সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি পরিকল্পনা করেন ও সঠিক পথের হিদায়াত দেন এবং মাতৃগর্ভে নিক্ষিপ্ত শুক্র বিন্দু থেকে নারী-পুরুষ যুগল সৃষ্টি করেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তার কোনো শরীক নেই। সূচনা ও সমাপ্তিতে তার জন্যই সকল প্রশংসা। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তাকে যখন আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় তিনি স্বীয় রবের বড় বড় অনেক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। সালাত ও সালাম প্রেরিত হোক বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ধারক তার পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।
অতঃপর… নারীদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদানকারী দীন একমাত্র ইসলাম। ইসলাম তাদের অনেক বিষয়কে বিশেষ গুরুত্বসহ গ্রহণ করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো শুধু নারীদের উদ্দেশ্য করেই উপদেশ প্রদান করতেন। ‘আরাফার ময়দানে তিনি নারীদের ওপর পুরুষদের হিতাকাঙ্ক্ষী হতে বলেন, যা প্রমাণ করে নারীরা বিশেষ যত্নের দাবিদার। বিশেষভাবে বর্তমানে যখন মুসলিম নারীদের সম্মান হরণ ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান থেকে বিচ্যুত করার নিমিত্তে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব, তাদের সচেতন করা ও তাদের সামনে মুক্তির নির্দেশনা স্পষ্ট করার বিকল্প নেই।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ মুসলিম নারীদের সামনে সে নির্দেশনা স্পষ্ট করবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রন্থখানা ক্ষুদ্র প্রয়াস ও দুর্বল ব্যক্তির পক্ষ থেকে সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র, আল্লাহ স্বীয় কুদরত মোতাবেক তার দ্বারা মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধন করবেন একান্ত আশা। এ ময়দানে এটিই প্রথম পদক্ষেপ, আশা করা যায় পরবর্তীতে আরো ব্যাপক ও বৃহৎ পদক্ষেপ করা হবে, যা হবে আরো সুন্দর ও আরো পরিপূর্ণ। আমি এখানে যা পেশ করছি তার পরিচ্ছেদসমূহ নিম্নরূপ:
১. প্রথম পরিচ্ছেদ: সাধারণ বিধান।
২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: নারীর শারীরিক সাজ-সজ্জা সংক্রান্ত বিধান।
৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ: হায়েয, ইস্তেহাযাহ ও নিফাস সংক্রান্ত বিধান।
৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ: পোশাক ও পর্দা সংক্রান্ত বিধান।
৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ: নারীর সালাত সংক্রান্ত বিধান।
৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: নারীর জানাযাহ সংক্রান্ত বিধান।
৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ: নারীর সিয়াম সংক্রান্ত বিধান।
৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ: নারীর হজ ও উমরাহ সংক্রান্ত বিধান।
৯. নবম পরিচ্ছেদ: দাম্পত্য জীবন ও বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিধান।
১০. দশম পরিচ্ছেদ: নারীর সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষা সংক্রান্ত বিধান।
ইসলাম-পূর্ব নারীর মর্যাদা:
ইসলাম-পূর্ব নারীর মর্যাদা:
ইসলাম-পূর্ব যুগ দ্বারা উদ্দেশ্য জাহেলী যুগ, যা বিশেষভাবে আরববাসী এবং সাধারণভাবে পুরো জগতবাসী যাপন করছিল, কারণ সেটা ছিল রাসূলদের বিরতি ও পূর্বের হিদায়াত বিস্মৃতির যুগ। হাদীসের ভাষা মতে “আল্লাহ তাদের দিকে দৃষ্টি দিলেন এবং আরব ও অনারব সবার ওপর তিনি গোস্বা করলেন, তবে অবশিষ্ট কতক আহলে কিতাব ব্যতীত”।[1] এ সময় নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ও সাধারণভাবে খুব কঠিন অবস্থার সম্মুখীন ছিল। বিশেষত আরব সমাজে। আরবরা কন্যা সন্তানের জন্মকে অপছন্দ করত। তাদের কেউ মেয়েকে জ্যান্ত দাফন করত যেন মাটির নিচে তার মৃত্যু ঘটে। আবার কেউ অসম্মান ও লাঞ্ছনার জীবন-যাপনে মেয়েকে বাধ্য করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ ٥٨ يَتَوَٰرَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ مِن سُوٓءِ مَا بُشِّرَ بِهِۦٓۚ أَيُمۡسِكُهُۥ عَلَىٰ هُونٍ أَمۡ يَدُسُّهُۥ فِي ٱلتُّرَابِۗ أَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ٥٩﴾ [النحل: ٥٨، ٥٩]
