যাঁর শুভ আবির্ভাবে দ্বীন পেল নবজীবন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

যাঁর শুভ আবির্ভাবে দ্বীন পেল নবজীবন

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

কারো জন্মের স্বার্থকতা নির্নীত হয় সাধারণত তার জীবনের অনন্য, ফলপ্রসূ ও সুদূরপ্রসারী কর্ম ও অবদান দ্বারা। তাই অনেকের জন্মের সময় তাঁেদর জন্মের তাৎপর্য অনুভূত না হলেও তাঁদের জীবনের পরবর্তী সোপান গুলোতে সমাজে তা সূর্যের মতো প্রকাশ পায়। কারো কারো বেলায় দেখা যায় যে, তাঁদের শুভ জন্মের মুহূর্ত থেকেই এমন সব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, যেগুলো থেকে তাঁদের পরবর্তী অবদানগুলো ও অনন্য সাফল্যের আলামত প্রকাশ পায়। আবার এমন কিছু পবিত্র সত্তা পৃথিবীতে আবির্ভূত হন ও হয়েছেন, যাঁদের জন্মের পূর্ব থেকেই তাঁেদর শুভ আবির্ভাবের আনন্দ বার্তা ও আভাস বিভিন্নভাবে ঘোষিত ও প্রকাশিত হয়। যেমন, আমাদের প্রিয়নবী বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েই শুধু দুনিয়াকে আলোকিত করেননি, বরং তাঁর শুভ আবির্ভাবের বহুকাল পূর্ব থেকেই প্রতিটি যুগেই তাঁর শুভাগমনের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল। এ সুসংবাদও দিয়েছেন খোদ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবী ও রসূলগণের মাধ্যমে। অনেকে তো তাঁর শুভ আবির্ভাবের ওসীলা নিয়ে আল্লাহ্র দরবারে দো‘আ-প্রার্থনা করতো তাদের মনষ্কামনা পূরণের জন্য। ফলে তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হতো, এমনকি বড় বড় যুদ্ধেও জয়লাভ করতো! আমাদের আক্বা ও মাওলার শুভ জন্মের সময় প্রকাশ পেয়েছিলো অনেক অলৌকিক ঘটনা (ইরহাসাত) আর তিনি ছিলেন আপাদমস্তক মু’জিযা, তাঁর গোটা নূরানী জীবনে প্রকাশ পেয়েছিলো হাজার হাজার মু’জিযা। সর্বোপরি, তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, গোটা বিশ্বের জন্য রহমত, সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক আর সমস্ত সৃষ্টির উভয় জাহানের সাফল্যের মাপকাঠি, মানদণ্ড ও উসওয়া-ই হাসানাহ। আলহামদুলিল্লাহ্! বলাবাহুল্য, এজন্যই গোটা বিশ্বে বিশ্বনবীর শুভ জন্মের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অতি গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয় ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
আমাদের আক্বা ও মাওলা বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেই পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলাম ক্বিয়ামত পর্যন্তের জন্য বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন, ওই দ্বীনের স্বচ্ছ অবয়বে, ইতিহাসের এক পর্যায়ে, যখন নানা গোমরাহীর তমসা ছাইয়ে গিয়েছিলো, তখন ওই দ্বীনকে পুনর্জীবন দান করেছিলেন, বিশ্বনবীরই নূরে নযর বংশধর হযরত শায়খ আবদুল কাদের জীলানী, গাউসুল আ’যম, শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। এজন্য তাঁর অন্যতম মহান উপাধি ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী)।
তাই বিভিন্ন কারণে শায়খ-ই জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শুভ আবির্ভাব (শুভজন্ম) বিশ্বের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রবর্তিত দ্বীনও যেমন বিশ্ববাসীর জন্য অনন্য রহমত, তেমনি এ দ্বীনকে প্রতিটি শতাব্দিতে পুনরায় জীবিত করার জন্যও আল্লাহ্ তা‘আলা অগণিত মুজাদ্দিদ (সংস্কারক)ও পাঠিয়েছেন। আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

اِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهذِهِ الْاُمَّةِ عَلى رَاسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّ دُلهَا دِيْنَهَا-

অর্থাৎ- প্রত্যেক শতাব্দির শেষ প্রান্তে এ উম্মতের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা একজন মুজাদ্দিদ অবশ্যই প্রেরণ করেন, যে উম্মতের জন্য তার দ্বীনকে সজীব করে দেবে।
হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এমনই এক মহান মুজাদ্দিদও ছিলেন। তাঁর শুভ জন্ম হয়েছিলো ১লা রমযানুল মুবারক, ৪৭০ হিজরী, মোতাবেক ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ।
[আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, কৃত ইমাম হাফেয ইবনে কাসীর দামেস্কী, ওফাত ৭৭৪ হিজরী, মিরআতুল জিনান ওয়া ইবরাতুল ইয়াক্বাযান, কৃত ইমাম ইয়াফে‘ঈ, ওফাত ৭৬৮ হিজরী] তারপর তাঁর সংস্কারগুলোও সর্বজন বিদিত। শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শুভজন্ম এজন্যও তাৎপর্যপূর্ণ যে, তিনি ছিলেন ‘নজীবুত্ব ত্বরফাঈন’ অর্থাৎ পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়ে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত। স্বর্ণের খনিতে স্বর্ণই উৎপন্ন হয়। সাইয়্যেদুনা গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশীয় ধারা সম্মানিত পিতা সাইয়্যেদ আবূ সালেহ্ মূসা জঙ্গী-দোস্ত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাই তিনি পিতার দিক দিয়ে হাসানী সাইয়্যেদ। আর তাঁর মহীয়সী আম্মাজান হযরত উম্মুল খায়র ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার বংশীয় ধারা তাঁর পিতা হযরত সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ সাউমা‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে সাইয়্যেদুনা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত পৌঁছে। তাই তিনি মায়ের দিক দিয়ে হোসাইনী সাইয়্যেদ।
সুতরাং তিনি তো ‘মুহিউদ্দীন’ হবেনই। এদিকে ইঙ্গিত করে আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘হাদাইক্বে বখশিশ’-এ লিখেছেন-
تو حُسينى حَسَنِى كيوں نه محى الدين هو
ائے خضر مجمع بحرين هے چشمه تيرا

অর্থাৎ: ওহে গাউসুস্ সাক্বালাঈন ও মুগীসুল মালাওয়াঈন! আপনি তো ইমামাঈনে হুমামাঈন সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হযরত হাসান ও হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার সন্তান, যাঁরা নিজেদের তাজা রক্ত দিয়ে শাজারাহ্-ই তাইয়্যেবাহ্ ইসলামকে সিঞ্চিত করে সবুজ-সজীব করেছেন; নিজ জীবন বিসর্জন দিয়ে ইসলামকে স্থায়িত্ব দান করেছিলেন।
বস্তুত: এ দু’হযরতের পবিত্র রক্ত ধারা আপনার ধমেিত চলমান। এতদসত্ত্বে আপনি ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীনকে পুনর্জীবন দাতা) হবেন না কেন? এ কারণে পথভ্রষ্টদের হিদায়তদাতা আপনার ঝর্ণাধারা ফয়য ও বদান্যতার দু’সমুদ্রের সঙ্গমস্থলই। ওই কল্যাণধারা ও খোদা পরিচিতির দু’সমুদ্রও হচ্ছেন আপনার পূর্বপুরুষদ্বয় হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা।
হুযূর গাউস আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিজের বংশীয় ধারা সম্পর্কে বলেছেন- (اَنَا نَجِيْبُ الطَّرْفَيْنِ) অর্থাৎ আমি পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়েই সম্ভ্রান্ত। বস্তুত: তাঁকে ভ্রান্ত ইহুদী ও রাফেযী (শিয়া সম্প্রদায়) ব্যতীত দুনিয়ার সবাই ‘নজীবুত্ব ত্বরফাঈন’ বলে মেনে নেয়। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ‘ইমাত্বাতুল আযা- ‘আন গাউসিল ওয়ারা’ শিরোনামের পুস্তকে দেখুন!
শাহানশাহে বাগদাদ হলেন ‘মুহিউদ্দীন’
সাইয়্যেদুনা গাউসুল আ‘যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র অগণিত লক্বব (উপাধি) রয়েছে। তাঁর একটি বরকতমণ্ডিত লক্বব (উপাধি) হচ্ছে ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীন ইসলামকে পুনর্জীবিতকারী)। তাঁর এ উপাধি কীভাবে হলো সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন- কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো- আপনার উপাধি ‘মুহিউদ্দীন’ কিভাবে হলো? তিনি বললেন, আমি ৫১১ হিজরীতে খালি পায়ে বাগদাদের দিকে আসছিলাম। পথিমধ্যে এক অসুস্থ, কৃষকায় ও ফ্যাকাশে রং এর এক ব্যক্তির সাথে আমার দেখা হলো। লোকটি মাটিতে শায়িত ছিলো। সে আমাকে ‘আস্সালামু আলায়কুম’ বলে, আমার নাম ধরে ডাক দিলো এবং আমাকে তার নিকট যেতে বললো। আমি যখন তার নিকটে গেলাম, তখন সে আমাকে ধরে তোলার জন্য বললো। আমি তা করলাম। এখন দেখতে দেখতে তার দেহ সুস্থ হয়ে যেতে লাগলো। গড়ন ও রং-এ সুস্থ হয়ে যেতে দেখা গেলো। আমি তার হঠাৎ এ পরিবর্তন দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। সে এবার আমাকে এ বলে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’’ আমি বললাম, ‘‘না তো?’’ তখন সে বলতে লাগলো, ‘‘আমি হলাম দ্বীন ইসলাম। আপনি আমাকে যে অবস্থায় দেখছিলেন, আমি বর্তমান সমাজে তেমন শোচনীয় অবস্থায় ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার প্রচেষ্টায় নতুনভাবে জীবন দান করেছেন। সুতরাং اَنْتَ مُحِىُّ الدِّيْنِ (আপনি হলেন ‘মুহিউদ্দীন’ দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী)। তারপর আমি সেখান থেকে জামে মসজিদে এলাম। তারপর চতুর্দিক থেকে লোকেরা আমাকে ‘মুহিউদ্দীন’ বলতে বলতে আমার ঘরে এলো এবং আমার হাত-পায়ে চুমু খেতে লাগলো। ওই সময় থেকে আমি এ উপাধি লাভ করলাম।
মুহিউদ্দীন উপাধির বাস্তবতা
উপরিউক্ত উক্তিটা কোন নিছক কারামতী নয়, বরং হুযূর গাউসে আ’যম বাস্তবিক পক্ষে দ্বীনের পুনর্জীবিতকারী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর জন্মের পূর্ববর্তী সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থাদি এবং তাঁর মাধ্যমে যে সংস্কার সাধিত হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে তাঁর উক্ত উপাধির সার্থকতা ও বাস্তবতা মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হবে। এ সম্পর্কে নিচে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর ইলমে গায়ব দ্বারা এরশাদ করেছিলেন- ‘পঞ্চম শতাব্দির নিকটবর্তী সময়ে আমার উম্মতের উপর নানা বিপদাপদের একটি চাক্কি ঘুরবে। যদি তা থেকে লোকেরা বাঁচতে পারে, তবে তার পরবর্তী এক দীর্ঘ মেয়াদের জন্য এ ভাল অবস্থা বিরাজ করবে। [সূত্র: ফয়যুল বারী] সুতরাং এ শতাব্দিতেই উম্মতের উপর ওই বিপদের চাক্কি ঘুরেছিলো। ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, ওই যুগে ইসলামের ব্যাপক অবনতি ও অধঃপতন আরম্ভ হয়েছিলো। যদিও ইসলামী রাষ্ট্রগুলো ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরম্পরা সুদূর স্পেন থেকে ভারত পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিলো, কিন্তু অভ্যন্তরীনভাবে অবস্থাদি অতিমাত্রায় খারাপ ও বর্ণনার অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো। ইসলামী জগতের কেন্দ্রীয় শক্তি অর্থাৎ বাগদাদের খিলাফত অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। বাকী অংশগুলোতে দেউলিয়াপনা বিরাজ করছিলো। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকদিয়ে সর্বত্র বিক্ষিপ্ততা ছিলো। শিবলী নো’মান ও সুলায়মান নদভী তাদের ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে আর আল্লামা ইবনে জুযী তাঁর ‘আল মুনায্যাম’-এ ওই সময়কার ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর যেসব অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, চতুর্দিকে অনাচার, ব্যভিচার ও পাপাচার, রাজনৈতিক বিক্ষিপ্ততা এবং চারিত্রিক অধঃপতন একবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো।
স্পেনের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, উমাইয়া বংশীয় আমীর আবদুর রহমান আদ-দাখিলের প্রতিষ্ঠিত হুকুমতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে এসেছিলো। ইউরোপের খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো সুযোগের সন্ধানে ছিলো। তাদের একান্ত ইচ্ছা ছিলো- মুসলমানদের খতম করে সেখানে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করবে।
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপর খ্রিস্টানদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর তারা ইরাক ও হেজাযের উপর হামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছিলো। এমন মনে হয়েছিলো যেন দুনিয়ার সমস্ত খ্রিস্টান সম্মিলিতভাবে ইসলামী ক্ষমতাকে নিঃশেষ করার জন্য তৎপর হয়েছিলো। মধ্যপ্রাচ্যে আব্বাসীয় শাসন নামে মাত্র পর্যায়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের অধীনস্থ সালজুক্বী ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো পরস্পর বিরোধে লিপ্ত ছিলো। যার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতো তার নামে জুমায় খোৎবা পড়া হচ্ছিলো।
