গ্রন্থ পরিচিতি
গ্রন্থের নাম: মুস্তাদরাক আল-আস সহিহাইন
রচয়িতা: আবি আবদিল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ বিন আবদিল্লাহ নিসাপুরি
রচয়িতার উপাধি : আল-হাকিম
জ্ঞান নগরি নিসাপুরের মহান মুহাদ্দিস ইমাম আবি আব্দিল্লাহ হাকিম নিসাপুরি অগণিত গ্রন্থের রচয়িতা।
‘ওয়াফিয়াতুল আ’য়ান’ (৪/২৮০) এর মধ্যে আল্লামা ইবন খাল্লিকান বলেন,ইমাম হাকেমের গ্রন্থের সংখ্যা দেড় হাজার।‘
তাবাকাতুশ শাফেইয়াতিল কুবরা’ কিতাবে (৪/১৬০) শায়খুল ইসলাম তাজুদ্দিন ইবনে শায়খুল ইসলাম তকিউদ্দিন সুবকি কুদ্দিসাস সিররুহুমাল্লাহ বলেন,
قَالَ مُحَمَّد بن طَاهِر الْحَافِظ سَأَلت سَعْدا الزنجاني الْحَافِظ بِمَكَّة قلت لَهُ أَرْبَعَة من الْحفاظ تعاصروا أَيهمْ أحفظ فَقَالَ من قلت الدَّارَقُطْنِيّ بِبَغْدَاد وَعبد الْغَنِيّ بِمصْر وَأَبُو عبد الله بن مندة بأصبهان وَأَبُو عبد الله الْحَاكِم بنيسابور فَسكت فألححت عَلَيْهِ فَقَالَ أما الدَّارَقُطْنِيّ فأعلمهم بالعلل وَأما عبد الْغَنِيّ فأعلمهم بالأنساب وَأما ابْن مندة فأكثرهم حَدِيثا مَعَ معرفَة تَامَّة وَأما الْحَاكِم فأحسنهم تصنيفا
—❝হাফিয মুহাম্মদ বিন ত্বাহির বলেন,আমি মক্কায় হাফিয সা’আদা আয-যানজানিকে বললাম,চারজন সমসাময়িক মহান হাফিযুল হাদিসগণের মধ্যে আপনি কাকে সর্বাপেক্ষা অগ্রগামী মনে করেন।উনি জিজ্ঞেস করলেন,’কোন চারজন?’ আমি বললাম,বাগদাদের দারাকুৎনী,মিশরের আবদুল গণি,ইস্পাহানের আবু আব্দুল্লাহ ইবনে মুনদাহ আর নিসাপুরের আবু আব্দুল্লাহ হাকিম!‘উনি চুপ রইলেন।আমার পিড়াপিড়িতে বললেন,❝হাদিসের দূর্বলতা নিরূপণে আবুল হাসান আদ-দারাকুৎনী অনবদ্য,বর্ণনাকারিদের পরম্পরাবিদ্যায় আবদুল গণি অদ্বিতীয় যুগপুরুষ,মা’আরিফাতের হাদিস বর্ণনায় প্রাচুর্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে মুনদাহ,আর অনিন্দ্যসুন্দর গ্রন্থ রচনায় হাকিম অগ্রগামী।(সুতরাং,আমি কাকে ফেলে কাকে নিবো!)❞
‘মুস্তাদরাক’ হল সে সেই কিতাব,যাতে সন্নিবেশিত হাদিসগুলো কোনো বিশিষ্ট মুহাদ্দিসের তালিকাবদ্ধের শর্তে উন্নীত হয় অথচ ঐ মুহাদ্দিস তার গ্রন্থে সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেন নি,এমন হাদিসের সমাহারে রচিত হাদিসগ্রন্থ।ইমাম হাকিমের ‘মুস্তাদরাক’ এর শর্তের ভিত্তি দুই সহিহ কিতাব (বোখারি ও মুসলিম) বা সহিহাইনের অনুরূপ।এজন্য হাকিমের মুস্তাদরাককে ‘মুস্তাদরাক আল-আস সহিহাইন’।
এটা রচনার যে কারণ,তা ইমাম হাকিম নিজেই এগ্রন্থের ভুমিকায় উল্লেখ করেন।উনি বলেন,
وقد نبغ في عصرنا هذا جماعة من المبتدعة يشمتون برواة الآثار بأن جميع ما يصح عندكم من الحديث لا يبلغ عشرة آلاف حديث، وهذه الأسانيد المجموعة المشتملة على ألف جزء أو أقل أو أكثر منه كلها سقيمة غير صحيحة، وقد سألني جماعة من أعيان أهل العلم بهذه المدينة وغيرها أن أجمع كتاباً يشتمل على الأحاديث المروية بأسانيد يحتج محمد بن إسماعيل ومسلم بن الحجاج بمثلها