“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হত, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়, আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে সে দুঃখে সে কওম থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রাখ, তারা যা ফয়সালা করে তা কতই না মন্দ”! [সূরা আন-নাহল, আয়াত: (৫৮-৫৯]
অন্যত্র তিনি বলেন:
﴿وَإِذَا ٱلۡمَوۡءُۥدَةُ سُئِلَتۡ ٨ بِأَيِّ ذَنۢبٖ قُتِلَتۡ ٩﴾ [التكوير: ٨، ٩]
“আর যখন জীবন্ত কবরস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে”? [সূরা আত-তাকওয়ীর, আয়াত: ৮-৯]
‘মাওউদাতু’ সে মেয়েকে বলা হয়, যাকে জীবিত দাফন করা হয় যেন মাটির নীচে মারা যায়। কোনো কন্যা যদিও জ্যান্ত দাফন থেকে নিষ্কৃতি পেত, কিন্তু লাঞ্ছনার জীবন থেকে মুক্তি পেত না। নারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সম্পদ যদিও প্রচুর হত, কিন্তু তার মৃত্যুর পর নারী কখনো মিরাসের অধিকারী হত না, যদিও সে হত অভাবী ও খুব সংকটাপন্ন! কারণ তাদের নিকট পুরুষদের জন্য মিরাস খাস ছিল, নারীদের তাতে কোনো অংশ ছিল না, বরং নারীরা মৃত স্বামীর সম্পদের ন্যায় মিরাসে পরিণত হত। ফলশ্রুতিতে এক পুরুষের অধীন অনেক নারী আবদ্ধ হত, যার নির্ধারিত কোনো সংখ্যা ছিল না। একাধিক সপত্নী বা সতীন থাকার কারণে নারীরা যে সংকীর্ণতা, যুলম ও কোণঠাসা অবস্থার সম্মুখীন হত -সেটাও তাদের অনেকের নিকট বিবেচ্য ছিল না।
[1] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৬৭/৫১১৩
ইসলামে নারীর মর্যাদা:
ইসলাম এসে নারীর ওপর থেকে এসব যুলম দূরীভূত করেছে, তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে পুরুষদের ন্যায় মনুষ্য অধিকার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ﴾ [الحجرات: ١٣]
“হে মানব জাতি, নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি পুরুষ ও নারী থেকে”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
এখানে আল্লাহ বলেছেন যে, মানব সৃষ্টির শুরু থেকে নারী পুরুষের সঙ্গী, যেমন সে পুরুষের সঙ্গী নেকি প্রাপ্তি ও শাস্তির ক্ষেত্রে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧﴾ [النحل: ٩٧]
“যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমরা তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব”। [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৯৭]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿لِّيُعَذِّبَ ٱللَّهُ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتِ وَٱلۡمُشۡرِكِينَ وَٱلۡمُشۡرِكَٰتِ﴾ [الاحزاب: ٧٣]
“যাতে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদের ‘আযাব দেন। আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭৩]
আল্লাহ তা‘আলা মৃত ব্যক্তির সম্পদের ন্যায় নারীকে পরিত্যক্ত মিরাস গণ্য করা হারাম করেন। যেমন তিনি বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَحِلُّ لَكُمۡ أَن تَرِثُواْ ٱلنِّسَآءَ كَرۡهٗاۖ ﴾ [النساء: ١٩]
“হে মুমিনগণ, তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোর করে নারীদের ওয়ারিশ হবে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯]
এভাবে ইসলাম নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে তাকে ওয়ারিশ ঘোষণা দেয়। কারণ, সে পরিত্যক্ত সম্পদ নয়। মৃত নিকট আত্মীয়ের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে মিরাসের হক প্রদান করে তাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لِّلرِّجَالِ نَصِيبٞ مِّمَّا تَرَكَ ٱلۡوَٰلِدَانِ وَٱلۡأَقۡرَبُونَ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٞ مِّمَّا تَرَكَ ٱلۡوَٰلِدَانِ وَٱلۡأَقۡرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنۡهُ أَوۡ كَثُرَۚ نَصِيبٗا مَّفۡرُوضٗا ٧﴾ [النساء: ٧]
