বিদআত

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

দুই বন্ধুর তুমুল বিতর্ক: “প্রসঙ্গ” খারাপ বিদআত ও ভাল বিদআত
———————-
সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারি

রোজেন ও রেজা দু বন্ধুর মধ্যে গলায় গলায় ভাব। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র। ঢাবিতে ভর্তির পর থেকেই তারা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড। তবে রোজেন বেশ কিছুদিন হলো “নতুন আবিষ্কৃত” (বিদআত) এক ইসলামি দলে যোগ দিয়েছে যারা মাজহাব মানে না, মূল ধারার ইসলামে প্রতিষ্ঠিত বহু বিষয়ই তারা মানে না বরং “শিরক-বিদআত” বলে সেসব কাজকে কটাক্ষ করে। তার দলের মুরুব্বিদের প্রভাব বেশ পড়েছে তার উপর, নিজেও কিছু পড়ালেখা করছে সে ইসলাম নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে। তারই প্রভাবে আবহমান কাল ধরে চলে আসা ইসলামের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে সে ইদানীং ঘোর আপত্তি তুলছে। অন্যদিকে তার বন্ধু রেজা ইসলামের মূল ধারাই অনুসরন করছে। ইদানীং দুই বন্ধুর মাঝে বেশ ভালই তর্ক-বিতর্ক চলছে বেশকিছু বিষয় নিয়ে। তবে তারা কেউই কাউকে মন্দ কথা বলে না, কটু কথা বলে না, কুরআন-হাদিস এবং যুক্তির বাহিরে কিছু বলে না তারা। সত্য জানতে ও সত্যের সন্ধানে তারা দুজনেই উন্মূখ।

একদিন দু বন্ধুর মাঝে কথা ওঠল আমাদের সমাজে প্রচলিত ঈদে মিলাদুন্নবী ﷺ বা প্রিয় নবীজীর ﷺ শুভাগমন দিবস উদযাপন প্রসঙ্গে। রোজেনের মতে নবীজীর ﷺ জন্মদিন একমাত্র রোজার মাধ্যমেই উদযাপিত হতে হবে, যেহেতু প্রিয় নবীজী ﷺ তাঁর জন্মদিনে রোজা রেখেছেন যেমনটা মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে। বাকি আমরা যা করি সব বিদআত, তাই এসবই পরিত্যাজ্য।

রোজেন বলল, “মিলাদুন্নবীতে ﷺ আমরা এখন যা করছি তা সবই বিদআত। আর নবীজী ﷺ বলেছেন, كل بدعة ضلالة “প্রত্যেক নব্য আবিষ্কারই পথভ্রষ্টতা।”

রেজা জবাব দিল, “তাহলে তো তুই আমি আমরা সবাই বিদআতের মাঝেই ডুবে আছি রে দোস্ত। মাইকে আজান, ইকামাত, মোবাইল, ঘড়ি, কম্পিউটার সবই তো বিদআত তথা নব্য আবিষ্কার যা আমরা…”

রোজেন রেজার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আরে আরে দোস্ত! আমি তো বলছি আমাদের ধর্মে, ইবাদাত-বন্দেগীতে প্রবিষ্ট নতুন রীতি নীতি নিয়ে, তুই যেগুলোর কথা বললি ওগুলো তো দুনিয়াবি আবিষ্কার। ধর্মের মধ্যে নতুন কিছু প্রবেশ করানো যাবে না, যেহেতু প্রিয় নবী ﷺ বলেছেন,
‎من أحدث في ديننا ما ليس منه فهو رد
অপর রেওয়ায়াতে এসেছে, من أحدث في امرنا هذا ما ليس منه فهو رد

“যে আমাদের ধর্মের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল যা তার অংশ নয় তা বাতিল।”

রেজা মুচকি হেসে বলল, বন্ধু! তোর বর্নিত হাদিস খানাতেই তোর দাবির বিরুদ্ধে দলিল আছে।

রোজেন বলল, তাই নাকি?

