[ইমাম অাহমদ শেহাবউদ্দীন আল-কসতলানী (রহ:) প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ‘রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নূর’ অধ্যায় হতে অনূদিত। প্রকাশক: অাস্ সুন্নাহ ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা;
[Imam Qastalani’s book ‘al-Mawahib al-Laduniyya’ (‘Light of the Prophet’ chapter); from As-Sunnah Foundation of America; translated by K.S.Hossain]
বঙ্গানুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
ইমাম মোহাম্মদ যুরকানী মালেকী (রহ:) ’আল-মাওয়াহিব’ বইটির ওপর ৮ খণ্ডের একটি ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইমাম কসতলানী (রহ:) ’আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ (যুরকানী রচিত ’শরাহ’ বা ব্যাখ্যা, ৩:১৭৪) গ্রন্থে বলেন:
মহা বরকতময় নাম ‘মোহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ওই নামের অর্থের সাথে যথাযথভাবে মিলে যায় এবং আল্লাহতা’লা মানুষের দ্বারা তাঁর প্রতি ওই মোবারক নামকরণের আগেই নিজ হতে ওই পবিত্র নাম তাঁর প্রতি আরোপ করেন। এটি তাঁর নবুয়্যতের একটি প্রতীকী-চিহ্ন প্রতিষ্ঠা করে, কারণ তাঁর নাম তাঁরই (নবুয়্যতের) সত্যতাকে নিশ্চিত করে। অতএব, তিনি যে জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা (সবাইকে) হেদায়াত দান করেছেন এবং (সবার জন্যে) কল্যাণ এনেছেন, সে কারণে তিনি এই দুনিয়ায় প্রশংসিত (মাহমূদ)। আর পরকালে শাফায়াত তথা সুপারিশ করার সুউচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত হবেন বলেও তিনি প্রশংসিত (মাহমূদ)।
[আল্লাহতা’লা সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুয়্যতকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে কীভাবে তাঁকে মহাসম্মানিত করেছেন, তার বর্ণনা; এতে আরও বর্ণিত হয়েছে তাঁর বংশপরিচয়, ঔরস, বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) ও (ছেলেবেলার) শিক্ষাদীক্ষা]
আশীর্বাদধন্য রূহের সৃষ্টি
আল্লাহতা’লা সৃষ্টিকুলকে অস্তিত্বশীল করার এরাদা (ঐশী ইচ্ছা) পোষণ করার পর তিনি নিজ ‘নূর’ হতে নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি মহানবী (দ:)-এর নূর হতে বিশ্বজগত ও আসমান-জমিনের তাবৎ বস্তু সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে তাঁর রেসালাত সম্পর্কে অভিহিত করেন; ওই সময় হযরত আদম (আ:) রূহ এবং দেহের মধ্যবর্তী (ঝুলন্ত) অবস্থায় ছিলেন। হুযূর পূর নূর (দ:) হতেই তখন সমস্ত রূহ অস্তিত্বশীল হন, যার দরুন তিনি সকল সৃষ্টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে সাব্যস্ত হন এবং সকল অস্তিত্বশীল বস্তুর উৎসমূলে পরিণত হন।
সহীহ মুসলিম শরীফে নবী করীম (দ:) এরশাদ করেন যে আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই আল্লাহ পাক সৃষ্টিকুলের ভাগ্য (তাকদীর) লিপিবদ্ধ করেছিলেন। অধিকন্তু, (হাদীসে) আরও বলা হয় যে আল্লাহতা’লার আরশ-কুরসি ছিল পানিতে এবং যিকির তথা উম্মুল কেতাবে যা কিছু লেখা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ’খাতামুন্ নাবিয়্যিন’ হওয়ার বিষয়টি। হযরত এরবায ইবনে সারিয়্যা (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ বিবৃত করেন যে আমি তখনো আম্বিয়া (আ:)-এর মোহর ছিলাম, যখন আদম (আ:) রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন (মানে সৃষ্টি হননি)।”