“পুরুষদের জন্য মাতা পিতা ও নিকট আত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ রয়েছে। আর নারীদের জন্য রয়েছে মাতা পিতা ও নিকট আত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ, তা কম হোক বা বেশি হোক, নির্ধারিত হারে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿يُوصِيكُمُ ٱللَّهُ فِيٓ أَوۡلَٰدِكُمۡۖ لِلذَّكَرِ مِثۡلُ حَظِّ ٱلۡأُنثَيَيۡنِۚ فَإِن كُنَّ نِسَآءٗ فَوۡقَ ٱثۡنَتَيۡنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَۖ وَإِن كَانَتۡ وَٰحِدَةٗ فَلَهَا ٱلنِّصۡفُۚ ﴾ [النساء: ١١]
“আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদেরকে ক্ষেত্রে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ, আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক …”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১]
এভাবে আল্লাহ একজন নারীকে মা, মেয়ে, বোন ও স্ত্রী হিসেবে মিরাস দান করেন।
আর বিবাহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি প্রদান করেন, শর্ত হচ্ছে নারীদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও তাদের সাথে প্রচলিত রেওয়াজ মোতাবেক আচরণ করতে হবে। তিনি বলেন:
﴿وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ﴾ [النساء: ١٩]
“আর তাদের সাথে সদ্ভাবে আচরণ কর”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯]
অধিকন্তু নারীর জন্য পুরুষের ওপর দেন-মোহর অবধারিত করে তাকে তা পরিপূর্ণ প্রদান করার নির্দেশ দেন, তবে নারী যদি স্বেচ্ছায় ও পূর্ণ সন্তুষ্টিতে কিছু হক ত্যাগ করে সেটা পুরুষের জন্য বৈধ। তিনি বলেন:
﴿وَءَاتُواْ ٱلنِّسَآءَ صَدُقَٰتِهِنَّ نِحۡلَةٗۚ فَإِن طِبۡنَ لَكُمۡ عَن شَيۡءٖ مِّنۡهُ نَفۡسٗا فَكُلُوهُ هَنِيٓٔٗا مَّرِيٓٔٗا ٤ ﴾ [النساء: ٤]
“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তিসহ খাও”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪]
ইসলাম নারীকে তার স্বামীর ঘরে আদেশ ও নিষেধকারী জিম্মাদার এবং স্বীয় সন্তানের ওপর কর্তৃত্বকারী অভিভাবক বানিয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا»
“নারী তার স্বামীর ঘরে জিম্মাদার এবং তার জিম্মাদারি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে”।[1]
রেওয়াজ মোতাবেক নারীর খরচ ও পোশাক-পরিচ্ছদ প্রদান করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব করেছেন।
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮২৯; তিরমিযী, হাদীস নং ১৭০৫, আবু দাউদ, হাদীস নং ২৯২৮, আহমদ: (২/১২১)
ইসলামের শত্রু ও তার দোসররা নারীর ইজ্জত-সম্মান হরণ করে কী চায়?
সন্দেহ নেই, ইসলামের শত্রু বরং মানব জাতির শত্রু কাফির, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত নারীর ইজ্জত, সম্মান ও নিরাপত্তা তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। কারণ এসব কাফির ও মুনাফিকরা চায় নারীরা দুর্বল ঈমান ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের শিকার করা বস্তু ও ধ্বংসের হাতিয়ার হোক। আর তাদের সমাজের নারীদের থেকে তারা নিজেরা প্রবৃত্তি পূর্ণ করে নিয়েছে সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَيُرِيدُ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلشَّهَوَٰتِ أَن تَمِيلُواْ مَيۡلًا عَظِيمٗا﴾ [النساء: ٢٧]
“আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা প্রবলভাবে (সত্য থেকে) বিচ্যুত হও”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৭]
বস্তুত যেসব মুসলিমদের অন্তরে রোগ ও ব্যাধি রয়েছে, তারা চায় নারীরা তাদের প্রবৃত্তি পূরণ ও শয়তানি কর্ম-কাণ্ডে সস্তাপণ্য হোক। তাদের সামনে উন্মুক্ত পণ্য হয়ে থাক, যেন তার সৌন্দর্য দেখে তারা মুগ্ধ হয় অথবা তার থেকে আরো ঘৃণিত উদ্দেশ্য হাসিল করতে সক্ষম হয়। এ জন্য তারা প্রলুব্ধ করে যেন কাজের জন্য নারী ঘর থেকে বের হয় ও তাদের পাশা-পাশি কাজ করে অথবা নার্স সেজে পুরুষদের সেবা দেয় অথবা বিমান বালা হয় অথবা সহশিক্ষায় ছাত্রী কিংবা শিক্ষিকা হয়। অথবা সিনেমায় অভিনেত্রী ও গায়িকা হয় অথবা বিভিন্ন মিডিয়ার বিজ্ঞাপনে মডেল হয়। উন্মুক্ত ঘোরাফেরা এবং কণ্ঠ ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ফেতনার জন্ম দেয়। ম্যাগাজিনগুলো অধিক প্রচার ও বাজার হাসিল করার উদ্দেশ্যে উলঙ্গ-আবেদনময়ী নারীদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কতক অসাধু ব্যবসায়ী তাদের পণ্য প্রচারের জন্য এসব ছবিকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে, তাদের উৎপাদিত পণ্য ও শো-রোমসমূহে এসব ছবি তারা সাঁটিয়ে দেয়। এ জাতীয় পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের কারণে অধিকাংশ নারী তাদের ঘরের প্রকৃত দায়িত্ব ত্যাগ করেছে, যে কারণে তাদের স্বামীরা ঘর গুছানো ও সন্তান লালন-পালন করার জন্য বাধ্য হয়ে বাহির থেকে খাদ্দামাহ ও সেবিকা ভাড়া করছে, যা অনেক ফিতনা ও অনিষ্টের জন্ম দিচ্ছে দিন দিন।
কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ঘরের বাইরে নারীর কাজ করা বৈধ:
১. নারী যদি কাজের মুখাপেক্ষী হয় অথবা সমাজ তার সেবার প্রয়োজন বোধ করে এবং তার সেবা দানকারী বিকল্প কোনো পুরুষ না পাওয়া যায়।
২. নারীর মূল দায়িত্ব বাড়ির কাজ শেষে অন্য কাজ করা।
৩. নারীদের পরিবেশে কাজ করা, যেমন পুরুষ থেকে পৃথক পরিবেশে নারীদের শিক্ষা দান করা অথবা নারীদের সেবা ও চিকিৎসা প্রদান করা। এ তিনটি শর্তে নারীর পক্ষে ঘরের বাইরে কাজ করা বৈধ।
৪. অনুরূপ নারীর পক্ষে দীনি ইলম শিখা ও শিখানো দোষ নয় বরং জরুরি, তবে নারীদের পরিবেশে হতে হবে। অনুরূপ মসজিদ ও মসজিদের মতো পরিবেশে ধর্মীয় মজলিসে অংশ গ্রহণ করা তার পক্ষে দোষণীয় নয়। অবশ্যই পুরুষ থেকে পৃথক ও পর্দানশীন থাকা জরুরি, যেভাবে ইসলামের শুরু যুগে নারীরা কাজ আঞ্জাম দিত, দীন শিক্ষা করত ও মসজিদে হাজির হত।
নারীরা তাদের শরীর ও নারীত্বের সাথে উপযোগী সৌন্দর্য গ্রহণ করবে
যেমন, নখ কাটা বরং নিয়মিত নখ কাটা সকল আহলে ইলমের ঐকমত্যে বিশুদ্ধ সুন্নত এবং হাদীসে বর্ণিত মনুষ্য স্বভাবের দাবি এটিই। অধিকন্তু নখ কাটা সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা এবং নখ না-কাটা বিকৃতি ও হিংস্র প্রাণীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেক সময় লম্বা নখের অভ্যন্তরে ময়লা জমে তাই সেখানে পানি পৌঁছায় না। কতক মুসলিম নারী কাফেরদের অনুকরণ ও সুন্নত না-জানার কারণে নখ লম্বা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলেছে যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
নারীর বগল ও নাভির নিচের পশম দূর করা সুন্নত। কারণ, হাদীসে তার নির্দেশ রয়েছে, এতেই তাদের সৌন্দর্য। তবে উত্তম হচ্ছে প্রতি সপ্তাহ পরিচ্ছন্ন হওয়া, অন্যথায় চল্লিশ দিনের ভেতর অবশ্যই পরিচ্ছন্ন হওয়া।
নারীর মাথার চুল, চোখের ভ্রু, খেযাব ও রঙ ব্যবহার করার বিধান:
মুসলিম নারীর মাথার চুল বড় করা ইসলামের দাবি, বিনা প্রয়োজনে মাথা মুণ্ডন করা হারাম।
সৌদি আরবের মুফতি শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ. বলেন: “নারীর চুল কাটা বৈধ নয়। কারণ, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম নাসাঈ স্বীয় সুনান গ্রন্থে, উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম বাযযার স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে এবং ইকরিমাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইবন জারির তাবারি স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে মাথা মুণ্ডন করতে নিষেধ করেছেন”।[1] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নিষেধাজ্ঞার অর্থ হারাম, যদি তার বিপরীত দলীল না থাকে।
মোল্লা আলী ক্বারী মিশকাতের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘মিরকাত’-এ বলেন: “নারীর মাথা মুণ্ডনের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণ: পুরুষের পুরুষত্ব ও সৌন্দর্যের জন্য দাঁড়ি যেরূপ নারীর নারীত্ব ও সৌন্দর্যের জন্য চুল/মাথার বেণী সেরূপ”।[2]
মাথার চুল কাঁটা যদি সৌন্দর্য ছাড়া কোনো প্রয়োজনে হয়, যেমন চুল বহন করা কঠিন ঠেকে অথবা বেশি বড় হওয়ার কারণে পরিচর্যা করা কষ্টকর হয়, তাহলে প্রয়োজন মোতাবেক কাটা সমস্যা নয়। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তার কতক স্ত্রী চুল ছোট করতেন। কারণ, তার মৃত্যুর পর তারা সৌন্দর্য পরিহার করতেন, তাই চুল বড় রাখা তাদের প্রয়োজন ছিল না।