রেজা বলল, হাদিসখানা আবার পড়ি চল। যে আমাদের ধর্মে নতুন কিছু প্রবিষ্ট করবে “যা তার অংশ নয়” ما ليس منه তা বাতিল। আর যা অলরেডি খন্ড খন্ডভাবে তার অংশ হয়েই আছে তা বাতিল হবে কেন?

রোজেন বলল, দোস্ত খোলে বল কি বলতে চাস।

রেজা বলল, ধর তুই বলছিস ঈদে মিলাদুন্নবীﷺ আমরা এখন যেভাবে উদযাপন করি তা বিদআত। কিন্তু আমরা এই উদযাপনের মধ্যে যে যে কাজ করছি সেগুলো কি সেই নবীজীﷺ ও সাহাবাগনের যুগ থেকেই দ্বীন তথা ইবাদাতের অংশ নয়? এই কাজগুলো কি খন্ড খন্ডভাবে আলাদা আলাদাভাবে কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত নয়?

রোজেন বলল, দোস্ত উদাহরন সহ বল। ক্লিয়ার বুঝতে পারছি না।

রেজা বলল, যেমন ধর, আমরা মিলাদ শরীফে বা মিলাদুন্নবীরﷺ মাহফিলসমূহে কুরআন শরীফ খতম করি, তিলাওয়াত করি, না’তে রাসূলﷺ পাঠ করি, জিকির করি, নবীজীরﷺ জন্ম ও সিরত শরীফ আলোচনা করি, উনার আগমনে আনন্দ প্রকাশ করি, উনার উপরে দরুদ ও সালাম পাঠ করি, দোআ করি। এখানে উল্লেখিত কোন কাজটি আলাদা আলাদাভাবে ইসলামের অংশ নয় বল। এই আমলগুলো করতে কি কুরআন-সুন্নাহ আমাদেরকে  যথেষ্ট উৎসাহ দেয়নি? এগুলো কি সাহাবাগনের আমল ছিল না?

রোজেন এবার একটু চুপসে গিয়ে বলল, কিন্তু দোস্ত এভাবে অনেকগুলো আমল একসাথে করে প্যাকেজ আকারে নতুন রুপে নতুন কিছু ইসলামে প্রবিষ্ট করার কথা তো কুরআন-সুন্নাহতে আসেনি।

রেজা বলল, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
‎ثُمَّ قَفَّيْنَا عَلَىٰ آثَارِهِم بِرُسُلِنَا وَقَفَّيْنَا بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ وَجَعَلْنَا فِي قُلُوبِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ رَأْفَةً وَرَحْمَةً وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا ۖ فَآتَيْنَا الَّذِينَ آمَنُوا مِنْهُمْ أَجْرَهُمْ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ

“অতঃপর আমি তাদের পশ্চাতে প্রেরণ করেছি আমার রসূলগণকে এবং তাদের অনুগামী করেছি মরিয়ম তনয় ঈসাকে ও তাকে দিয়েছি ইঞ্জিল। আমি তার অনুসারীদের অন্তরে স্থাপন করেছি নম্রতা ও দয়া। আর বৈরাগ্যবাদ, সে তো তারা নিজেরাই বিদআত বা উদ্ভাবন করেছে; আমি এটা তাদের উপর ফরজ করিনি; কিন্তু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে এটা অবলম্বন করেছে। অতঃপর তারা যথাযথভাবে তা পালন করেনি। তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী ছিল, আমি তাদেরকে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার দিয়েছি। আর তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” (সূরা আল -হাদিদ, সূরা নং ৫৭-আয়াত নং ২৭)

দেখ এই আয়াতে আল্লাহ পাক স্পষ্ট বলেছেন, হাওয়ারীয়্যিন বা ঈসা আ: এঁর অনুসারীগন বৈরাগ্যবাদ বা বিয়ে না করে কুমার-কুমারী থাকার এই রীতি তারা নিজেরাই বিদআত বা উদ্ভাবন করেছেন, আল্লাহ পাককে সন্তুষ্ট করতে। আল্লাহ পাক তা তাদের উপর চাপিয়ে দেননি। তারা বিদআত করেছে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য। এজন্য আল্লাহ পাক তাদের এই কাজের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে কেন তারা তাদের আবিষ্কৃত সেই বিদআতের উপর কায়েম থাকেনি সেজন্য সমালোচনাও করেছেন তাদের।

