আল্লাহ হচ্ছেন অরূপ আর বান্দা হচ্ছে স্বরূপ। অরূপ ও স্বরূপের মধ্যে মিলন খুবই কঠিন। তার জন্য প্রয়াজন সেতুবন্ধন। আল্লাহ হচ্ছেন অসীম আর বান্দা হচ্ছে সসীম। অসীম আর সসীমের মিলনও খুবই জটিল। তাই এমন এক মধ্যস্থতার প্রয়োজন- যার একদিক রয়েছে অসীমের দিকে, অপর দিক রয়েছে সসীমের দিকে। অসীম ও অরূপ থেকে কিছু ফয়েয নিতে হলে মাধ্যম প্রয়োজন। বান্দার সাথে লেনদেনের জন্যই আল্লাহপাক অন্য প্রিয় বান্দাকে নির্বাচন করেন- তাদের মাধ্যমেই ঈমান দেন, নামায দেন, রোযা দেন, হজ্ব দেন, যাকাত দেন, শরিয়তের বিধি বিধান দেন- এক কথায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রদান করেন। আম্বিয়ায়ে কেরাম হচ্ছেন, আল্লাহ প্রদত্ত ফয়যে এলাহী প্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। তাই নবী ও রাসূলগণ হচ্ছেন মহামানব ও অতিমানব বা সুপারম্যান। তাঁদের মধ্যে যেমনি রয়েছে মানবীয় গুণাবলীর সমাবেশ তেমনিভাবে মালাকী ও হাক্কী গুণাবলীরও সমাবেশ। তাদের মধ্যে কখনও প্রকাশ পায় অতিমানবীয় গুণাবলী। তাই তাঁরা অন্যান্য মানুষের মত নন যদিও সূরতে ও আকৃতিতে মানব জাতিই বটে। (রুহুল বয়ান)।
নবীগনের মধ্যে বাশারী, মালাকী ও হক্কী গুণাবলীর সমাবেশ স্বীকার না করলে তাঁদের শানমান খাটা করা হয়- যা ঈমানের পরিপন্থী। বিষয়টি বাস্তব হলেও অতি দূর্বোধ্য এবং জটিল। তাই কিছু লোক বাহ্যিক আচরণ দেখে আমাদের প্রিয় নবীকে তাদের মত সাধারণ মানুষ বলে গণ্য করে। তাঁর অপর দুইটি দিক সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলে। এক ব্যক্তি বলেছে, তিনি শুধু বশর- ”আর কিছু নন”। জ্ঞানের অপ্রতুলতাও গভীরতার অভাবেই এরূপ বলতে পারে।
রাসূল প্রেরণের প্রয়োজনীয়তার আলোচনা করতে গিয়ে উপরের ভূমিকার অবতারণা না করে উপায় ছিলনা। কেননা, রাসূলগণকে কিছু দিয়েই প্রেরণ করা হয় -তা বান্দাকে দেয়ার জন্য। বান্দার সাথে আল্লাহর সেতুবন্ধন রচনা করার জন্য রাসূলগণ হচ্ছেন মাধ্যম।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- একটি মানব দেহে রূহ, ক্বলব বা হৃৎপিন্ড, শিরা, রগ ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে। তার মধ্যে রূহ হচ্ছে হায়াতের মূল। এই রূহ মানবদেহকে প্রতিপালিত করে- ক্বলব বা হৃৎপিন্ডের মাধ্যমে। ক্বলব বা হৃৎপিন্ড রক্ত সঞ্চালন করে রগ ও শিরার মাধ্যমে। আবার রগ ও শিরা রক্ত সঞ্চালন করে দেহের প্রতিটি অঙ্গে।
এখন দেখা যাচ্ছে, রগ ও শিরার মাধ্যমে ক্বলব বা হৃৎপিন্ড হতে দেহ রক্ত গ্রহণ করে। আবার হৃৎপিন্ড বা ক্বলব সতেজ ও সচল থাকে রূহের মাধ্যমে। দেহ, রগ, ক্বলব বা হৃৎপিন্ড এবং রূহ -এই বস্তু চতুষ্টয় এক জিনিস নয়। এগুলোর মধ্যে রূহ হচ্ছে হুকুমদাতা, ক্বলব হচ্ছে যোগানদাতা, রগ ও শিরা হচ্ছে বহণকারী এবং দেহ হচ্ছে গ্রহণকারী। মূল দাতা রূহ এবং গ্রহীতা দেহের মধ্যখানে ক্বলব, রগ ও শিরার যেই অবস্থান- ঠিক আল্লাহ ও বান্দার মধ্যখানে রাসূলগণের এবং অলীগণেরও সেই অবস্থান।
এবার আসুন আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সম্পর্কের কথায়। আল্লাহ অতি দূরে, ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আল্লাহ হচ্ছেন নূর আর বান্দা হচ্ছে অন্ধকার। আল্লাহ শক্তির আঁধার, বান্দা হচ্ছে দূর্বল। আল্লাহ ফয়েয দাতা, বান্দা ফয়েয গ্রহীতা। তাই আবদ ও মা’বুদ, খালেক ও মাখলুক, রব ও বান্দা, মোহতাজ ও বে-নিয়ায -এর মধ্যখানে এমন এক মাধ্যমের প্রয়োজন- যিনি প্রভু হতে ফয়েয নিতে পারেন এবং বান্দাকে দিতে পারেন। রূহের ফয়েয যেমন প্রথমে যায় ক্বলবে- তারপর রগও শিরায়, তারপর যায় দেহে- তদ্রূপ আল্লাহর যাবতীয় ফয়যে এলাহী প্রথমে বর্ষিত হয় আম্বিয়ায়ে কেরামের উপর, তারপর নবীজীর সাহাবী ও আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে- অন্যান্য বান্দার উপর বর্ষিত হয়। আগুণের তাপ প্রথমে লাগে তাওয়ার গায়ে, তারপর লাগে রুটিতে। সরাসরি রুটির গায়ে আগুন লাগলে রুটি পুড়ে যায়। আল্লাহর তাজাল্লী সরাসরি তুর পাহাড়ে পড়েছিল বলেই তো তুর পাহাড় জ্বলে গিয়েছিল। আল্লাহ হচ্ছেন আগুন স্বরূপ, নবী হচ্ছেন তাওয়া স্বরূপ এবং আমরা হচ্ছি রুটি স্বরূপ।
এটা বুঝার জন্য উদাহরণ মাত্র। নতুবা আল্লাহর শান কত ঊর্ধ্বে, নবীজীর শানও কত ঊর্ধ্বে। তাই কোন বান্দা রব পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে বা তার থেকে কিছু পেতে হলে অবশ্যই রাসূলের প্রয়োজন হয়। কেননা, রাসূল হচ্ছেন সিড়ি স্বরূপ। সিড়ি বেয়েই দোতলায় এবং উপরে উঠতে হয়। রাসূলের একদিক হচ্ছে মানুষের দিকে- অপর দিক হচ্ছে আল্লাহর দিকে। তিনি এক হাতে আল্লাহর থেকে আনেন- অন্য হাতে বান্দাদেরকে দান করেন।
واللّة يُعطى و أنا القاسم – “আল্লাহ হচ্ছেন দাতা আর আমি হলোম বন্টনকারী”। দুনিয়ার সংকট থেকে উদ্ধার পেতে হলে নবীজীর দামান (আঁচল) ধরতে হবে। এদিকে ইশারা করেই আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন –
واعتصموا بخبّل اللّه جميعا ولأتفرّ فؤا “তোমরা আল্লাহর রশিকে (নবীকে) মজবুত করে আঁকড়ে ধর এবং এই রশি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। (সূরা নিসা, ১০৩ আয়াত)।
কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন-
کی وفا تونے محمد سے تو ھم تیرتے هیں
یه جھاں چیز ھے کیا لوح و قلم تیرے ھیں
“তুমি যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ওয়াফাদার গোলাম হতে পারো- তাহলে আমিও তোমার পক্ষে আছি। এই পৃথিবী কোন ছার- তখন লওহ-কলমও তোমার হবে”। (জওয়াবে শিকওয়া)।
কত গভীর দর্শনের কথা এটি। কোরআন মজিদের ঐ আয়াতেরই কাব্যিক ব্যাখ্যা হচ্ছে ইকবালের এটি- যে আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন –
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ
”বলুন হে প্রিয় হাবীব! তোমরা যদি আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও- তাহলে আমার অনুসরণ করে- তাবেদারী করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন”। (সূরা আলে ইমরান, ৩১ আয়াত)।
কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন –
”ঐ নামেরি রশি ধরে- যেতে হবে খোদারি ঘরে,
নদী তরঙ্গে পড়েছে যে ভাই- সাগরেতে আপনে মিশে”।
কুপের নীচে থাকে কাদা ও ময়লা। তার উপরে থাকে স্বচ্ছ পানি। বালতিতে রশি বেঁধে স্বচ্ছ পানি তুলতে হয়। সেই পানিই পান করার যোগ্য। কাদা ও ময়লা তুলে আসলে সেই পানি হয় অপেয়। তদ্রূপ এই পৃথিবীও একটি গভীর কূপের ন্যায়। এখানে যেমন আছে সঠিক আক্বিদা ও নেক আমল স্বরূপ স্বচ্ছ পানি, তেমনিভাবে আছে খারাপ আক্বীদা ও খারাপ আমল স্বরূপ কাদাযুক্ত ময়লা পানি। স্বচ্ছ পানি পান করা যায়- চাষাবাদ করা যায়। কিন্তু ময়লাযুক্ত পানি- না পান করার উপযুক্ত- না চাষাবাদের উপযুক্ত। তদ্রূপ মান আক্বীদার স্বচ্ছ পানি দ্বারাও আখেরাতের চাষাবাদ হয় এবং বেঈমানির ময়লা পানি দ্বারা আখেরাতের ক্ষেতি বরবাদ হয়ে যায়। এই রশি ধরেই খোদার ঘরে যেতে হবে। এরই নাম হচ্ছে “হাবলুল্লাহিল মাতীন” বা মজবুত রশি। যে এই রশি ও দামানকে ধরেছে, সে আল্লাহর হাতকেই আঁকড়ে ধরেছে। তাই কোরআন পাকে ঘোষণা হয়েছে - إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ – “নিশ্চয়ই যারা আপনার কাছে বাইআত গ্রহণ করে, সে আল্লাহর কাছেই বাইআত গ্রহণ করে। তাদের হাতের উপর রয়েছে আল্লাহর কুদূরতের হাত” (সূরা আল-ফাতাহ, ১০ আয়াত)।