রোযা ইসলামী শরিয়তের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম তাৎপর্যবহ ইবাদত। সাইয়্যেদুনা হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম হতে সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলের শরিয়তেঐ তাঁদের উম্মতগণের উপর রোযা একটি ফরয এবাদত হিসেবে বিধিবদ্ধ ছিল। মানব সত্তার আত্মিক উৎকর্ষ ও দৈহিক সুস্থতা সাধনে রোযার অপরিসীম প্রভাব ও উপকারিতা রয়েছে। নামায, সাজদা ইত্যাদি ইবাদত ফিরিশতা, জিন্সহ অন্যান্য মাখলুক্বও সম্পন্ন করে থাকে। কিন্তু রোযা একমাত্র মানব জাতিরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। নাফ্স ও রূহ পরস্পর চরম শত্রু। পানাহার দ্বারা নাফ্স শক্তিশালী হয় এবং রূহ দুর্বল হয়। আর রোযা পালনের মধ্য দিয়ে রূহ শক্তিশালী হয়। তা দ্বারা রূহ পবিত্র, পরিশুদ্ধ ও উন্নত হয়। একবিংশ শতাব্দির চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এযুগেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে পরিকল্পিত উপায়ে পানাহার নিয়ন্ত্রণ অনেক রোগ-ব্যাধির মোক্ষম চিকিৎসা। আর তা সহজে অর্জিত হয় সিয়াম সাধনা বা রোযা পালনের মাধ্যমে। ওযূ-গোসল দ্বারা মু‘মিন নামায, ক্বোরআন তেলাওয়াত ও মসজিদে প্রবেশ ইত্যাদি ইবাদতের উপযুক্ত রূপে গণ্য হয়। অনুরূপ সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে বান্দা আল্লাহর দিদার-দর্শন লাভের যোগ্য বলে গণ্য হয়। নাফ্সের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ, আধ্যাত্মিক অগ্রগতি সাধন, ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত, অভাবী-অসহায়দের জ্বালা-যন্ত্রণা অনুধাবন করে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন, মানব মনে আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্যের জযবা সৃষ্টি ইত্যাদির ক্ষেত্রে রোযার কার্যকারিতা অপরিসীম। এ কারণে পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীস-ই রাসূলের মধ্যে ইখ্লাস নৎ একনিষ্ঠতার সাথে রোযা পালনের উপরও অতীব গুরুত্বারোপ করা হয়েছে-
রোযার সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
صوم আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা ও সরল-সোজা হওয়া ইত্যাদি। [তাফসীর-ই কবীর ও তাফসীর-ই নঈমী]
নিরবতা পালনকেও صوم বলা হয়। কেননা এক সময় পূর্ববর্তী কোন কোন শরীয়তে কথোপকথন থেকেঐ বিরত থাকা হতো। যেমন, পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে- اِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمنِ صَوْمًا অর্থাৎ- আমি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের মানসে صوم তথা কথোপকথন হতে বিরত থাকার মান্নত করেছি। [সূরা মার্য়াম]
আরবী ভাষায় দুপুরকেও صَوْمُ النَّهَارُ বলা হয়। কেননা, এ সময় সূর্য স্থির ও সোজা হয়ে যায়। আরবীতে আরো বলা হয়- صَامَ الرْفَرَسُ অর্থাৎ ঘোড়া দাঁড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ- চলার গতি ত্যাগ করেছে। [তাফসীর-ই কবীর ও তাফসীর-ই নঈমী]
ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় صوم এর সংজ্ঞা হলো- اَلصَّوْمُ هُوَ الْاِمْسَاكُ عَنِ الْاَكَلِ وَالشَّرْبِ وَالْجِمَاعِ نَهَارًا مَعَ النِّيَّةِ অর্থাৎ- মু‘মিন নর-নারীর সুবহি সাদিক্ব হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইবাদতের নিয়্যতে সকল প্রকার পানাহার ও স্ত্রী সহবাস তথা কামাচার থেকে বিরত থাকাকে শরীয়তের পরিভাষায় রোযা বলা হয়। [মুখতাসারুল কুদুরী ও তাফসীর-ই নঈমী]
উল্লেখ্য যে, صيام শব্দটি قيام এর ন্যায় মাসদার রূপেও ব্যবহৃত হয়। আবার صوم صيام – বহুবচনরূপেও ব্যবহৃত হয়। যেমন نائم এর বহুবচন نيام এবং قائم এর বহুবচন قيام ।
রোযার প্রকারভেদ
ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদ ফোক্বাহায়ে কেরাম ফিক্ব্হ শাস্ত্রের কিতাবসমূহে বর্ণনা করেছেন-রোযা প্রধানতঃ দু’প্রকার। ফরয রোযা আর নফল রোযা। [মুখতাসারুল ক্বুদুরী]
ফরয রোযা আবার দু’ভাগে বিভক্ত। যথা-
প্রথমতঃ ওই সকল ফরয রোযা, গ্গবণগ্ধমৎ আদায় করা নির্দিষ্ট সময়-কালের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন- মাহে রমযান শরীফের ফরয রোযা আর সুনির্দিষ্ট দিন-কালের সাথে সংশ্লিষ্ট মান্নতের রোযা।
এ সকল ফরয রোযা রাত্রিকালীন নিয়তের মাধ্যমেও শুদ্ধ হবে। আবার রাত্রিকালে ভুলবশতঃ নিয়্যত করা না হলে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পূর্বে নিয়্যতের মাধ্যমেও রোযা বৈধ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়তঃ ওই সকল ফরয রোযা, যেগুলো সম্পন্ন করার জন্য সময় নির্দিষ্ট নেই, মু’মিনের দায়িত্বে ওইগুলো বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। যেমন, মাহে রমযানের রোযার ক্বাযা আদায় করা, সাধারণ মান্নতের তথা সুনির্দিষ্ট সময়-কালের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন মান্নতের রোযা এবং বিভিন্ন প্রকারের কাফ্ফারার রোযা ইত্যাদি। এ সকল ফরয রোযা রাত্রিকালীন নিয়্যতের মাধ্যমেই একমাত্র শুদ্ধ ও বৈধ হয়। কেননা এসব রোযার জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে সময় নির্ধারিত নেই। তাই সুবহি সাদিক্বের পূর্বে নিয়্যত করার মধ্য দিয়ে সময়কে রোযার জন্য নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়।
নফল রোযা আবার দুই ভাগে বিভক্ত
যথা, ১. নফলে মাসনূন অর্থাৎ- সুন্নাতে রাসূলের আলোকে নফল এবং ২. নফলে মুস্তাহাব। দশ মুহারর্ম (আশূরা)’র রোযা, আইয়ূামে বীদ্ব তথা প্রতি চান্দ্র মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখের রোযা, আরফা-দিবসের রোযা, সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযা এবং পবিত্র শাওয়াল মাসের ছয় রোযা ইত্যাদি নফলে মাসনূনের রোযা। সকল প্রকার নফল রোযা সূর্যাস্তের পর হতে পরদিন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পূর্ববর্তী সময়ে নিয়্যত করার মধ্য দিয়ে শুদ্ধ ও বৈধ হয়। [আলমগীরী, দুর্রে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার]
এ ছাড়া অন্যান্য সময়ে স্বেচ্ছায় রোযা পালন করা নফলে মুস্তাহাব। উল্লেখ্য যে, বছরে পাঁচ দিন অর্থাৎ- দুই ঈদের দুই দিন, এগার, বার ও তের যিলহজ্জ, (আইয়্যামে তাশরীক্বে) রোযা রাখা সম্পূর্ণরূপে হারাম। [প্রাগুক্ত]
রোযা কবে ও কিভাবে ফরয হয়
ইসলামী আইন শাস্ত্র বিশারদ ফোক্বাহায়ে কেরাম ও হাদীস বেত্তাদের মতে, রোযা দ্বিতীয় হিজরীর দশ শাওয়াল পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় ফরয হয়।[দুররে মুখতার, তাফসীরে খাযা-ইনুল ইরফান ও খাযিন]
প্রথমে দশ মুহর্রম আশুরার একটি মাত্র রোযা ফরয হয়। পরবর্তীতে এ বিধান রহিত হয়ে প্রতি চান্দ্র মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখের, তথা আইয়ামে বীদ্বের রোযা ফরয হয়। এরপরে এ বিধান রহিত হয়ে মাহে রমযানের একমাসব্যাপী রোযা ফরয হয়; কিন্তু মু’মিনগণের এখতিয়ার ছিল- হয়তো রোযা পালন করবে অথবা প্রতিটি রোবার পরিবর্তে অর্ধ্ব সা’ পরিমাণ গম কিংবা তার মূল্য ফিদিয়া হিসেবে আদায় করবে। পরবর্তীকালে এ বিধানঐ রহিত হয়ে মাহে রমযান শরীফে রোযা পালন করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
রোযা ফরয হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ববর্তী শরীয়তের ন্যায় ইসলামেও ইফতারের পর হতে এশা তথা ঘুমিয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বৈধ ছিল। এ কঠোর বিধান সাহাবায়ে কেরামের উপর কষ্টকর হওয়ার কারণে পরবর্তীতে এটা রহিত হয়ে সুবহি সাদিক্বের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার বৈধ হয়। কিন্তু স্ত্রী সহবাস হারাম হিসেবে বলবৎ থাকে। একদা সাইয়েদুনা ওমর ফারুক্বে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এবং আরো কতিপয় সাহাবীর পক্ষ থেকে এশার নামাযের পর স্ত্রী সহবাসের ঘটনা ঘটে যায়। আমিরুল মু’মনীন সাইয়্যেদুনা ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু গোসল করে কান্নাকাটি করতে লাগলেন এবং নিজকে তিরস্কার করতে শুরু করলেন। অতঃপর রাসূলে খোদা হাবীবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে সাইয়্যেদুনা ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম! আপনার পবিত্রতম দরবারে আমি আমার অপরাধী ও অবাধ্য নাফসের ওযর পেশ করে আরয করছি যে, এশার নামাযের পর আমি স্বীয় স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছি। তখন আরো কয়েকজন সাহাবী দাঁড়িয়ে আরয করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! আমরাও উক্ত অপরাধে জড়িত হয়েছি। তখনই ক্বোরআন মজীদে নাযিল হয় اُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ اِلي نِسَآئَكُمْ الاية অর্থাৎ- রোযার রাত্রিকালে স্ত্রী সহবাস তোমাদের জন্য হালাল করা করা হয়েছে। [সূরা বাক্বারা, আয়াত- ১৮৭]
এটা দ্বারা অতীতের অপরাধের ক্ষমা এবং সুবহি সাদিক্বের পূর্ব পর্যন্ত স্ত্রী সহবাস হালাল হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। [তাফসীর-ই দুররে মানসূর, রূহুল মা’আনী, তাফসীর-ই নঈমী]
তাফসীরে দুররে মানসূর শরীফে উল্লেখিত আছে যে, নামাযের বর্তমান বিধান যেভাবে পর্যায়ক্রমে হয়েছে, তেমনি রোযা ফরয হওয়ার বেলায়ও। নামায সর্বপ্রথম মি’রাজ রজনীতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয হয়। অতঃপর সাইয়্যেদুনা মূসা কলীমুল্লাহ আলায়হিস সালামের আবেদনক্রমে রাসূলে করীম রঊফুর রহীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফরিয়াদের প্রেক্ষিতে নামাযের পরিমাণ কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়। প্রথমতঃ নামায প্রতি ওয়াক্ব্ত দুই রাক’আত করে ফরয করা হয়। পরবর্তীতে সফরের অবস্থায় দুই রাক’আত ফরয বহাল রাখা হয় এবং মুক্বীম অবস্থায় দুই রাক’আত বৃদ্ধি করে চার রাক’আত ফরয করা হয়।[তাফসীর-ই আহমদী ও দুররে মানসূর]