আফগানিস্তান এবং ভারতের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। আফগানিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সুলতান মাহমূদ গযনভীর উত্তরসূরীদেরও পতন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিলো। হিন্দু রাজা-মহারাজাগণ তাদের পুরানা পরাজয় ও লাঞ্ছনাগুলোর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরস্পর শলা-পরামর্শ করছিলো।
মিশরে বাতেনী ওবায়দী সালতানাতকে আল্লামা সুয়ূতী তাঁর তারীখুল খোলাফায় ‘দওলতে খবীসাহ্’ (নাপাক রাষ্ট্র) বলে আখ্যায়তি করেছেন। তারা ইলহাদে বে-দ্বীনী (নাস্তিকতা বিশেষ)কে প্রসারিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছিলো। এসব লোক ইসলামের যে ক্ষতি করেছিলো তা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে।
চারিত্রিক অধঃপতন
এতদ্ব্যতীত মুসলমানদের চারিত্রিক অবস্থাও খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ধনী ও উচ্চপদস্থ লোকেরা বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে যায়। মধ্য প্রাচ্যের এক মাঝারি পর্যায়ের ধনী ব্যক্তি ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে কথিত আছে যে, তার হেরমে শুধু গান-বাদ্যকারী দাসীদের সংখ্যা ছিলো পাচশ’র কাছাকাছি। ইমাম শাফে’ঈ আলায়হির রাহমাহ্র বর্ণনা মতে, কডোবার ‘মু’তামাদ নামীয় এক ধনীর নিকট এমন আটশ’ নারী ছিলো। স্পেনের নেকাব (গোমটা) পরিহিত সুলতানদের যুগে ইসলামী পর্দাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। পুরুষরা নেক্বাব পরতে আরম্ভ করেছিলো আর নারীরা খোলা চেহারায় ঘোরা-ফেরা করতো। মদ্যপান ও ব্যভিচার ব্যাপক ছিলো, সাধারণ মানুষের কথা কী বলবো, আমীর-উমারা ও বাদশাহগণ এমনকি আলিম-ওলামা পর্যন্ত আভিজাত্য পূজায় বিভোর ছিলো আর মগ্ন ছিলো নানা বিলাসিতায়।
ধর্মীয় অঙ্গনেও শোচনীয় অবস্থা বিরাজিত ছিলো। ভ্রান্ত কারামিতাহ্ ও বাতেনিয়া সম্প্রদায়, তাছাড়া রাফেযী-শিয়া এবং মু’তাযিলাহ্ গোষ্ঠী দু’টি আর মন্দ আলিমদের ফিৎনাগুলো এবং প্রচুর সংখ্যায় আত্মপ্রকাশকারী ফির্ক্বাগুলো ইসলামের কেন্দ্রীয় শহর বাগদাদ পর্যন্ত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বসেছিলো। প্রতিদিন অগণিত ওলামা-মাশাইয়খ, আমীর-উমারা ও অন্যান্য সরলপ্রাণ মুসলমান ভ্রান্ত ফির্ক্বা-ই বাত্বেনিয়ার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও তরবারির শিকার হচ্ছিলেন। প্রসিদ্ধ সালজূক্বী মন্ত্রী নিযামুল মুলক তূসী এবং তারপর ৪৮৫ হিজরিতে সালজূক্বী শাসক মালিক শাহ্ও খোদার ভয়শূন্য ওইসব হন্তার হাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। গ্রীক দর্শন (ইউনানী ফলসফাহ্) পৃথক ইসলামী আক্বাইদ ও দৃষ্টিভঙ্গির শিকড়লোকে উপড়ে ফেলাছিলো। ইসলামী আলিমগণ তাদ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্রমশ দ্বীন থেকে সরে যাচ্ছিলো। এ কারণেই মি. গ্যাবন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ওই সময়কে ইসলামী জগতের এক আন্ধকার যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ইমাম গাযালী আলায়হির রাহমাহ্ তাঁর ‘ইহইয়াউল উলূম’-এ লিখেছেন, তাঁর যুগটি এমনই শোচনীয় ছিলো যে, সত্যপন্থী সুন্নীদেরকে, যেমন মাতুরীদী, আশ‘আরী এবং হানাফী, মালেকী, হাম্বলী ও শাফে‘ঈ প্রমুখকে বিরুদ্ধবাদী অসুন্নীদের সাথে প্রায়শ! তর্ক-মুনাযারায় লিপ্ত থাকতে হতো। পরস্পর গালি-গালাজ এমনকি কখনো কখনো রক্তপাতের ঘটনাও ঘটে যেতো। সমাজে মা‘মূলী বিষয়ে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়ে যেতো। এটা সামাজিক ওই বিপর্যয় ছিলো, যাকে খোদ হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস সালাম মুলমানদের জন্য বিপজ্জনক সাব্যস্ত করেছিলেন।
