মিশকাত শরীফের কিতাবুল ইমারাতে মুসলিম শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমান –
مَنْ اَتَاكُمْ وَاَمْرَكُمْ جَمِيْعٌ عَلى رَجُلٍ وَاحِدٍ يُرِيْدُ اَنْ يَّشُقَّ عَصَاكُمْ وَيُفَرِّقُ جَمَاعَتَكُمْ فَاقْتُلُوْهُ
অথাৎ – তোমরা সর্ব সম্মতিক্রমে কোন এক জনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছ, এমতাবস্থায় যদি অন্য কেউ তোমাদের নিকট এসে তোমাদের লাঠি (ঐক্য) ভেঙ্গে দিতে ও তোমাদের মাঝে দলা-দলি সৃষ্টির প্রয়াস পায়, তাহলে তোমরা তাকে হত্যা করে দাও।
এখানে ব্যক্তি বিশেষ বলতে ইমাম ও উলামায়ে দ্বীনকে বোঝানো হয়েছে। কেননা শরীয়ত বিরোধী কাজে সমকালীন শাসকের আনুগত্য জায়েয নয়।
ইমাম মুসলিম (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর সংকলিত ‘মুসলিম শরীফে’ ইমারত শীর্ষক আলোচনায়,
بَابُ وُجُوْبِ طَاعَةِ الْاُمَرَاءِ فِىْ غَيْرِ مَعْصِيَةٍ
পাপাচার ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে শাসকের আনুগত্য করা ওয়াজির নামে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে একজনের আনুগত্য করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
মিশকাত শরীফে কিতাবুল ‘বুয়ূ’ ‘বাবুল ফারাইযে’ বুখারী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে: হযরত আবু মুসা আশআরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) হযরত ইবন মাসউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) সম্পর্কে বলেছিলেন-
لَاتَسْئَلُوْا نِىْ مَادَامَ هَذَا الْحِيْرُ فِيْكُمْ
অর্থাৎ যতদিন এ আল্লামা (হযরত ইবন মাসউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) আপনাদের মধ্যে থাকবেন ততদিন আমার নিকট মাসাইল জিজ্ঞাসা করবেন না । এতে বোঝা যায় সর্বোত্তম ব্যক্তির উপস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত কম মাহাত্মের অধিকারী ব্যক্তির আনুগত্য করতে নেই এবং প্রত্যেক অনুসারী ব্যক্তির দৃষ্টিতে স্বীয় ইমাম সর্বশ্রেষ্ট বিবেচিত হন।
ফাতহুল কাদীর আছে-
মুসলমানদের শাসনকর্তা যখন জেনে শুনে মুসলমানদের জন্যে এমন একজন প্রশাসক নিয়োগ করলেন, যার থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযূক্ত ও কুরআন হাদীসে অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন, তখন তিনি আল্লাহ, রসুল আলাইহিস সালাম এবং সাধারন মুসলমানদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করলেন।
মিশকাত শরীফে ‘কিতাবুল ইমারাত’ এর ১ম পরিচ্ছেদ আছেঃ
وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِىْ عنُقِه بَيْعَةٌ مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيَّةً
(যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তাঁর গলে বায়’আত বন্ধন রইল না । সে অজ্ঞতার মৃত্যুবরণ করলো।)
এখানে বায়’আত বলতে ইমামের বায়’আতের অর্থাৎ তাবলীদ বা অনুসরণ ও আওলিয়া কিরামের হাতে বায়’আত গ্রহণ এ উভয় প্রকারের বায়’আতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? এখন বলুন, এ যুগে ভারতীয় ওহাবীগণ কোন সুলতানের বায়’আত গ্রহণ করেছেন?
তাকলীদের সমর্থনে এ কয়েকটি আয়াত ও হাদীছের বর্ণনা করা হল। এগুলো ছাড়া আরও অনেক আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু বক্তব্য সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এখানে ইতি টানা হলো।
এখন উম্মতের আমল পর্যালোচনা করে দেখুন তবে ‘তাবিয়ীনদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত উম্মত তাকলীদের পথে চলে আসছে অর্থাৎ যে নিজে মুজতাহিদ নয়, সে অপর একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করছে। উম্মতের ইজমা’র উপর আমল করার বিষয়টা কুরআন হাদীছ থেকে প্রমাণিত ও আবশ্যকীয়ও বটে।
আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেনঃ
وَمَنْ يَّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَاتَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعُ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَاتَوَلّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا
(সঠিক পথ প্রকাশিত হওয়ার পরেও যে ব্যক্তি রসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরোধিতা করে, মুসলমানদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে চলে, তাকে আমি তার স্বীয় অবস্থায় ছেড়ে দিব, এবং তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। এটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান)