হযরত মায়সারা আল-দাব্বী (রা:) বলেন যে তিনি মহানবী (দ:)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এয়া রাসূলুল্লাহ (দ:)! আপনি কখন নবী হন?” তিনি জবাবে বলেন, “যখন আদম (আ:) রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন।”
সুহায়ল বিন সালেহ আল-হামাদানী (রহ:) বলেন, “আমি (একবার) হযরত ইমাম আবূ জা’ফর মোহাম্মদ ইবনে আলী (রা:)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মহানবী (দ:) কীভাবে অন্যান্য পয়গম্বর (আ:)-মণ্ডলীর অগ্রবর্তী হতে পারেন, যেখানে তিনি-ই সবার পরে প্রেরিত হয়েছেন?’ হযরত ইমাম (রা:) উত্তরে বলেন যে আল্লাহ পাক যখন বনী আদম তথা আদম-সন্তানদেরকে জড়ো করে তাঁর নিজের সম্পর্কে সাক্ষ্য (‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ প্রশ্নের উত্তর) নিচ্ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (দ:)-ই সর্বপ্রথমে উত্তর দেন, ‘জ্বি, হ্যাঁ।’ তাই তিনি-ই সকল আম্বিয়া (আ:)-এর পূর্বসূরী, যদিও তাঁকে সবশেষে প্রেরণ করা হয়েছে।”
ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:) ওপরোল্লিখিত হাদীস (মুসলিম শরীফ) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে আল্লাহতা’লা যেহেতু দেহের আগে রূহ (আত্মা) সৃষ্টি করেন এবং যেহেতু মহানবী (দ:) কর্তৃক ‘আমি তখনো নবী ছিলাম যখন আদম (আ:) রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন’ মর্মে মন্তব্য করা হয়, সেহেতু তাঁর ওই বক্তব্য তাঁর-ই পবিত্র রূহকে, তাঁর-ই বাস্তবতাকে উদ্দেশ্য করে; আর আমাদের মস্তিষ্ক (বিচার-বুদ্ধি) এই সব বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে অপারগ হয়ে পড়ে। কেউই সেসব বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সক্ষম নয় একমাত্র সেগুলোর স্রষ্টা (খোদাতা’লা) ছাড়া, আর সে সকল পুণ্যাত্মা ছাড়া, যাঁদেরকে আল্লাহ পাক হেদায়াতের নূর দান করেছেন।
অতএব, হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টিরও আগে আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর রূহ মোবারককে নবুওয়্যত দান করেছিলেন; কেননা, তিনি তাঁকে সৃষ্টি করে অগণিত (অফুরন্ত) নেয়ামত দান করেন এবং খোদার আরশে মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারকও লেখেন, আর ফেরেশতা ও অন্যান্যদেরকে মহানবী (দ:)-এর প্রতি নিজ মহব্বত ও উচ্চধারণা বা শ্রদ্ধা সম্পর্কে জানিয়ে দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বাস্তবতা তখন থেকেই বিরাজমান, যদিও তাঁর মোবারক জিসম (দেহ) পরবর্তীকালে আবির্ভূত হন। হযরত আল-শি’বী (রা:) বর্ণনা করেন যে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন?” হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, ”যখন আদম (আ:) তাঁর রূহ এবং দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে ওয়াদা নেয়া হয়েছিল।” তাই আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মধ্যে তিনি-ই সর্বপ্রথমে সৃষ্ট এবং সর্বশেষে প্রেরিত।
