নি দোযখে ফিরে এসেছিল । শুধু সেই অগ্নির যে ধূয়া অবশিষ্ট ছিল, তা হতেই দুনিয়ার অগ্নির সৃষ্টি হয়েছে। এতেই বুঝতে পারেন যে, দোযখের অগ্নির তেজ কত প্রখর।
দোযখবাসীগণ পিপাসায় কাতর হয়ে ঠাণ্ডা পানি প্রার্থনা করলে তাদেরকে উত্তপ্ত পানি ও দুর্গন্ধময় পুজ পান করতে দেয়া হবে। তা পান করা মাত্র তাদের পেটে ভীষণ যন্ত্রণা আরম্ভ হবে ও পেটের নাড়ীভূড়ি খসে পড়বে। পাপী লোকদিগকে দোযখে নিক্ষেপ করলে তাদের হাত পা তাদিগকে তিরষ্কার করে বলবে যে, দুনিয়াতে যেমন আল্লাহ্ নাফরমানী করেছ, আজ তেমনই তার ফল ভোগ কর। দোযখীগণ উত্তাপে অস্থির হয়ে বৃষ্টির প্রার্থনা করলে তাদের উপরে যে বৃষ্টিপাত হবে, তা ভীষণ উত্তপ্ত হবে এবং তার প্রত্যেক ফোটা পানি বন্দুকেরগুলির ন্যায় তাদের উদরে প্রবেশ করবে এবং তারা ভীষণ যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকবে। তদুপরি সেই বৃষ্টির সাথে অসংখ্য বড় বড় সাপ ও বিচ্ছু পতিত হয়ে তাদের শরীর কামড়িয়ে ধরবে।
এগুলো এত বিষাক্ত যে একবার দংশন করলে হাজার বৎসর পর্যন্ত তার যন্ত্রণা অব্যাহত থাকবে। এত কষ্টের ভেতরেও দোযখে কারও মৃত্যু হবে না। এই সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা কোরআন শরীফে বলেছেন “লাইয়ামুতু ফিহাওয়াল ইয়াহইয়া”। অর্থাৎ সেখানে তারা মরিবও না বাচবেও না।
আল্লাহ্ তা’আলা মোট সাতটি দোযখ সৃষ্টি করেছেন। যথাক্রমে একটি অপরটির নিম্নে সজ্জিত আছে। একটি হতে অপরটির দুরত্ব একটি দ্রুতগামী অশ্বের সহস্র বৎসরের রাস্তা এবং একটি হতে অপরটির আযাবের পরিমাণ ৭০ গুণ অধিক, যে দোযখ যত অধিক নীচে অবস্থিত সেই দোযখের আযাবের পরিমাণও যথাক্রমে ততো অধিক ।
জাহান্নাম কয়টি ও কী কী?
(১) হাবীয়াহ
(২) ছায়ীর
(৩) সাকার
(৪) জাহীম
(৫) হুতামা
(৬) লাজা
(৭) ওয়াইল
সাতটি দোযখের নাম এবং কোনটিতে কাদের অবস্থান
(১) হাবীয়াহ : যাবতীয় কাফেরও মুশরিকগণ এ দোযখে অবস্থান করবে।
(২) ছায়ীর ঃ মুনাফিকগণ এ দোযখে বাস করবে।
সাকার জাহান্নামে কারা যাবে ?
(৩) সাকার : দেবদেবী ও মূর্তির উপাসকগণ এ দোযখে বাস করবে।
(৪) জাহীম : শয়তান তার দলবল ও অগ্নির উপাসকগণ এ দোযখে বাস করবে।
(৫) হুতামা : এ দোযখ ইয়াহুদীদের চির বাসস্থান।
(৬) লাজা : খ্রিস্টানগণ এ দোযখে বাস করবে।
(৭) ওয়াইল : এ দোযখের নাম বলে মালেক ফেরেশতা নীরব হলে হযরত রাসূলুল্লা (সাঃ) বললেন, হে ভাই মালেক। সপ্তম দোযখের অধিবাসী কারা, তাতো বললেন না? তখন মালেক ফেরেশতা একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আপনার উম্মতগণের মধ্যে যারা মহাপাপে লিপ্ত হবে, তারাই এ দোযখে বাস করবে। মালেক ফেরেশতার মুখে একথা শ্রবণ করে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে মালেক! আমার উম্মতগণও যে দোযখে যাবে তা আমার ধারণা ছিল না। মালেক ফেরেশতা উত্তর করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আপনার উম্মতগণের প্রতি আল্লাহ তা’আলার এত অধিক মেহেরবাণী রয়েছে যে, তারা জীবনে যত অধিক পাপের কাজই করুক না কেন, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও যদি তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের গুণাহ মাফ করে তাদিগকে বেহেশতে প্রদান করবেন । শুধু যারা সম্পূর্ণ বিনা তওবায় মরে যাবে, তারাই ওয়াইল দোযখে বাস করবে। এ কথা শ্রবণ করে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিছুটা আশ্বস্ত হলেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দোযখ দর্শন
মালেক ফেরেশ্তা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপনি দোযখ দর্শন করতে ইচ্ছা করেন কি? হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্মতি জানালে মালেক ফেরেশতা দোযখের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, দোযখের দ্বার উন্মুক্ত হলে আমি একবার মাত্র দোযখের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। দোযখের প্রতি দৃষ্টি পতিত হওয়া মাত্রই আমার মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তীত হয়ে গেল। দোযখের অগ্নির প্রখরতা ও তার তাপ এত ভীষণ, যে তার প্রকৃত বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় এবং স্বচক্ষে দর্শন না করলে কেহ তা বুঝতেও পারবে না। দোযখের মধ্যে অসংখ্য সাপ, বিষ্ণু এবং আযাবের বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে। দোযখের সর্পগুলো উটের মত এবং বিচ্ছুগুলো গাধার মত বৃহৎ। উক্ত সাপ ওবিচ্ছুর বিষ এত তীব্র যে, যদি তাদের বিষের এক ফোঁটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হত, তবে সমুদ্রের যাবতীয় পানি বিষাক্ত হয়ে যেত। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার মাত্র দোযখের প্রতি দৃষ্টিপাত করবার পরেই আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে মালেক ফেরেশতা দোযখের দ্বার বন্ধ করেছিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে দোযখের দ্বার বন্ধ করে দেয়ার কারণ এই যে, দোযখের যাবতীয় আযাব যদি তিনি দর্শন করতেন তবে কিছুতেই তিনি তা সহ্য করতে পারতেন না।