মানুষের জীবনে যত উত্তম গুণাবলী রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম উত্তম গুণ হলো- বিনয় ও নম্রতা। বিনয় ও নম্রতা মানুষের উত্তম চরিত্রের ভূষণ ও অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনয় মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সহায়তা করে। বিনয়ী ব্যক্তিকে আল্লাহ যেমন ভালোবাসেন, তেমনি মানুষও তাকে ভালোবাসেন। যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।
বিনয়ীকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। যে যত বেশী বিনয়ী ও নম্র হয় সে তত বেশী উন্নতি লাভ করতে পারে। এ পৃথিবীতে যারা আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন লাভ করে আছেন তাদের প্রত্যেকেই বিনয়ী ও নম্র ছিলেন। বিনয় ও নম্রতা সর্বকালের সেরা মানব রসুলে পাক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভূষণ।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র মানুষ ছিলেন শেষ নবী রসুলে পাক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ছিলেন বিনয় ও নম্রতার মূর্তপ্রতীক। তিনি এতটা বিনয়ী ছিলেন যে, তার তুলনা মেলাই ভার। বিনয় ও নম্রতা দ্বারাই তিনি মানুষকে আপন করে নিয়েছেন। তাইতো মহান আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবেوَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘আর নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’ (কালাম ৬৮/৪)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে,وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- ‘আপনি আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হউন’ (শু‘আরা ২৬/২১৫)।
আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার ইহুদীদের একটি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসার জন্য অনুমতি চেয়ে বলল, السَّامُ عَلَيْكَ ‘আপনার মৃত্যু ঘটুক’। তখন আমি উত্তরে বললাম,عَلَيْكُمُ السَّامُ وَاللَّعْنَةُ ‘বরং তোমাদের মৃত্যু ঘটুক এবং অভিশম্পাত বর্ষিত হোক’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আয়েশা! থাম। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা সর্ববিষয়ে কোমলতাকেই পসন্দ করেন। উত্তরে আমি বললাম, তারা যা বলেছে, আপনি কি তা শোনেননি? তিনি বললেন, আমি তো ‘ওয়ালাইকুম’ বলে (তাদের কথা তাদের দিকে ফিরিয়ে) দিয়েছি।[ বুখারী হা/৬২৫৬; মুসলিম হা/২১৬৫।]
কোমলতা ও নম্রতা আল্লাহর বিশেষ গুণ :
———————————————————————————–
আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহা হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা বা অন্য কোন আচরণের প্রতি ততটা অনুগ্রহ করেন না’।[মুসলিম হা/২৫৯৩; মিশকাত হা/৫০৬৮।]
বিনয়-নম্রতার ফযীলত ও উপকারিতা:
———————————————————————————–
বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ. ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[ তিরমিযী হা/২০১৩; মিশকাত হা/৫০৭৬; ছহীহাহ হা/৫১৯।]
মহান আল্লাহ বিনয়ীদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। তিনি আরো বলেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ عَلَى كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ
‘আমি কি তোমাদেরকে জানাব না যে, কারা জাহান্নামের জন্য হারাম বা কার জন্য জাহান্নাম হারাম করা হয়েছে? জাহান্নাম হারাম আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী ও নম্র লোকের জন্য’।[ তিরমিযী হা/২৪৮৮; ছহীহাহ হা/৯৩৮।]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামআরো বলেন,
إن الله إذا أحب أهل بيت أدخل عليهم الرفق
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালবাসেন, তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ করান’।[ ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩, ১৭০৩; সিলসিলা ছহীহা ২/৫২৩।]
আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহা হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ.
‘হে আয়েশা! আল্লাহ তা‘আলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার দরুন দান করেন না; আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা দান করেন না’।[মুসলিম হা/২৫৯৩; মিশকাত হা/৫০৬৮।]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’।[মুসলিম হা/২৫৮৮।]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহাকে বলেছেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হ’তে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে’।[ মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৬৮।]
আল্লাহ কর্তৃক বিনয়ীদের প্রশংসা:
—————————————————————–
মহান আল্লাহ বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষদের প্রশংসায় বলেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً، وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَاماً، إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرّاً وَمُقَاماً-
‘দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা রাত্রি অতিবাহিত করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত থেকে ও দন্ডায়মান হয়ে এবং যারা বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর, নিশ্চয়ই এর শাস্তি নিশ্চিত বিনাশ। নিশ্চয়ই তা অবস্থান ও আবাসস্থল হিসাবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৬)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ
‘এটা আখিরাতের নিবাস যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
পক্ষান্তরে উদ্ধত অহংকারী দাম্ভিকদের সম্পর্কে আল্লাহ রাববুল আলামীন কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন,
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحاً إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ-
‘অহংকার বশে তুমি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (লোক্বমান ৩১/১৮)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلاً-
‘পৃথিবীতে দম্ভভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি পদভারে ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনও পর্বত সম হ’তে পারবে না’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৭)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিনয়ীদের প্রশংসা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন,
الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ
‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়’।[তিরমিযী হা/১৯৬৪; মিশকাত হা/৫০৮৫।]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ-
‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল সরলতার দরুণ দুর্বল, যাদেরকে লোকেরা হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোন বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামআরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী বদমেযাজী ও অহংকারী’।[মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬।]
ঔদ্ধত্যপরায়ণ, অহংকারীদের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِىْ صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُوْنَ إِلَى سِجْنٍ فِىْ جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُوْلَسَ تَعْلُوْهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ الْخَبَالِ
‘ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে পিপীলিকার ন্যায় জড়ো করা হবে। অবশ্য আকৃতি-অবয়ব হবে মানুষের। অপমান তাদেরকে চতুর্দিক হ’তে বেষ্টন করে রাখবে। ‘বুলাস’ নামক জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। অগ্নিশিখা তাদের উপর ছেয়ে যাবে। আর তাদেরকে পান করানো হবে জাহান্নামীদের দেহনিঃসৃত ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক কদর্য পুঁজ-রক্ত’।[ তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১১২।]
মন্দকে প্রতিহত করতে হয় বিনয় ও নম্রতা দ্বারা:
================================
মন্দকে মন্দ দ্বারা, শত্রুকে শত্রুতা দ্বারা প্রতিহত না করে বরং বিনয়-নম্রতা ও উৎকৃষ্ট ব্যবহার দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে মানুষের হৃদয় জয় করতে হয়। মহান আল্লাহ এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন, وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ ‘ভাল ও মন্দ সমান হ’তে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, يَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا، وَسَكِّنُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا ‘তোমরা নম্র হও, কঠোর হয়ো না। শান্তি দান কর, বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না’।[বুখারী হা/৬১২৫।]
অন্যত্র তিনি বলেন, خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)।
পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য পাপাচারী ছিল ফেরাউন, যে নিজেকে সবচেয়ে বড় প্রভু বলে দাবী করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে সে পাপিষ্ট ফেরাউনের নিকট কোমল ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى، فَقُولَا لَهُ قَوْلاً لَّيِّناً لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى- ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও, সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে। অতঃপর তোমরা তার সাথে নম্রভাষায় কথা বল, হয়ত বা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (ত্বা-হা ২০/৪৩-৪৪)।
কষ্ট প্রদানকারীর উপর ধৈর্য ধারণ ও নম্রতা : হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহা হ’তে বর্ণিত যে, একবার তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহোদের দিনের চেয়ে কঠিন কোন দিন কি আপনার উপর এসেছিল? তিনি বললেন, আমি তোমার ক্বওম হ’তে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তা তো হয়েছি।
তাদের হ’তে অধিক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, আকাবার দিন যখন আমি নিজেকে ইবনু আবদে ইয়ালীল ইবনে আবদে কুলালের নিকট পেশ করেছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম, সে তার জবাব দেয়নি। তখন আমি এমনভাবে বিষণ্ন চেহারা নিয়ে ফিরে এলাম যে, ক্বারনুস ছা‘আলিবে পৌঁছা পর্যন্ত আমার চিন্তা দূর হয়নি। তখন আমি মাথা উপরে উঠালাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। আমি সে দিকে তাকালাম। তার মধ্যে ছিলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম।
তিনি আমাকে ডেকে বললেন, আপনার ক্বওম আপনাকে যা বলেছে এবং তারা উত্তরে যা বলেছে তা সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার নিকট পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। এদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছে আপনি তাঁকে হুকুম দিতে পারেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এসব ব্যাপার আপনার ইচ্ছাধীন। আপনি যদি চান, তাহ’লে আমি তাদের উপর আখশাবাইন (উভয় পাহাড়)কে চাপিয়ে দিব।
উত্তরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا. ‘বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না’।[বুখারী হা/৩২৩১; মুসলিম হা/১৭৯৫; মিশকাত হা/৫৮৪৮।]
বিনয় আর নম্রতা মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানিয়ে দেয় বিনয়ের গুরুত্বপূর্ণ পথ অবলম্বন করা ছাড়া মানুষ তার অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সক্ষম হয়না। বিনয় জীবনের এমন এক অনুষঙ্গ যে, যদি কেউ তা অবলম্বন না করে তাহলে তার জীবনমরুতে অহংকার বালু তপ্ত হয়ে উঠে।
সুতরাং যে কোন মূল্যে হোক জীবনের খালী মাঠে বিনয়ের সবুজ বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। অন্যথায় অহংকারের বিষে মানুষ ফিরআউন হয়ে যায়, প্রতারিত হয়, জীবনের বহু সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। কেননা দিনের বিপরীতে যেমন রাত তদ্রুপ বিনয়ের বিপরীতে হল অহংকার। সুতরাং যখন জীবনে বিনয়ের আলো না আসবে তখন অহংকারের অন্ধকার জীবনে ছেয়ে যাবে। অন্তরে নিজের বড়ত্ব সৃষ্টি হবে। অন্তরে বড়ত্ব সৃষ্টি হওয়া এমন এক মরনব্যাধি যা অভ্যন্তরীণ সমস্ত রোগের মূল।
এই দুনিয়াতে সর্বপ্রথম যে নাফরমানী প্রকাশ পেয়েছে তার মূলে ছিল অহংকার। আল্লাহ যখন হযরত আদমকে সৃষ্টি করে তাঁর ম্মানার্থে ইবলিসকে সিজদা করার আদেশ করেন তখন সে অহংকারের বশবর্তী হয়ে বলে উঠল, আমি তো তার চেয়ে উত্তম, আমি কেন তাকে সিজদা করবো..?
একজন সফল ব্যক্তি তাকেই বলা যায় যার মাঝে দয়া, সাহস, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতার পাশাপাশি বিনয়, নম্রতা, সততা ও নৈতিকতার গুণ থাকে। আর বিনয় ও নম্রতার বিপরীত শব্দ হ’ল ঔদ্ধত্য, কঠোরতা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্রের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব। এ পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি, খুন-রাহাজানি সহ যত অশান্তির সৃষ্টি হয় তার মূলে রয়েছে ঔদ্ধত্য, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি।