প্রশ্নঃ নেকীবদীর পাল্লা বা মিযান বলতে কী বুঝায়? হিসাব নিকাশ বা জিজ্ঞাসাবাদের পূর্বে আমল ওজন করা হবে- নাকি পরে? পুলসিরাতের পূর্বে- নাকি পরে ওজন করা হবে? কার কার আমল ওজন করা হবে?
উত্তরঃ মিযান শব্দটির দুটি অর্থ আছে। একটি হলো ইছমে আলা- এর অর্থ। আরেকটি হলো মাস্দারের অর্থ। ইছ্মে আলা হলে তার অর্থ হবে- ওজনের যন্ত্র, পরিমাপক যন্ত্র বা পাল্লা। বাংলায় বলা হয় দাঁড়িপাল্লা। আর মাস্দার হলে তার অর্থ হবে- ওজন করা- তা যেভাবেই হোক্না কেন। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে দাঁড়িপাল্লা ছাড়াও অন্যভাবে ওজন করতে পারেন। এখানে পাল্লা অর্থেই মিযান শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
২য় প্রশ্নের উত্তর হলোঃ জিজ্ঞাসাবাদের পরেই আমল পূনঃ ওজন করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদ বা মোহাছাবা-র উদ্দেশ্য হবে নেকীবদী প্রমাণ করা এবং ওজন করার উদ্দেশ্য হবে- নেকী বদীর পরিমাপ করা। সুতরাং মোহাছাবা, হিসাব নিকাশ ও জিজ্ঞাসাবাদের পরেই পূনঃ নেকীবদীর পরিমাপ ঠিক করার জন্য তা ওজন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা কুরতুবী (রহঃ) বলেন,
قال العلماء: واذا انقض الحساب۔ کان بعدہ وزن الاعمال۔ لان الوزن للجزاء فینبغی ان یکون بعد المحاسبۃ۔ فان المحاسبۃ لتقدیر الاعمال۔ والوزن لاظھار مقادیرھا۔ لیکون الجزاء بحسبھا۔ قال اللّٰہ تعالی۔ ونضع الموازین القسط لیوم القیامۃ۔ فلا تظلم نفس شیئا وان کان مثقال حبۃ من خردل۔ اتینا بھا۔ وکفی بنا حاسبین ۔
অর্থাৎঃ বিশেষজ্ঞ উলামাগণের অভিমত হলো- হিসাব নিকাশ করার জন্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারপর পূনঃ ওজন করা হবে। তারপর ফয়সালা করা হবে। এই ওজন করার পদ্ধতিকেই মিযান, মাওয়াযীন ইত্যাদি নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ওজন করা হবে প্রতিদানের উদ্দেশ্যে। সুতরাং হিসাব নিকাশ বা জিজ্ঞাসাবাদের পরেই তা হওয়া বাঞ্চনীয়। কেননা, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ভালমন্দ আমল নির্ধারন করার উদ্দেশ্যে, আর ওজন করা হয় ভালমন্দ পরিমাপ করার জন্য- যাতে সে মোতাবেক প্রতিদান নির্দ্ধারন করা যায়। “এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন- আমি ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে কিয়ামতের দিনে মানদন্ডসমূহ স্থাপন করবো। সুতরাং কারও প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবেনা। যদি কোন আমল (ভালমন্দ) সরিষার দানার পরিমানও হয়- আমি তা উপস্থিত করবো। আর হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ঠ”। (সুরা আম্বিয়া ৪৭ আয়াত)।
৩য় প্রশ্নের উত্তর হলোঃ পুলসিরাতের পূর্বে মিযান স্থাপন করা হবে। এটা হবে দ্বিতীয় পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষা ছিল জিজ্ঞাসাবাদ বা যোগ জিজ্ঞাসার পর্যায়। পুল্সিরাত অতিক্রম করা হবে ফাইনাল অগ্নিপরীক্ষা। (হাশর, মিযান ও পুলসিরাতের পরীক্ষার সময় যেন নবীজীর সাহায্য ও শাফাআত আমাদের নসীব হয়- আমীন। )
৪র্থ প্রশ্নের উত্তর হলোঃ আয়াত ও কোন কোন হাদীস দ্বারা বাহ্যিকভাবে বুঝা যায় যে, গুনাহ্গার, মোমেন, কাফের এবং মুশরিক সকলেরই আমলের ওজন করা হবে। যেমন- সুরা ক্বারিয়াহ্ ৬-৯ আয়াত, সুরা আ’রাফ ৯ নম্বর আয়াত, সূরা মুমিনুন ১০৫ নম্বর আয়াত এবং সুরা আম্বিয়ার ৮৭ আয়াত পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, গুনাহ্গার মুমিনদের সাথে কাফির এবং মুশরিকদের আমলও ওজন করা হবে। সুরা ক্বারিয়ার ৬-৯ আয়াত হচ্ছে,
فَأَمَّا مَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ – فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَّاضِيَةٍ – وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ – فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ
অর্থঃ যার নেকীর পাল্লা ভারী হবে- সে সুখী জীবন যাপন করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে- তার ঠিকানা হবে হাবিয়া” (প্রজ্জ্বলিত অগ্নি)।
সূরা আরাফ- এর ৯ নম্বর আয়াত হচ্ছে,
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَٰئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُم
অর্থঃ “যাদের পাল্লা হাল্কা হবে, তারা এমন লোক- যারা নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করেছে”।
সূরা মুমিনুন- এর ১০৫ নং আয়াত হলোঃ
أَلَمْ تَكُنْ آيَاتِي تُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ فَكُنتُم بِهَا تُكَذِّبُونَ
অর্থঃ আল্লাহ্পাকের পক্ষ হতে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলা হবেঃ “তোমাদের নিকট কি আমার আয়াত সমূহ পাঠ করা হতো না? অতঃপর তোমরা তাকে মিথ্যা বল্তে”। (সুরা মোমিনুন ১০৫ আয়াত ১৮ পারা)।
সুরা আম্বিয়া ৪৭-আয়াত হলোঃ
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا
অর্থঃ কিয়ামাতের দিন ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে আমি মানদন্ড (মিযান) স্থাপন করবো। সুতরাং কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবেনা”। (সূরা আম্বিয়া ৪৭ আয়াত)।
ব্যাখ্যাঃ উক্ত ৪টি আয়াত ও অন্যান্য আয়াত দ্বারা ওলামাগণ বলেছেন- উক্ত আয়াত সমূহে কাফিরদের আমলসমূহ ওজন করার প্রতিই স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
কিন্তু ইমাম গাযালীর দীর্ঘ বর্ণনায় পূর্ব অধ্যায়ে বলা হয়েছে- কাফিরদের কোন হিসাবই হবে না। (দেখুন ৩৬ অধ্যায়- তাদেরকে বিনা হিসাবে জাহান্নামে প্রেরন করা হবে। আর ৪৯০ কোটি মুমিনেরও হিসাব হবে না। প্রমান নীচে দেখুন)।
নোটঃ ইমাম গাযালী বলেন- ৭০,০০০ x ৭০,০০০ = ৪৯০, ০০০০০০০ (চারশত নব্বই কোটি)। লোকের হিসাব হবেনা এবং আমলের ওজনও হবেনা। বিচার আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই তাঁরা বিনাহিসাবে ও বিনা ওজনে নবীজীর শাফাআতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আরবী এবারত নিম্নরূপ,
قال ابو حامد : والسبعون والسبعون الالف الذین یدخلون بلا حساب لا یرفع لھم میزان ولا یأخذون صحفا
ইমাম গাযলী (রহঃ) বলেন- ৭০,০০০ x ৭০,০০০ = ৪৯০, ০০০০০০০ (চারশত নব্বই কোটি) লোক যারা বিনা হিসাবে বিচারের পূবেই জান্নাতে প্রবেশ করবেন- তাঁদের জন্য ওজনের মানদন্ড উত্তোলন করা হবে না এবং তাঁদের আমলনামাও দেখা হবে না”। (আত- তাযকিরাহ্ পৃঃ ৩৩৮)
অতএব বুঝাগেল- কিছু খাস লোকের হিসাব হবেনা। অনুরূপভাবে কাফিরদের আমলেরও হিসাব বা ওজন হবে না।
(১) ভাল মন্দ ওজনের খন্ড খন্ড চিত্রঃ (মিযান)
ইমাম বুখারী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন- রাসুল করিম (ﷺ) এরশাদ করেছেন- কাফেরদের সৎকাজ ওজনযোগ্য নয়ঃ
عن ابی ھریرۃ۔ عن النبی ﷺ۔ قال: انہ لیأتی الرجل العظیم السمین یوم القیامۃ۔ لا یزن عند اللّٰہ جناح بعوضۃ۔ واقرأوا ان شئتم۔’’ فلا نقیم لھم یوم القیامۃ وزنا‘‘۔
অর্থাৎঃ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)- এর মাধ্যমে বর্ণিত হাদীসে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- “কিয়ামতের ময়দানে একজন মোটা তাজা ও বিরাট শরীরধারী লোক আসবে- অথচ আল্লাহর নিকট তার ওজন একটি মশার ডানার সমানও হবেনা”।
নবী করীম (ﷺ) বলেন- ইচ্ছা করলে তোমরা এ প্রসঙ্গে আল্লাহর কালামের একটি আয়াতাংশ পড়ে দেখতে পারো- তা হচ্ছে-
فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا
অর্থাৎঃ (যারা আল্লাহর সম্মুখে সাক্ষাতের বিরোধীতা করে নিষ্ফল হয়ে যাবে) “অতএব আমি কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোন গুরুত্বই স্থির করবো না”। অর্থাৎ- “তাদের কোন গুরুত্বই দেয়া হবে না এবং তাদের কোন মূল্যায়নই করা হবে না”। (সূরা কাহাফ ১০৫ আয়াতাংশ)।
অত্র হাদীসে বুঝাগেল- কাফিরদের আমলের কোন ওজন হবে না। অত্র আয়াতেও হাদীসের প্রতি সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে।
উলামায়ে কেরাম অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন- “কাফিরগণ তাদের দুনিয়াবী কোন সৎকর্মেরই প্রতিদান পাবে না এবং মিযানেও তার কোন ওজন হবে না বা মূল্যায়ন হবে না। আরো বুঝা যাচ্ছে যে, তাদের এমন কোন সৎকর্ম নেই যে, তা মিযানের পাল্লায় ওজনের যোগ্য হবে। আর যার কোন গ্রহণযোগ্য সৎকর্মই নেই- তার ঠিকানা হবে বিনা হিসাবে জাহান্নাম”।
এ মর্মে সাহাবী হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে-
یؤتی باعمال کجبال تھامۃ۔ فلا تزن شیأ
অর্থাৎঃ “তিহামা পর্বতসম সৎ কাজ উপস্থিত করা হবে- অথচ তা ওজন বা মূল্যায়নের কোন যোগ্যই হবে না”।
ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত হাদীসে বিরাট বপু বা নাদুস নুদুস লোকের প্রতি এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, সে দুনিয়াতে উদরপূর্তি ও আমোদ আহ্লাদে থেকে আল্লাহর স্মরণ হতে গাফেল ছিল। সুতরাং প্রয়োজনের অতিরিক্ত খানাপিনায় আসক্ত লোক তাদের দেহকে জাহান্নামের লাক্ড়ী হিসাবেই ব্যবহৃত হওয়ার উপযুক্ত করে মাত্র। তাদের আমলের কোন ওজন হবে না। বিনা হিসাবে ও বিনা ওজনে তারা জাহান্নামী। ইমাম গাযালীর কথাই সঠিক।
(২) মিযান কয়টি হবে? একটি- না কি বহু?
আল্লাহ্পাক কোরআন মজিদে মিযান শব্দটি বহু বচনে ব্যবহার করেছেন। যথা- ৮ পারা সুরা আ’রাফ ৯ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেনঃ
وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ
“যাদের মিযানের পাল্লাসমূহ হাল্কা হবে”। এখানে مَوَازِينُ বহুবচনেরও বহু বচন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন مفاتیح কে جمع الجموع হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এতে বুঝা যায়- এক একজনের এক এক ধরণের আমলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মিযান বা নিক্তি হবে। বুঝা গেল- মিযান অনেক হবে।
অন্যরা বলেছেন- হাদীসেপাকে মিযান শব্দটি একবচনেই এসেছে। এতে বুঝা যায়- সবার জন্য একটিমাত্র মিযান হবে। ঐ মিযানেই সবার আমল ওজন করা হবে।
তাদের দলীল হলো- আল্লাহর কালামে বহুবচন ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হলো মিযানের শানমান বর্ণনা করা যে, একটিমাত্র মিযানে একই সময়ে এত লোকের আমল ওজন করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। সুতরাং একটি মিযানই শত মিযানের সমান। যেমন- কোরআন মজিদে এক বচনকে বহুবচনে উল্লেখ করার নযির হলো- ১৯ পারা সুরা শুয়ারা ১০৫ নম্বর আয়াত- যেমন,
كَذَّبَتْ قَوْمُ نُوحٍ الْمُرْسَلِينَ
অর্থাৎঃ “নূহের সম্প্রদায় রাসুলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল”। এখানে مرسل এক বচনের পরিবর্তে مرسلین বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে- অথচ উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন রাসুল- তথা নূহ্ আলাইহিস সালাম। নিজের শান বয়ান করার উদ্দেশ্যে “আমি” না বলে “আমরা” শব্দ ব্যবহার করার রীতি বাংলা ভাষায়ও আছে। তদ্রুপ مرسل না বলে مرسلین ব্যবহার করা হয়েছে।
সিদ্ধান্তঃ ইমাম কাস্তুলানী (রহঃ) বলেন- এক মিযান- এর বর্ণনাই সঠিক এবং ইহার উপরই অধিকাংশের ঐক্যমত্য রয়েছে। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া পৃষ্ঠা ৬৬০-৬৬১)। ইমাম কুরতুবী বলেন- موازین শব্দটি میزان এর বহুবচন নয়- বরং موزون শব্দের বহুবচন। সুতরাং মিযান হবে একটিই- কিন্ত ওজনকৃত আমল হবে বহু। ইহাই موازین শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা।
(৩) মিযান কোথায় স্থাপন করা হবে?