এ আয়াত থেকেও বোঝা গেল, সাধারণ মুসলমানদের জন্য মনোনীত যে পথ, সে পথ অবলম্বন করা ফরয বা অবশ্য কর্তব্য। তাকলীদের ব্যাপারে মুসলমানদের সার্বিক সম্মতি বা ইজমা রয়েছে।
মিশকাত শরীফের ‘আল ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াসসুন্নাহ’অধ্যায় আছে-
اِتَّبِعُوْا السَّوَادَ الْاَعْظَمَ فَاِنَّهُ مَنْ شَذَّشُذَّ فِى النُّارِ
(সর্ববৃহৎ দলের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। কেননা, যে মুসলমানদের দল থেকে পৃথক রয়েছে, তাকে পৃথক ভাবে জাহান্নামে পাঠানো হবে।)
অন্য এক হাদীছে আরও আছে-
مَارَاَهُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ
অর্থাৎ যে পথ ও মতকে মুসলমানরা ভাল জানেন, উহা আল্লাহর কাছেও ভাল ও পছন্দনীয় হিসেবে গণ্য।
এখন ভেবে দেখুন, বর্তমানে এবং এর আগেও সাধারণ মুসলমানগণ ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদকে ভাল জ্ঞান করে আসছেন; মুকাল্লিদ বা অনুসারী হয়ে কালাতিপাত করছেন। এখনও আরব- আজমের মুসলমানগণ ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ বা অনুসরণ করে থাকেন। সুতরাং, যে লা মাযহাবী হল, সে ইজমায়ে উম্মতকে অস্বীকার করলো। ইজমা বা সর্ব সম্মত মতকে স্বীকার না করলে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদিআল্লাহু আনহু) ও হযরত উমর ফারুক (রাদিআল্লাহু আনহু) এর খিলাফতকে কিরূপে প্রমান করবেন? তাঁদের খিলাফতও ইজমায়ে উম্মত থেকেই প্রমাণিত। যে ব্যক্তি এ দু’জনের মধ্যে যে কোন এক জনের খিলাফতকে অস্বীকার করে, সে কাফির হিসেবে গণ্য। (ফাতওয়ায়ে শামী ইত্যাদি কিতাব দেখুন) একই-ভাবে তাকলীদের ব্যাপারেও উম্মতের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তাফসীরে খাযিনে وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে যে, হযরত আবু বকর (রাদিআল্লাহু আনহু) আনসারদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, কুরআন শরীফে মুহাজিরগণকে صَادِقِيْنَ (সত্যবাদী) আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ করা হয়েছে- اُلَئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ (তারাই সত্যবাদী) এর পর তিনি বলেছিলেন- وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ (সত্যবাদীদের সাথে থাকুন) সুতরাং আপনারাও পৃথক খিলাফত কায়েম করবেন না, আমাদের সাথে থাকুন।
অনুরূপ আমিও লা মাযহাবীদেরকে বলছি সত্যবাদীরা তাকলীদ করেছ্নে, আপনারাও তাদের পথ অনুসরণ করুন অর্থাৎ মাযহাবের অনুসারী হোন।
আকলী বা জ্ঞান ও যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণঃ এ পৃথিবীতে কোন লোক অপরের অনুসরণ ছাড়া কোন কাজই করতে পারে না। প্রত্যেক পেশা ও বিদ্যার নির্ধারিত রীতিনীতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকদের নির্দেশ পালন করতেই হয়। ধর্মীয় বিষয়সমূহ পার্থিব কর্মকান্ডের তুলনায় অনেক জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল। অতএব, এতেও অভিজ্ঞ ধর্মীয় মনীষীদের অনুসরণ করতে হবে বৈকি।
ইলমে হাদীছের মধ্যেও তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যেমন, বলা হয় অমুক হাদীছটি যাঈফ (দুর্বল), কেননা ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বা অমুক মুহাদ্দিছ অমুক বর্ণনাকারীকে যঈফ (দুর্বল) বলেছেন। এখানে তাঁর অভিমতটা গ্রহন করাটাই হলো তাকলীদ।
কুরআনের কিরাতের ব্যাপারেও ক্বারীদের তাকলীদ করা হয়। যেমন, বলা হয়ে থাকে অমুক ক্বারী অমুক আয়াতটাকে এভাবে পড়েছে। কুরআনের স্বরচিহ্ন, اِعْرَاب আয়াত ايت ইত্যাদির ব্যাপারেও তাকলীদ করা হয়। যখন জামাআতে নামায আদায় করা হয়, তখন সমস্ত মুক্তাদী ইমামেরই তাকলীদ করেন। ইসলামী রাজ্যে সমস্ত মুসলমান একজন বাদশাহের তাকলীদ করে থাকেন। রেল গাড়ীর সমস্ত যাত্রী এক ইঞ্জিনেরই তাকলীদ করেন। মোট কথা, মানুষ প্রত্যেকটি কাজেই অপরের অনুসারী বা মুকাল্লিদ।
স্মর্তব্য যে, উল্লেখিত সব ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়েছে। নামাযের মধ্যে ইমাম একজন ছাড়া দু’জন হয় না। ইসলামী রাজ্যের বাদশাহ দু’জন হয় না। সুতরাং শরীয়তের ইমামও একজন ছাড়া দুইজন কি করে সম্ভব?
মিশকাত শরীফে ‘কিতাবুল জিহাদ’ এর ‘আদাবুস সফর’ অধ্যায়ে আছেঃ
اِذَا كَانَ ثَلَاثَةٌ فِى سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوْا اَحَدَهُمْ
অর্থাৎ যখন তিনজন লোক ভ্রমনে বের হয়, একজনকে আমীর বা নেতা মনোনীত করা বাঞ্ছনীয়। -সুত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-