‘মীলাদ’ আরবী শব্দ। আরবীতে ‘মীলাদ’ ও ‘মাওলেদ’ প্রায়ই সমার্থক। ‘মাওলেদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ وَقْتُ الْوِلاَدَةِ اَوْ مَاكَانُهَا জন্মগ্রহণের সময় অথবা স্থান। আর ‘মীলাদ’ শব্দের অর্থ ‘জন্ম গ্রহণের সময়। কোন কোন অভিধানে জন্মগ্রহণের সময় এবং স্থানকেও ‘মীলাদ’ বলা হয়েছে। সুতরাং ‘মীলাদুন্নবী’র অর্থ দাঁড়ায় নবী করীম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জন্ম তথা শুভাগমনের সময় ও স্থান।
ইসলামের ইমামগণ ও বিজ্ঞ ওলামা-ই কেরামের পরিভাষায় ‘মীলাদুন্নবী’ হচ্ছে-
اِجْتِمَاعُ النَّاسِ وَقِرْأَةُ مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْانِ الْكَرِيْمِ وَرِوَايَةُ الْاَخْبَارِ الْوَارِدَةِ فِى وِلاَدَةِ نَبِىٍّ مِّنَ الْاَنْبَيَاءِ اَوْ وُلِىٍّ مِّنَ الْاَوْلِيَآءِ وَمَدحُهُمْ
অর্থাৎ লোকজন সমবেত হওয়া, ক্বোরআনুল করীম থেকে যতটুকু সহজ প্রথা সম্ভব হয় তিলাওয়াত করা, সম্মানিত নবীগণ কিংবা ওলীগণ থেকে কারো পবিত্র জন্ম সম্পর্কে বর্ণিত বর্ণনাদি আলোচনা করা এবং তাঁদের পবিত্র বাণীগুলো ও কর্মসমূহের প্রশংসা করা। প্রসিদ্ধ কিতাব ‘ই‘আনাতুত্ তালেবীন’ ৩য়খন্ডের ৩৬১ পৃষ্ঠায় এটা উদ্ধৃত হয়েছে। তা ছাড়া, ‘বুলূগুল মা’মূল ফিল ইহ্তিফা-ই ওয়াল ইহতিফালে বিমাওলিদির রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’-এও এ উদ্ধৃতিটি আনা হয়েছে।
‘মীলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। পৃথিবীতে প্রচলিত প্রত্যেক ধর্মেই বিভিন্ন ‘পর্ব’ উদ্যাপনের রীতি পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। প্রতিটি গোত্র বা সম্প্রদায় নিজ নিজ পর্বসমূহ অত্যন্ত আনন্দ সহকারে পালন করে। প্রতিটি উৎসব আবার সমাজ ও গোত্র অনুসারে বিশেষ বৈশিষ্ট্যেরও ধারক। বিশেষত দ্বীন-ইসলামে যেসব উপলক্ষ ও পর্বোৎসব রয়েছে, সেগুলোতো অতি তাৎপর্যবহ। কারণ, এসব অনুষ্ঠান শুধু প্রচলিত নিয়ম-নীতি পালন করা কিংবা আমোদ-প্রমোদের জন্য নয়, বরং সেগুলো অতীতের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী ইসলামের মহা মনীষীদের উল্লেখযোগ্য কার্যাবলীর স্মৃতি বহন করে। এসব পর্বানুষ্ঠান কায়েম রাখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে যেসব মহান ব্যক্তিত্ব এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে জুলুম-অত্যাচারকে পদদলিত করে ন্যায়, সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং যাঁরা সত্য ও ন্যায়ের পতাকাকে উড্ডীন করে কর্মক্ষেত্রে আত্মোৎসর্গ করে মিথ্যা ও বাতিলকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিকে অক্ষুণœ রাখা উচিত। এতে তাঁদের কথা স্মরণ করার সাথে সাথে তাঁদের কার্যাবলী ও মহা অবদানগুলোর কথাও স্মরণ হয়। তদুপরি, তখন মুসলমানদের মনে সৎকর্মের উদ্দীপনা, স্বত:স্ফূর্ততা, আনন্দানুভূতি, জ্ঞানের প্রসারতা ও উচ্চ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। মুসলমানগণ পুনরায় তাদের হারানো মর্যাদা লাভের অনুপ্রেরণা পায়। আর স্বীয় কার্যকলাপকে পূর্ববর্তী বুযুর্গদের আদর্শানুযায়ী পরিচালনা করার ও তাঁদের ধাঁচে স্বীয় চরিত্র গঠনের প্রয়াস পায়। এজন্য আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বোরআন মজীদে এরশাদ করেছেন- وَذَكِّرْهُمْ بِاَيِّامِ اللهِ অর্থাৎ ‘আল্লাহর দিনগুলো তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দাও।’’ মুফাস্সিরকুল শিরমণি হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত উবাই ইবনে কা’ব, হযরত মুজাহিদ, হযরত ক্বাতাদাহ্ এবং অন্যান্য মুফাস্সিরগণ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম বলেছেন, এ আয়াতে ‘আল্লাহ্ তা‘আলার দিনগুলো’ বলতে ওইসব দিনকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছেন। [সূত্র. তাফসীর-ই ইবনে জরীর, খাযিন, মাদারিক, খাযাইন, নূরুল ইরফান ও মুফরাদাত-ই ইমাম রাগেব ইত্যাদি]
ঈমানদার মাত্রই জানেন যে, আমাদের নবী, নবী ও রসূলকুল সরদার হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ নি’মাত বা অনুগ্রহ। আর অন্যান্য সমস্ত অনুগ্রহ তাঁরই মাধ্যমে বিশ্ববাসী লাভ করেছে। কারণ তাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ্ তা‘আলা কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তাছাড়া, তাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা বিশ্ববাসীর জন্য ‘উস্ওয়াহ্-ই হাসানাহ্’ (উত্তম আদর্শ) হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
সুতরাং যে মহান দিবসে আল্লাহর এ সর্ববৃহৎ অনুগ্রহ এ ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছেন, ওই দিবসকে স্মরণ করিয়ে দেয়া মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালনের সামিল; বিদ্‘আত কিংবা না-জায়েয তো মোটেই হতে পারে না, বরং যথানিয়মে আল্লাহর নির্দেশ পালন করাতো ইবাদত, তইা মহা পুণ্যেরই কাজ। সূরা ইয়ূনুসের ৫৮নং আয়াতে তো খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা আল্লাহর নি’মাত প্রাপ্তিতে খুশী উদ্যাপনের নির্দেশই দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে- قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْتَمَتِه فَبِذالِكَ فَلْيَفْرَحُوْا ط هُوَ خَيْرٌ مِّمَا يَجْمَعُوْنَ
অর্থাৎ হে হাবীব! আপনি বলে দিন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া; এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়।’’
মুফাস্সিরকুল শিরমণি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন, এ আয়াতে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ মানে ‘ইলমে দ্বীন’ এবং ‘তাঁর রহমত’ মানে ‘নবী করীম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।’ সূরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে- وَمَآاَرْسَلْنكَ اِلاَّ رَحْمَةً لِلْعلَمِيْنَ
অর্থাৎ ‘‘হে হাবীব! আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত করেই প্রেরণ করেছি।’’
হাফেযুল হাদীস ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূত্বী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল-হাভী লিল ফাতাওয়া’য় লিখেছেন-
اِنَّ اَصْلَ عَمَلِ الْمَوْلِدِ الَّذِىْ هُوَ اِجْتِمَاعُ النَّاسِ وَقِرْأَةُ مَاتَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْانِ وَرِوَايَةُ الْاَخْبَارِ الْوَارِدَةِ فِىْ مَبْدَأَ اَمْرِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَا وَقَعَ فِىْ مَوْلِدِه مِنَ الْايَاتِ هُوَ مِنَ الْبِدْعِ الَّتِىْ يُثَابُ عَلَيْهَا صَاحِبُهَا لِمَا فِيْهِ مِنْ تَعْظِيْمِ قَدْرِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاِظْهَارِ الْفَرْحِ وَالْاِشْتِبْشَارِ بِمَوْلِدِه الشَّرِيْفِ ـ
অর্থাৎ ‘মীলাদুন্নবী’র মূল কাজ হচ্ছে এ’তে লোক-সমাগম হয়, সাধ্যানুসারে ক্বোরআন পাকের তিলাওয়াত হয়, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের ঘটনাবলী আলোচনা করতে গিয়ে অনেক হাদীস শরীফ, নির্দশনাদি এবং সত্য ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়। বস্তুত: এগুলো হচ্ছে এমনসব কাজ, যেগুলোর উপর সম্পাদনকারীদের সাওয়াব দান করা হয়। কেননা, এর মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং এ ধরাবুকে তাঁর আবির্ভাবের উপর আনন্দ প্রকাশ করা হয়।
‘মীলাদুন্নবী’ মুসলিম সমাজে প্রতিটি যুগে অতি গুরুত্বের সাথে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ক্বাস্তলানী, বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারী আলায়হির রাহমাহ্ বলেছেন-
وَلاَزَالَ اَهْلُ الْاِسْلاَمِ يَحْتَفِلُوْنَ بِشَهْرِ مَوْلِدِه عَلَيْهِ الصَّلواةُ وَالسَّلاَمُ وَيَعْمَلُوْنَ الْوَلآءِمَ وَيَتَصَدَّقُوْنَ فِىْ لَيَالِيْهِ بِاَنْوَاعِ الصَّدَقَاتِ وَيُظْهِرُوْنَ السُّرُوْرَ وَيَزِيْدُوْنَ فِى الْمُبْرَأَّتِ وَيَعْتَنُوْنَ بِقِرَأَةِ مَوْلِدِهِ الْكَرِيْمِ
অর্থাৎ মুসলমানগণ সর্বদা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় জন্মের মাসে ‘মীলাদুন্নবী’ মাহফিরের আয়োজন করে আসছেন এবং তাঁরা আনন্দিত মনে খাবার তৈরী করে মুসলমানদেরকে দাওয়াত দিয়ে থাকেন। এ পবিত্র রাতে তাঁরা নানা দান-খয়রাত, সাদ্ক্বাহ্ করে খুশী প্রকাশ করেন এবং গভীর উৎসাহ্-উদ্দীপনা সহকারে বিভিন্ন পুণ্যকর্মে অংশ নেন। সর্বোপরি, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মীলাদ শরীফ পাঠে বিশেষভাবে যতœবান হন।
মুসলিম সমাজ এ বরকতময় কাজটি করবেনও না কেন? হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘মীলাদ’ শরীফ বর্ণনা করা খোদ্ আল্লাহ্ পাকের সুন্নাত। কারণ, আল্লাহ্ পাক পবিত্র ক্বোরআনে হুযূর-ই পাকের শুভাগমনের বর্ণনা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, ‘লাক্বাদ জা-আকুম রসূ-লূন’ (নিশ্চয় নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন এক মহান রসূল।- সূরা তাওবাহ্) অন্য আয়াতে এরশাদ করেছেন- ক্বাদ্ জা- আকুম বোরহানুম্ র্মি রাব্বিকুম। (নিশ্চয় নিশ্চয় তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে- সূরা নিসা), অন্যত্র এরশাদ করেছেন, ‘‘ক্বাদ্ জা-আকুম মিনাল্লা-হি নূরুন।’’ (নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘মহান নূর’ এসেছে-সূরা মা-ইদাহ্) ইত্যাদি। এসব আয়াতে যথাক্রমে রসূল, বোরহান ও নূর বলতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লা-এর কথা বুঝানো হয়েছে। (সূত্র. নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থাদি।) আর এ আয়াতগুলোতে বিশ্বনবীর ‘মীলাদ’ শরীফের মাধ্যমে দুনিয়ায় শুভাগমনের দিকেই ইঙ্গিতে করা হয়েছে। ‘ইশারাতুন্নাস্’ও শরীয়তের অকাট্য প্রমাণ।
মীলাদুন্নবী উদ্যাপনকে খোদ্ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা-ই কেরামকে উৎসাহিত করেছেন। হুযূর-ই আক্রাম নিজেও বহুবার নিজের মীলাদ শরীফের কথা বর্ণনা করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ্দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, একদা তিনি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হযরত ‘আমের আনসারী’ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ঘরে গিয়েছিলেন। তখন হযরত ‘আমের’ আনসারী তাঁর সন্তানগণ ও স্বগোত্রীয় লোকদের সাথে নিয়ে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করছিলেন। আর বলছিলেন, ‘‘এ-ই দিনটি, এ-ই দিনটি!’’ তখন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘হে আমের আনসারী নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার জন্য রহমতের দরজাগুলো খুলে দিয়েছেন। আর ফিরিশতাগণ তোমার জন্য শাফা‘আত কামনা করছে। তাছাড়া, যারা তোমার মতো আমার জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে (তথা মীলাদুন্নবী উদযাপন করবে) তারা তোমার মতোই নাজাত লাভ করবে। [সূত্র. আত্তানভীর ফী মাওলিদিল বশীর ওয়ান্নযীর]
তাছাড়া, শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী, তাঁর পিতা শাহ্ আবদুর রহীম এবং হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত আবদুল হক মুহাক্বিক্ব-ই দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিম ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ উদ্যাপনের পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন এবং তাঁদের ও অন্যান্য লিখকদের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদিতে। ইরাক অঞ্চলের তদানীন্তন ইরবিলের দ্বীনদার বাদশাহ্ আবুল মুযাফ্ফর ঈদে মীলাদুন্নবীর আয়োজনের জন্য রাজকীয়ভাবে বিশাল আয়োজন করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তাতে দেশবরেণ্য ওলামা কেরাম হাজির থাকতেন। তিনি হাফেয ইবনে দাহিয়্যার মাধ্যমে ‘আত্তানভীর’ নামক বিরাটাকার একটি কিতাবও ‘মীলাদুন্নবী’ বিষয়ের উপর লিখিয়েছিলেন।
