প্রশান্তি
মুহাম্মদ সিরাজুম মুনির তানভীর
অনেক মানুষ বিভিন্ন কারণে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভোগে। দু:শ্চিন্তা ও হতাশা তাদের চিন্তাশক্তি আচ্ছন্ন করে ফেলে। তখন তারা নানা অশ্লীলতা, পাপচার ও নেশার রাজ্যে বুদ হয়ে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে। এতে সাময়িকভা্বে অস্থিরতা থেকে কিছুটা মুক্তি পেলেও এর পরে আগের চেয়েও অস্থিরতা ও মানসিক অশান্তি বৃদ্ধি পায়। অথচ ইসলাম মেনে চলার মধ্যে যে মানসিক তৃপ্তি ও প্রশান্তি নিহীত রয়েছে তা অনেকেই জানে না।
তাই আসুন, ইসলামের দৃষ্টিতে মানসিক প্রশান্তি অর্জনের কতিপয় উপায় জেনে নিই:
(১) ইখলাস বা একনিষ্ঠতা সহকারে আল্লাহর ইবাদত করা:
আল্লাহ তাআলা বলেন: “তাদেরকে একমাত্র এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে।”
[সূরা বাইয়্যেনাহ: ৫]
❑ ইখলাসের আলামত:
★জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য অনুভব করা। আল্লাহর সাহায্যের কারণে একজন ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগী ও কার্যক্রম ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পদস্খলন থেকে রক্ষা পায়।
★ইবাদতে পর্যাপ্ত সময় ও শ্রম ব্যয় করা।
★গোপনে ইবাদত করার আগ্রহ থাকা। তবে যে সব ইবাদত জনসম্মুখে করতে হয় সেগুলোর কথা ভিন্ন। যেমন জামাআতে সালাত, আল্লাহর পথে দাওয়াত।
★অতি যত্ন সহকারে সুন্দরভাবে ইবাদত করা এবং এ ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনে আন্তরিক হওয়া।
★আল্লাহর দরবারে ইবাদত গৃহীত না হওয়ার ভয় থাকা।
(২) রাসূল ﷺ-কে অনুসরণ করা:
মানসিক প্রশান্তি অর্জন করতে হতে হলে ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, চরিত্র, পারিবারিক, সামাজিক তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ ও আদর্শের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিজের জানমাল, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা ও সকল প্রিয়জন থেকে তার ভালবাসাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলেই কেবল পূর্ণ মুমিন হওয়ার সম্ভব।
রাসূল ﷺ বলেন: “তোমাদের কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না যে পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা পুত্র এবং অন্য সকল লোক হতে অধিক প্রিয় না হই।”
(বুখারী ও মুসলিম)
আর এতে কোন সন্দেহ নাই যে, যে হৃদয়ে প্রিয় নবী ﷺ এর ভালবাসা সকল ভালবাসার উপরে স্থান পাবে সে হৃদয় হবে সবচেয়ে প্রশান্ত ও স্থির এবং তার জন্যই অপেক্ষা করছে উপরোক্ত সুসংবাদ।
❑ রাসূল ﷺ-কে অনুসরণের আলামত:
★রাসূল ﷺ এর সুন্নত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন এবং গ্রহণে উদগ্রীব থাকা
★সীরাত তথা ﷺ এর জীবন-চরিত সম্পর্কিত বই-পুস্তক অধ্যয়ন করা।
★রাসূল ﷺ-কে অনুসরণ-অনুকরণে অগ্রণী থাকা।
(৩) আল্লাহ তাআলাকে গভীরভাবে ভালবাসা:
আল্লাহ তাআলাকে ভালবেসে যখন কেউ আল্লাহর রঙ্গে জীবন রাঙ্গিয়ে দিতে পারে তখন সকল বিপদ-মুসিবতে সবর করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। সর্বাবস্থায় সে তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণ করে। শত কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে। বিপদে ধৈর্যের পরিচয় দেয় আর সুখ ও আনন্দের সংবাদে কৃতজ্ঞতা আদায় করে।এসব কারণে তার মন থেকে অস্থিরতা, হাহাকার, না পাওয়ার বেদনা দূরভিত হয় যায়। মন ভরে উঠে পরম প্রশান্তিতে।
❑ আল্লাহকে ভালবাসার কতিপয় আলামত:
★নিভৃতে আল্লাহর ইবাদত করতে ভালো লাগা।
★আল্লাহর বাণী মহাগ্রন্থ আল কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণ করতে আনন্দ পাওয়া।
★নামায, রোযা, দান-সদকা ইত্যাদি ইবাদতে তৃপ্তি অনুভব করা।
★তাসবীহ, তাহলীল, যিকির, দুআ, ইস্তিগফার ইত্যাদির মাধ্যমে জিহ্বাকে সিক্ত রাখা।
★আল্লাহর পছন্দ ও অপছন্দনীয় বিষয়ে মানসিকভাবে পূর্ণ সম্মতি থাকা।
★কোন ইবাদত ও নেকির কাছ থেকে মন ছুটে গেলে মনে কষ্ট অনুভূত হওয়া এবং আফসোস করা।
★আল্লাহর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘিত হতে দেখলে মনে প্রচণ্ড রাগ সৃষ্টি হওয়া।
(৪) আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি:
রাসূল ﷺ বলেন: “ওই ব্যক্তিই ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে যে ব্যক্তি আল্লাহকে প্রতিপালক,ইসলামকে দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) এবং মুহাম্মদ ﷺ রাসুল হিসেবে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিল।”
(সহীহ মুসলিম)
যে আল্লাহ তাআলাকে প্রতিপালক হিসেবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে স্বাভাবিকভাবে তার অন্তরে অস্থিরতা ও দু:শ্চিন্তা স্থান পাবে না। কারণ সে জানে মহান আল্লাহ অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ও কুশলী আর তার প্রতিটি সিদ্ধান্তই প্রজ্ঞাপূর্ণ। তাই তার ভাল-মন্দ সকল সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি থাকার মাধ্যমেই হৃদয়ে জাগ্রত হয় অনাবিল প্রশান্তি।
(৫) সত্যবাদিতা:
সত্যবাদিতার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত প্রশান্তি। পক্ষান্তরে মিথ্যায় রয়েছে মানসিক অশান্তি, সন্দেহ, সংশয় ও অস্থিরতা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সত্য হল প্রশান্তি আর মিথ্যা হল সংশয়।”
(মুসনাদ আহমদ, মুস্তাদরাক হাকিম)
সত্যবাদিতার তিনটি ক্ষেত্রে রয়েছে। যথা:
** আল্লাহর সাথে সত্যবাদিতা:
★প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী মুমিন হবে।
★কথায় সত্যবাদী। সুতরাং তার মুখ থেকে কখনও অসত্য কথা বের হবে না।
★আচরণে সত্যবাদী। সুতরাং সে হঠাৎ করেই রঙ বদলাবে না বা ধোঁকাবাজি ও মুনাফেকি করবে না।
★কর্মে সত্যবাদী। সুতরাং সে আমল করবে ইখলাসের সাথে এবং রাসূল ﷺ এর দেখানো পদ্ধতির আলোকে।
** বান্দাদের সাথে সত্যবাদিতা: আল্লাহ ও তার মাঝে যে চেহারা থাকে মানুষের সাথে উঠবস ও লেনদেনের সময় তার চেয়ে ভিন্ন চেহারা নিয়ে হাজির হবে না।
** নিজের সাথে সত্যবাদিতা: যা সে বিশ্বাস করে তা সে কর্মে বাস্তবায়ন করে। নিজেকে সংশোধন করে, আত্ম সমালোচনা করে এবং প্রবৃত্তির টানে ছুটে বেড়ায় না আর একান্ত একাকীত্বেও আল্লাহর ভয় হৃদয়ে জাগ্রত রেখে হারাম থেকে দূরে থাকে।
(৬) তাকওয়া অবলম্বন:
তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার কারণে সে আল্লাহর ইবাদত করে; অবাধ্যতা করে না। কৃতজ্ঞতা আদায় করে; অকৃতজ্ঞ হয় না। আল্লাহকে স্মরণ করে; তাকে ভুলে থাকে না আর বেঁচে থাকে বড়-ছোট সকল প্রকার পাপাচার থেকে।
স্বাভাবিকভাবে মানুষ যখন আল্লাহর ভয় হৃদয়ে জাগ্রত রাখে তখন সে যেমন আল্লাহর অধিকার লঙ্ঘন করে না ঠিক তেমনি বান্দার হকও নষ্ট করে না। এতে হৃদয়ে বিরাজ করে এক অভূতপূর্ব তৃপ্তি ও অবর্ণনীয় প্রশান্তি। পক্ষান্তরে আল্লাহর দাসত্ব থেকে বের হয়ে গেলে এবং বান্দার অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে অপরাধীর হৃদয়ে অশান্তির দাবানল জ্বলতে থাকে আর অস্থিরতা ও দু:শ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে।
৭) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ:
মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করা, আল্লাহ তাআলা যে কাজে রাগ করেন সে কাজ থেকে সতর্ক করা এবং এ পথে ধৈর্য ধারণ করা।
(৮) মানুষের কল্যাণে কাজ করা:
তথা গরীব, অসহায়, বিধবা ও এতিমদের সাহায্য করা ইত্যাদি।
(৯) সুন্দর চরিত্র:
হাসিমুখে থাকা, দেখা হলে সালাম দেয়া, কুশল বিনিময় করা, মানুষের সুখে সুখী হওয়া, দু:খে দুখী হওয়া, প্রতিবেশী ও মেহমানকে সম্মান করা ইত্যাদি।
(১০) অধিক পরিমানে আল্লাহর যিকির করা:
আল্লাহ বলেন: “জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।”
[সূরা রা’দ: ২৮]
কুরআন তিলাওয়াত সবচেয়ে বড় যিকির। তারপর সকাল সন্ধ্যার দুআ-যিকির, বিভিন্ন কাজের আলাদা আলাদা দুআ, পাঁচওয়াক্ত সালাত, অন্যান্য তাসবীহ-তাহলীল, ইস্তিগফার ইত্যাদি অধিক পরিমানে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ মনে অভাবনীয় প্রশান্তি অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন।
আমীন!!