মিলাদ অর্থ জন্ম। ঈদে মিলাদুন্নাবি অর্থ রাসুলুল্লাহ ﷺ এর জন্মদিন উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা। তাঁর জন্মবিত্যান্ত আলোচনা করা। ঈদে মিলাদুন্নাবি পালন করা ফরয বা ওয়াজিব নয় কিন্তু মুস্তাহাব কাজ। পালন করাটা ঈমামগন ও ওলীয়াল্লাহদের সুন্নাহ, না করলে গুনাহ নেই। তবে বিরোধিতা করা গুমরাহির অন্তর্ভুক্ত।
আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, আজ যেভাবে র্যালী-মিলাদ মাহফিল করে মিলাদুন্নাবি পালন হচ্ছে সেভাবে মিলাদুন্নাবি পালন তো স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ বা তাঁর সাহাবীরাও করেননি। যেই কাজ রাসুলের সাহাবীরাই করেননি আমরা কিভাবে সে কাজ করতে পারি? আমরা কি রাসুলুল্লাহ ﷺ কে সাহাবীদের চেয়েও বেশী ভালোবাসি?
এর উত্তর হচ্ছে, ক্বুরআন হাদিসে এমন কোনো আয়াত নেই যেখানে আল্লাহ বা রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যে, হে আমার বান্দা বা উম্মতেরা তোমরা এমন কোনো কাজ করো না যা আমি বা আমার সাহাবা করেননি। বরং ইসলামে নতুন সৃষ্ট ভালো কাজকে সর্বদাই উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ সাহাবাগন বিদয়াতে হাসানা পছন্দ করেছেন।
উমার রাঃ যখন নিয়মিত ভাবে তারাবীর নামায জামায়াত সহকারে পড়া আরম্ভ করলেন, (বুখারী শরীফ, তারাবিহ অধ্যায় ১৮৮৩ নং হাদিস) তখন কোনো সাহাবি উমার রাঃ কে এ প্রশ্ন করেননি যে, হে উমার যে কাজ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ নিয়মিতভাবে করেননি তাহলে আপনি কেনো নিয়মিতভাবে করছেন? আপনি কি দ্বীন রাসুলের চেয়ে বেশি বুঝেন? কোনো সাহাবীই উমার রাঃ কে এ প্রশ্ন করেননি, কেননা তারা জানতেন এ কাজ উত্তম, এ বিদয়াত ভালো, এ নব্যসৃষ্টি ভালো। তাইতো উমার রাঃ একে “নে’মাতু বিদয়াতিল হাযিহি” অর্থাৎ উত্তম বিদআত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (বুখারী তারাবীহ অধ্যায় দেখুন)
এছাড়াও রাসুলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেনঃ “হালাল এটিই যা আল্লাহ কিতাবে হালাল করেছেন। হারাম এটিই যা আল্লাহ গ্রন্থে হারাম করেছেন এবং যা উল্লেখিত নেই তা ক্ষমাপ্রাপ্ত (জায়েয)।” [তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ]
সূরা আল হাশর ৭ঃ “রাসুল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” এখানে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিলেন যা রাসুল নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, রাসুল যা করেননি তা নিষেধ করা হয়নি।
এভাবেই আপনি যখন শরীয়ত মেনে মিলাদুন্নাবি পালন করবেন, তখন কেউ আপনাকে নবী করেননি, সাহাবী করেননি বলে প্রশ্ন করলে তাকে উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা বুঝিয়ে দিন যে, নবি করেননি, সাহাবী করেননি তাই একাজ করা যাবেনা একথা ঠিক নয়। বরং নবীজী যা নিষেধ করেছেন তা করা ঠিক নয়। আল্লাহ সুরা হাশরের ৭ নং আয়াতে একথাই উল্লেখ করেছেন। মিলাদুন্নাবিতে মিসিল, মিলাদ মাহফিল করাটা সুন্নাত নয়, কিন্তু এটা মুস্তাহাব, তথা ভালো কাজ।
আল্লাহ সুরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে এরশাদ করেন অর্থঃ “আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।” আল্লাহ এখানে রাসুলুল্লাহ ﷺ কে সমগ্র জাহানের জন্য রহমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আবার সূরা ইউনুস:৫৮ এ আল্লাহ এরশাদ করেন – “আপনি বলে দিন, তারা যেনো আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করে। এ (খুশি ও আনন্দ উদযাপন) তাদের সমুদয় সঞ্চয় থেকে উত্তম।”
১ম আয়াতে আল্লাহ রাসুলুল্লাহ ﷺ কে রহমত বলছেন এবং ২য় আয়াতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন এই রহমত (অর্থাৎ রাসুলকে) পেয়ে খুশি উদযাপন করতে। শুধু উদযাপনই নয় বরং এই খুশি উদযাপন করাটা তাদের সমস্ত সঞ্চয় (আমল) থেকে উত্তম বলে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষনা দিয়েছেন। রাইসুল মুফাসসিরিন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ সহ অনেক মুফাসসিরীন এ বিষয়ে একমত যে, উক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘ফাদল’ (অনুগ্রহ) ও ‘রাহমাত’ দ্বারা রাসুলুল্লাহ ﷺ কে বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও বুখারী শরীফে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রয়েছে যে,”মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নি’মাত।” (বুখারী ২/৫৬৬)।
সূরা আল ইমরান:১৬৪ – “আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন।” এখানেও আল্লাহ বুঝাতে চাচ্ছেন যে রাসুলকে প্রেরন করে তিনি মুমিনদের উপর অনেক বড় এহসান করেছেন, তাই এই নেয়ামত পাওয়ার জন্য তাদের খুশি উদযাপন করা উচিৎ।
সূরা আল বাক্বারাহ:২৩১ -“আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা তোমাদের উপর রয়েছে ।” এখানেও আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ তথা নবিজীর কথা স্বরন করার আদেশ দিয়েছেন।
এছাড়াও পবিত্র ক্বুরআনের আলোকে জানা যায়, আল্লাহর নে’মাত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করা নবীদেরই সুন্নাত। যেমন ঈসা (আঃ) যখন আল্লাহর দরবারে নিজ উম্মতের জন্যে খাদ্য চেয়েছিলেন, তখন এভাবে আরয করলেন, সূরা মায়েদা-১১৪ অর্থঃ “হে আল্লাহ আমাদের রব! আসমান থেকে আমাদের জন্য নেয়ামতের খানা অবতীর্ণ করুন, যা আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্যে ঈদ হবে।” ক্বুরআনের এ আয়াতে ঈসা আঃ এ আশাই ব্যক্ত করেছেন যে, যেদিন আল্লাহপাকের নেয়ামত অবতীর্ন হবে, সেদিনটি ঈদ হিসেবে পালিত হোক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল উম্মতের জন্য; যা ওই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের একটি উত্তম পন্থা।
ঈসা আঃ যদি সামান্য জান্নাতি খাবার পেয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারেন তাহলে আমরা রাহমাতুল্লিল আলামিনকে (যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেন না) পেয়ে কেনো ঈদ উদযাপন করতে পারবো না? তাঁর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি আছে বা হতে পারে বা কখনও হবে?
রাসুলুল্লাহ ﷺ কি নিজের জন্মদিন নিজেই পালন করেছেন?
হ্যাঁ, তিনি করেছেন। কেননা হযরত আবু কাতাদা (রা) হতে বর্ণিত, একজন সাহাবী রাসুলুল্লাহ ﷺ এর খেদমতে আরজ করলেন “ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার মাতা পিতা আপনার কদমে ক্বুরবান হোক। আপনি প্রতি সোমবার রোযা পালন করেন কেনো?
