মহিমান্বিত রজনী শবে বরাত: ফযীলত ও আমল | শবে বরাত নামাজের নিয়ম
শা’বান মাসের পঞ্চদশ রাতকে ‘শব-ই বরাত’ বলা হয়। ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ মানে মুক্ত হওয়া ও সম্পর্কচ্ছেদ করা। ইরশাদ-ই রসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম “শব-ই বরাতের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করো এবং দিনের বেলায় রোযা রাখো।” সুতরাং সারারাত বা রাতের অধিকাংশ সময় জাগ্রত থেকে ইবাদত করা উচিত।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে শাবান মাসের ১৫তম রাতকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। নামকরণগুলো দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকে:
মধ্য শাবান বা অর্ধ শাবান, ইসলামী দিনপঞ্জির অষ্টম মাস শাবান মাসে দিনটির অবস্থান অনুসারে নামকরণ।
- ইরান ও আফগানিস্তানে নিম শা’বান।
- আরবী ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফ্ শা’বান।
- মালয় ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফু শা’বান; ইত্যাদি।
- বরাতের রাত, ফার্সিতে বরাত শব্দের অর্থ হল ভাগ্য, বণ্টন, নির্ধারিত।
- লাইলাতুন নিফসি মিন শা’বান
- লাইলাতুল দোয়া।
- তুর্কি ভাষাভাষীগণ বলেন বিরাত কান্দিলি।
- ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় শবে বরাত, নিসফু শাবান ইত্যাদি।
এ বরকতময় রজনীতে করণীয় আমলসমূহঃ।
১) শবে বরাতের রাতে মাগরিবের পর গোসল করবেন। যদি কোন অসুবিধার কারণে গোসল করতে সক্ষম না হন, তবে শুধু ওযু সহকারে দু’ রাক’আত ‘তাহিয়্যাতুল ওষু’ পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসী একবার, সূরা ইখলাস তিনবার পড়বেন। এ নামাযগুনাহ মাফ হওয়ার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ
২) এ রাতে বিশেষভাবে দু রাক’আত নামায পড়া যায়। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসী একবার, সূরা ইখলাস পনেরবার করে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর দুরূদ শরীফ একশ’ বার পড়ে রিষক (জীবিকা) বৃদ্ধির জন্য দো’আ করবেন। ইনশা-আল্লাহ, এ নামাযের কারণে রিযক (জীবিকা) বৃদ্ধি পাবে।
৩) শবে বরাতের রাতে এশার’র সুন্নাত ও নফল নামায আদায়ের পর ২ রাক’আত করে ১২ (বার) রাক’আত নামায আদায় করা করবেন। প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কুদর পড়বেন, দ্বিতীয় রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস পাঠ করবেন। চার রাক’আত পর পর মুনাজাত করবেন, মুনাজাতের পূর্বে ১০০ (একশত) বার ইস্তিগফার করবেন, ১০০ বার কালেমা তামজীদ, ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করবেন। ইনশা-আল্লাহ সকল প্রকার ফরিয়াদ কবুল হওয়ার মাধ্যম।
৪) শবে বরাতের রাতে ২ রাক’আত করে৮ রাক’আত নামায পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ক্বদর একবার করে পড়বেন। আর সূরা ইখলাস পড়বেন ২৫ বার করে। গুনাহর ক্ষমার জন্য এ নামায অতি উত্তম। ইনশা-আল্লাহ এ নামায সম্পন্নকারীকে আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেবেন।
৫) শবে বরাতের রাতে ৪ রাক’আত করে ৮ রাক’আত নফল নামায রয়েছে। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সুরা ইখলাস ১০ (দশবার) করে পড়বেন। আল্লাহ তা’আলা এ নামায সম্পন্নকারীর জন্য অগণিত ফিরিশতা নিয়োগ করবেন যাঁরা কবরের আযাব থেকে নাজাত ও বেহেশতে প্রবেশের সু-সংবাদ দেন।
৬) এ রাতে ব্যাপক ফযীলতপূর্ণ সলাতুত তাসবীহ আদায় করুন। সালাতুত্ তাসবীহু আদায় পদ্ধতি:

নিয়্যত: নাওয়াত্ব আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা আরবা’আ রা’আ-তি সালাতিত তাসবীহ্ সুন্নাতু রাসূলিল্লা-হি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহ আকবর।
নিয়ম: অন্যান্য নামাযের নিয়মে চার রাক’আত সালাতুত্ব তাসবীহ্’র নিয়্যত করে সানা পড়ার পর নিম্নের কলেমাটি ১৫ বার পড়বে, তারপর সূরা ফাতিহা ও তার সঙ্গে একটি সূরা মিলিয়ে রু’তে যাওয়ার আগে নিম্নোক্ত কলেমাটি ১০ বার পড়বে। কলেমাটি হচ্ছে-
سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ
উচ্চারণঃ সুবহানাল্লা-হি ওয়াল হামদু লিল্লা-হি ওয়া লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবর।
তারপর রুকু’তে গিয়ে প্রথমে রুকু’র তাসবীহ ‘সুবহানা রাব্বিয়াল ‘আযী-ম ৩ বার পাঠ করে উক্ত কলেমাটি পড়বে ১০ বার। তারপর ‘সামি’আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’ বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলবে। তারপর উক্ত কলেমাটি পড়বে ১০ বার। তারপর আল্লা-হু আকবর বলে সাজদায় গিয়ে সাজদার তাসবীহ্ ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ ৩ বার পড়ে উক্ত কলেমাটি পড়বে ১০ বার। তারপর আল্লা-হু আকবর বলে সোজা হয়ে বসে সেই কলেমাটি পড়বে ১০ বার এবং দ্বিতীয়
সাজদায় ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ ৩ বার পড়ে এ কলেমা ১০ বার পড়বে। তারপর আল্লা-হু আকবর বলে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় রা’আত শুরু করবে। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত প্রথম রাক’আতে কলেমাটি সর্বমোট ৭৫ বার পঠিত হলো। এভাবে প্রত্যেক রাক’আতে ৭৫ বার হিসেবে চার রাক’আত নামাযে সর্বমোট ৩০০ বার কলেমাটি পাঠ করতে হবে। প্রথম ও শেষ বৈঠকে যথানিয়মে তাশাহহুদ ইত্যাদি পড়তে হবে। (বোখারী শরীফ)
৭) সালাতুল খায়র: আ’লা হযরত ইমাম শাহ্ আহমদ রেযা খারাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি বলেন: প্রতি মাসের পঞ্চদশ রাতগুলোতে জাগরণ করা মুস্তাহাব। তন্মধ্যে একটি শা’বানুল মু’আয্যম-এর পঞ্চদশ রাত। এ রাত জাগরণ করাও
মুস্তাহাব। এ রাতে মাশাইখ-ই কিরাম একশত রাক’আত নফল নামায এক হাজার বার ‘সূরা ইখলাস’ সহকারে আদায় করতেন। তা এভাবে যে, প্রতি রাক’আতে (১০) দশবার সূরা ইখলাস পড়তেন। এ নামাযকে তাঁরা ‘সালাতুল খায়র’ নামকরণ করেন। এটির বরকত সর্বজন স্বীকৃত। এ রাতে (তথা ১৫ শা’বানে) তাঁরা মজলিস কায়েম করতেন এবং মাঝে মাঝে ওই নামায জামা’আত সহকারেও আদায় করতেন।”
তাছাড়া, শবে বরাতে ছয় নিয়্যতে বার রাক’আত নফল নামায পড়লেও প্রচুর সাওয়াব পাওয়া যায়। প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ‘কদর’ ও দ্বিতীয় রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর তিনবার সূরা ইখলাস পড়বেন। সূরা কদর মুখস্থ না থাকলে উভয় রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর তিনবার করে সূরা ইখলাস (কুল হুয়ালআহু আহাদ) পড়া যাবে।
৮) শা’বানের পঞ্চদশ রাতে সূরা বাক্বারার শেষ দু’আয়াত كَافِرِينَ امَنَ الرَّسُوْلُ ২১ বার তিলাওয়াত করা শবে বরাতে সূরা ইয়াসীন তিনবার পড়লে এ উপকারাদি রয়েছে- রিযক বা জীবিকা বৃদ্ধি, দীর্ঘায়ু এবং আকষ্মিক বিপদাপদ
নিরাপত্তা, শান্তি ও জান-মালের হিফাযতের জন্য উপকারী।
- শবে বরাতে সূরা ইয়াসীন তিনবার পড়লে এ উপকারাদি রয়েছে – রিযক্ব বা জীবিকা বৃদ্ধি, দীর্ঘায়ু এবং আকষ্মিক বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকা যায় ইত্যাদি ।
- শবে বরাতে সূরা দুখান সাতবার তিলাওয়াত করা অতি উত্তম। ইনশা-আল্লাহু তা’আলা বিশ্ব প্রতিপালক তিলাওয়াতকারীর সত্তরটি দুনিয়ার প্রয়োজন এবং সত্তরটি আখিরাতের প্রয়োজন এর বরকতে পূরণ করবেন।
৯) শবে বরাতের রাতে কবর, মাজার শরীফ যিয়ারত করবেন। [রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসল্লাম জান্নাতুল বাক্বী শরীফে যিয়ারত করতেন।।
১০) শব-ই বরাতের রাতে হুযূর করীমের বিশেষ দো’আ
يَا عَظِيمُ يُرجى لِكُلِّ عَظِيمٍ يَا عَظِيمُ اغْفِرِ الذَّنْبَ الْعَظِيمَ, سَجَدَ وَجْهِي لِلَّذِي خَلْقَهُ وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ, أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ, وَأَعُوذُ بِعَفْوِكَ مِنْ عِقَابِكَ, وَأَعُوذُ بِكَ مِنْكَ لَا أَحْصِى ثَنَاءً عَلَيْكَ أَنْتَ كَمَا أُثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমার বাণী: “পাঁচ রাত এমন রয়েছে, যাতে দো’আ রদ্দ করা হয় না। সেগুলো হচ্ছে, ১. জুমু’আর রাত, ২. রজবের প্রথম রাত, ৩. ১৫ শা’বানের রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত এবং ৫. ঈদুল আযহার রাত।”
১১) রোযা: ১৪ শা’বানের দিনে রোযা রাখবে এবং উত্তম হচ্ছে, ১৫ শা’বানের দিনের বেলায়ও রোযা রাখবে। আর যদি আল্লাহ্ তা’আলা সামর্থ দেন, তাহলে আরো বেশি পরিমাণে রোযা পালন করবে। হযরত উম্মে সালামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন, “আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে শা’বান ও রমযান ব্যতীত ধারাবাহিকভাবে দু’মাস রোযা রাখতে দেখি নি।”
মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমীরাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হিবলেন: এ রাত অতীব বরকতময় রাত। এ রাতে কবরস্থানে যাওয়া, সেখানে ফাতিহা পাঠ করা সুন্নাত। অনুরূপ বুযুর্গদের মাযারে উপস্থিত হওয়াও সাওয়াবের কাজ। সম্ভব হলে ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখুন, ১৫ তারিখে হালুয়া ও মিষ্টান্ন জাতীয় ইত্যাদিতে বুযুর্গানে দ্বীনের ফাতিহা পড়ে সাক্বাহ-খায়রাত করবে এবং সারারাত জাগ্রত থেকে নফল নামায পড়ন। এ রাতে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের কাছে নিজের ভুলত্রুটির ক্ষমা চেয়ে নেবে, ঋণ ইত্যাদি পরিশোধ করে দিবে, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করবে; কেননা বিদ্বেষ পোষণকারী মুসলমানের দো’আ কবুল হয় না। যদি এ রাতে ৭ টি কুল (বরই) পাতা পানিতে সিদ্ধ করে গোসল করে, তাহলে ইন শা আল্লাহুল’আযীয পুরো বছর যাদুর প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকবে।





Users Today : 332
Users Yesterday : 759
This Month : 5366
This Year : 177237
Total Users : 293100
Views Today : 4026
Total views : 3459137