নারীর চুল কাটার উদ্দেশ্য যদি হয় কাফির ও ফাসিক নারী বা পুরুষদের সাথে সামঞ্জস্য গ্রহণ করা, তাহলে নিঃসন্দেহে তা হারাম। কারণ, কাফিরদের সামঞ্জস্য গ্রহণ না করাই ইসলামের সাধারণ নির্দেশ। অনুরূপ নারীদের জন্য পুরুষদের সামঞ্জস্য গ্রহণ করা হারাম, যদি সৌন্দর্যের উদ্দেশ্য গ্রহণ করা হয় তবুও হারাম।
আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ আমীন শানকিতি রহ. ‘আদওয়াউল বায়ান’ গ্রন্থে বলেন: “অনেক দেশে নারীরা মাথার কাছ থেকে চুল কাঁটার যে অভ্যাস গড়ে নিয়েছে -তা পশ্চিমা ও ইউরোপীয় রীতি। এ স্বভাব ইসলাম ও ইসলাম পূর্ব যুগে আরবদের নারীদের ছিল না। উম্মতের মাঝে ধর্মীয়, চারিত্রিক ও বৈশিষ্ট্যে সেসব বিকৃতি ও পদস্খলন মহামারির আকার ধারণ করেছে এটা তারই অংশ। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত হাদীস সম্পর্কে বলেন:
»أن أزواج النبي صلى الله عليه وسلم يأخذن من رؤوسهن حنى تكون كالوفرة«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ কানের লতি পর্যন্ত তাদের মাথার চুল কর্তন করতেন”।[3] এরূপ করেছেন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর, তার জীবিতাবস্থায় তারা সৌন্দর্য গ্রহণ করতেন, যার অন্যতম অংশ ছিল চুল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তাদের জন্য বিশেষ বিধান হয়, যে বিধানে পৃথিবীর কোনো নারী তাদের শরীক নয়। সেটা হচ্ছে বিবাহের আশা তাদের একেবারেই ত্যাগ করা। এমনভাবে ত্যাগ করা যে, কোনো অবস্থায় বিবাহ সম্ভব নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তারা আমৃত্যু ইদ্দত পালনকারী নারীর মত ছিলেন। ইদ্দত পালনকারী নারীর মতো তাদের পক্ষে বিবাহ করা বৈধ ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمَا كَانَ لَكُمۡ أَن تُؤۡذُواْ رَسُولَ ٱللَّهِ وَلَآ أَن تَنكِحُوٓاْ أَزۡوَٰجَهُۥ مِنۢ بَعۡدِهِۦٓ أَبَدًاۚ إِنَّ ذَٰلِكُمۡ كَانَ عِندَ ٱللَّهِ عَظِيمًا﴾ [الاحزاب: ٥٣]
“আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিয়ে করা কখনো তোমাদের জন্য সঙ্গত নয়। নিশ্চয় এটি আল্লাহর কাছে গুরুতর পাপ”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৩]
অতএব, একেবারে পুরুষদের সঙ্ঘ থেকে নিরাশ হওয়ার ফলে সৌন্দর্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা ছাড় রয়েছে, যেভাবে নিরাশ হওয়া অন্যান্য নারীদের জন্য বৈধ নয়।[4]
তাই নারীর ওপর কর্তব্য হচ্ছে, মাথার চুল সংরক্ষণ করা, চুলের যত্ন নেওয়া ও লম্বা বেণী বানিয়ে রাখা, মাথার ওপর বা ঘাড়ে জমা করে রাখা নিষেধ।
শাইখুল শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন: “কতক অসৎ নারী দুই কাঁধের মাঝে চুলের একটি খোঁপা বা বেণী বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখে”।[5]
সৌদি আরবের মুফতি শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ. বলেন: “এ যুগে কতক মুসলিম নারী, মাথার চুলকে যেভাবে একপাশে নিয়ে ঘাড়ের নিকট খোপা বানিয়ে রাখে অথবা মাথার ওপর স্তূপ করে রাখে, যেরূপ পশ্চিমা ও ইউরোপীয় নারীরা করে তা বৈধ নয়। কারণ, এতে কাফিরদের নারীদের সাথে সামঞ্জস্য হয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত একটি লম্বা হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
»صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ، لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا«
“দু’প্রকার জাহান্নামী লোক যাদের আমি এখনো দেখি নি: এক প্রকার লোকের সাথে গরুর লেজের ন্যায় লাঠি থাকবে, তা দিয়ে তারা মানুষদের পেটাবে। আর পোশাক পরিহিত বিবস্ত্র নারী, তারা নিজেরা ধাবিত হয় ও অপরকে ধাবিত করে। তাদের মাথা উটের ঝুঁকে পড়া কুজের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার গন্ধও পাবে না, যদিও তার গন্ধ এত এত দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়”।[6]
“ধাবিত হয় ও ধাবিত করে” কথার ব্যাখ্যায় কতক আলেম বলেন: “তারা নিজেরা এমনভাবে চিরুনি করে যা আবেদনময়ী ও অপরকে আকৃষ্টকারী এবং অপরকেও তারা সেভাবে চিরুনি করে দেয়, যা নষ্ট নারীদের চিরুনি করার রীতি। পশ্চিমা নারী এবং তাদের অনুসারী বিপথগামী মুসলিম নারীদের চিরুনি করার এটিই রীতি।[7]
যেরূপ নিষেধ বিনা প্রয়োজনে মুসলিম নারীর মাথার চুল কর্তন অথবা ছোট করা, সেরূপ নিষেধ তার চুলের সাথে অপরের চুল যুক্ত করা ও অপরের চুল দ্বারা তার চুল বর্ধিত করা। কারণ, সহীহ বুখারী বুখারী ও মুসলিমে এসেছে:
»لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم الواصلة والمستوصلة«
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াসিলাহ ও মুসতাওসিলাহকে অভিসম্পাত করেছেন”।[8]
‘ওয়াসিলাহ’ সে নারীকে বলা হয়, যে নিজের চুলের সাথে অপরের চুল যোগ করে, আর যে নারী চুল যোগ করার কাজ করে তাকে বলা হয় মুসতাওসিলাহ। এ কাজ ও পেশায় মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা হয় তাই হারাম। চুল যোগ করার পর্যায়ে পড়ে বারুকা তথা ‘পরচুলা’ পরিধান করা। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেন: মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মদিনায় এসে খুৎবা প্রদান করেন, তখন তিনি চুলের একটি খোঁপা অথবা চুলের কিছু অংশ বের করেন এবং বলেন: তোমাদের নারীদের কী হলো, তারা তাদের মাথা এরূপ করে? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
»مَا مِنِ امْرَأَةٍ تَجْعَلُ فِي رَأْسِهَا شَعْرًا مِنْ شَعْرِ غَيْرِهَا، إِلا كَانَ زُورًا«
“যে কোনো নারী নিজের মাথায় অপরের চুল রাখবে সে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণকারী”।
‘বারুকা’ বা ‘পরচুলা’ একপ্রকার কৃত্রিম চুল, যা দেখতে মাথার চুলের ন্যায়। এগুলো পরিধান করাও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করার শামিল।
খ. চেঁছে অথবা ছেঁটে অথবা লোম নাশক দ্রব্য ব্যবহার করে ভ্রুর পশম সম্পূর্ণ বা আংশিক দূর করা মুসলিম নারীর জন্য হারাম। কারণ, এটাকে আরবিতে ‘নামস’ বলে, যা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারণ করেছেন। ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করেন:
»لعن صلى الله عليه وسلم النامصة والمتنمصة«
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামিসাহ ও মুতানাম্মিসাহকে লা‘নত করেছেন”।[9]
‘নামিসাহ’ সে নারীকে বলা হয়, যে নিজের ধারণায় সৌন্দর্য চর্চা করতে গিয়ে পূর্ণ ভ্রু বা আংশিক ভ্রু ফেলে দেয়। আর যে এ কাজ করে তাকে ‘মুতানাম্মিসাহ’ বলা হয়। এ জাতীয় কাজ আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন আনার শামিল, যা থেকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে, আর শয়তান বনী আদমকে দিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার প্রতিজ্ঞা করে এসেছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَأٓمُرَنَّهُمۡ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلۡقَ ٱللَّهِۚ﴾ [النساء: ١١٩]
“আমরা অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ করব, যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৯]
অনুরূপ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»لعن الله الواشمات والمستوشمات والنامصات والمتنمصات والمتفلجات للحسن، المغيرات خلق الله«
“আল্লাহ তা‘আলা লা‘নত করেছেন উল্কি গ্রহণকারী ও উল্কি অঙ্কনকারী। কৃত্রিম চুল সংযোগকারী ও কৃত্রিম চুল সংযোজন পেশায় নিয়োজিত নারীকে এবং যারা সৌন্দর্যের জন্য দাঁত ফাঁক করে, আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে”।[10]
অতঃপর ইবন মা‘সউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদেরকে লা‘নত করেছেন আমি কি তাদেরকে লা‘নত করব না অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার নির্দেশ আল্লাহর কিতাবে রয়েছে?! আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْ﴾ [الحشر: ٧]
“আর রাসূল যা তোমাদেরকে দিয়েছে তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তিনি তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন, তোমরা (তা থেকে) বিরত থাক”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭]
ইবন কাসির রহ. স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে এ আলোচনা করেছেন।[11]
বর্তমান যুগে বিপদজনক এ কবিরাহ গুনাহতে অনেক নারীই লিপ্ত, কৃত্রিম চুল সংযোজন করা তাদের নিত্যদিনের সাজ-সজ্জার অন্তর্ভুক্ত। অথচ এ জাতীয় কর্মের নির্দেশ যদি স্বামী করে, তবুও তার অনুসরণ করা বৈধ নয়। কারণ, এটা পাপ।