জবাবে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহন করেছি এবং এই দিনেই আমার উপর ওহী নাযিল হয়েছে। (সহীহ মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড, ৮১৯ পৃষ্ঠা, বায়হাকী: সুনানে কুবরা, ৪র্থ খন্ড ২৮৬ পৃ: মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল ৫ম খন্ড ২৯৭ পৃ: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক্ব ৪র্থ খন্ড ২৯৬পৃ: হিলয়াতুল আউলিয়া ৯ম খন্ড ৫২ পৃ:)।
যেহেতু রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজেই উদযাপন করেছেন তাই আপনি রোযা রাখার পাশাপাশি অন্যান্য জায়েয কাজের মাধ্যমে উদযাপন করলে সাওয়াবের অংশীদার হবেন।
রাসুলুল্লাহ ﷺ কে পেয়ে খুশি হওয়ার ফলাফলঃ হযরত আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখি। সে আমাকে বলে “কবরের জিন্দেগীতে আমি শান্তিতে নেই। কিন্তু হ্যাঁ, প্রত্যেক সোমবার তর্জনী আঙ্গুল থেকে আমি মিস্টি পানি পেয়ে থাকি কেননা আমি সুয়াইবা নামক বাদীকে (নবীজীর মিলাদের সংবাদ দেয়ায় খুশী হয়ে) আজাদ করেছিলাম এ আঙ্গুলের ইশারায়। “(সহিহ বুখারী কিতাবুন নিকাহ-৫১০১নং হাদিস)। এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আব্বাস রাঃ বলেন: সোমবারের শাস্তি লাঘবের কারণ রাসুল ﷺ এর জন্মের খবর আবু লাহাবকে দিলে সে খুশি হয়ে সুয়াইবাকে (খবরকারী দাসী) আজাদ করেছিল। (ফাতহুল বারি শরহে সহীহুল বুখারী, ৯ম খন্ড,১১৮ পৃষ্ঠা, ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী)।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আবু লাহাবের মত কাফের যার ধ্বংস হওয়ার ব্যপারে ক্বুরআনে সুরা নাযিল হয়েছে, যার স্থান সর্বদাই জাহান্নাম, সে যদি নবীজির জন্মদিনের সংবাদে খুশি হয়ে মাত্র একটি দাসী আযাদ করলে প্রতি সোমবার জাহান্নামে আল্লাহ তাকে পানি দান করেন, তাহলে আমরা যারা মুমিন মুসলমান, নবি প্রেমিক তারা মিলাদুন্নাবি পালন করলে আল্লাহ কি আমাদের উত্তম প্রতিদান দিবেন না? ইন শা আল্লাহ অবশ্যই দিবেন, কেননা তিনিই বলেছেন আল্লাহর রহমতকে পেয়ে খুশি উদযাপন করা সকল সঞ্চয়কৃত আমলের চেয়ে উত্তম (সুরা ইউনুস ৫৮)। আলহামদুলিল্লাহ।
রাসুলুল্লাহ ﷺ কে পেয়ে যে জাশনে জুলুস বা খুশি হয়ে মিসিল বা র্যালী করা তাও কিন্তু নতুন কিছু নয়। বরং এটা সাহাবীদের সুন্নত। মুসলিম শরীফের ২য় খণ্ডের ৪১৯ পৃষ্ঠায় হাদিসে বর্ণিত আছে “রাসূল ﷺ যেদিন হিজরত করে মদিনা শরীফে আগমন করেছেন ওইদিন মদিনাবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সাহাবীগন রাসূল ﷺ এর আগমনের শুকরিয়া হিসেবে আনন্দ মিছিল করেছিলেন এবং তালায়াল বাদরু আলাইনা….. এই নাত পাঠ করেছিলেন। কেউ কেউ বাড়ির ছাদের উপর আরোহন করেছিলেন, আবার অনেকে রাস্তায় ছড়িয়ে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ শ্লোগান দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।” এ হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে খুশি উদযাপন করার মাধ্যম হিসেবে মিছিল করা রাসুলুল্লাহ ﷺ সমর্থিত সাহাবীদের সুন্নাহ এবং কোনোমতেই ইসলাম বিরোধী কোনো কাজ নয়।
এছাড়াও উমার রাঃ এর ইসলাম গ্রহনের প্রসিদ্ধ ঘটনা যা আমরা সকলেই জানি এবং যা ইবনে ইসহাক্বের সিরাহ সহ অসংখ্য সিরাতের কিতাবে পেয়ে থাকি যে, উমার রাঃ ইসলাম গ্রহন করলে সাহাবিগন রাসুলে আরাবি ﷺ এর কাছে আবেদন জানান যে তারা ইসলামের সুমহান বানী ও উমার রাঃ এর মুসলমান হওয়ার কথা পুরো মক্কায় প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দিতে চান মিসিলের মাধ্যমে (কেননা উমার রাঃ এর মুসলমান হওয়ার আগে ইসলাম প্রচার চুপি চুপি করে করা হতো, কুফফারে মক্কার অত্যাচারের ভয়ে)। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের অনুমতি দিলে তাঁরা ৪০ জন সাহাবি একে অপরের হাত ধরে মক্কার অলিগলিতে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ স্লোগান দিয়ে মিসিল করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ। সাহাবিগন উমারকে রাঃ পেয়ে খুশিতে মিসিল করতে পারলে আমরা কি উমার রাঃ এর নবি, সমস্ত নবিদের সরদার, শাফায়াতের কান্ডারী, আমাদের ঈমানের জান কে পেয়ে খুশিতে মিসিল করতে পারিনা?
হ্যাঁ, তবে এই মিসিল শরিয়ত বিরোধী কাজ (যেমনঃ যেকোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র, নাচানাচির মতো বাচনভঙ্গি, অহেতুক কথাবার্তা) হতে মুক্ত হতে হবে।
লোকেরা তাদের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য মিসিল করলে তা কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করেনা!! অথচ হায় এই নাবীর উম্মত হয়ে তাঁর নামে দরুদপাঠ, স্লোগান দিয়ে মিসিল করলে আপনি দলীল খুজেন!! এই ঈমান আপনার? এই মিসিলকে তো কেউ ফরয ওয়াজিব বা এমনকি সুন্নাহও বলেনা, বরং মুস্তাহাব বলে। আহলে সুন্নাতের এটাই আক্বিদা যে প্রত্যেক কাজ যা ক্বুরআন সুন্নাহ বিরোধী নয় তাই জায়েয, আলহামদুলিল্লাহ।
এটা অত্যান্ত দুঃখের বিষয় যে কিছু মানুষের ঈমান এতই দুর্বল হয়ে গিয়েছে যে আজ তারা নিজের পরিবারের বা অন্য কারো জন্মদিন বিধর্মীদের নিয়মে (গানবাজনা, নাচ যা সম্পুর্ন ইসলাম বিরোধী) পালন করলে তাদের বিবেক তাদের বাধা দেয়না, তখন তারা ক্বুরআন-হাদিসে এর বৈধতা খোজে না। কিন্তু যখনিই কোনো নবি প্রেমিক মুমিন রাসুলুল্লাহ ﷺ কে পেয়ে ক্বুরআন ও শরিয়ত মোতাবেক (মিলাদুন্নাবিতে ক্বুরআন-হাদিস পাঠ, নবিজীর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ, নবিজীর আলোচনা যা আল্লাহ পুরো ক্বুরআন জুড়ে করেছেন, সাহাবিদের সুন্নতের অনুসরণ করে জাশনে জুলুস করা, অবশেষে মুনাজাত করা হয়। আপনিই বলুন এখানে কোন কাজটি ইসলাম বিরোধী? একটিও পাবেন না, বরং সবই ক্বুরআন হাদিস মতে উত্তম কাজ) রাসুল ﷺ এর জন্মদিন পালন করে তখন কিছু অবুঝের ঈমান/বিবেক ক্বুরআন হাদিস খুজে!!! ধিৎকার এমন বিবেকে যা ইসলাম, আল্লাহ ও রাসুল ﷺ থেকে মানুষকে দুরে রাখে। এটা ঈমান নয় বরং এটা শয়তান। কেননা আমরা পড়েছি ইবন কাসির এর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছেঃ যখন রাহমাতুল্লিল আলামিনের জন্ম হলো তখন ইবলিস খুবই কেঁদেছিল ও দুঃখিত হয়েছিল। তাই আজ মিলাদুন্নাবিতে কারো মন যদি ব্যথিত হয়, তাহলে সেই বিবেচনা করুক তার ঈমান কোন দিকে যাচ্ছে এবং কাকে অনুসরণ করছে? রাহমানকে নাকি শয়তানকে!
কিছু স্বল্পজ্ঞানী বলে থাকে যে এদিনই রাসুল ﷺ ওয়াফাতও করেছেন, তাই আমাদের শোক পালন করা উচিত!! তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি যে হাদিসে এসেছে নবীগন কবরে জীবিত ও তারা নামাযরত (মুসলিম শরীফ খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ১৮৪৫ হাদীস নং ২৩৭৫, ইবনে মাজাহ শরীফ খন্ড: ২ পৃষ্ঠা ২৯১ হাদীস নং ১৬৩৭, মুসনাদে আবু ইয়ালা খন্ড:৩ পৃষ্ঠা৩৭৯ হাদীস নং ৩৪১২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ খন্ড ৮ পৃষ্ঠা ২১১)
এছাড়াও সহিহ হাদিসমতে আপনি সাধারণ কোনো মানুষের জন্যও তিন দিনের বেশি শোক পালন করতে পারবেননা। (সহীহ বুখারি- ৩০৭ ই. ফা.)। তাইতো রাসুলুল্লাহ ﷺ এর জন্য শোক পালন আজ পর্যন্ত কেউ করেননি। এছাড়াও রাসুল ﷺ বলেছেন “আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যানকর এবং আমার ওয়াফাত ও তোমাদের জন্য কল্যানকর।” (শিফা শরীফ কৃত কাজী আয়ায খন্ড২ পৃ১৯, খাসায়েসুল কুবরা কৃত ঈমাম সুয়ুতী খন্ড২ পৃ২৮১)।
অবাক লাগে যখন শুনি কিছু অবুঝ মিলাদুন্নাবির র্যালীকে জন্মাষ্টমীর মিসিলের সাথে তুলনা দেয়; কেউ কেউ তো এতোদুর বলে ফেলে যে, মিলাদুন্নাবীর র্যালী নাকি জন্মাষ্টমীর অনুকরণে করা হয়!!! মুসলমানেরা হিন্দুদের অনুকরনে নাবীজির জন্মদিন পালন করে!!! নাউযুবিল্লাহ
এই সমস্ত অজ্ঞদের বলবো দয়া করে ইতিহাস সম্পর্কে পড়ুন, ইতিহাস জানুন; যে কোনটি কতসালে পালন করা শুরু হয়। সর্বজনস্বীকৃত মত হলো রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর পালন শুরু করেন আরবের অধিপতি বাদশাহ মালিক মুজাফফর উদ্দিন কৌকুরী, ৬০৪ হিজরীতে তথা ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে আর জন্মাষ্টমী পালন শুরু হয় ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে (সময় হলে উইকিপিডিয়াসহ অন্যান্য মাধ্যম দেখুন, নিজেই সত্যতা যাচাই করুন)। এর অর্থ হলো মিলাদুন্নাবি পালনের কমপক্ষে ৪০০ বছর পর হিন্দুরা মুসলিমদের অনুকরণে তাদের ধর্মগুরুর জন্মদিন পালন শুরু করেছে। মুসলমানেরা বিধর্মীদের অনুকরণ করেনি বরং বিধর্মীরা মুসলমানদের অনুকরন করেছে, আলহামদুলিল্লাহ।
কিছু মানুষকে একথা বলে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে যে রাসুলুল্লাহ ﷺ এর জন্ম তারিখ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে!! অথচ জন্ম তারিখের কয়েকটি হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। যেখানে হযরত আফফান রাঃ হতে বর্নিত, হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “রাসুলুল্লাহ ﷺ এর জন্ম হস্তি বাহিনী বর্ষের ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার হয়েছিল।” (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা; বুলূগুল আমানী ফী শরহিল ফাততিহর রব্বানী’ ২য় খণ্ড, ১৮৯ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’ ২য় খণ্ড, ২৬০ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত)। এছাড়াও ৫৬টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৫১টি দেশই ১২ই রবিউল আউয়াল রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষনা করেছে; তাই মুসলিম উম্মাহ যে এ বিষয়ে একমত তা প্রমানে এ তথ্য যথেষ্ট। (একমত না হলে একেক দেশ একেক দিনে পালন করতো নয় কি?)
এরপরেও যদি কারো ১২ই রবিউল আউয়াল রাসুলের জন্মদিন অবিশ্বাস হয়, তাহলে তারা যেদিন বিশ্বাস করে, সেদিনই মিলাদুন্নাবি পালন করুক; কেননা আমরা চাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সর্বাধিক গুণগান হোক, তা যেদিনই বা যেখানেই হোক না কেনো; আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের নিকট ১২ তারিখ সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য তাই আমরা ১২ তারিখ করি, আপনার নিকট যে তারিখ গ্রহনযোগ্য মনে হয় আপনি সেই তারিখে করুন কারোও বিরোধিতা না করে।
হাজার বছর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দ্বারা উদযাপিত মহান দিন ঈদে মিলাদুন্নাবিকে ৫০/১০০ বছরের আগের কোনো লেখকের বইয়ের মাধ্যমে আপনি হারাম বিদআত বলতে পারেননা। ঈদে মিলাদুন্নাবি পালন যদি আসলেই বিদআত /হারাম/অনৈসলামিক হতো তাহলে ৫৬টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৫১টি দেশই এদিনে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষনা করতো কেনো? কেনো এ আইন বানানোর সময় সেদেশের প্রকৃত! মুসলমানেরা এর বিরুদ্ধাচার করলোনা? বরং এটা তো ইন্টারনেটের যুগ। নেটে সার্চ করে দেখবেন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঈদে মিলাদুন্নাবি পালিত হচ্ছে। মিথ্যাবাদীদের কথায় কান না দিয়ে নিজেই যাচাই করুন। এগুলিই কি প্রমান করেনা ঈদে মিলাদুন্নাবি পালন মুসলিম উম্মাহর স্বীকৃত খারাপ বিদআত নয় বরং একটি উত্তম আমল?