আল্লাহ পাক আরো বলছেন,

‎مَّن يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُن لَّهُ نَصِيبٌ مِّنْهَا ۖ وَمَن يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُن لَّهُ كِفْلٌ مِّنْهَا ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ مُّقِيتًا

“অর্থঃ যে ব্যক্তি কল্যাণ ও সৎকাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে এবং যে ব্যক্তি অকল্যাণ ও অসৎকাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে৷ আর আল্লাহ সব জিনিসের প্রতি নজর রাখেন৷”[সূরা নিসা, আয়াত নং ৮৫]

রোজেন অনেকটা হতাশা নিয়ে বলল, “বুঝলাম দোস্ত।  কিন্তু না, এই আয়াতগুলো স্পষ্ট নয় ভাল বিদআত দ্বীনের মধ্যে প্রবিষ্ট করার বিষয়ে।”

রেজা বলল, আচ্ছা কুরআন শরীফের কোন বিষয় স্পষ্ট করে না বুঝলে সাহাবাগন কার কাছে যেতেন?

রোজেন বলল, অবশ্যই প্রিয় নবীরﷺ কাছে।

রেজা বলল, তাহলে চল আমরাও সহিহ হাদিসের দ্বারস্থ হই।

‎ﻣَﻦْ ﺳَﻦَّ ﻓِﻲ ﺍﻹِﺳْﻼﻡِ ﺳُﻨَّﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ﻓَﻠَﻪُ ﺃَﺟْﺮُﻫَﺎ ﻭَﺃَﺟْﺮُ ﻣَﻦْ ﻋَﻤِﻞَ ﺑِﻬَﺎ ﺑَﻌْﺪَﻩُ ﻣِﻦْ ﻏَﻴْﺮِ ﺃَﻥْ ﻳَﻨْﻘُﺺَ ﻣِﻦْ ﺃُﺟُﻮﺭِﻫِﻢْ ﺷَﻲْﺀٌ ﻭَﻣَﻦْ ﺳَﻦَّ ﻓِﻲ ﺍﻹِﺳْﻼﻡِ ﺳُﻨَّﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔً ﻛَﺎﻥَ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭِﺯْﺭُﻫَﺎ ﻭَﻭِﺯْﺭُ ﻣَﻦْ ﻋَﻤِﻞَ ﺑِﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﻩِ ﻣِﻦْ ﻏَﻴْﺮِ ﺃَﻥْﻳَﻨْﻘُﺺَ ﻣِﻦْ ﺃَﻭْﺯَﺍﺭِﻫِﻢْ ﺷَﻲْﺀ  ٌ

“যে ব্যক্তি ইসলামে একটি নতুন ভাল প্রথা আবিষ্কার করল তার জন্য উত্তম প্রতিদান রয়েছে, এবং যারা এর উপর আমল করবে তাদের জন্যও উত্তম প্রতিদান রয়েছে। এতে লোকেরা যে অনুযায়ী আমল করেছে,তাকে সব আমলকারীর সমান সওয়াব দেওয়া হবে,আবার তাদেরকে ও কম দেওয়া হবে না। আর যে ইসলামে একটি খারাপ নতুন প্রথা চালু করেছে ও লোকেরা সে অনুযায়ী আমল করেছে,তাকে সব আমলকারীর সমান পাপ দেওয়া হবে। আবার তাদের পাপে কম করা হবে না।”  (সহিহ মুসলিম, ৮ম খন্ড, ইলম অধ্যায়,অনুচ্ছেদ -৩, হাদিস নং ৬৬১০ প্রকাশনী: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার-ঢাকা)

আর এর সমর্থনে হাদিছ শরীফে আরো এসেছে: فما رأي المسلمون حسنا فهو عند الله حسن وما راوا سيأ فهو عند الله سيء

“মুসলমানরা যে কাজকে ভাল মনে করে, আল্লাহর কাছেও তা ভাল , আর যে জিনিসকে মুসলমানরা খারাপ মনে করে সে জিনিস আল্লাহর কাছেও খারাপ।”(মুসনাদে ইমাম আহমাদ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা: ৩৭৯, মুসতাদরাকুল হাকিম, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৮৪, ইমাম বাজ্জার মুসনাদে, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-২১৪ )

এই সহিহ হাদিস দুখানা স্পষ্টভাবে প্রমান করে যে, ইসলাম নতুন রীতি প্রবিষ্ট করার সু্যোগ আছে।

রোজেন এবার রেজাকে একটু চেপে ধরার চেষ্টা করল, “আচ্ছা তাহলে সাহাবাগন নবীজীরﷺ পর কেন নতুন ভাল রীতিনীতি ইসলামে প্রবিষ্ট করতে সচেষ্ট হলেন না? আমরা কি তাঁদের চেয়ে কুরআন সুন্নাহ বেশি বুঝি?”

রেজা বলল, তোকে কে বলেছে যে সাহাবাগন দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু প্রবিষ্ট করেননি? এই নে আমি তোকে কয়েকটা উদাহরন দিচ্ছি শুধু বোখারী শরীফ এক কিতাব থেকেই, তোরা তো আবার বোখারী খুব মানিস। কিন্তু সেই বোখারীই কি ভাল করে বুঝিস?:

১.হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত (রা:) কে যখন কুরআনে পাক একত্রিত করার হুকুম দিলেন, এক মলাটে সংরক্ষন করার কথা বললেন তখন  যায়েদ ইবনে ছাবেত (রা:) আরয করলেন:
‎كيف تفعلون شيئا لم يفعله رسول الله صلى الله عليه وسلم قال هو خير-

“আপনি এ কাজ কেন করতে যাচ্ছেন, যা হুযুর (ﷺ) করেননি? হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) ফরমালেন, “এতো ভাল কাজ। ” (বুখারী শরীফ : ৮ম খন্ড :  كتاب فضائل القران এর جمع القران পরিচ্ছেদ, হাদিস নং-৪৬২১, প্রকাশনী: ই:ফা:)

অর্থাৎ হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত রা: হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা:) এর সমীপে আরয করলেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন কুরআন এক মুসহাফে একত্রিতকরণ হচ্ছে বিদআত কাজ যা প্রিয় নবীজীﷺ করে যান নি। তাই আপনি কেন এই বিদআতের উদ্যোগ নিচ্ছেন? তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা:) ইরশাদ ফরমালেন- বিদআত বটে তবে উত্তম বিদআত তা ভাল কাজ। এর থেকে প্রমাণিত হলো সাহাবায়ে কিরামের কাছে বিদআতে হাসানা গ্রহনযোগ্য ছিল। এখানে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) চাইলেই বলতে পারতেন যে, নবী করীম (ﷺ) হাদিছ শরীফে স্পষ্ট বলে গেছেন যে, তোমাদের জন্য আমার ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীন গনের সুন্নাহ মানা জরুরী। কিন্তু তিনি তা না বলে বললেন যে, কোরআন এক জায়গায় জমা করা ভাল কাজ বা উত্তম কাজ।

২। হযরত উমর (রা:) স্বীয় খিলাফাতের যুগে নিয়মিতভাবে জামাত সহকারে তারাবীর নামায আদায় করার হুকুম দিয়েছিলেন এবং জামাত অনুষ্ঠিত হতে দেখে বলেছেন نعم البدعة هذه- এতো বড়ই ভাল বেদআত। দেখুন হযরত উমর (রা:) নিজেই নিজের প্রচলিত কাজকে বিদআতে হাসানা বলেছেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রিয় নবীজীﷺ তাঁর জীবনে মোট তিনদিন তারাবির নামাজ পড়েছেন। বোখারি শরীফের তারাবির নামাজের অধ্যায়ে এসেছে, হজরত আয়েশা রা: বর্ননা করছেন, নবীজী ﷺ রামাদ্বানের রাতে মসজিদে তারাবি নামাজ পড়তে দাঁড়াতেন। তাঁর তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনে সাহাবাগনও  জামাতবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। এভাবে তারাবির নামাজের মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকলে নবীজীﷺ তারাবির ৪র্থ রাত থেকে তারাবি নামাজ পড়া বন্ধ করে দেন তা ফরজ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে। নবীজীﷺ  কিন্তু কখনোই কোন সাহাবিকে ডাকেননি তাঁর পেছনে জামাতবদ্ধ হয়ে তারাবি পড়তে, বরং তাঁরা কিরাত পড়ার আওয়াজ শুনে নিজ থেকে এসে শামিল হতেন। হজরত আবু বকর (রাঃ) এঁর সময়ও জামাত বদ্ধ তারাবির নামাজ ছিলনা। হযরত উমর (রাঃ) রামাদ্বানের রাতের ৩০ দিন জামাত সহকারে তারাবিহ নামাজ চালু করেন। হযরত উমর (রাঃ) একদা হযরত আব্দুর রহমান (রাঃ) কে সাথে নিয়ে রাতে বের হলেন, যখন তিনি সবাইকে জামাত সহকারে তারাবীহ নামাজ পরতে দেখলেন তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন ” এটা কতইনা উত্তম বিদআত !”
(সহীহ বুখারী, তারাবি নামাজের অধ্যায়, তৃতীয় খন্ড, হাদিছ নং  ১৮৮৩, প্রকাশনী: ই:ফা:)

এখানেও লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে হযরত ওমর ফারুক (রা:) চাইলেই বলতে পারতেন যে, নবী করীম  (ﷺ)  হাদিছ শরীফে স্পষ্ট বলে গেছেন যে, “তোমাদের জন্য আমার ও আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীন গনের সুন্নাহ মানা জরুরী।” কিন্তু তিনি তা না বলে বললেন যে, কতই না উত্তম বিদআত এই তারাবীর নামাজ জামাতের সাথে পড়া!

৩.হজরত ওসমান (রা:) তৃতীয় আরেকটি আজান চালু করেন জুমআ’ বারে যা জওরা নামক বাজারে দেয়া হতো।
‎فقد روى البخاري  عن السائب بن يزيد رضي الله عنهما قال : كَانَ النِّدَاءُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوَّلُهُ ، إِذَا جَلَسَ الْإِمَامُ عَلَى الْمِنْبَرِ ، عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، فَلَمَّا كَانَ عُثْمَانُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، وَكَثُرَ النَّاسُ ، زَادَ النِّدَاءَ الثَّالِثَ عَلَى الزَّوْرَاءِ .
হজরত সায়িব ইবনু ইয়াজিদ (রা:)বলেন, “জুমআর দিনে প্রথম আজান ছিল যখন ইমাম মিম্বরে বসবেন তখন। এভাবেই চলছিল প্রিয় নবীﷺ , আবু বকর ও ওমর রা: এঁর সময়ে, পরে ওসমান রা: এঁর সময়ে মানুষের সংখ্যা যখন বাড়ল তখন জওরা নামক স্থানে তৃতীয় আজানের ব্যবস্থা করা হলো।” (বোখারী, জুমআর নামাজ অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: জুমআর আজান, হাদিস নং-৮৬৬, প্রকাশনী: ই:ফা:)

৪। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা:) একদা হযরত আয়েশা সিদ্দিরা (রা:) এঁর ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মসজিদে নববীতেﷺ বসেছিলেন, আর তখন উনার সামনে কিছু লোক যারা সাহাবী ও তাবেয়ীন ছিলেন, তাঁরা মসজিদে নববীতে সালাতুত দোহা পড়ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা:) কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দিলেন, “বিদআত”। (সহীহ বোখারী , তৃতীয় খন্ড, হজ্জ  অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ১১১৪:নবীজী কতবার উমরা করেছেন?হাদিস নং -১৬৬১, প্রকাশনী: ই:ফা: )

অর্থাৎ সালাতুত দোহা ঘরে না পড়ে মসজিদে পড়া বিদআত। কিন্তু তিনি আগে পরে কোনদিন কাউকে মসজিদে সালাতুত দোহা পড়তে বাধা দেন নাই। মুখে বলেছেন ইহা বিদআত, কিন্তু যদি তা খারাপ কাজ হত তবে বাধা দেয়া ওয়াজিব ছিল, যা তিনি করেন নাই। আর হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা:) এঁর মত সাহাবী যদি বাধা দিতেন তবে সবাই তা মান্য করতেন। কারন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা:) ছিলেন নবীজীর (ﷺ) সুন্নাতের এক জ্বলন্ত নমুনা ছিলেন ও সর্বাধিক হাদিছ বর্ণনাকারী সাহাবীগনের অন্যতম।

কাজেই দোস্ত রোজেন, আমরা দেখতে পেলাম যে, খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িন বিদআতে হাসানাহ তথা ভাল নতুন কাজের পক্ষে ছিলেন হোক না তা নতুন কোন রীতি। তবে শর্ত ছিল একটাই সেই নতুন কাজটি কুরআন-হাদিসে অনুশাসনের বিপরীত কোন কাজ হতে পারবে না।

রোজেন স্বীকার করতে বাধ্য হলো, বন্ধু! রেজা আমি তো ভাই কোনদিন এভাবে চিন্তা করিনি। কিন্তু এই যে তুই বলছিস খারাপ বিদআত ও ভাল বিদআত, এর একাডেমিক ভিত্তি ক? অর্থ্যাৎ ইসলামী জ্ঞানের যারা অথরিটি বা আমাদের সম্মানিত ইমামগণ তাঁদের কিতাবসমূহে কি এই প্রকারভেদের বিষয়ে কিছু এসেছে?

রেজা বলল, দোস্ত! বিদআত (ইসলামে প্রবিষ্ট নতুন রীতি-নীতি পদ্ধতি) যে দু প্রকার তা সহিহ হাদিসেই উল্লেখ আছে, যা আমরা আমাদের আলোচনায় আগেই উল্লেখ করেছি (সহিহ মুসলিম, জ্ঞানের অধ্যায়ে, হাদিস নং-৬৬১০, ই:ফা: প্রকাশনী) । তবে তোর জানার জন্য বলছি, বিদআত যে মূলত: দুই প্রকার (খারাপ ও উত্তম) তা ভারতীয় কোন আলিম বা ইমামের একাডেমিক আবিষ্কার নয়, এমনকি সমসাময়িক কোন আলিমে দ্বীনের একাডেমিক আবিষ্কারও নয়। বরং প্রথম যিনি একাডেমিক্যালি এই বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় একটি মাজহাবের ইমাম হজরত ইমাম আবু ইদ্রিস আস শাফেয়ী (রাহ:)। যার জন্ম ১৫০ হিজরীতে। তিনিই প্রথম বিদআতকে মূল দুই ভাগে ভাগ করেন। (তথ্যসূত্র: মানাকিবে ইমাম শাফেয়ী, লেখক: ইমাম বায়হাকি) উনার উল্লেখিত এই  প্রকারভেদ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অপর একজন হাদিসের ইমাম হজরত ইমাম বায়হাকী (রাহ:) যাঁর জন্ম আজ থেকে ১০০০ এরও বেশি বছর আগে ৩৮০ হিজরী সনে।

পরবর্তীতে ইমাম নববী, ইমাম ইজ্জুদ্দিন ইবনু আব্দিস সালাম রাহ:, ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী রাহ: এঁর মত বড় বড় সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইমানগন বিদআতকে ওয়াজিব, মাকরুহ ও মোবাহসহ আরো বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। দোস্ত তাঁরা কেহই কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের ইমাম ছিলেন না। সবাই আরব বংশোদ্ভূত ছিলেন এবং তাঁরা সকল মতবাদের মুসলমানগনের বিশ্বস্ত ইমাম।

রেজা বলল, দোস্ত! তোর কি মনে হয় তোর মুরুব্বিরা ও তুই নিজে ইবাদাত বন্দেগীতে বিদআতের আশ্রয় নেস না?

রোজেন বলল, না। আমরা কুরআন-সহিহ হাদিস ছাড়া নতুন কোন রীতি-নীতি মানি না।

রেজা এবার হেসে দিয়ে বলল, তুই কি তারাবির নামাজে কুরআন খতম দিস অর্থ্যাৎ খতমে তারাবিহতে অংশ নিস? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কি তুই মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করিস?

রোজেন বলল, হ্যাঁ এগুলো তো অতি উত্তম কাজ, রামাদ্বানে খতমে তারাবিহ পড়া ও মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ পড়া।

রেজা বলল, দোস্ত! প্রথমত: বেতনভুক্ত ইমামের পিছনে নামাজ পড়া ও বেতনভুক্ত মোয়াজ্জিন রাখা নি:সন্দেহে বিদআত। সিহাহ সিত্তার (বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদিস গ্রন্থ) অন্যতম প্রধান কিতাব সুনান আবু দাউদের, সালাত অধ্যায়ের, ৪৫নং অনুচ্ছেদ: আজানের পরিবর্তে বিনিময় গ্রহন করা সম্পর্কে, হাদিস নং ৫৩১ (যা সহীহ মুসলিম, নাসাই , তিরমিজী ও ইবনে মাজাহতেও এসেছে) পড় আর দয়া করে আমাকে বল, টাকা দিয়ে রাখা বেতনভুক্ত ইমাম আর মুয়াজ্জিনের পিছনে যে নামাজ পড়ি তা কোন সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত? সহীহ হাদিছ বাদ দে এই হাদিছের মুকাবেলায় একখানা দ্বয়ীফ বা হাসান হাদিস আমাকে দেখা যা প্রমান করে যে ইমাম ও মুআজ্জিনের জন্য বেতন নেওয়া জায়েজ। চিরকৃতজ্ঞ থাকব তোর প্রতি ও তোদের মুরুব্বিদের প্রতি যদি দেখাতে পারিস। এই হাদিস খানা বোখারী শরীফ ছাড়া সিহাহ সিত্তার বাকি পাঁচখানা কিতাবেই বর্নিত হয়েছে। বিদআতে হাসানাহ বা উত্তম নতুন রীতির প্রবর্তন ছাড়া ইসলামের হাজারো হুকুম আহকাম টিকবে না। তো আমরা নবীজীর (ﷺ) উপর দরুদ ও সালাতু সালাম পাঠ করার নতুন রীতি মিলাদ শরীফ চালু করলে তোদের সমস্যা হয় কেন?

দ্বিতীয়ত: তারাবী নামাজ “জামাতে” পড়ার সিস্টেম উমর (রা:) চালু করেছিলেন আর তারাবী নামাজে “খতমে কোরআনের” সিস্টেম চালু করেছিলেন তাঁর নাতি হযরত উমর ইবনু আব্দুল আজিজ (রহ:) যিনি একজন তাবেয়ী ছিলেন, সাহাবী ছিলেন না। এটা একটা উত্তম বিদআত। তোর মুরুব্বিগনকে বল তো নিয়ম করে “খতমে তারাবি” পড়ার পক্ষে একখানা সহিহ দূরে থাক দ্বয়িফ হাদিস দেখাতে।

আচ্ছা দোস্ত রোজেন! তবে কি ধরে নেব যে, নবীজীরﷺ শান ও মান এবং উনার দরুদ সালামকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে ও সবার কাছে পৌঁছে দিতে আমরা নতুন কোন ভাল বিদআত যা খন্ড খন্ডভাবে ইসলাম সমর্থিত এরকম কোন কাজ করলেই তোদের মুরুব্বিদের সমস্যা শুরু হয়?

রোজেন অসহায়ের মত মাথা ঝাঁকাতে লাগল। এক পর্যায়ে বন্ধু রেজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দোস্ত! জাযাকাল্লাহু খাইরান। আল্লাহ তোকে উত্তম প্রতিদান দিন। তুই এরকম সুন্দরভাবে আমাকে বুঝিয়ে না বললে হয়ত আমি আমার প্রিয় নবীজীরﷺ ভালবাসা বহি:প্রকাশের এই আমলগুলো থেকে সারাজীবন দূরেই থাকতাম। আল্লাহ আমায় ক্ষমা করুন। আমার জন্য দোআ কর দোস্ত।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment