রহমত, ক্ষমা ও দোযখ থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে আগমন করেছে মহামান্বিত মাস ‘‘রমযানুল মুবারাক’’। যে মাসের সম্মানার্থে আল্লাহ তা’লা বেহেস্তের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেন, দোজখের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেন এবং অভিশপ্ত শয়তানকে বন্ধী করে রাখেন ।
এ মহান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আর কুরআন অবতীর্ণ হওয়া মানেই সকল প্রকার কল্যাণের সূচনা হওয়া। আল্লাহ তালা বলেন- “রমযান মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, মানব জাতির জন্য হিদায়ত (দিশারী) এবং সৎপথের সুষ্ঠু নিদর্শন ও সত্য-অসত্যের পার্থক্যকারী রূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম (রোযা) পালন করে। আর কেহ অসুস্থ কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না এ জন্যই যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে। এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার’’। [সূরা বাক্বারাহ, আয়াত-১৮৫]
মানুষের জীবনের কম বয়সে এবং অল্প সময়ের মধ্যে আল্লাহ তাআলা তার জন্য ভাল কাজের মৌসুম রেখেছেন। তার জন্য স্থান এবং কালের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে কাল ও স্থানের মাধ্যমে সে তার ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। সে সব বিশেষ মৌসুমের মধ্য থেকে অন্যতম একটি মৌসুম হল পবিত্র রমযান মাস।
এটি একটিমাত্র মাস যাকে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ,তবেতাবেয়ীন ও তাঁদের পরবর্তীরা খুবই আগ্রহ নিয়ে এ মাসের আগমনের অপেক্ষায় থাকতেন। মুয়াল্লা বিন ফদল বলেন- ‘‘ছালফে ছালেহীনগণ বৎসররের ছয় মাস ব্যাপী দোয়া করতেন রমযান পর্যন্ত পৌছার জন্য, আর বাকী ছয় মাস দোয়া করতেন রমযান কবুল করার জন্য”। তাঁরা বলেন- ‘‘মানুষ যদি জানতো রমযানে কি কল্যাণ নিহীত রয়েছে, তাহলে তারা কামনা করতো সারা বৎসর যেন রমযান হয়’’। আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও রজব মাস যখন প্রবেশ করতো তখন থেকে দোয়া করতেন: “হে আল্লাহ আমাদেরকে বরকত দাও রজব ও শাবান মাসে এবং পৌছিয়ে দাও আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত”।
প্রকৃতপক্ষে পবিত্র মাহে রমযান মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক প্রশিক্ষণ কোর্স, যার মাধ্যমে রোযাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র রমযান মাস ভালোভাবে যাপন করবে, তার সমগ্র বৎসর ভালোভাবে যাপিত হবে।’ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি ঈমান ও নিষ্ঠার সাথে রমযানের রোযারাখবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে” । [বুখারী] তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি রমযানে রাত জেগে ইবাদত করবে তথা তারাবীহ আদায় করবে তার অতীতের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে)। [বুখারী]
এ পবিত্র মাসে এমন এক মহিমান্বিত রাত রয়েছে যে রাতটি ১০০০(এক হাজার) মাসের চেয়েও উত্তম অর্থাৎ ক্বদরের রাত্রি। প্রিয় নবী এরশাদ করেন “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে ক্বদরের রাত্রি উদযাপন করেছে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে” [হাদিছ]
আর সিয়াম বা রোযা হলো ইসলামের পাচঁটি মূলস্তম্ভের অন্যতম একটি, যা একটি অত্যাবশ্যকীয় তথা ফরয ইবাদত। আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:- “হে মুমিনগন! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা মুত্তকী বা খোদাভীরু হতে পার। সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েকদিনের জন্য। তামাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ বা সফরে থাকলে, অন্য সময় এ সংখ্যা পূর্ণ করে নিতে হবে। আর যারা অক্ষম তাদের উপর কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদ্য়া- একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। যদি কেহ সেচ্ছায় সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য অধিকতর কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে!” [সূরা বাক্বারাহ ,আয়াত-১৮৩-১৮৪]
বুখারী ও সুসলিম শরীফে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: ‘‘মানবজাতির সব আমল তার নিজের জন্যই; প্রত্যেক পূণ্য কাজের ছাওয়াব দশগুণ থেকে শুরু করে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তালা বলেন- একমাত্র রোযা ব্যতিরেকে, কেননা তা হলো একমাত্র আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। কারণ সে (রোযাদার) তার প্রবৃত্তি, খাদ্য ও পানীয় পরিহার করেছে একমাত্র আমারই জন্য। রোযাদারের জন্য দুটি খুশি নির্ধারিত, একটি হলো- তার ইফতারের সময়, আর অন্যটি হলো বেহেস্তে স্বীয় রবের দিদার বা সাক্ষাত লাভের সময়। নিশ্চয় রোযাদারের মুখ থেকে নির্গত গন্ধ [যা পানাহার থেকে বিরত থাকার কারণে সৃষ্টি হয়] আল্লাহ তালার নিকট মেশক আম্বরের চেয়েও অধিক সুগন্ধময় [ বুখারী ও মুসলিম]
অর্থাৎ প্রত্যেক আমলের ছাওয়াব বৃদ্ধি পেয়ে সাতশত গুণ পর্যন্ত পৌছে কিন্তু রোযার ছাওয়াব অসংখ্য-অগণিত, মহান আল্লাহ তালা তার কুদরাতের হাতেই তার প্রতিদান দেবেন। আল্লাহর মালিকানা যেহেতু অসীম তাই তার দানও অসীম। কেননা রোযা হলো ছবর বা ধৈর্য্য, আর ধৈর্য্যরে প্রতিদান হলো- বেহেশÍ।
কারণ রোযার মধ্যে যে ইখলাছ বা নিষ্ঠা বিদ্যমান তা অন্য কোন ইবাদতে পাওয়া যায় না, তাই বলা হয় রোযার মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানো নেই। রোযাদার চাইলে সবার অজান্তে কিছু খেয়ে নিতে পারে কিন্তু আল্লাহ তালা দেখছেন এ বিশ্বাসের কারণে সে তা থেকে বিরত থাকে, তাই এ কাজকে আল্লাহ তালা নিজের জন্যই খাচ করে নিয়েছেন, এজন্য দেখা যায় যদি কোন ঈমানদারকে রোযা ভঙ্গ করার জন্য প্রহারও করা হয় তারপরও সে রোযাভাঙ্গতে রাজি হবে না, কেননা তার ঈমান হলো আল্লাহ তা’লা তা পছন্দ করেন না।
জেনে রাখা দরকার যে, শুধুমাত্র পানাহার ত্যাগের নাম রোযা নয় বরং সকল প্রকার নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হলো রোযা এবং সেই সাথে অন্তরকে করতে হবে পরিচ্ছন্ন, তবেই রোযা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। তাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অনুরূপ কাজ পরিহার করল না, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার মধ্যে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [ বুখারী]
তাই প্রত্যেক রোযাদারকে সকল প্রকার নিষিদ্ধ – বিশেষত: মিথ্যা. পরনিন্দা, হিংসা, গালাগালি, জুলুম ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে, আর তখনই রোযাদারের আসল ও প্রকৃত প্রতিদানে ধন্য হবে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন: ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগাল বা তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে¬ আমি রোযাদার’ (বুখারি ও মুসলিম)।
অতএব রোযাদারকে পানাহারের পাশাপাশি কান, চোখ, জবান, ও হাত-পা কে মিথ্যা ও নিষিদ্ধ কাজ ও কথা থেকে বিরত রাখতে হবে, অন্যথায় তা শুধুমাত্র উপবাস যাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “কিছু রোযাদার এমনও আছে যার রোযা থেকে তার প্রাপ্য হলো- শুধুমাত্র ক্ষুধা ও পিপাসা এবং কিছু এমনও আছে যার রাত জাগা থেকে প্রাপ্য হলো একমাত্র অনিদ্রা।” [ইবনে মাজাহ ও আহমদ]
সে ঐ ব্যাক্তি যে আহার বাদ দিল, কিন্তু গীবতের মাধ্যমে নিজের ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া থেকে বিরত হতে পারল না। পান করা থেকে বিরত থাকল কিন্তু মিথ্যা, ধোকা, মানুষের উপর অত্যাচার থেকে বিরত হল না। তাই সিয়ামের অর্থ হচ্ছে তাকওয়ার অনুশীলন, আর তাকওয়ার অনুশীলনই অপরাধমুক্ত সমাজ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার।
রমযান ধৈর্য ও সবরের মাস: এ মাসে ঈমানদার ব্যক্তিগণ সকল আচার-আচরণে যে ধৈর্য ও সবরের এত অধিক অনুশীলন করেন তা অন্য কোন মাসে বা অন্য কোন পর্বে করেন না। এমনিভাবে সিয়াম পালন করে যে ধৈর্যের প্রমাণ দেয়া হয় তা অন্য কোন ইবাদতে পাওয়া যায় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন “ধৈর্যশীলদের তো বিনা হিসাবে পুরস্কার দেয়া হবে। (সূরা যুমার : ১০) হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন-‘‘রোযা একমাত্র আল্লাহরই জন্য তাই তার প্রতিদান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা’’ । [তাবরানী]
রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ও তাঁর সাহাবারা অধিক পরিমাণে শক্তি, সজিবতা এবং ইবাদতের জন্য ধৈর্য ধারণ করার উদ্যম অনুভব করতেন, তাইতো রমযান মাসকে সৎকাজ, ধৈর্য ও দানের মাস বলা হয়। রমযান দুর্বলতা, অলসতা, ঘুমানোর মাস নয়। পূর্বেকার মুসলমানেরা রমযান যাপন করতেন তাদের অন্তর এবং অনুভূতি দিয়ে। রমযান আসলে তারা কষ্ট করতেন। ধৈর্যের সাথে দিন যাপন করতেন। আল্লাহর ভয় এবং পর্যবেক্ষণের কথা তাদের স্মরণ থাকত। তার সিয়াম নষ্ট হয় অথবা ত্রুটিযুক্ত হয় এমন সব কিছু থেকে দুরে থাকতেন। খারাপ কথা বলতেন না, ভাল না বলতে পারলে নীরব থাকতেন। তারা রমযানের রাত্রি যপন করতেন সালাত, কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের অনুসরণ করেই।
যেহেতু এ মাসের ইবাদত-বন্দেগির সাওয়াব অন্য মাসের ইবাদত-বন্দেগি থেকে কমপক্ষে ৭০ গুণ বেশি। সুতরাং আসুন এখনই আমরা রমযানের পুণ্যময় ইবাদত-বন্দেগির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিজের বিগত দিনের পাপতাপ মাফির এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করি।
রোজার ফযীলত পর্বঃ০২
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।