কিছু অবুঝেরা বলে থাকে যে ইসলামে ঈদ নাকি শুধু দুটোই, ঈদুল ফিতর ও আযহা!!! আসলেই কি তাই? হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন, নিশ্চয় এ দিন (জুমুআর দিন) আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি জুময়া পড়তে আসবে সে যেন গোসল করে ও সুগন্ধি থাকলে উহা লাগায় এবং তোমাদের উপর মিসওয়াক করা আবশ্যক। [ইবনে মাজাহ পৃঃ ৭৮]। অনেক রেওয়াতে ৯ই জিলহজ্ব অর্থাৎ আরাফার দিনটিকেও ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। [ মিশকাত শরীফ পৃঃ ১২১ ও তিরমিযী শরীফ পৃঃ ১৩৪]। সুতরাং একথা বলা যে ঈদ শুধু দুটোই স্বল্পজ্ঞান বা মুর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।
৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী (রঃ) মিলাদুন্নাবী এর পক্ষে উনার রচিত স্বীয় কিতাব হুসনুল মাক্বাসিদ ফি আ’মালিল মোলিদ ৬৫ পৃঃ, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রাঃ তাঁর ফায়সালায়ে হাফ্ত মাসায়েলে মিলাদুন্নবি পালন সম্পর্কে উত্তম কথা বলেছেন। এছাড়াও ইবনে তাইমিয়া (যাকে সমস্ত মিলাদুন্নাবি বিরোধীরা নিজের ইমাম মনে করে) তার কিতাব “ইক্তিদায়ে সিরাতে মুস্তাকীম ৩১৩” পৃস্টায় লিখেছে, ”যদি মিলাদ মাহফিল নবী ﷺ এর প্রতি ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য করা হয়ে থাকে তবে আল্লাহ এ মুহাব্বত ও সম্মান প্রদর্শনের কারণে সওয়াব বা প্রতিদান দেবেন।”
একই কিতাবের ৩১৫ পৃস্টায় সে লিখেছে, “বরং ঐ দিনে (রাসুল ﷺ জন্মদিনে) পরিপূর্ণরূপে অনুষ্ঠান করা এবং এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, উত্তম নিয়ত এবং হুযুরে পাক ﷺ এর প্রতি মুহাব্বত প্রদর্শন বড় প্রতিদানের কারন হবে।”
এছাড়াও অসংখ্য ইমাম,মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজাদ্দিদ ও হক্কানী আলেমগন মিলাদুন্নাবী পালন করেছেন যার বর্ননা আন নে’য়মাতুল কুবরা আ’লাল আ’লাম এ বিস্তারিতভাবে রয়েছে।
অপরপক্ষে মিলাদুন্নাবি পালন হারাম বা নাজায়েয হওয়ার কথা ক্বুরআন সহিহ হাদিসতো দূরের কথা বরং দ্বয়ীফ হাদিসেও নেই।
আসল কথা বলতে অবুঝরা সাধারণ মুসলমানদের বিপথগামী করতে জন্মদিবস ঠিক নেই, বিদয়াত, নাবী সাহাবি পালন করেননি, শোক দিবস পালন করা উচিৎ, এটা বিধর্মী সভ্যতা ইত্যাদি ভিত্তিহীন কথা বলে থাকে। আর আশিক্বে রাসুলের জন্য তো এটুকু দলীলই যথেষ্ট যে এদিনে তার প্রিয়তম হাবীব দুনিয়ায় তাশরিফ এনেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহ আমাদের ঈমানকে ছদ্মবেশী অবুঝদের হাত থেকে রক্ষা করে সিরাতে মুস্তাক্বিমে চলে এই মহান দিবসকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করার তাওফিক দান করুন।