ভিক্ষাবৃত্তি: কত টাকা ‘আয়’ করেন ভিক্ষুকরা?
মূল বিষয়টা কী?
—–
আজ প্রায় ৮/১০ বছর যাবৎ আমি পথে ভিখিরি-ব্যবসায়ীদের কিছু দিই না।
তার আগে আসুন গল্পটায়:
এক মাদ্রাসা সুপারের সাথে কথা হচ্ছিল। তাঁর এক ছাত্রের নানা হলেন অভিভাবক। ঘটনাক্রমে সেই নানা-নানী হচ্ছেন ভিক্ষুক। মাদ্রাসা সুপারের বাড়ি যে থানায়, সেই থানা শহরে ওই ভিক্ষুক থাকেন। ছাত্রের খোঁজ দেয়ানেয়ার জন্য শিক্ষক গেলেন অভিভাবকের বাসায়।
দেখে তাঁর ভাল লাগলো। পাঁচতলা ভবনে তিন তলায় থাকেন ওই ভিক্ষুক নানা। ছোটই বাসা। ২/৩ রুমের হবে।
শিক্ষক বেরিয়ে চায়ের দোকানে কিছু কিনছিলেন, কথায় কথায় বললেন, আমার ছাত্রের নানা এই বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকে। ভিক্ষা করে তো ভালই আয় করে দেখছি।
দোকানদার হাসলো, কী বলেন, ভিক্ষা করে ওই বিল্ডিংয়ের একটা ফ্যামিলিই। তারা ওই বিল্ডিংয়ের মালিক।
এরপর একদিন ওই অভিভাবক নানা মাদ্রাসায় এলে সুপার জিগ্যেস করেন, কত টাকা দিনে আয় হয়?
ভিক্ষুক বললেন, বেশি না, দুই হাজারের উপরনিচে হয়।
আর ওর নানী ভিক্ষা করে কত পান?
নানা তখন অত্যন্ত অশ্লীল একটা গালি দিয়ে বললেন, বলেন না হুজুর, … টা ঠিকমতন টাকাও কামাইতে জানে না। দিনে ১২/১৩ শ ই হয়। আজ পর্যন্ত শিখল না!
এই ঘটনা হল একটা মফ:স্বল থানা শহরের ভিক্ষুকের।
তাহলে জেলা শহরের ভিক্ষুকরা প্রতিদিন কত ‘আয়’ করে?
বিভাগীয় শহর বা বড় শহরগুলোতে?
রাজধানীতে?
এখন প্রশ্ন হল, এই টাকাটা যে দিচ্ছে, সে কি মাসে লাখ টাকা পাওয়া মানুষের জন্য দিচ্ছে, নাকি অন্ন নাই, বস্ত্র নাই, চিকিৎসা নাই, অসহায় মানুষের জন্য দিচ্ছে? এই ভিক্ষুকরা কি অন্ন নাই বস্ত্র নাই চিকিৎসা নাই ক্যাটাগরির?
টাকাটা নেয়া কি তাদের জন্য হারাম নয়? কুল্লে কুল্লে হারাম।
ভিক্ষুকরা যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়, তারা মাসে আয় করে ১০-৫০ হাজার টাকা, আর সেই ভিক্ষুক ‘আয়’ করে মাসে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা।
এটা যদি প্রতারণা না হয়, প্রতারণা কী? ওই ভিক্ষুকের তো টাকা দেয়ার কথা তাকে, যার কাছ থেকে নিচ্ছে!
ভিক্ষুকরা কিছুতেই ভিক্ষা ছাড়বে না। কোন কাজ তাকে মাসে ২/১ লাখ টাকা দিবে? কোন কাজ করে সে ১০০ বিঘা জমি কিনবে? হ্যা, ডজন ডজন বিঘা জমি কিনেছে এমন ভিক্ষুক অসংখ্য। তিন-চার-পাঁচটা পাঁচতলা বিল্ডিং আছে এমন ভিক্ষুক অসংখ্য।
আমি একজনকে চিনি, সে এক্কেবারে জোয়ানমর্দ মানুষ। টগবগে। ৩০-৩৫ বছরের সুঠাম দেহ। একটা পা ভাঙা। সে পায়ের চিকিৎসা করার কথা বলে মানুষনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসম্ভব বিরক্ত করে। অথচ সে ব্যক্তিগত বলয়ে বলে, আল্লাহ্’র রহমত হইসে আমার পাওটা ভাইঙা। এই পায়ের জন্য যত টাকা আমি পাই, যত সহজে পাই, পা থাকলে এই টাকা আমি কামাই করতে পারতাম না।
মানুষজন এমনকি অজপাড়াগাঁর ভিক্ষুকদেরকে চাকরি দিতে চাইলে তারা বলে ফেলে, ৫ হাজার টাকায় তো আমার এক সপ্তাহের হাতখরচও হবে না।
ভিক্ষুকরে জিগ্যেস করেন, এই কাজ তো আপনার জন্য হারাম। এত টাকা ‘আয়’ করা তো হারাম। সে বলবে,
হারাম না। হারাম কেন হবে? মানুষ মায়া করে দেয়। মানুষের ভালবাসা কি হারাম নাকি? মানুষ আল্লাহ্’র কথা ভেবে দেয়, আল্লাহ্’র কথা ভেবে দেয়া কি হারাম নাকি? আর আমি তো সব সময় আল্লাহ্-নবিজি দ.’র কথা বলে ভিক্ষা করি। আল্লাহ্-নবিজির কথা বলা কাজ না? এইটারে কাজ মনে করেন না কেন? এই কাজে কি কম কষ্ট? যারা টাকা দেয়, তাদের কত গুনাহ আছে। আল্লাহ্ তাদের মনটা দেখবে। তারা যে মায়া করে টাকা দিচ্ছে, সেটা দেখে গুনাহ মাফ করে দিবে। রোগশোক শেফা করে দিবে।
বুঝলেন বিষয়টা?
বিষয়টা হল চোরের উপর বাটপারি।
আরো ভেঙে বলি:
দেখুন,
ভিক্ষুকরা টিঁকে আছে কয়েকটা কারণে:
১. বাংলাদেশের মানুষ মায়াময়।
২. বাংলাদেশে মানুষ অত্যন্ত বেশি।
৩. মানুষ দৃঢ় নয়। মুখের উপর ‘না’ না বলে ৫/১০ টাকা দিয়ে ঝামেলা বিদায় করে।
৪. বাংলাদেশে নৈতিকতার কোন চর্চা নাই। সবাই পাপে ডুবে আছে। গান্ডুরা পাপ কাটায় বৃদ্ধ/বৃদ্ধা ভিখিরিকে ৫/১০ টাকা দিয়ে। ভিক্ষুকেরও কোন নৈতিকতা নাই। সে তারচে ১০ গুণ গরিবের কাছ থেকেই সব সময় টাকা নেয়। ১০০ গুণ গরিবের কাছ থেকে টাকা নেয়।
৫. আমরা ধর্মকেই ভুল বুঝি। রাসূল দ. সাসটেইনেবল কল্যাণ নিয়ে এসেছেন, ৫ টাকার কল্যাণ নিয়ে আসেননাই। এখন কোনটা সাসটেইনেবল আর কোনটা ৫ টাকার দায়মুক্তি- এইটা বোঝার মতন ঘিলু আমাদের দেশের মানুষের মাথায় থাকলেও তারা কখনো বিষয়গুলোর মুখোমুখি হননি। বাংলাদেশের মানুষ সবচে বেশি ভুল বোঝে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দ. কে। তারা সবচে বেশি ভুল বোঝে ইসলাম আসার কারণ এবং ইসলামের কাজের ধরণকে।
কারণ মাত্র একটা। এই দেশে কেউ নৈতিকতার চর্চা করে না।
হোলিস্টিক নৈতিকতা, টোটালিটারিয়ান নৈতিকতার চর্চা না ডাক্তার করে, না মোক্তার, না আমলা, না শামলা। কেউ সমাজে ব্যবহারিক সর্বব্যাপী নৈতিকতার চর্চা দেখেই নাই। সরলভাবে যদি বলি, কেউ মনে করে আমার মুখে দাঁড়ি আছে দুয়েকটা মিথ্যা কথা বললে কী? কেউ মনে করে, মিথ্যা কথা তো বলি না, মুখে দাঁড়ি না থাকলে কী? অর্থাৎ আমরা পাপকে জায়েজ করি কোন পূণ্য দিয়ে। দায়বোধ নাই।
দেখবেন, যে ডাক্তার সবচে বেশি অ্যাবোরশন করে, সে সবচে বেশি নামাজ পড়ে। বাবা, তোমার নামাজ তো অ্যাবোরশনের কাফফারা না। আল্লাহ্ ইসলাম তো অ্যাবোরশন করিয়ে তারপর নামাজ পড়ার জন্য পাঠান নাই।
দেখবেন, চোর-ছিনতাকইকারী-মাদকব্যবসায়ীর আচরণ খুবই ভদ্র হয়। বিশেষ করে মাদকাসক্ত মাদকব্যবসায়ী সামাজিকভাবে খুবই আন্তরিক। ভ্রাতা, তুমি মাদক বিক্রি করে গরিবরে টাকা দিবা, এইজন্য রাসূল দ. ইসলাম আনেন নাই।
সব মাস্তান/লোকাল সন্ত্রাসী দেখবেন খুব খুব মাতৃভক্ত। তোমার মায়ের পায়ের তলায় বেহেস্ত কথা সত্য, কিন্তু মানুষের পেটে ক্ষুর চালানোর জন্য তো আল্লাহ্ মায়ের পায়ের তলায় বেহেস্ত দেননাই।
নাহলে খাবারে ভেজাল দেয়া, মওজুদদার লোক কী করে মনে করে যে পরের ওয়াক্তে নামাজ পড়লেই সব মাফ? নাহলে ওজনে কম দেয়া লোক কী করে ৫ টাকা দিয়ে নিজেকে ব্যালান্স করে? নাহলে কাজের মেয়ের সাথে অত্যাচার করা মানুষ কী করে আল্লাহ্’র কাছে মাফ চায়?
এইগুলা হইল নৈতিকতার প্যারাডক্স।
এইগুলা সরল বিষয়, কিন্তু প্র্যাক্টিসিং সূফিরা ছাড়া অন্যরা এইগুলা কমই বোঝে।
এই থেকে আমাদের মুক্তি নাই, আমরা যদি নৈতিকতার সূর্যোদয় ঘটাতে পারি, আমরা যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দ. কী চান, কীভাবে চান, কীভাবে করিয়েছেন সেটা ধরতে পারি- সকল অন্ধকার দূর হবে। তার আগ পর্যন্ত না।