গ. সৌন্দর্যের জন্য মুসলিম নারীর দাঁত ফাঁক করা হারাম। যেমন, সুন্দর করার উদ্দেশ্যে রেত দিয়ে ঘষা, যাতে দাঁত সামান্য ফাঁক হয়। হ্যাঁ, দাঁত যদি বক্র হয় ও তাতে বিকৃতি থাকে, তবে অপারেশন দ্বারা ঠিক করা বৈধ। অথবা দাঁতে পোকা হলে দূর করা দুরস্ত আছে। কারণ, এটা চিকিৎসা ও বিকৃতি দূর করার শামিল, যা দন্ত চিকিৎসকের কাজ।
ঘ. শরীরে উল্কি আঁকা নারীর জন্য হারাম। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্কি গ্রহণকারী ও উল্কি অঙ্কনকারী উভয়কে লা‘নত করেছেন। হাদীসে অভিশপ্ত الواشمة ‘ওয়াশিমা’ ঐ নারীকে বলা হয়, যে সুঁই দ্বারা হাত অথবা চেহারা ছিদ্র করে, অতঃপর তা সুরমা বা কালি দিয়ে ভরাট বা ফিলিং করে দেয়, আর অভিশপ্ত المستوشمة ঐ নারীকে বলা হয়, যার সাথে এসব করা হয়। এ জাতীয় কাজ হারাম ও কবিরা গুনাহ। এসব গ্রহণকারী ও সম্পাদনকারী উভয়কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা‘নত করেছেন, আর কবিরা গুনাহ ব্যতীত কোনো গুনাহর জন্য লা‘নত করা হয় না।
ঙ. নারীদের চুল রঙিন করা এবং স্বর্ণ ও খেজাব ব্যবহার করার বিধান:
১. খেযাব বা মেহেদির ব্যবহার: ইমাম নাওয়াওয়ী রহ. বলেন: “বিবাহিত নারীর দুই হাত ও দুই পা মেহেদী দ্বারা খেযাব করা মুস্তাহাব। কারণ, এ মর্মে অনেক প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে”।[12] প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা তিনি আবু দাউদে বর্ণিত হাদীসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন:
»أن امرأة سألت عائشة رضي الله عنها عن خضاب الحناء، فقالت: لا بأس به، ولكني أكرهه، كان حبيبي رسول الله صلى الله عليه وسلم يكره ريحه«
“জনৈকা নারী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে মেহেদীর খেজাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি বলেন: এতে সমস্যা নেই, তবে আমি তা পছন্দ করি না। কারণ আমার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পছন্দ করতেন না”।[13]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ‘আনহা থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেন:
»أومأت امرأة من وراء ستر – بيدها كتاب – إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقبض النبي صلى الله عليه وسلم يده وقال: ما أدري أيد رجل أم يد امرأة ؟ قالت: بل يد امرأة: قال: لو كنت امرأة لغيرت أظفارك – يعني: بالحناء«
“জনৈকা নারী হাতে কিতাব নিয়ে পর্দার আড়াল থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ইশারা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে বলেন: আমি জানি না এটা পুরুষের হাত না নারীর হাত? সে বলল: বরং নারীর হাত। তিনি বলেন: তুমি নারী হলে অবশ্যই তোমার নখ পরিবর্তন করতে- অর্থাৎ মেহেদী দিয়ে”।[14] তবে এমন বস্তু দিয়ে রঙ করবে না, যা জমে যায় ও পবিত্রতা অর্জনে বাঁধা হয়।[15]
২. নারীর চুল রঙ্গিন করার বিধান:
নারী যদি বৃদ্ধা হয়, তাহলে কালো ব্যতীত যে কোনো রঙ্গ দ্বারা তার চুল রঙ্গিন করা বৈধ। কারণ, কালো রঙ ব্যবহার করা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ইমাম নাওয়াওয়ী রহ. ‘রিয়াদুস সালিহীন’ গ্রন্থে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন, যার শিরোনাম: “নারী ও পুরুষের চুলে কালো খেযাব ব্যবহার করা নিষেধ”।[16] তিনি আল-মাজমু‘ গ্রন্থে বলেন: “নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য কালো খেযাব ব্যবহার করা নিষেধ, এতে কোনো পার্থক্য নেই। এটিই আমাদের মাযহাব”।[17]
যুবতী নারীর কালো চুল অন্য রঙ দ্বারা রঙ্গিন করা আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়, তার কোনো প্রয়োজনও নেই। কারণ, চুলের ক্ষেত্রে কালোই সৌন্দর্য। চুলের কালো রঙ বিকৃতি নয় যে, পরিবর্তন করতে হবে। দ্বিতীয়ত এতে কাফির নারীদের সাথে সামঞ্জস্য হয়।
[1]তিরমিযি: (৯১৪), নাসাঈ, হাদীস নং৫০৪৯)
[2] মাজমুউল ফতোয়া শাইখ ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ: (২/৪৯)
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২০