মিশরে শাসন করছিলো ফির্ক্বা-ই বাতেনিয়াহ। এ ভ্রান্ত ফির্ক্বাটি হুযূর গাউস পাকের জীবদ্দশায়-ই পতনোন্মুখ হয়ে পড়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর ভেসাল শরীফের পর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, যেভাবে কাগজে কখনো ভুল শব্দ লিপিবদ্ধ হয়ে গেলে পরক্ষণে সেটাকে কাগজ থেকে একেবারে মুছে ফেলা হয়। আর তদস্থলে সুলনতান নূর উদ্দীন যঙ্গী, তারপর সুলতান সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী শাসনভার গ্রহণ করেন। যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে আপন রাজ্যকে ইসলামী ঐক্যের সাথে গ্রথিত করে আব্বাসী খলীফার নামে খোৎবা পড়তে আরম্ভ করেন। তারপর আপন আপন যুগে ইউরোপের সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীকে কয়েকটা যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের ক্ষমতাকে খর্ব করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে আবাদ করেন। ইমাম ইয়াফে‘ঈ ও ইবনে আসীর আপন আপন ইতিহাস গ্রন্থে ওই দ্বীনদার শাসকদের প্রশংসার অতি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
এমনই মুহূর্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত গযনী সালতানাতের স্থলে ঘুরী সুলতানগণ এসে ভারতবর্ষে নতুন ও ব্যাপক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাতে হুযূর গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকটাত্মীয় ও ফয়যপ্রাপ্ত হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায মু‘ঈন উদ্দীন চিশ্তী আজমীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিরও হাত ছিলো। এর পরবর্তী সময়গুলোর শাহানশাহে বাগদাদের খলীফা ও শীষ্যগণ আর মাশাইখে চিশ্ত আহলে বেহেশত, মাশাইখে সোহরুওয়ার্দিয়া, হযরত বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী, শাহ্ সদরুদ্দীন, আবুল ফাত্হ, শাহ্ রুক্নে আলম মুলতানী, সাইয়্যেদ জামাল উদ্দীন বোখারী আউচী, মাখদূমে জাহানিয়াঁ জাহান গাশত আউচী, জনাব লা‘ল শাহ্বায ক্বলন্দর সিন্ধী, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মা‘আরিফে লাদুন্নিয়া ও উলূমে ইলাহিয়্যার ধারক হযরত আবদুর রহমান চৌরভী, তাঁর খলীফা নায়েবে গাউসুল ওয়ারা হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী গাউসে যমান হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তাইয়্যেব শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ সহ বুযুর্গানে দ্বীন এ উপমহাদেশে সর্বত্র নিজেদের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে লোকজনকে ইসলাম ও ইসলামের প্রকৃত আদর্শ শিক্ষা ও দীক্ষা দিয়ে ধন্য করেছেন।
মোটকথা, হযরত গাউসুল আ’যম এবং তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফয়যপ্রাপ্তগণের প্রচেষ্টায় ইসলামে শুধু নব জীবনের সঞ্চার হয়েছিলো; বরং তাঁর রূহানী ক্ষমতা এ পর্যন্ত সজাগ ও সচেষ্ট ছিলো যে, যখন সপ্তম শতাব্দির শুরুতে, অর্থাৎ ৬১৭ হিজরীতে তাতারীদের ক্বিয়ামতরূপী আক্রমণে আরো অর্দ্ধ শতাব্দি অর্থাৎ ৬৫৬ হিজরী পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর ভিত একেবারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিলো, তখন ইসলামের প্রদীপ নির্বাপিত হবার স্থলে শুধু আলোকিতই থাকেনি, বরং শুধু পঁচিশ বছরের অভ্যন্তরে অর্থাৎ ৬৮০ হিজরী পর্যন্ত সময়ের মধ্যে খোদ ওই আক্রমণকারীদের শিরগুলোকে ইসলামের ছায়াতলে সন্নিবিষ্ট করতে কামিয়াব হয়েছে।
আর এ মারাত্মক সংঘর্ষ কোন শাহী কিংবা পার্থিব ক্ষমতার জোরে প্রশমিত হয়নি, বরং ওই সুলতানুল ওজূদ ক্বুত্ববুল ওয়াক্বত, খলীফাতুল্লাহ্ ফিল আরদ্ব, ওয়ারিসে কিতাব, নায়েবে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, আল মুতার্সারিফ ফিল ওয়াজূদ আলাত তাহক্বীক্ব মাযহারে আসমাই ইলাহী গাউসুল আ’যম দস্তগীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর রূহানী ক্ষমতা প্রয়োগ (তাসাররুফ)-এরই কারামত ছিলো। ফলে ইসলামের ওই শত্রুরা ইসলাম ক্ববূল করে ইসলামের জন্য অনন্য ও ঐতিহাসিক খিদমত আন্জমাম দিয়েছিলো।
এক তাতারী শাহযাদার ঘটনা এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রনিধানযোগ্য। তাতারীদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাও অতি হ্রদয়গ্রাহী। ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে যে, তাতারীদের প্রাধান্য বিস্তারের পর সিলসিলা-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়ার এক খোরাসানী বুযুর্গ এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে হালাকু খানের পুত্র তাগুদার খানের নিকট পৌঁছেন। তখন তিনি শিকার থেকে ফিরে এসেছিলেন। আর নিজ শাহী মহলের সামনে এ দরবেশকে দেখে তাঁর প্রতি ঠাট্টাচ্ছলে বললেন, ‘হে দরবেশ! তোমার দাড়ির লোমগুলো উত্তম। নাকি আমার কুকুরের লেজের লোমগুলো উত্তম, তিনি তার জবাবে বলেছেন, ‘‘আমিও আমার মালিকের কুকুর। যদি আমি আমার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ও বিশ্বস্ততার মাধ্যমে তাঁকে খুশী করতে পারি, তাহলে আমার দাড়ির লোমগুলোই উত্তম। অন্যথায় আপনার কুকুরের লেজের লোমগুলো শ্রেয়, যা আপনার আনুগত্য করে এবং আপনার জন্য শিকারের মতো খিদমত আন্জাম দেয়।’’
ওই মহান বুযুর্গের এমন জবাবের বাক্যগুলো তাগুদার খানের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলেন। তিনি ওই বুযুর্গকে নিজ মহলে মেহমান করে রেখে দিলেন এবং তাঁর নিকট শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ করছিলেন। আর এক পর্যায়ে গোপনে ইসলাম কবূল করে ফেললেন। কিন্তু এটা তিনি এ ধারণায় প্রকাশ করেননি যে, তিনি তাঁর দরবারের লোকজনকে ক্রমশঃ মানসিকভাবে এ নতুন ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণ করার জন্য সুকৌশল তৈরী করে নিতে পারবেন। এরপর ওই বুযুর্গ তাঁর দেশে চলে গেলেন। আর এক সময় তাঁর জীবনকাল সমাপ্ত হয়ে গেলে আল্লাহ্ তা‘আলার ডাকে সাড়া দিয়ে ইন্তিক্বাল করলেন।
কথিত আছে যে, ‘হারচেহ পেদর নাতাওয়ানাস্ত পেসর তামাম কুনাদ’ (পিতা যা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন না, তা তাঁর পুত্র পরিপূর্ণ করেন)। সুতরাং কিছুদিন পর তাঁর পুত্র পিতার ওসীয়ত অনুসারে তাগুদার খানের নিকট পৌঁছলেন। তাগুদার খান বুযুর্গপুত্রকে সূরতে হালের বর্ণনা দিয়ে বললেন, দরবারের প্রায় সবাই ইসলামের প্রতি প্রায় ঝুঁকে পড়েছে, কিন্তু এক সরদার, যার পেছনে এক বিরাট দল রয়েছে, এখনো ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না।
বুযুর্গ তাগুদার খানের সাথে পরামর্শ করে ওই সরদারকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। সরদার আসার পর তাঁকে বুযুর্গ ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু সে বললো, ‘‘আমি একজন সিপাহী। আমার সারা জীবন যুদ্ধবিগ্রহে অতিবাহিত হয়েছে। আমি শুধু শারীরিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। আপনি যদি আমার পলোয়ানের সাথে কুস্তি খেলে তাকে ধরাশায়ী করতে পারেন, তাহলে আমি মুসলমান হয়ে যাবো।’’ এটা শুনে দরবেশ ওই পলোয়ানের সাথে কুস্তি খেলার জন্য রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু তাগুদার খান তাঁকে এ বলে নিষেধ করলেন যে, ‘‘আপনি একজন দরবেশ মানুষ, ওই পলোয়ান দৈহিকভাবে অতি শক্তিশালী।’’ কিন্তু দরবেশ উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অনড় রইলেন।
সুতরাং কুস্তির দিন, তারিখ ও সময় নিদ্ধারিত হলো। হাজারো কৌতূহলী দর্শকদের জমায়েতে কুস্তির জন্য উভয়ে এগিয়ে এলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! বুযুর্গ দরবেশ কুস্তির সূচনালগ্নেই ওই পলোয়ানের মুখমন্ডলে এক থাপ্পড় এত জোরে মেরে দিলেন যে, তার (পলোয়ান) মাথার খুলি পর্যন্ত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। চুতুর্দিকে শোর-চিৎকার পড়ে গেলো। দরবেশের বিজয়ে সবাই চিন্তা করতে লাগলো এ মহান দরবেশ (ওলী) কার পলোয়ান?
ফলশ্রুতিতে, ওই সরদার এগিয়ে গিয়ে তাঁর ওয়াদা মোতাবেক শুধু মহান বুযুর্গের হাতে চুমু খায়নি বরং ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলেন। তাগুদার খানও সাথে সাথে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন এবং নিজের নাম আহমদ রাখলেন, এরপর তিনি মিশরের সুলতান’র সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক কায়েম করেন। (যদিও তাঁর বিধর্মী জেনারেলগণের বিদ্রোহের ফলে তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করেছিলেন।)
ঐতিাহসিকগণ এ ঘটনাকে এভাবে বিচিত্রত করেছেন যে, ইে হালাকু খান ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ অস্তিত্বকে বিলীন করার জন্য চেষ্টা করেছিলো, তার পুত্র তাগুদার খান (আহমদ) নিজের প্রাণটুকু বিসর্জন দিয়ে ওই ইসলামের অনন্য খিদমত আন্জাম দিয়ে গেছেন। উল্লেখ্য, তাগুদার খানের শাহাদতে যদিও ইসলামের অগ্রযাত্রা এতদঞ্চলে কিছুটা থেমে গিয়েছিলো, কিন্তু যেহেতু অন্যদিকে হালাকু খানের চাচাত ভাই বারাকাহ্ (১২৫৬-১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ)ও হযরত শায়খ শামসুদ্দীন বাখোরীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তারপর তাগুদার খান আহমদের ভাতিজার পুত্র গযন মাহমূদ (১২৯৫-১৩০৪)ও ইসলাম কবুল করেছিলেন, সেহেতু মধ্য এশিয়ার তাতারী হুকুমতে তাতারী ইসলামী হুকুমত পরিবর্তিত হয়েছিলো।
এ গযন খানের বিরুদ্ধে বিধর্মী জেনারেলগণ বিদ্রোহ করলেও গযন খান তাদের সবাইকে পরাস্ত করে বিজয়ী হন। ফলে প্রায় সব তাতারী গোত্র ইসলাম কবূল করেছিলো।
ভারতে গাউসে পাকের ফয়য জারী হয়েছে
হযরত মাওলানা আবদুল কাদের ইরবিলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘তাফরীহুল খাত্বির ফী মানাক্বিবি আবদুল ক্বাদির’-এর ৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘‘শায়খ নূরুল্লাহ্ ফক্বীহ্, শায়খ হাসান ক্বত্ববীর নাতি ‘আল লাত্বা-ইফুল ক্বাদেরিয়া’য় লিখেছেন, শায়খুল ওয়াসেলীন মু‘ঈনুল হক্বক্বি ওয়াদ্ দ্বীন (অর্থাৎ খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী) গাউসে আ’যম থেকে ইরাক চেয়েছিলেন। তখন তিনি বলেন, ‘‘এটা তো আমি শেহাব উদ্দীন ওমর সোহরুওয়ার্দিকে দিয়ে দিয়েছি, আপনাকে আমি হিন্দুস্তান (ভারত) দান করলাম।’

যিন্দা কারামত

এটা হযরত গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর যিন্দা কারামত ও চাক্ষুষ সাক্ষী যে, ভারতে সিলসিলাহ-ই চিশতিয়ার যত উন্নতি হয়েছে, অন্য কোন দেশে ততটুকু হয়নি। অনুরূপ ইরাক ইত্যাদিতে সোহরুওয়ার্দিয়াহ্ সিলসিলার যতটুকু উন্নতি হয়েছে, ততটুকু অন্য কোথাও হয়নি, এভাবে নক্বশ্বন্দী সিলসিলার উপরও পীরানপীরের ফয়য পড়েছে। সিলসিলয়াহ্-ই ক্বাদেরিয়া তো আছেই। মোটকথা যে যতটুকু ফয়য পেয়েছেন, তা হযরত গাউসুল আ’যম থেকে পেয়েছেন।

ইশ্ক্ব অথবা আশিক্ব

প্রায় সব জীবনী রচয়িতার মতে হুযূর গাউসে পাকের জন্মসাল ৪৭০ হিজরী। আর ইমাম ইয়াফে‘ঈর এক বর্ণনা মতে তাঁর জন্মসাল হয় ৪৭১ হিজরী। সুতরাং আবজাদ হিসাবানুযায়ী এ সংখ্যা দু’টি যথাক্রমে ইশ্ক্ব (عشق) ও আশিক্ব (عاشق)-এর অনুরূপ হয়। সুতরাং এ দু’টি শব্দই হুযূর গাউসে পাকের আদর্শ জীবনে প্রতিফলিত হয়। তিনি ছিলেন আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আকৃত্রিম আশিক্ব, তাঁর মধ্যে আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের ইশ্ক্ব তথা ভালবাসা পূর্ণ মাত্রায় ছিলো। এর বদৌলতেই তিনি গাউসিয়াতের এত উচুঁ আসনে সমাসীন হন।
জন্মের সাথে সাথে শাহান শাহে বাগদাদ শরীয়তের বিধান পালনে যতœবান হন
হুযূর গাউস পাকের আম্মাজান বলেন, তিনি পহেলা রমযানুল মুবারক জন্মগ্রহণ করেছেন। জন্মের সাথে সাথে শরীয়তের বিধানাবলীর প্রতি তিনি এতই যতœবান ছিলো যে, তা তাঁর অলৌকিকত্বকে প্রমাণ করে। তিনি গোটা রমযান মাস দিনের বেলায় মোটেই দুধ পান করতেন না, বরং রোযা পালন করতেন। এমনকি ওই বছর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে ২৯ শা’বান আকাশে রমযানের চাঁদ দেখা যায়নি। তাই লোকেরা সন্দিহান ছিলো। কিন্তু ওই মাদারযাদ ওলীর চোখে মেঘের আড়ালে থাকা নবচন্দ্র গোপন থাকেনি। তিনি ভোরে ওই দিন থেকে মায়ের দুধ পান করেন নি। বাস্তব অনুসন্ধানেও জানা গেছে যে, ওই দিন রমযানের চাঁদ উদিত হয়েছে। পরদিন ছিলো ১লা রমযান।

শিশু অবস্থার স্বর্ণালী ঘটনাবলী