—❝আমাদের এ সময় বিদআতপন্থী একটা দলের উদ্ভব হয়েছে,যারা হাদীসের বর্ণনাকারিদের সম্পর্কে এরূপ কটূক্তি করে যে,’ঐ সমস্ত হাদীস,যা তোমাদের নিকট সহীহ হিসাবে বিবেচিত,তার সংখ্যা দশ হাযারের অধিক নয়।আর এই যে সনদ একত্রিত করা হয়েছে, এর অংশ হলো এক হাজার এর চাইতে কম বা বেশী হলে, তা হবে রুগ্ন এবং অশুদ্ধ সনদ।’ তখন এই শহরের আলিমরা আমাকে এরকম একটা গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য উদ্বুদ্ধ করে যেখানে ঐ সমস্ত হাদীস বর্ণিত হবে,যার সনদ দ্বারা ইমাম বুখারী ও মুসলিম দলীল পেশ করেছেন।❞
ইমাম হাকিম নিশাপুরি একারণে এখানে উল্লিখিত প্রায় সমস্ত হাদিসে বুখারি-মুসলিমের শর্তের উপর লিপিবদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট হন।এখানে প্রায় প্রত্যেক হাদিস উল্লেখের পর উনি,’হাদিসটির সনদ শায়খাইনের শর্তে বিশুদ্ধ কিন্তু উনারা তা লিপিবদ্ধ করেননি বা হাদিসটির সনদ বুখারি/মুসলিমের শর্তে বিশুদ্ধ কিন্তু উনি তা লিপিবদ্ধ করেননি’— মর্মে মন্তব্য করতেন।
তবে ইমাম হাকিম নিশাপুরির উপর অনেকে শিয়া হবার অভিযোগ এনেছেন।এটার কয়েকটা কারণের একটা হল উনি ‘হাদিসে ত্বইর’ বা ‘পাখির হাদিস’কে বুখারী মুসলিমের শর্তে সহিহ বলে দিয়েছেন।পাখির হাদিসের তিরমিযির ভাষ্য হল,
حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ وَكِيعٍ، حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، عَنْ عِيسَى بْنِ عُمَرَ، عَنِ السُّدِّيِّ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ كَانَ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم طَيْرٌ فَقَالَ” اللَّهُمَّ ائْتِنِي بِأَحَبِّ خَلْقِكَ إِلَيْكَ يَأْكُلُ مَعِي هَذَا الطَّيْرَ ” . فَجَاءَ عَلِيٌّ فَأَكَلَ مَعَهُ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِنْ حَدِيثِ السُّدِّيِّ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَقَدْ رُوِيَ مِنْ غَيْرِ وَجْهٍ عَنْ أَنَسٍ . وَعِيسَى بْنُ عُمَرَ هُوَ كُوفِيٌّ وَالسُّدِّيُّ اسْمُهُ إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ وَقَدْ أَدْرَكَ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ وَرَأَى الْحُسَيْنَ بْنَ عَلِيٍّ وَثَّقَهُ شُعْبَةُ وَسُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ وَزَائِدَةُ وَوَثَّقَهُ يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الْقَطَّانُ
❝হযরত আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণিত আছে,তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ ﷺ নিকট পাখির ভুনা গোশত হাযির ছিল।তিনি বলেন,হে আল্লাহ!তোমার সৃষ্টির মধ্যে তোমার নিকট সবচাইতে প্রিয় ব্যক্তিকে আমার সাথে এই পাখির গোশত খাওয়ার জন্য হাযির করে দাও। ইত্যবসরে আলী كَـرَّم اَلـلَّـهُ وَجْهَـهُ এসে হাযির হন এবং তার সাথে খাবার খান।❞
[৩৭২১]
ইমাম তিরমিযির অভিমত এ ব্যাপারে,
هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِنْ حَدِيثِ السُّدِّيِّ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَقَدْ رُوِيَ مِنْ غَيْرِ وَجْهٍ عَنْ أَنَسٍ . وَعِيسَى بْنُ عُمَرَ هُوَ كُوفِيٌّ وَالسُّدِّيُّ اسْمُهُ إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ وَقَدْ أَدْرَكَ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ وَرَأَى الْحُسَيْنَ بْنَ عَلِيٍّ وَثَّقَهُ شُعْبَةُ وَسُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ وَزَائِدَةُ وَوَثَّقَهُ يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الْقَطَّانُ
—❝এ হাদীসটি দুর্লভ।আমরা শুধু এই সূত্রে আস-সুদ্দির রিওয়ায়াত হতে এ হাদীস জেনেছি। এ হাদীস অন্যভাবেও হযরত আনাস হতে বর্ণিত হয়েছে।আস-সুদ্দির নাম ইসমাঈল ইবনু আবদুর রহমান।তিনি আনাস রা. এর দেখা পেয়েছেন এবং হুসাইন ইবনু আলী عليهم السلام কে দেখেছেন।শুবা, সুফিয়ান সাওরী,যাইদাহ,ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আলকাত্তান প্রমুখ তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।
[আলবানি এ হাদিসকে কেবল যইফ বলেছেন]
কিন্তু মজার ব্যাপার হল হযরত ইবন আব্বাস,হযরত আলি,আবু সাঈদ খুদরি,জাবের বিন আব্দুল্লাহ,হাবশি বিন জুনাদাহ এবং আনাস হতে ২৮ জন এই হাদিস বর্ণনা করেছেন।আর প্রায় প্রত্যেকটা সনদই ত্রুটিযুক্ত!
অথচ ইমাম হাকিম এটাও বর্ণনা করেছেন,নবি ﷺ বলেছেন,
فقال:يا عائشة هؤلاء الخلفاء من بعدي
—❝হে আয়িশাহ!এরাই (সাইয়্যিদুনা আবু বকর, উমর এবং উসমান رضي الله عنهم) আমার পর খলিফা হবে।❞
[★মুস্তাদরাক,৩/৯৬-৯৭,তালখিস লিয যাহাবি ১২৪৫পৃ.
★মুসনাদে আবি ইয়ালা,৮/২৯৫,হাদিস নং ৪৮৮৪]
ইমাম শাফি’ই,ইমাম হাকিম,ইমাম নাসায়ি,ইমাম আবদির রাযযাক ইনাদের কেইস মূলত: একই। বিস্তর গবেষণার পর উনার ওপর শিয়া হবার অভিযোগ আরোপ করলে তা আসলে ইবনে তায়মিয়াবাদ বলেই গণ্য হবে। উনি তো ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’র ৭ম খন্ডে মুহাদ্দিসে মাগরিব ইবনে আব্দির বার আল মালেকি,ইমাম নাসায়ি,ইমাম জারির তাবারিকে শিয়া বানিয়ে দিয়েছেন। প্রকৃত অবস্থা হলো সেটা যা শায়খুল ইসলাম ইমাম তাজুদ্দিন সুবকি লিখেছেন,
وقد رُمي هذا الإمام الجليل بالتشيع
—আর অবশ্যই এই মহান ইমামের দিকে শিয়াইজমের তীর নিক্ষেপ করা হয়েছে।
যা হোক,উনি আহলে সুন্নতের ইমামের অন্তর্গত এবং উনার এই গ্রন্থ সর্বমহলে ‘সহিহ মুস্তাদরাক’ নামে পরিচিত।চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা আলি খান মুহাদ্দিসে আজমে বেরেলভি এবং ত্রয়োদশ শতাব্দির মুজাদ্দিস শায়খ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিসে আজমে দেহলভি কুদ্দিসাস সিররুহুমাদ্বয়ও স্থানে স্থানে ‘সহিহ মুস্তাদরাক’ লিখেছেন।
দারুল কুতুব ইলমিয়াহ,বৈরুত হতে ২০০২ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হয়,যেখানে ৮৮০৩ টা হাদিস ইমাম হাকিম সংকলন করেছেন।এর সব হাদিস বিশুদ্ধ নয়।
হাকিমের মুস্তাদরাকের উপর সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন হাফিয যাহাবি।উনি এর বিশুদ্ধতা যাচাই করে বলেন ‘সিয়ারু আলাম আন-নুবালা’য় বলেন (১৭/১৭৫),
ففي المستدرك جملة وافرة على شرطهما ، وجملة كبيرة على شرط أحدهما، ولعل مجموع ذلك نحو نصف الكتاب، وفيه نحو الربع صح سنده وإن كان فيه علة، وما بقي وهو نحو الربع فهو مناكير وواهيات لا تصح، وفي بعض ذلك موضوعات
—❝আসল কথা হলো,অনেক হাদীস শায়খাইনের অথবা দু’জনের একজনের শর্তের সাথে সংগতিপূর্ণ পাওয়া যায়।প্রায় কিতাবের অর্ধেক এরূপ।চারভাগের একভাগের অবস্থা এরকম যে,হাদীসের সনদ সঠিক,কিন্তু বুখারি-মুসলিমের শর্তের অনুরূপ নয়।বাকী চারভাগের একভাগ হাদিস মুনকার হাদিসে পরিপূর্ণ,বিশুদ্ধ নয় (অর্থাৎ যইফ) কোনো কোনোটা আবার মওযু।❞
যাহাবি আবার সব হাদিসের ওপর কথাও বলেননি,কখনো কখনো মৌনতা অবলম্বন করেছেন।এগুলো বিশুদ্ধ অথবা হাসান হিসেবে গণ্য করেন মোহাদ্দিসরা।
আবার মুহাদ্দিসে আজমে দেহলভি শায়খ আবদুল আযিয কুদ্দিসাস সিররুহ ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসিন’ এ লিখেছেন,
ولأجل ذلك صرح العلماء بأنه لا ينبغي لأحد أن يعتمد على المستدرك للحاكم إلا بعد النظر في تلخيص الذهبي
—❝এজন্য হাদীসের আমিলরা বলেছেন:যাহাবীর বর্ণিত মতামত দেখার আগে,হাকিম রচিত মুস্তাদরিক গ্রন্থের উপর নির্ভর করা উচিত নয়।❞
আবার যাহাবির কিছু সিদ্ধান্তকে মুহাদ্দিসীনে কেরামরা অগ্রাহ্যও করেছেন।বিভিন্ন হাদিসের শাহেদ/সাক্ষ্য এর ভিত্তিতে অনেক সময় যাহাবির যইফের হুকুমকে টপকে সূয়ুতি,সাখাভি, সুবুকিদেরকে হাসান-সহিহ বলতেও দেখা গেছে।সেক্ষেত্রে উনারা নির্ভর করেছেন হাকিমের উপর।
এখন একটা প্রশ্ন জাগতে পারে,হাকিম নিশাপুরি এতবড় ইমাম হবার সত্ত্বেও এরকম ঝামেলা আসার কারণ কি?এটার জবাবে খাতিমুল আইম্মাহ শাইখুল ইসলাম ইবনু হাজার বলেন,এই গ্রন্থটা উনি রচনার করেন সত্তর বছর বয়সে।তখন হিফয দূর্বল হওয়া এবং সিদ্ধান্ত নিতে হেরফের হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
হাকিমের এই কিতাব নবি ﷺ এর দরবারে কবুল হওয়া একটা হাদিস গ্রন্থ।শাহ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে আজম দেহলভি রহ. ‘বুস্তান’ গ্রন্থে লিখেন,❝৪০৫ হিজরির সফরে ইমাম হাকিমের মৃত্যু হলে একজন তাকে স্বপ্নে দেখে, উনি বলছিলেন,’আমি নাজাত পেয়েছি!’ কিসের উসিলায় জিজ্ঞেস করা হলে বলেন,’নবি ﷺ এঁর হাদিস লিপিবিদ্ধ করার কারণে।’