[4] আদওয়াউল বায়ান: (৫/৫৯৮-৬০১) স্বামী যদি চুল কাঁটার নির্দেশ দেয় তবুও তার পক্ষে চুল কাঁটা বৈধ নয়, কারণ স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোনো অনুকরণ নেই।
[5] মাজমুউল ফতোয়া: (২২/১৪৫)
[6] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১২৮; আহমদ (২/৪৪০); ইমাম মালিক, হাদীস নং ১৬৯৪
[7] মাজমুউল ফতোয়া: (২/৪২), আরো দেখুন: ঈদাহ ও আত-তাবঈন: (পৃ. ৮৫) লি শাইখ হামুদ তুওয়াইজিরি।
[8] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৯৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১২৪; তিরমিযী, হাদীস নং ১৭৫৯, নাসাঈ, হাদীস নং ৫০৯৫; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪১৬৮; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৯৮৭; আহমদ (২/২১)
[9] নাসাঈ, হাদীস নং ৫১০১
[10] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৮৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১২৫; তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৮২; নাসাঈ হাদীস নং ৫০৯৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪১৬৯; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৯৮৯; আহমদ (১/৪৩৪), দারেমী, হাদীস নং ২৬৪৭
[11] (২/৩৫৯), দারুল উন্দুলুস প্রকাশিত।
[12] আল-মাজমু: (১/৩২৪)
[13] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪১৬৪, নাসাঈ, হাদীস নং ৫০৯০; আহমদ: (৬/১১৭)
[14] নাসাঈ, হাদীস নং ৫০৮৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪১৬৬; আহমদ (৬/২৬২)
[15] উদাহরণত, সেসব রঙ যার দ্বারা রঙ করলে নখের উপর প্রলেপ পড়ে যায় এবং তার অভ্যন্তরে পানি পৌঁছে না। যেমন লখ পালিশ।
[16] সিয়াদুস সালিহীন: (৬২৬)
[17] আল-মাযমু: (১/৩২৪)
স্বর্ণ ও রূপার ব্যবহার
সমাজে প্রচলিত রীতি মোতাবেক স্বর্ণ ও রূপা দ্বারা নারীর সৌন্দর্য গ্রহণ করা বৈধ। এটা আলেমদের ঐকমত্যে। তবে পর-পুরুষের জন্য তার অলঙ্কার প্রকাশ করা বৈধ নয়, তাদের থেকে আড়ালে রাখবে, বিশেষভাবে যখন সে ঘর থেকে বের হয় ও পুরুষদের দৃষ্টির নাগালে থাকে। কারণ, এতে ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য নারীর পায়ের নিচে কাপড়ের আড়ালে থাকা অলঙ্কারের আওয়াজও পুরুষকে শুনাতে নিষেধ করা হয়েছে।[1] অতএব, প্রকাশ্য অলঙ্কারের হুকুম সহজে অনুমেয়?
[1] আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তারা যেন নিজেদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে”। সূরা নূর: (৩১)
হায়েযের সংজ্ঞা:
হায়েযের আভিধানিক অর্থ প্রবাহিত হওয়া। শরী‘আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট সময় নারীর রেহেমের গভীর থেকে কোনো অসুখ ও আঘাত ব্যতীত যে রক্ত প্রবাহিত হয় তা-ই হায়েয। হায়েয মনুষ্য স্বভাব ও প্রকৃতি, যার ওপর আল্লাহ আদমের মেয়েদের সৃষ্টি করেছেন। তাদের গর্ভাশয়ে আল্লাহ এ রক্ত সৃষ্টি করেন যেন গর্ভে থাকা বাচ্চা তা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। প্রসবের পর এ রক্তই দুধ হিসেবে রূপান্তর হয়। নারী গর্ভবতী বা দুগ্ধ দানকারীনী না হলে গর্ভাশয়ে সৃষ্ট রক্ত ব্যবহৃত হওয়ার কোনো স্থান থাকে না, তাই তা নির্দিষ্ট সময় জরায়ু দিয়ে নির্গত হয়, যার নাম ঋতু, রজঃস্রাব, মাসিক ও পিরিয়ড ইত্যাদি।
হায়েযের বয়স:
নারীরা ন্যূনতম নয় বছরে ঋতুমতী হয়, পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَٱلَّٰٓـِٔي يَئِسۡنَ مِنَ ٱلۡمَحِيضِ مِن نِّسَآئِكُمۡ إِنِ ٱرۡتَبۡتُمۡ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَٰثَةُ أَشۡهُرٖ وَٱلَّٰٓـِٔي لَمۡ يَحِضۡنَۚ﴾ [الطلاق: ٤]
“তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা ঋতুমতী হওয়ার ফলে কাল অতিক্রম করে গেছে, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা যদি সংশয়ে থাক এবং যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি তাদের ইদ্দত কালও হবে তিন মাস”। [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত:৪]
এখানে ঋতুমতীর ইদ্দতকাল অতিক্রম করার অর্থ পঞ্চাশ বছরে উপনীত হওয়া। আর ঋতুর বয়সে পৌঁছে নি অর্থ যে মেয়েরা এখনো ছোট, নয় বছরও হয় নি যাদের।