শুরু থেকেই খোদা ওয়ান্দে ক্বুদ্দুসের অনেক দান হযরত গাউসে আ’যমের দিকে ধাবিত ছিলো। তারপর তাঁর আকাশচুম্বি মর্যাদাকে কে স্পর্শ করতে পারে? কিংবা অনুমান ও করতে পারে? এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বর্ণনা দেন, ‘‘আমার জীবনের প্রাথমিক অবস্থায় আমি যদি কখনো অন্য ছেলের সাথে খেলাধূলা করতে চাইতাম, তখন অদৃশ্য থেকে আহ্বান আসতো, ‘‘তুমি খেলাধূলা থেকে বিরত থাকো!’’ তা শুনে আমি রুখে যেতাম। তখন আমি আমার আশে-পাশে দেখতাম, কিন্তু কোন আহ্বানকারী দেখতাম না। আমি ভীত হয়ে দৌঁড়ে ঘরে চলে যেতাম আর আমার মায়ের আঁচলের নিচে আত্মগোপন করতাম। এখন আমি ওই আহ্বান আমি একাকী অবস্থায়ও শুনতে পাই। আমার চোখে যখন ঘুম এসে যেতো, তখন ওই আহ্বান কানে আসতো আর আমার ঘুম ভেঙ্গে যেতো, তখন আমাকে বলা হতো, ‘‘তোমাকে তো এজন্য সৃষ্ট করা হয়নি যে, তুমি ঘুমে বিভোর হয়ে থাকবে।’’ একদা ঘর থেকে দূরে একবার আমি শিশুসুলভ আচরণ করতে গিয়ে এক গাভীর লেজ ধরে টান দিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে গাভীটি কথা বললো, ‘‘হে আবদুল কাদের কাদির! তুমি এজন্য সৃষ্টি হওনি।’’ সাথে সাথে আমি সেটাকে ছেড়ে দিলাম। আর আমার হৃদয়ে এক প্রকার ভয় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।

বিসমিল্লাহ্ খানীর অলৌকিক ঘটনা
প্রসিদ্ধ বর্ণনা আছে- যখন সাইয়্যেদুনা সরকার গাউসুল আ’যম-এর বয়স শরীফ চার বছর হয়েছিলো, তখন ইসলামী রেওয়াজ অনুযায়ী তাঁর পিতা মহোদয় হযরত শায়খ আবূ সালিহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁকে প্রথম সবক প্রদান (বিসমিল্লাহ্ খানী)-এর জন্য মকতবে নিয়ে গেলেন। সুতরাং তিনি ওস্তাদ মহোদয়ের সামনে দু’জানু হয়ে বসে গেলেন। ওস্তাদ বললেন, ‘‘পড়ো বৎস! বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম!’’ তিনি বিসমিল্লাহ্ শরীফ পড়ার সাথে সাথে আলিফ-লাম-মীম থেকে আরম্ভ করে পূর্ণ সতের পারা পর্যন্ত মুখস্ত পড়ে ফেললেন। সবাই হতবাক হয়ে গেলেন। ওস্তাদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বৎস! এত পারা তুমি কোথায় ও কিভাবে শিখেছো ও মুখস্ত করেছো?’’ তিনি বললেন, ‘‘আমার আম্মাজান সতেরো পারার হাফিযা। এ পারাগুলো তিনি বেশীরভাগ সময় তিলাওয়াত করতেন। আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম তখন তাঁর মুখে শুনতে শুনতে পারাগুলো আমারও হেফ্য হয়ে গেছে।
তারপর আঠার বছর বয়সে তিনি বাগদাদ আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ বাসস্থান গীলানে করলেও বাগদাদে এসে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। দ্বীনী শিক্ষার যাবতীয় বিষয়ে তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। ইত্যবসরে তিনি আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং দীক্ষাও অর্জন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন- দারাসতুল ইলমা হাত্তা সিরতু ক্বুতবান। অর্থাৎ- শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষা দান করতে করতে আমি বেলায়তের উচ্চ পর্যায় ক্বত্বব হয়ে গেছি। তিনি দীর্ঘ দিন বাগদাদের বনে-জঙ্গলে কঠোর রিয়াজত করেন। ফলে গাউসিয়াতে উয্মার উচ্চাসনে সমাসীন হন। তিনি নিজেই, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে, ঘোষণা করেছিলেন- ‘‘ক্বাদামী হাযিহী আলা রাক্বাবাতে কুল্লি ওয়ালিয়্যিল্লা-হি।’’ ‘‘আমার এ কদম সমস্ত ওলীর গর্দানের উপর।’’
পরিশেষে, গীলান শহরে ৪৭০/৪৭১ হিজরী ১লা রমযান হাসানী-হোসাইনী খান্দানে যে শিশু অসংখ্য অলৌকিক ক্ষমতা সহকারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি বড় হয়ে বিশ্ব জোড়া দীর্ঘস্থায়ী মহা মর্যাদায় আসীন হয়েছেন। ইসলামকে করেছেন পুনর্জীবিত, দুনিয়াকে করেছেন ইসলামী আদর্শে আলোকিত। এসব বিষয় বিবেচনা করলে গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বেলাদত বা জন্ম যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি তা হয়েছে সর্বদিক দিয়ে অপূর্ব স্বার্থক। সর্বোপরি তাঁর শুভ আবির্ভাবের বরকত ও কল্যাণ হয়েছে সুদূর প্রসারী।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment