সংকলন, সম্পাদনা ও ব্যাখ্যাঃ
Masum Billah Sunny
▪ ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রাঃ) বলেন,
হাদীস জানার চেয়েও হাদীসের সঠিক ব্যখ্যা জানা উত্তম।
[সূত্র-জামিউ বারামিল ইলমি ওরা কাদলিহী-২-১৭৫ পৃ]
▪ ইমাম আবু হানীফা (রাঃ) বলেন,
যে ব্যক্তি হাদীস অন্বেষণ করল অথচ হাদীসের সঠিক ব্যখ্যা জানল না, সে তার সকল পারিশ্রমকে মাটি করে দিলো এবং নিজের উপর বিপদ ডেকে আনলো।
[সূত্র-মানাকিবু ইমাম আবু হাণীফা-৩৭৭ পৃ:]
▪ হাদিসের অপব্যাখ্যার জবাব ১ :
➖➖➖➖➖➖➖➖➖
عن انس قال لم يكن شخص احب اليهم من رسول الله صلى الله عليه وسلم وكانوا اذا رأوه لم يقوموا لما يعلمون من كراهيته لذالك، رواه الترمذي___
অর্থঃ- হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে সাহাবীগণ সকল কিছুর চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন, অথচ তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতেন, তখন দাঁড়াতেন না, কারণ সাহাবীগণ জানতেন যে, তিনি ইহা অপছন্দ করতেন।
[সুনানে তিরমিজি]
হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
➖➖➖➖➖
ব্যাখ্যা ১ :
বিশ্ব বিখ্যাত তফসীরে জালালাইন ও তফসীরে রুহুল বয়ানে এর ব্যাখ্যা সরূপ যা আছে তার মূলভাব এমন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে তার জন্য অবশ্যই মানুষকে দাঁড়ানো উচিত কিংবা দাঁড়াতে হবে তবে ঐ ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো না জায়েজ। এমন কি যদি কেউ অহংকার বশত বলে যে, তাকে সালাম দিতেই হবে তাকে সালাম দেয়া না জায়েজ। এসব হাদিস মূলত নম্রতার শিক্ষা।
ব্যাখ্যা ২ :
সাহাবীগণ দাড়াতেন না, কারণ তাঁরা জানতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা অপছন্দ করেন। এর কারণ হল আরবের কিছু সংখক অহংকারী-গর্বকারী-দাম্ভিক নেতাদের বিরোধিতা করার জন্য। এই দাম্ভিকতার রীতি উৎখাত করার জন্য তিনি ইহা অপছন্দ করতেন। শুধু তাই নয়, বরং সাহাবীগণ অধিক জোরালোভাবে অগ্রাধিকার দিতেন, যেন তাঁরা নিজেরা আরবের অহংকারী-দাম্ভিকদের-
দাঁড়ানোর নিয়ম, খাওয়ার নিয়ম, বাসার নিয়ম, পান করার নিয়ম, পোষাক পরার নিয়ম, হাঁটা চলার নিয়ম, সকল প্রকার কাজের নিয়ম এবং তাদের চরিত্র, আচরণ পরিহার করে আর সকল প্রকার (ইসলামী শরীয়ত বিরোধী) নিয়মের বিরোধিতা করে।
[তুহফাতুল আহয়াযী বি শারহে জামিউত তিরমিজি, বৈরুত লেবাননের ছাপা, ৮ম খন্ড, ২৯ পৃষ্ঠা]
▪ হাদিসের অপব্যাখ্যার জবাব ২ :
➖➖➖➖➖➖➖➖➖
عن معاوية قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من سره ان يتمثل له الرجال قياما فليتبوا مقعده من النار، رواه ابي داود___
অর্থঃ- হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হতে বর্নিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি এটায় আনন্দ পায় যে, তার জন্য লোকজন মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকুক,
তাহলে সে যেন জাহান্নামের মধ্যে তাহার বাসস্থান নির্ধারণ করিয়া নেয়।
[সুনানে আবু দাউদ]
হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
➖➖➖➖➖
[যে ব্যাক্তির অহংকার বশত ইচ্ছা পোষণ করবে, আমার জন্য সকলেই দাঁড়িয়ে থাকুক, সে ব্যাক্তি জাহান্নামী]
ব্যাখ্যা ১ :
কারো সম্মানে মূর্তির মত সোজা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ।
ব্যাখ্যা ২ :
আরবের লোকদের অভ্যাস ছিল তাহারা তাহাদের মনিব, বাদশাহ কিংবা অহংকারী সরদারদের সম্মুখে অন্তত বিনয়ের সহিত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিত। ইহা ছিল তাদের চরম লৌকিকতা আর ঘোর ইসলাম বিরোধী শিষ্টাচার। কারণ ইসলাম ধর্মে অহংকার মানেই হারাম।
ব্যাখ্যা ৩ :
অনেক সাহাবী মূর্তিপূজা ছেড়ে যখন নতুন ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তখন আরবের রেওয়াজ ও নিয়ম অনুযায়ী অবনত মস্তকে অত্যন্ত অনুনয়-বিনয়ের সাথে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই নিয়মে দাঁড়াতে কঠোরভাবে নিষেধ করিয়েছেন।
ব্যাখ্যা ৪ :
▪ ফতুহুল বারী শরহে সহীহুল বুখারীতে, ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ) তিনি ইমাম নববী (রহঃ) থেকে এর ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন, এই হাদীসের জবাবে বলেন,
وفي فتح الباري قال النبووي في الجواب عن ﻫﺬﺍ الحديث:- لا حاجة الي ما سواء ان معناه زجر المكلف ان يجب فيام الناس له، قال وليس فيه تعرض للقيام بنهي ولا غيره وهذا متفق عليه___
অর্থঃ কোন প্রয়োজন ছাড়া শুধু শুধু কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারে এজন্যই এতো কঠোর নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে কারণ মানুষগণ যাতে তাঁর জন্য অন্যের দাঁড়ানোকে ওয়াজিব বা অপরিহার্য মনে না করে।”
▪ ইমাম নববী (রহঃ) আরো বলেন,
“উক্ত হাদিসে এটা নিষেধ করে নি যে,
কেউ আসলে তার জন্য (সম্মানার্থে) দাঁড়িয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ এবং অন্যান্য প্রকারের কিয়ামকেও নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর এটাই ইমাম বুখারী এবং মুসলিম (রহঃ) বর্ননা করেছেন।”
[১. আওনুল মা’আবুদ আলা শরহে সুনানে আবু দাউদ, বৈরুত লেবাননের ছাপা, ১ম খন্ড, ২৩৭০ পৃষ্ঠা
২. ইবনে হাজর আসকালানীঃ ফতুহুল বারী শরহে সহীহুল বুখারী]
ব্যাখ্যা ৫ :
মানুষের মধ্যে কিছু কিছু লোকের এই স্বভাব আছে যে, সে কোথাও গেলে লোকজন তাহার সাম্মানে উঠে যদি দাঁড়িয়ে যায় তাহলে সে অহংকার বশত নিজেকে অন্যান্যদের চেয়ে অনেক সম্মানিত মনে করে আর সে এই কাজকে খুব পছন্দ করে।
সে এটা কামনা করে যে লোকজন তাকে দেখে সবাই দন্ডায়মান হউক এবং তাহাকে কুর্নিশ করিয়া অভ্যর্থনা জানানো হউক। ইহাতে সে ব্যক্তি নিজের মধ্যে আনন্দ ও খুশি অনুভব করে। যা কিনা অহংকারের বহিঃপ্রকাশ।
আর যদি এমন ব্যক্তির জন্য কেউ না দাঁড়ায়, তবে সে ব্যক্তি রাগ হয় এবং যে দাঁড়াল না তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করে তাহলে সে ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো না জায়েজ। আর সে ব্যক্তি অহংকারী বিধায় সে জাহান্নামী।
(অপর হাদিসে আছে, যা অন্তরে তিল পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।)
▪ হাদিসের অপব্যাখ্যার জবাব ৩ :
➖➖➖➖➖➖➖➖➖
عن ابي امامة قال خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم متوكئا علي عصا، فقمنا اليه، فقال :- لا تقومو كما يقوم الاعاجم ﻳﻌﻈﻢ بعضها ﺑﻌﻀﺎ، رواه ابي داود___
অর্থঃ- হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাঠিতে ভর করিয়া ঘর হতে বাহিরে আসিলেন, তখন আমরা তাঁহার জন্য দাড়িয়ে গেলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, তোমরা আজমী লোকদের মতো দাড়াইও না, আজমীরা যেভাবে একে অপরকে দাড়াইয়া সম্মান করে সেভাবে সম্মান প্রদর্শন করিও না।
[সুনানে আবু দাউদ]
হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
➖➖➖➖➖
ব্যাখ্যা ১ :
প্রথমত এই হাদিসের মান খুবই দুর্বল।
▪ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) বলেন,
এই হাদীসটি দুর্বল সনদ দ্বারা প্রমানিত কিনা তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত, কারণ এই হাদীসটির সনদের কোন পরিচয় নাই।
▪ ইবনে সা’আদ (রহঃ) তাবাকাত এর মধ্যে বলেন, এই হাদীসটি এমন দুর্বল হাদীস যা বাতিল, প্রত্যাখাত এবং অগ্রহণযোগ্য।
▪ ইমাম নাসায়ী (রহঃ) বলেন,
এই হাদীসটি যয়ীফ বা দুর্বল।
[আওনুল মা’আবুদ আলা শরহে সুনানে আবু দাউদ, বৈরুত লেবাননের ছাপা, ১ম খন্ড, ২৩৭১ পৃষ্ঠা।]
তাছাড়া আমাদের নিকট কিয়ামে তাজিমী সম্পর্কে আরো বহু দলিল রয়েছে। যেমনঃ
وفي حديث سعد دلالة علي ان قيام المرء بين بدي الرئيس الفاضل والوالي العادل وفيام المتعلم للمعلم مستحب غبر مكروه وقال البيهقي هذا القيام يكون علي وجه البر والاكرام كما كان قيام الانصار لسعد وقيام طلق لكعب بن مالك___
অর্থঃ- সা’আদ (রাঃ) এর হাদীসের মধ্যমে আরেকটি দলীল পাওয়া যায় যে,
কোন সম্মানিত মুরুব্বীর জন্য, ন্যায়-পরায়ণ বিচারকের জন্য, শাগরেদ উস্তাদের জন্য দাঁড়ানো মুস্তাহাব, ইহা মকরূহ নয়।
ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেন,
এই দাঁড়ানোটার মূল উদ্দেশ্য হল-
উক্ত ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণতা, উত্তম গুণ এবং উচ্চমর্যাদা এসবকিছু।
যেমনঃ আনসারগণ সা’আদ (রাঃ) এর জন্য সম্মানার্থে দাঁড়িয়েছিল এবং কা’ব ইবনে মালেক (রাঃ) এর সম্মানার্থে দাড়িয়েছিল।
ব্যাখ্যা ২ :
এই হাদীসে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে,
কাদের মত দাঁড়ানো নিষিদ্ধ? আজমীদের মত।
কেন তাদের মত দাঁড়ানো নিষেধ করেছিলেন?
কারণ এই আজমী জাতি নিজেদের বাদশাহের সামনে মাথা নত করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকত। তাই তাদের নিয়মে দাঁড়ানোকে নিষেধ করা হয়েছে। মূলত দাঁড়ানো নিষেধ নয় তাদের মত করে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ।
যেমনঃ হাদিসে নিষিদ্ধ আছে,
কুকুরের মত করে তোমরা নামাজে বসবে না,
কুকুরের মত করে (পুরুষরা বাহু বিছিয়ে দিয়ে) সিজদা করবে না। ইত্যাদি এর মানে এই নয় যে নামাজে বসতে মানা করা হয়েছে কিংবা সিজদা করতে মানা করা হয়েছে।