অতএব, ‘মীলাদুন্নবী’ উদযাপন করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সাওয়াবদায়ক কাজ। আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে অতি উত্তম আদর্শ। সুতরাং ‘মীলাদুন্নবী’ উদ্যাপনের মাধ্যমে নবী পাকের আদর্শ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করা যায়। আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধুর আলোচনা ও তাঁকে পাওয়ার জন্য খুশী প্রকাশ করাও আল্লাহ্ পাকের নিকট অতি পছন্দনীয় কাজ হওয়া স্বাভাবিক। আল্লামা ক্বাস্তলানী আলায়হির রাহমাহ্ লিখেছেন-
وَيَظْهَرُ عَلَيْهِمْ مِنْ بَرَكَاتِه كُلُّ فَضْلٍ عَمِيْمٍ وَمِمَّا جُرِّبَ مِنْ خَوَاصِّه اَنَّه اَمَانٌ فِىْ ذلِكَ الْعَامِّ وَبُشْرى عَاجِلَةٌ بِنَيْلِ الْبُغْيَةِ وَالْمَرَامِ ـ فَرَحِمَ اللهُ اِمْرَأً اِتَّخَذَ لَيَالِىْ شَهْرِ مَوْلِدِهِ الْمُبَارَكِ اَعْيَادًا يَكُوْنَ اَشَدَّ عِلَّةِ عَلى مَنْ فِىْ قَلْبِه مَرَضٌ [زرقانى على المواهب صفحه ১৩৯]
অর্থাৎ মীলাদ উদযাপনকারীদের উপর আল্লাহ্ তা‘আলার ব্যাপক করুণা ও বরকতরাশির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মীলাদ উদযাপনের অন্যতম পরীক্ষিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে বছর মীলাদুন্নবীর আয়োজন করা হয়, তা মুসলমানদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার বছরে পরিণত হয়। মীলাদ শরীফের বরকতে সহসা মনের বাসনা পূরণ হয়।
তদুপরি, আল্লাহ্ তা‘আলা ওই ব্যক্তির উপর অসংখ্য রহমত নাযিল করেন, যে পবিত্র বেলাদতের মহান রাতকে এমনি উত্তমরূপে পালন করে, যেন তা ওইসব ব্যক্তির জন্য কঠিন পীড়াদায়ক হয়, যাদের অন্তরে হিংসা ও হঠকারিতার ব্যাধি রয়েছে। মীলাদুন্নবীর খুশী প্রকাশ করে আবূ লাহাব তার দাসী সুয়াইবাকে আযাদ করেছিলো। এর ফলে দোযখের শাস্তি লঘু করা হয়েছে বলে বিশুদ্ধ বর্ণনা এসেেেছ। [সূত্র. ফত্হুল বারী: বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ]
আল্লামা জাযারী দামেস্কী হাফেযুল হাদীস রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, যখন কাফির আবূ লাহাব ‘মীলাদুন্নবী’তে খুশী প্রকাশে উপকৃত হয়েছে তখন ওই একত্ববাদী মুসলমানতো আশাতীত উপকৃত হবে, যে হুযূর করীমের বেলাদতে খুশী হয়ে তাঁরই ভালবাসা স্বীয় সামর্থ্যানুসারে অর্থ ব্যয় করবে। তিনি বলেন, আমার জীবনের শপথ! পরম দয়ালু আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে দীর্ঘ ব্যাপক করুণা দ্বারা সুখময় জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। [সূত্র. যারক্বানী শরহে মাওয়াহিব, ১৩১পৃ.]
অতএব, উপরোক্ত বিবরণ থেকে বুঝা গেলো, ‘মীলাদুন্নবী’ উদযাপন কতোই তাৎপর্যবহ, কেনই বা মুসলমানগণ মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালন করে থাকেন। কেন মীলাদুন্নবী মাহফিল, জশনে জুলুস ইত্যাদি আয়োজন করেন। দেশ বরং বিশ্বব্যাপী যতই ঈদে মীলাদুন্নবী যথাযথভাবে উদযাপতি হবে, ততই দেশবাসী ও বিশ্বের মানুষ বিশ্বনবীর আদর্শ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করার সুযোগ পাবে এবং তাঁর আদর্শানুসরণ করে উভয় জাহানে নিশ্চিতভাবে সাফল্যমন্ডিত হতে পারবে। আল্লাহ্ পাক আমাদের সবাইকে যথানিয়মে মীলাদুন্নবী উদযাপন করার তৌফিক দিন! আ-মী-ন।
মহাপরিচালক, আন্জুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।