রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ কোন মু’মিন ব্যক্তির জন্য নিজেকে অপমানিত করাটা শোভনীয় নয়। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, সে নিজেকে কিভাবে অপমানিত করে? তিনি বললেনঃ এমন কঠিন বিষয়ে লিপ্ত হওয়া যার সামর্থ্য তার নেই। (সূনান আত তিরমিযী ২২৫৪)
আবূ উমাইয়া আশ-শাবানী (রাঃ) বলেন, আমি আবূ সালাবা আল-খুশানী (রাঃ) এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই আয়াত সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন, কোন আয়াত? আমি বললাম, এই আয়াত (অনুবাদঃ) ‘‘হে মুমিনগণ! আত্মসংশোধন করাই তোমাদের কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’’ (সূরা মায়িদাঃ ১০৫)। তিনি বলেন, আমি এ আয়াত সম্পর্কে অধিক অবহিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছি। আমি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছি।
তিনি বলেনঃ বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ নিষেধ করতে থাকো। শেষে এমন এক যুগ আসবে যখন তুমি লোকদেরকে কৃপণতার আনুগত্য করতে, প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে, পার্থিব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে এবং প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অহংকার করতে দেখবে (প্রত্যেকেই নিজের মতকে সর্বোত্তম মনে করছে) আর তুমি এমনসব গর্হিত কাজ হতে দেখবে যা প্রতিহত করার সামর্থ্য তোমার থাকবে না, এরূপ পরিস্থিতিতে তুমি নিজেকে হেফাজত করো এবং সর্বসাধারণের চিন্তা ছেড়ে দাও। তোমাদের পরে আসবে কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষার যুগ। তখন ধৈর্যধারণ করাটা জ্বলন্ত অঙ্গার হাতের মুঠোয় রাখার মত কঠিন হবে সে যুগে কেউ নেক আমল করলে তার সমকক্ষ পঞ্চাশ ব্যক্তির সওয়াব তাকে দান করা হবে। (সুনান আত তিরমিযী ৩০৫৮, সুনানে ইবনে মাজাহ ৪০১৪)
আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন অবশ্যই বান্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, শেষে বলবেনঃ তুমি অন্যায় কাজ হতে দেখে তা প্রতিহত করোনি কেন? (সে জবাবদানে অসমর্থ হলে) আল্লাহ তাকে তার যথাযথ উত্তর শিখিয়ে দিবেন। তখন বান্দা বলবে, হে প্রভু! আমি তোমার রহমতের প্রত্যাশী হয়ে লোকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিয়েছি। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৪০১৭)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে সে যেন হাত দ্বারা এর প্রতিহত/ সংশোধন করে দেয়। যদি এর ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখের দ্বারা, যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর দ্বারা (উক্ত কাজকে ঘৃণা করবে), আর এটাই ঈমানের দুর্বলতম পরিচায়ক। (যার কাছে ঈমান আছে সে অন্ততপক্ষে অন্যায় কাজকে অন্তরে হলেও ঘৃণা করবে। উল্লেখ্য যে, ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি নেই। কেউ হয় ঈমানদার আর না হয় বে-ঈমান বা কাফের। কোন ব্যক্তি একাধারে মু’মিন ও কাফির হতে পারে? যে মু’মিন সে নিঃসন্দেহে মু’মিন এবং যে কাফির সে তাে নিঃসন্দেহে কাফির। একীন ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও দুর্বলতার নিরিখে ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের আনুগত্য ঈমানের ফসল। ফসলের ক্ষেত্রে কম বেশির সুযােগ রয়েছে। একজন মুমিনের প্রকৃত ঈমানের দিক দিয়ে এ সম্ভাবনা নেই)। (সহিহ মুসলিম ৮১)
আল ফিকহুল আকবরে উল্লেখ করা হয়েছে যে,
ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি নেই, আসমানের অধিবাসী যেমন ফিরিশতা ও জান্নাতবাসী এবং দুনিয়ার অধিবাসী যেমন আম্বিয়া, আউলিয়া, নেককার মু’মিন ও বদকার মু’মিন, এদের ঈমানে মু’মিন হিসাবে হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। কর্মের কারণে মু’মিনের প্রতি প্রতিদানের প্রেক্ষিতে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির কথা আল – কুরআনে ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা আনফাল ৮ , আয়াত ২ – এ বলা হয়েছেঃ “ মু’মিন তাে তারাই , যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তার আয়াত তাদের কাছে পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে আর তারা তাদের রবের ওপর ভরসা করে।” হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এঁর কাছে ঈমান হ্রাস-বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় কি-না জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “ হ্যাঁ , তা বৃদ্ধি পায় , যতক্ষণ না সে তার ধারককে বেহেশতে প্রবেশ করায়। এবং তা হ্রাস পায়, যতক্ষণ না তার ধারককে দোযখে প্রবেশ করায়। এখানে ঈমানদারের আমলের কথা বলা হয়েছে। নেক আমলের কারণে ঈমানদার প্রথমেই বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর বদ আমলের কারণে গুনাহগার ঈমানদার প্রথমে দোযখে ও পরে বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহর স্মরণ ও তিলাওয়াতে কুরআন মু’মিনের ঈমানে দৃঢ়তা দান করে। আসল ঈমান অপরিবর্তিত থাকে। ইমাম আ’যম তার ‘আল অসিয়াত’ কিতাবে লিখেছেন যে, ঈমান বাড়েও না কমেও না , কেননা ঈমানের বৃদ্ধি কুফরী হ্রাসের সম্ভাবনা ছাড়া অকল্পনীয়। অনুরূপভাবে ঈমানের হ্রাস হওয়া কুফরী বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। এক ব্যক্তি কিরূপে এক অবস্থায় একাধারে মু’মিন ও কাফির হতে পারে? যে মু’মিন সে নিঃসন্দেহে মু’মিন এবং যে কাফির সে তাে নিঃসন্দেহে কাফির। যেমন সূরা নিসা ৪ , আয়াত ১৫১ – তে বলা হয়েছে, তারা প্রকৃত অর্থে কাফির, আর আমি কাফিরদের জন্য তৈরি করে রেখেছি লাঞ্ছনাদায়ক আযাব। সূরা ৮ আনফালের ৪ আয়াতে বলা হয়েছে ৪ তারা তাে প্রকৃত অর্থে মু’মিন, তাদের জন্য রয়েছে মর্যাদার আসন তাদের রবের কাছে , আরাে রয়েছে অনুকম্পা ও সম্মানজনক জীবনােপকরণ । মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ ﷺ -এঁর উম্মতরা সকলেই মু’মিন । তাঁরা কাফির নয় । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত অভিমত হলাে যে , গুনাহ ঈমানকে বিদূরিত করে না। একজন মু’মিন গুনাহ করতে পারে এবং গুনাহর কারণে তার ঈমান চলে যায় না (গুনাহ যদি কুফর পর্যন্ত না পৌঁছায়)। যদিও এ ব্যাপারে মু’তাযিলা ও খারিজিদের মত স্বতন্ত্র। আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের আনুগত্য ঈমানের ফসল। ফসলের ক্ষেত্রে কম বেশির সুযােগ রয়েছে। ঈমানের কারণে মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি মহব্বত পয়দা হয়। আমলের কারণে তা বৃদ্ধি পায় ও হ্রাস পায়। তাই হ্রাস-বৃদ্ধি আমলের সাথে সম্পৃক্ত, ঈমানের সঙ্গে নয়।
ইমাম রাযীর মতে, ঈমান হ্রাস-বৃদ্ধি কবুল করে না মূল বিশ্বাস হিসাবে , তবে একীনের দিক দিয়ে নয়। কেননা মু’মিনদের স্তর বিভিন্ন। আইনুল একীনের স্তর ইলমুল একীনের স্তরের ঊর্ধ্বে। এ জন্যই ইবরাহীম আলায়হিস সালাম বলেছিলেনঃ হে আমার রব! আমাকে দেখাও কিরূপে তুমি মৃতকে জীবিত কর। আল্লাহ্ তাকে তার ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেনঃ তুমি কি ঈমান রাখ না ? তিনি উত্তরে বললেনঃ অবশ্যই আমি ঈমান রাখি, তবে আমার চিত্ত যাতে প্রশান্ত হয় তার জন্য দেখতে চাই। এতে হযরত ইবরাহীমের ঈমানে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি। হয়েছে তার অন্তরে প্রশান্তি। তাঁর ইলমুল একীন ছিল, তিনি চাইলেন আইনুল একীন, এদিক দিয়ে ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। তবে মূল ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। একজন সাহাবীর ঈমান ও রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এঁর ঈমান , একজন সাধারণ মু’মিন ও একজন সাহাবীর ঈমান সমান নয়। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সমস্ত মু’মিনের ঈমানের সঙ্গে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এঁর ঈমানের ওজন করলে তার ঈমান নিশ্চিত প্রবল হবে। এ তার একীনের দৃঢ়তার দরুণ। একীন ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও দুর্বলতার নিরিখে ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। একজন মুমিনের প্রকৃত ঈমানের দিক দিয়ে এ সম্ভাবনা নেই। (আল ফিকহুল আকবর ৭৫-৭৬ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)