এ প্রসঙ্গে হাকীম তিরমিযি তাঁর নাওয়াদিরুল উসূল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
اختلف فی کیفیۃ وضع المیزان۔ والذی جاء فی اکثر الاخبار ان الجنۃ توضع عن یمین العرش۔ والنار عن یسار العرش۔ ثم یؤتی بالمیزان۔ فتنصب بین یدی اللّٰہ تعالی ۔ فتوضع کفۃ الحسنات مقابل الجنۃ۔ وکفۃ السیأت مقابل النار ۔
অর্থঃ “মিযান বা পাল্লা বসানোর স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে অধিকাংশ হাদীস ও বর্ণনায় যা এসেছে- তাহলো- জান্নাত স্থাপন করা হবে আরশের ডান দিকে, দোযখ স্থাপন করা হবে আরশের বাম দিকে এবং মিযান স্থাপন করা হবে আরশ অধিপতি আল্লাহ্ তায়ালার সম্মুখে। ” নেক আমল সমূহ রাখা হবে জান্নাতের দিকের মিযান বা পাল্লায়- অর্থাৎ ডান পাল্লায় এবং বদ আমল সমূহ রাখা হবে দোযখের দিকের পাল্লায়- অর্থাৎ বাম পাল্লায়।
(৪) মিযানের পাল্লায় কি হুবহু আমল সমূহ রাখা হবে- নাকি আমলনামা বা রেকর্ডপত্র রাখা হবে? এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।
(৪-ক) একদল ওলামা বলেন- হুবহু আমলই রাখা হবে মিযানের পাল্লায়। যেমন- নামায, রোযা ও অন্যান্য নেককাজসমূহ রাখা হবে ডান পাল্লায় এবং চুরির মাল, যুলুম, অন্যায় ও অন্যান্য বদ আমলগুলো হুবহু রাখা হবে বামের পাল্লায়। উনারা বলেন- আমলসমূহ যদিও অদৃশ্য বা নির্জীব- কিন্তু হাশরের দিনে নামায, রোযা, চুরি, ডাকাতি, ইত্যাদি রূপক আকৃতিতে হাযির হবে এবং ইহা আল্লাহর কুদরতের আওতায় রয়েছে।
(৪-খ) অন্য একদল উলামার মতে হুবহু আমল নয়- বরং তার বিবরণী বা সহিফা বা আমলনামাই ওজন করা হবে। তাঁদের প্রমান হলো- “হাদীসে বাত্বাকা” -অর্থাৎ ﷺ শরীফের কাগজ বা রেকর্ড। নবী করীম (ﷺ) যখন উক্ত কাগজ নেকীর পাল্লায় রাখবেন, তখন নেকীর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। এই হাদীসখানা শাফাআত অধ্যায়ে হুবহু বর্ণনা করা হয়েছে- (ইমাম তিরমিযি কর্তৃক সংকলিত)। বুঝা গেল- হুবহু ﷺ নয়- বরং দরূদের রেকর্ড পাল্লায় ওজন করা হবে।
(৪-গ) ইমাম তিরমিযি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনে আছ (রাঃ) থেকে একখানা মারফু’ হাদীস এভাবে বর্ণনা করেছেন- যাকে “হাদীসে বাত্বাক্বা” বলা হয়। উক্ত বাত্বাক্বায় কলেমা শাহাদাত লিখা থাকবে।
(৫) হাদীসে বাত্বাকাঃ (কালেমার বাতাক্বা)
عن عبد اللّٰہ بن عمروبن العاص ص یرفعہ بلفظ: ان اللّٰہ یستخلص رجلا من امتی علی رؤوس الخلائق یوم القیامۃ۔ فینشر علیہ تسعۃ وتسعین سجلا۔ کل سجل منھا مثل مد البصر۔ ثم یقول: اتنکر من ھذا شیأ ؟ اظلمک کتبتی الحافظون؟ فیقول: لا۔ یارب ۔ فیقول: او لک عذر؟ فیقول: لا۔ یا رب۔ فیقول: بلٰی۔ ان لک عندنا حسنۃ۔ وانہ لا ظلم علیک الیوم۔ فیخرج بطاقۃ۔ فیھا ’’اشھد ان لا الہ الا اللّٰہ وان محمدا عبدہ ورسولہ‘‘۔ فیقول: احضر وزنک۔ فیقول: یارب۔ ما ھذہ البطاقۃ مع ھذہ السجلات؟ فقال: انک لا تظلم ۔ قال : فتوضع السجلات فی کفۃ۔ والبطاقۃ فی کفۃ۔ قال: فطاشت السجلات۔ وثقلت البطاقۃ۔ فلا یثقل مع اسم اللّٰہ شئی۔
অর্থাৎঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনে আস্ (রাঃ) মারফু” শব্দাবলী দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেছেন- নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন- “আল্লাহ্ তায়ালা কিয়ামতের দিন প্রকাশ্যে আমার উম্মতের এক ব্যক্তিকে খালাস দিবেন এভাবে- তার সামনে নিরানব্বইটি বদ্ আমলের দপ্তর তুলে ধরা হবে। এক একটি দপ্তরের দৈর্ঘ হবে দৃষ্টিসীমানা পর্য্যন্ত। এরপর আল্লাহ্পাক তাকে জিজ্ঞেস করবেন- তুমি কি এর কোন একটি অস্বীকার করো? আমার কিরামান কাতেবীন কি তোমার উপর যুলুম করেছে? তখন সে ব্যক্তি বলবে- না, অস্বীকার করি না এবং ফিরিস্তাদ্বয়ও আমার প্রতি কোন প্রকার যুলুম করেনি। আল্লাহ্পাক পুনরায় প্রশ্ন করবেন- তোমার কি এতে কোন আপত্তি আছে? ঐ ব্যক্তি বলবে- না, হে প্রতিপালক! কোন ওযর- আপত্তি নেই। তখন আল্লাহ্পাক বলবেন- হাঁ, আমার নিকট তোমার অন্য একটি নেক আমল একান্ত গোপনে আছে। তোমার উপর আজ কোন যুলুম করা হবে না। এ বলে আল্লাহ্পাক এক টুকরা “ছোট্ট কাগজ” বের করবেন- তাতে লেখা আছে। “আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু”।
তারপর আল্লাহ্পাক বলবেন- তোমার ওজনের পাল্লায় হাযির হও। বান্দা বলবে- হে রব! এই ছোট্ট টুকরাটি এতগুলো বদ্ দপ্তরের সাথে কেন? আল্লাহ্ বলবেন- “তোমার উপর কোন যুলুম হবে না”।
নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন- তার নিরানব্বই পাপের দপ্তর রাখা হবে এক পাল্লাতে, আর এই ‘টুকরাটি’ রাখা হবে অন্য পাল্লাতে (নেকীর পাল্লাতে)। হুযুর (ﷺ) এরশাদ করেন- অতঃপর তার ৯৯ দপ্তরের পাল্লা হাল্কা হয়ে যাবে এবং কাগজের ছোট্ট টুকরার পাল্লাটি ভারী হয়ে যাবে। আল্লাহর পবিত্র নামের বিপরীতে অন্য কিছু ভারী হতে পারে না”।
(ইমাম তিরমিযি বলেছেন- এই হাদীসটি হাসান। মুসতাদ্রাক হাকেম বলেছেন- এই হাদীসখানা সহীহ। ইমাম বায়হাকীর অভিমতও তাই। এছাড়াও ইবনে মাজাহ্ এবং ইবনে হিববান এই হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন)।
সুব্হানাল্লাহ্। আল্লাহ্ দয়া করবেন শেষ কলেমার আমল দিয়ে এবং নবীজী দয়া করবেন ﷺ শরীফের টুক্রা দিয়ে। উভয়টির নামই “বাত্বাকা”। হে আল্লাহ্! আমরা তোমার ও তোমার হাবীবের দয়া প্রার্থী। (মাওয়াহিব পৃষ্ঠা ৬২১)। নবীজীর দরূদের কাগজের টুকরার নাম বাত্বাকা এবং কলেমা শাহাদাতের কাগজের টুকরার নামও বাত্বাকা। সোব্হানাল্লাহ্! এতে বুঝা গেল- হুবহু আমলের ওজন হবেনা- বরং রেকর্ড ওজন করা হবে। আরো বুঝা গেল- শেষ কলেমা নসীব হলে সব গুনাহ্ মাফ।
(৫) নেকী ও বদী সমান সমান হলে কি হবে?
এ প্রসঙ্গে ইমাম গাযালী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন- কিয়ামত দিবসে এমন এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে- যার আরেকটি নেকী হলে নেকীর পাল্লা ভারী হতো। বর্তমানে তার নেকী- বদী সমান সমান। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ দয়া করে তাকে বলবেন- মানুষের কাছে গিয়ে দেখ- কেউ তোমাকে একটি নেকী দেয় কিনা। তাহলে আমি ঐ একটি নেকীর দ্বারা তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবো। সে তখন একটি নেকীর তালাশে বের হয়ে যার কাছেই একটি নেকী সাহায্য চাইবে- সে-ই অস্বীকার করবে। অন্য এক পাপী ব্যক্তি তার এ অবস্থা দেখে বলবে- আমার একটিমাত্র নেকী আছে। এটি দিয়ে তো আমার মুক্তি হবে না। তাই এটি তুমি নিয়ে মুক্তি লাভ করো। সে ঐ একটি নেক আমল নিয়ে খুশী মনে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে তা পেশ করবে। তখন আল্লাহ্পাক তাকে বলবেন- তোমার খবর কি? সে ঘটনা খুলে বলবে। আল্লাহ্পাক দয়া করে ঐ দাতা গুনাহ্গার ব্যক্তিকে ডেকে বলবেন- তোমার দয়া ও দানের চেয়ে আমার দয়া ও দান অনেক বিস্তৃত। যাও! তোমার ভাইয়ের হাত ধরে তোমরা উভয়ে জান্নাতে প্রবেশ করো”। (মাওয়াহিব পৃষ্ঠা ৬৬৩)। এ মর্মে পূর্বেও একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে হিসাব নিকাশ অধ্যায়ে। এটি হবে দয়া। বিচারের পরেই দয়া বা গবৎপু পিটিশন দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
(৬) নেকীবদী বরাবর হওয়ার আরেকটি ঘটনা
এ প্রসঙ্গে ইমাম গাযালী (রহঃ) একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন- “এক ব্যক্তির নেকীবদীর পাল্লা সমান সমান হবে। আল্লাহ্পাক তাকে বলবেন- তুমি না-জান্নাতী, না-জাহান্নামী! এমন সময় একজন ফিরিস্তা একটি ছোট্ট টুকরা তার বদীর পাল্লায় রাখবে। তাতে বদীর পাল্লাটি ভারী হয়ে যাবে। ঐ টুকরাতে লেখা রয়েছে উহ্ (اف) শব্দ। অর্থাৎঃ সে পিতা মাতার অবাধ্য। মা-বাপ তার আচরনে উহ্ বল্তো। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার আদেশ হবে।
তখন সে অনুরোধ করবে- তাকে আল্লাহর সামনে নিয়ে যাওয়া হোক। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ হতে হুকুম আসবে- তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাও। আল্লাহ্ তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন- হে পিতামাতার অবাধ্য সন্তান! তুমি কোন্ উদ্দেশ্যে আমার কাছে আসতে চেয়েছিলে? সে বলবে, হে আল্লাহ্! আমি যখন জাহান্নামের দিকে যাচ্ছিলাম- তখন দেখি- আমার পিতাও জাহান্নামের দিকে যাচ্ছেন। “হে আল্লাহ্! তুমি আমার পিতার গুনাহ্ আমাকে দিয়ে তাঁকে মাফ করে দাও”!
নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন- তার কথা শুনে আল্লাহ্ খুশীতে হেসে ফেলবেন এবং বলবেন- দুনিয়াতে তুমি তার সাথে দুর্ব্যবহার করে আখেরাতে এসে সৎব্যবহার করছো? যাও- তোমার পিতার হাত ধরে আমার দয়ায় উভয়ে জান্নাতে চলে যাও”। (মাওয়াহিব পৃষ্ঠা ৬৬৩)।
ব্যাখ্যাঃ ৫ ও ৬ নম্বরে বর্ণিত ঘটনা দুটি ব্যতিক্রমধর্মী ও বিশেষ ধরণের ছাড় এবং তা ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইহা সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত আল্লাহর দয়ার দৃষ্টান্ত মাত্র। সবাই যেন এ আশায় বসে না থাকে (এম.এ. জলিল)।
(৭) পাল্লাভারী বা হাল্কা হওয়ার ধরন কি রকম হবে?
এ প্রসঙ্গে কোন কোন তাফসীর ও হাদীস বিশারদ বলেন- দুনিয়ার নিয়মে পাল্লা ভারী হওয়ার অর্থ নীচের দিকে ঝুঁকে পড়া; আর হাল্কা হওয়ার অর্থ উপরের দিকে উঠে যাওয়া। কিন্ত হাশরের ময়দানে তার বিপরীত হবে। অর্থাৎঃ পাল্লা ভারী হলে উপরের দিকে উঠে যাবে- আর হাল্কা হলে নীচের দিকে ঝুঁকে পড়বে।
আল্লামা যারকাশী ভিন্নমত পোষন করে বলেন- ভারী ও হালকা দুনিয়ার নিয়মেই হবে। আল্লাহ্পাক ভারী হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন- ছুরা ক্বারিয়ায়। সুতরাং উহা নীচের দিকেই ঝুঁকবে। ভারী জিনিস নীচের দিকেই ঝুঁকে।
(৮) সব আমল ওজন হবে- নাকি শেষ আমল?
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট তাবেয়ী ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রহঃ) বলেন- শেষ আমলই ওজন করা হবে এবং এর উপরই নির্ভর করবে শান্তি বা শাস্তি। কেননা, রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) এরশাদ করেছেন-
انما الاعمال بالخواتیم
অর্থাৎঃ “শেষ আমলের উপরই নাজাত নির্ভরশীল”। (বুখারী হাদীস নম্বর ৬৬০৭)। এটা তাঁর ব্যক্তিগত নিজস্ব অভিমত। হিসাব হবে জাররা জাররা।
(৯) মানব সেবার কারনে নবীজী সুপারিশ করবেন-
এ প্রসঙ্গে হাফিযুল হাদীস আবু নোয়াঈম হযরত নাফে’ থেকে- তিনি হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন,
ان رسول اللّٰہ ﷺ قال: من قضی لاخیہ المؤمن حاجۃ۔ کنت واقفا عند میزانہ ۔ فان رجح ۔والا شفعت لہ۔
অর্থঃ হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি তার অপর মুমিন ভাইয়ের একটি বৈধ হাজত পূর্ন করবে- আমি তার মিযানের পাল্লার কাছে দাঁড়িয়ে দেখবো। যদি নেকীর পাল্লা ভারী হয়ে যায়- তাহলে তো কোন কথা নেই। কিন্তু যদি হাল্কা হয়- তাহলে আমি তার ঐ মানব সেবার বিনিময়ে তার জন্য সুপারিশ করবো” (এবং তাকে জান্নাতে নিব)। (আবু নোয়াঈমের হিল্ইয়া)।
(১০) ﷺ শরীফের মাধ্যমে নেকীর পাল্লা ভারী হবে (হাদীসে বাত্বাক্বা)
এ প্রসঙ্গে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেনঃ
وفی الخبر۔ اذا خفت حسنات المؤمن۔ اخرج رسول اللّٰہ ﷺ بطاقۃ کالانملۃ۔ فیلقیھا فی کفۃ المیزان الیمنی۔ التی فیھا الحسنات فیقول ذلک العبد المؤمن للنبی ﷺ: بابی انت وامی۔ ما احسن وجھک وما احسن خلقک۔ من انت؟ فیقول؟ انا نبیک محمد۔ وھذہ صلاتک علی۔ التی کنت تصلی۔
অর্থঃ নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন- যখন মোমেনের নেকীর পাল্লা হাল্কা হয়ে যাবে- তখন (আমি) আল্লাহর রাসুল পীপীলিকার ন্যায় ছোট্ট একটি কাগজের টুকরা বের করে তার নেকীর পাল্লায় রেখে দিবেন। এতেই তার নেকীর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। ঐ মোমেন ব্যক্তি আল্লাহর নবীকে (আমাকে) উদ্দেশ্য করে বলবে- আপনার চেহারা কতই না সুন্দর, আপনার চরিত্র কতই না উত্তম ! আমার পিতামাতা আপনার উপর কোরবান হোক! আপনি কে? নবী করীম (ﷺ) তখন বলবেন- “আমি তোমার দয়াল নবী এবং এটি তোমার ﷺ”। (ইতিপূর্বেও ৪ (খ)-তে একবার উল্লেখ করা হয়েছে)। দয়াল নবীর দয়া দেখুন!
হে আল্লাহ্! আমাদেরকে বেশী বেশী ﷺ পড়ার তৌফিক দাও এবং হাশরে হুযুর (ﷺ) -এর শাফাআত আমাদের নসীব করো! আমীন।
(১১) জ্বীন জাতির হিসাব নিকাশ ও আমলের ওজন হবে কি- না?
প্রথম মতঃ এ প্রসঙ্গে আল্লামা কুরতুবীর নিজস্ব মতামত তুলে ধরা হলো।
(ক) তাঁর মতে- জ্বীন ইনসান সবার-ই হিসাব কিতাব হবে। আল্লাহ্পাক যেসব আয়াতে ঈমানদারদের জন্য জান্নাত ঘোষনা করেছেন- এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নাম ঘোষনা করেছেন ঐসব আয়াতে জ্বীন ও ইনসান সবাই অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং জ্বীন জাতিও জান্নাতে অথবা জাহান্নামে যাবে। (দেখুন আর রহমান সূরা ৩১, ৩২, ৩৩ আয়াত)।
(খ) অন্যত্র আল্লাহ্পাক বলেছেন- হে জ্বীন ও ইনসান জাতি, তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসুলগণ তাশরীফ নিয়ে যাননি? তাঁরা কি আমার আয়াতসমূহ তোমাদেরকে শুনাননি? তাঁরা কি তোমাদেরকে আজকের দিনে আমার সম্মূখে উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করেননি? তারা বলবে- হ্যাঁ, আমরা নিজের উপর সাক্ষ্য দিচ্ছি। (দেখুন সূরা আন্আম ১৩০ আয়াত)।
(গ) আল্লাহ্পাক অন্য আয়াতে এরশাদ করেছেন- “আমি জাহান্নামের জন্য অনেক জ্বীন ও ইনসানকে তৈরী করেছি- যাদের বোধশক্তি থেকেও বুঝেনা, চক্ষু থাকা সত্বেও সত্য দেখেনা, কর্ন থাকা সত্বেও সত্য উপদেশ শুনেনা। তারা পশুর চেয়েও অধম”। (দেখুন সূরা আ’রাফ ১৭৯ আয়াত)।
এসব আয়াতের দ্বারা প্রমানিত হচ্ছে যে, পরকালে জ্বীনদেরও হিসাব নিকাশ হবে এবং মানুষের মত তারাও জান্নাতে অথবা জাহান্নামে যাবে। তদুপরি- নবী করিম (ﷺ) এক হাদীসে এরশাদ করেছেন- “তোমরা গোবর ও হাড্ডি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করোনা। কেননা, এগুলো হচ্ছে পরিবর্তিত রূপে তোমাদের ভাই জ্বীন জাতির খোরাক। বুঝা গেল- জ্বীন জাতি আমাদের ভাই এবং পরকালে আমাদের মতই তাদের পরিনতি হবে।
দ্বিতীয় মতঃ অন্য একদল উলামা বলেছেন- কোরআন মজিদে জ্বীনদের জন্য শুধু জাহান্নামের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। জান্নাতের বেলায়, হিসাব নিকাশের বেলায়, মিযানের বেলায় জ্বীন জাতির কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। সুতরাং দুষ্ট ও কাফির জ্বীনেরা জাহান্নামে যাবে ঠিকই- কিন্ত নেক্কার ও মুমিন জ্বীন জাতি জান্নাতে যাবে না। জান্নাত হলো আদম সন্তানের জন্য। কোরআন ও হাদীসে আদম সন্তানের জন্যই জান্নাতের হুর ও অন্যান্য নেয়ামতের কথা উল্লেখ আছে। জ্বিনদের পুরষ্কার হবে শুধু শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া। তাদেরকে মাটিতে পরিনত করা হবে। ইমাম কুরতুবীর দলীল হলো নিজস্ব যুক্তি ভিত্তিক- কোরআন-সুন্নাহ্ ভিত্তিক নয়। সুতরাং অনুমান করে জান্নাতবাসী ঘোষণা করা ঠিক নয়।
বিঃ দ্রঃ মুসলামানদের ৭২ ফের্কার মধ্যে একটি যুক্তিবাদী গোমরাহ্ দল আছে। তাদেরকে মো’তাযিলা বলা হয়। তারা হিসাব নিকাশ ও মিযান অস্বীকার করে। তাদের মতে আমল কোন এমন বস্তু নয় যে- ওজন দেয়া যাবে, বা প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা যাবে। সুতরাং, এগুলোকে রূপক অর্থে ধরে নিতে হবে। তারা গোম্রাহ্ দল। তাদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। হিসাব সত্য, মিযানও সত্য।