বর্ণিত আছে যে, মহানবী (দ:)-ই হলেন একমাত্র বনী আদম, যাঁকে রূহ ফোঁকার আগে (সর্বপ্রথমে) বেছে নেয়া হয়; কেননা তিনি-ই মনুষ্যজাতির সৃষ্টির কারণ, তিনি-ই তাদের অধিপতি, তাদের অন্তঃসার, তাদের উৎসমূল এবং মাথার মুকুট।
সর্ব-হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:) ও ইবনে আব্বাস (রা:) উভয়েই বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আদম (আ:) থেকে আরম্ভ করে সমস্ত নবী-রাসূল প্রেরণের আগে তাঁদের কাছে আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:) সম্পর্কে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, যদি তাঁদের হায়াতে জিন্দেগীতে তাঁরা মহানবী (দ:)-এর সাক্ষাৎ পান, তবে যেন তাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁকে (সর্বাত্মক) সাহায্য-সমর্থন করেন; আর যেন তাঁরা নিজেদের উম্মতকেও অনুরূপ কর্তব্য পালনের আদেশ দেন।”
বর্ণিত আছে যে আল্লাহ পাক যখন আমাদের মহানবী (দ:)-এর নূর সৃষ্টি করেন, তখন তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-কে অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-এর নূরের দিকে তাকাতে বলেন। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নূর সবার নূরকে ঢেকে ফেলে (অথবা সবার নূরকে ছাপিয়ে ওঠে) ; এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক তাঁদেরকে কথা বলতে দিলে তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, ‘এয়া আল্লাহ, কে আমাদেরকে তাঁর নূর দ্বারা ঢেকে রেখেছেন?’ আল্লাহতা’লা জবাবে বলেন, ‘এটি সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নূর। যদি তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনো, তবে আমি তোমাদেরকে নবী বানিয়ে দেবো।’ তাঁরা সবাই বলেন, ‘আমরা তাঁর প্রতি এবং তাঁর নবুওয়্যতের প্রতি ঈমান আনলাম।’ অতঃপর আল্লাহ পাক জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কি তোমাদের সাক্ষী হবো?’ তাঁরা উত্তর দেন, ’হ্যাঁ’। আল্লাহ পাক আবার প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কি এই প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা মেনে নিলে?’ তাঁরা উত্তরে বলেন, ‘আমরা তা মানার ব্যাপারে একমত।’এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা বলেন, ‘তাহলে সাক্ষী হও, আর আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী হলাম।’ এটি-ই হলো পাক কালামের অর্থ যেখানে আল্লাহতা’লা এরশাদ করেছেন: “এবং স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ আম্বিয়াবৃন্দের কাছ থেকে তাদের অঙ্গিকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের কাছে ওই রাসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যঅবশ্য তাঁকে সাহায্য করবে’।” [আল-কুরআন, ৩:৮১]
ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:) বলেন, “এই মহান আয়াতে করীমায় মহানবী (দ:)-এর প্রতি পেশকৃত শ্রদ্ধা ও উচ্চ সম্মান একেবারেই স্পষ্ট। এতে আরও ইঙ্গিত আছে যে অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর জীবদ্দশায় মহানবী (দ:)-কে প্রেরণ করা হলে তাঁর রেসালাতের বাণী তাঁদের জন্যে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হতো। অতএব, তাঁর রেসালাত ও রেসালাতের বাণী সাইয়্যেদুনা আদম (আ:) থেকে আরম্ভ করে শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত আগত সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্যে সার্বিক হিসেবে সাব্যস্ত হয় এবং সকল আম্বিয়া (আ:) ও তাঁদের উম্মত-ও মহানবী (দ:)-এর উম্মতের অন্তর্গত বলে গণ্য হন। এ কারণে ‘আমাকে সকল জাতির জন্যে প্রেরণ করা হয়েছে’ মর্মে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীসটি শুধু তাঁর সময়কার ও শেষ বিচার দিবস অবধি আগত মনুষ্যকুলের জন্যে উচ্চারিত হয়নি, বরং এতে অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের পূর্ববর্তীরাও। এ বিষয়টি আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে তাঁর নিম্নবর্ণিত হাদীসকে, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান: ‘আমি তখনো নবী ছিলাম, যখন আদম (আ:) রূহ এবং দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন।’ মহানবী (দ:) যে নবী (আ:)-দের নবী (দ:), সেটি জানা যায় তখনই, যখন দেখতে পাই মে’রাজ রজনীতে সকল আম্বিয়া (আ:) তাঁর ইমামতিতে নামায পড়েছিলেন। পরকালে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব আরও স্পষ্ট হবে, যখন সকল আম্বিয়া (আ:) তাঁর-ই পতাকাতলে সমবেত হবেন।”
জিসম মোবারকের সৃষ্টি
হযরত কা’আব আল-আহবার (রা:) বলেন, “আল্লাহতা’লা যখন সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন তিনি ফেরেশতা হযরত জিবরীল আমীন (আ:)-কে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু হতে মাটি আনতে বল্লেন, যেটি হলো ওর সৌন্দর্য ও নূর (জ্যোতি)। অতঃপর হযরত জিবরীল (আ:) জান্নাতুল ফেরদৌস ও রফীকে আ’লার ফেরেশতাদেরকে সাথে নিয়ে (ধরণীতে) নেমে আসেন এবং মহানবী (দ:)-এর মোবারক দেহ সৃষ্টির জন্যে (বর্তমানে) যেখানে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা শরীফ অবস্থিত, সেখান থেকে এক মুঠাে মাটি নেন। সেই মাটি ছিল ধবধবে সাদা এবং নূরানী তথা আলো বিচ্ছুরণকারী। এরপর ফেরেশতা জিবরীল (আ:) ওই পবিত্র মাটিকে জান্নাতের ‘তাসনিম’ নহরের সেরা সৃষ্ট পানির সাথে মিশিয়ে নেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তা তীব্র প্রভা বিকীরণকারী সাদা মুক্তোর মতো হয়ে গিয়েছিল। ফেরেশতাবৃন্দ তা বহন করে সুউচ্চ আরশ, পাহাড়-পর্বত ও সাগর-মহা সাগর ঘুরে বেড়ান। এভাবেই ফেরেশতাবৃন্দ ও সকল সৃষ্টি আমাদের আকা ও মওলা মহানবী (দ:) সম্পর্কে জানতে পারেন, যা তাঁরা হযরত আদম (আ:)-কে জানারও আগে জেনেছিলেন।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর (ওই) মাটির মূল উৎস পৃথিবীর নাভি হতে উৎসারিত, যা মক্কা মোয়াযযমায় কা’বা ঘর যেখানে অবস্থিত, সেখানেই কেন্দ্রীভূত। অতএব, সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সৃষ্টির উৎসমূলে পরিণত হন, আর সকল সৃষ্টি তাঁর-ই অনুসরণকারী হন।”
’আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ গ্রন্থপ্রণেতা (সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন যে (হযরত নূহ আলায়হিস্ সালামের যুগের) মহাপ্লাবনের সময় স্রোতের তোড়ে মহানবী (দ:)-এর মৌল সত্তা মদীনা মোনাওয়ারায় তাঁর বর্তমানকালের রওযা শরীফের কাছে এসে অবস্থান নেন। তাই তিনি মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারা উভয় স্থানের বাসিন্দা হিসেবে পরিণত হন।
বর্ণিত আছে যে আল্লাহ পাক যখন হযরত আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি তাঁকে এ আরজি পেশ করতে অনুপ্রাণিত করেন, “এয়া আল্লাহ! আপনি কেন আমাকে ‘আবূ মোহাম্মদ’ (মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পিতা) নামে ডেকেছেন?” আল্লাহতা’লা জবাবে বলেন, “ওহে আদম! তোমার মাথা তোলো!” তিনি শির মোবারক তুলে (খোদার) আরশের চাঁদোয়ায় মহানবী (দ:)-এর নূর মোবারক দেখতে পান। হযরত আদম (আ:) আরয করেন, “এই জ্যোতি কিসের?” জবাবে আল্লাহ পাক ফরমান, “এটি তোমারই ঔরসে অনাগত এক নবী (দ:)-এর জ্যোতি। আসমানে (বেহেশ্তে) তাঁর নাম আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম), আর দুনিয়াতে হলো মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আ’লেহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁকে সৃষ্টি না করলে আমি তোমাকে, বা আসমান, অথবা জমিন কিছুই সৃষ্টি করতাম না।”
ইমাম আব্দুর রাযযাক (রহ:) বর্ণনা করেন হযরত জাবের বিন আব্দিল্লাহ (রা:) হতে, যিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। (অনুগ্রহ করে) আমায় বলুন, আল্লাহতা’লা সর্বপ্রথম বা সর্বাগ্রে কী সৃষ্টি করেন?’ জবাবে মহানবী (দ:) বলেন, ‘ওহে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ পাক সর্বাগ্রে তোমার নবী (দ:)-এর নূর (জ্যোতি)-কে তাঁর নূর হতে সৃষ্টি করেন। ওই নূর আল্লাহতা’লা যেখানে চান, সেখানেই তাঁর কুদরতে ঘুরতে আরম্ভ করেন। সেসময় না ছিল লওহ, না কলম, না বেহেশ্ত, না দোযখ, না ফেরেশ্তাকুল, না আসমান, না জমিন, না সূর্য, না চন্দ্র, না জ্বিন-জাতি, না মনুষ্যকুল। আল্লাহতা’লা যখন সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন তিনি ওই নূরকে চারভাগে বিভক্ত করলেন। অতঃপর প্রথম অংশটি হতে তিনি কলম সৃষ্টি করেন; লওহ সৃষ্টি করেন দ্বিতীয় অংশ থেকে, আর তৃতীয় অংশ থেকে আরশ সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি চতুর্থ অংশটিকে আবারও চারভাগে বিভক্ত করেন। ওর প্রথম অংশ দ্বারা তিনি আরশের (আজ্ঞা)-বাহকদের (তথা শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাদের) সৃষ্টি করেন; দ্বিতীয় অংশ দ্বারা কুরসী সৃষ্টি করেন; আর তৃতীয় অংশটি দ্বারা বাকি সকল ফেরেশতাকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি চতুর্থ অংশকে আবারও চারভাগে বিভক্ত করেন: প্রথম অংশটি দ্বারা তিনি সমস্ত আসমান সৃষ্টি করেন; দ্বিতীয় অংশটি দ্বারা সমস্ত জমিন সৃষ্টি করেন; তৃতীয় অংশটি দ্বারা বেহেশ্ত ও দোযখ সৃষ্টি করেন। এরপর আবারও তিনি চতুর্থ অংশটিকে চারভাগে বিভক্ত করেন: প্রথম অংশ থেকে তিনি ঈমানদারদের দর্শনক্ষমতার নূর সৃষ্টি করেন; দ্বিতীয় অংশ থেকে অন্তরের নূর (তথা আল্লাহকে জানার যোগ্যতা) সৃষ্টি করেন; আর তৃতীয় অংশ থেকে মো’মেন (বিশ্বাসী)-দের সুখ-শান্তির নূর (উনস্, অর্থাৎ, ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কলেমাটি) সৃষ্টি করেন।”
অপর এক বর্ণনা হযরত আলী ইবনে আল-হুসাইন (রহ:), তিনি তাঁর পিতা (রা:) হতে, তিনি তাঁর প্রপিতা (রা:) হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:) হতে রেওয়ায়াত করেন; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “আমি ছিলাম এক নূর আমার প্রভু খোদাতা’লার দরবারে, এবং তা হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টিরও চৌদ্দ হাজার বছর আগে।” বর্ণিত আছে যে আল্লাহতা’লা যখন আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি ওই নূরে মোহাম্মদী (দ:)-কে তাঁর পিঠে স্থাপন করেন; আর সেই নূর তাঁর সম্মুখভাগে এমন আলো বিচ্ছুরণ করতেন যে তাঁর (আদমের) অন্যান্য জ্যোতি তাতে ম্লান হয়ে যেতো। এরপর আল্লাহ পাক সেই নূরকে তাঁরই মহাসম্মানিত আরশে উন্নীত করেন এবং ফেরেশতাদের কাঁধে বহন করান; আর তিনি তাঁদের প্রতি আদম (আ:)-কে সমস্ত আসমান ঘুরিয়ে তাঁরই সৃষ্টি-সাম্রাজ্যের (শ্রেষ্ঠতম) বিস্ময়গুলো দেখাতে আদেশ দেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “হযরত আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করা হয় শুক্রবার অপরাহ্নে। আল্লাহতা’লা অতঃপর ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর বাঁ পাঁজর থেকে তাঁরই স্ত্রী বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠে মা হাওয়াকে দেখে স্বস্তি বোধ করেন এবং নিজ হাত মোবারক তাঁর দিকে বাড়িয়ে দেন। ফেরেশতাবৃন্দ বলেন, ‘ওহে আদম (আ:)! থামুন।’ তিনি এমতাবস্থায় প্রশ্ন করেন, ‘কেন, আল্লাহতা’লা কি একে আমার জন্যে সৃষ্টি করেননি?’ ফেরেশতাবৃন্দ বলেন, ‘আপনার দ্বারা তাঁকে দেনমোহর পরিশোধ না করা পর্যন্ত নয়।’ তিনি আবার প্রশ্ন করেন, ‘তার দেনমোহর কী?’ জবাবে ফেরেশতাবৃন্দ বলেন, ‘সাইয়্যেদুনা মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি তিনবার সালাত-সালাম (দুরুদ) পাঠ’।” [অপর রেওয়ায়াতে আছে বিশবার]
আরও বর্ণিত আছে যে হযরত আদম (আ:) বেহেশত ত্যাগ করার সময় আরশের পায়ায় এবং বেহেশতের সর্বত্র আল্লাহতা’লার নামের পাশে মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারক লিপিবদ্ধ দেখতে পান। তিনি আরয করেন, “হে প্রভু, মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে?” আল্লাহ পাক জবাব দেন, “তিনি তোমার পুত্র, যাঁকে ছাড়া আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।” অতঃপর হযরত আদম (আ:) ফরিয়াদ করেন, “হে প্রভু, এই পুত্রের অসীলায় (খাতিরে) এই পিতার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন।” আল্লাহতা’লা উত্তরে বলেন, “ওহে আদম! আসমান ও জমিনের অধিবাসীদের জন্যে যদি তুমি মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর মধ্যস্থতায় (অসীলায়) সুপারিশ করতে, আমি তা গ্রহণ বা মঞ্জুর করতাম।”
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ ফরমান: “আদম (আ:) কর্তৃক নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তিনি আরয করেন, ‘এয়া অাল্লাহ! সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর অসীলায় আমায় ক্ষমা করুন।’ আল্লাহতা’লা বলেন, ‘তুমি তাঁকে কীভাবে চেনো, আমি তো এখনো তাঁকে সৃষ্টি করিনি?’ হযরত আদম (আ:) উত্তর দেন, ‘হে প্রভু, এটি এ কারণে যে আপনি যখন আপনার কুদরতী হাতে আমায় সৃষ্টি করেন এবং আমার দেহে আমার রূহ ফোঁকেন, তখন আমি মাথা তুলে আরশের পায়ায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (কলেমা) বাক্যটি লিপিবদ্ধ দেখতে পাই। অামি বুঝতে পারি, সৃষ্টিকুলে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কারো নাম-ই আপনি আপনার নামের পাশে যুক্ত করেছেন।’ অতঃপর আল্লাহ পাক বলেন, ‘ওহে আদম! তুমি সত্য বলেছো। আমার সৃষ্টিকুলে তিনি-ই আমার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন। আর যেহেতু তুমি তাঁর-ই অসীলায় আমার কাছে চেয়েছো, সেহেতু তোমাকে ক্ষমা করা হলো। মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যদি না হতেন, তাহলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না। তিনি তোমারই বংশে পয়গম্বর-মণ্ডলীর সীলমোহর’।”
হযরত সালমান ফারিসী (রা:)-এর এক বর্ণনায় জানা যায়, হযরত জিবরীল আমীন (আ:) অবতীর্ণ হয়ে মহানবী (দ:)-কে বলেন: “আপনার প্রভু খোদাতা’লা বলেন, ‘আমি ইবরাহীম (আ:)-কে আমার খলীল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করলে আপনাকেও (হে হাবীব) তা হিসেবেই গ্রহণ করেছি। আপনার চেয়ে আমার এতো কাছের জন হিসেবে আর কাউকেই আমি সৃষ্টি করিনি; উপরন্ত, আমি এই বিশ্বজগতকে এবং এর অধিবাসীদেরকে সৃষ্টি করেছি কেবল আপনার শান-মান এবং আপনি আমার কতো প্রিয় তা জানাবার উদ্দেশ্যেই; আপনি না হলে আমি এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করতাম না’।”
হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়ার ঘরে বিশ বারে সর্বমোট চল্লিশজন পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু মা হাওয়ার গর্ভে সাইয়্যেদুনা শীষ (আ:)-এর জন্ম হয় আলাদাভাবে। এর কারণ হলো আমাদের মহানবী (দ:)-এর প্রতি তা’যিম বা শ্রদ্ধা প্রদর্শন, যাঁর নূর মোবারক হযরত আদম (আ:) থেকে শীষ (আ:)-এর মাঝে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সাইয়্যেদুনা আদম (আ:)-এর ’বেসাল’ তথা খোদার সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির আগে তিনি শীষ (আ:)-এর জিম্মায় তাঁর (ভবিষ্যত) প্রজন্মকে রেখে যান; আর এরই ধারাবাহিকতায় শীষ (আ:)-ও সন্তানদেরকে আদম (আ:)-এর অসীয়তনামা হস্তান্তর করেন; সেই অসীয়ত হলো, শুধু পুতঃপবিত্র ও নির্মল (আত্মার) নারীর মাঝে ওই নূর হস্তান্তর করা। এই অসীয়ত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছিল, যতোক্ষণ না আল্লাহ পাক আব্দুল মোত্তালিব ও তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে এই নূর মঞ্জুর করেন। এভাবেই আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর পূর্বপুরুষদের বংশপরম্পরাকে মূর্খদের অবৈধ যৌনাচার থেকে পুতঃপবিত্র রেখেছিলেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি বিবৃত করেন: “মূর্খতাজনিত অবৈধ যৌনাচার আমার বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন)-কে স্পর্শ করেনি। আমার বেলাদত হয়েছে ইসলামী বিবাহ রীতির ফলশ্রুতিতেই।”
হিশাম ইবনে মোহাম্মদ আল-কালবী বর্ণনা করেন তাঁর বাবার ভাষ্য, যিনি বলেন: “আমি রাসূলে খোদা (দ:)-এর উর্ধ্বতন (বা পূর্ববর্তী) বংশীয় পাঁচ’শ জন মায়ের হিসেব আমার গণনায় পেয়েছি। তাঁদের কারো মাঝেই কোনো অবৈধ যৌনাচারের লেশচিহ্ন মাত্র আমি খুঁজে পাইনি, যেমনটি পাইনি অজ্ঞদের কর্মকাণ্ড।”
সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (ক:) বর্ণনা করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আমি বিয়ের ফলশ্রুতিতেই বেলাদত-প্রাপ্ত হয়েছি, অবৈধ যৌনাচার থেকে নয়; আবির্ভূত হয়েছি আদম (আ:) হতে বংশপরম্পরায় আমার পিতামাতার ঘরে। মূর্খতাজনিত অবৈধ যৌনাচারের কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করেনি।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) রেওয়ায়াত করেন মহানবী (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ ফরমান: “আমার পিতামাতা কখনোই অবৈধ যৌনাচার করেননি। আল্লাহতা’লা আমাকে পুতঃপবিত্র ঔরস থেকে পুতঃপবিত্র গর্ভে স্থানান্তর করতে থাকেন; যখনই দুটো (বিকল্প) পথ সামনে এসেছে, আমি সেরা পথটি-ই পেয়েছি।”
হযরত আনাস (রা:) বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (দ:) ‘লাকাদ জা’আকুম রাসূলুম্ মিন আনফুসিকুম’- আয়াতটি তেলাওয়াত করেন এবং বলেন: “আমি আমার খানদান, আত্মীয়তা ও পূর্বপুরুষের দিক দিয়ে তোমাদের মাঝে সেরা; হযরত আদম (আ:) হতে আরম্ভ করে আমার পূর্বপুরুষদের কেউই অবৈধ যৌনাচার করেননি।”
সাইয়্যেদাহ আয়েশা সিদ্দীকা (রা:) মহানবী (দ:) হতে বর্ণনা করেন যে হযরত জিবরীল আমীন (আ:) বলেন, “আমি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত খুঁজেও মহানবী (দ:)-এর মতো সেরা ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাইনি; আর বনূ হাশিম গোত্রের পুত্রদের মতো কোনো বাবার সন্তানের দেখাও পাইনি আমি।”
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আদম সন্তানদের সেরা প্রজন্মে, একের পর এক, যতোক্ষণে আমি না পৌঁছেছি আমার (বর্তমান)-টিতে।”
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত ওয়াতিলা ইবনে আল-আসকা’ বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ পাক হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর পুত্রদের মধ্যে কেনানাকে বেছে নিয়েছেন এবং কেনানা হতে কুরাইশ গোত্রকে পছন্দ করেছেন; অার কুরাইশ গোত্র হতে বনূ হাশিমকে বেছে নিয়েছেন; এবং চূড়ান্তভাবে হাশিমের পুত্রদের মাঝে আমাকেই পছন্দ করেছেন।”
হযরত আব্বাস (রা:) রেওয়ায়াত করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বাণী, যিনি বলেন: “সৃষ্টিকুলের অস্তিত্ব দেয়ার পর আল্লাহ পাক আমাকে সেরা দলগুলোতে অধিষ্ঠিত করেন; এবং দুটো দলের মধ্যে সেরা দলে (আমি অধিষ্ঠিত হই)। অতঃপর তিনি গোত্রগুলো বেছে নেন এবং সেগুলোর সেরা পরিবারটিতে আমাকে অাবির্ভূত করেন। অতএব, আমার ব্যক্তিত্ব, আত্মা ও স্বভাব সর্বসেরা এবং আমি এগুলোর সেরা উৎস হতে আগত।”
হযরত ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলকে যাচাই করে আদম সন্তানদেরকে তা থেকে বাছাই করেন; এরপর তিনি আদম সন্তানদেরকে যাচাই করে তাদের মধ্য থেকে আরবদেরকে মনোনীত করেন; অতঃপর তিনি আরবদেরকে যাচাই করে আমাকে তাদের মধ্য হতে পছন্দ করে নেন। অতএব, আমি-ই সব পছন্দের সেরা পছন্দ। সতর্ক হও, আরবদেরকে যে মানুষেরা ভালোবাসে, তা আমার প্রতি ভালোবাসার কারণেই ভালোবাসে; আর যারা আরবদেরকে ঘৃণা করে, তারা আমাকে ঘৃণা করার কারণেই তা করে থাকে।”
জ্ঞাত হওয়া দরকার যে সাইয়্যেদুনা মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম তাঁর পিতামাতা হতে সরাসরি (জন্ম নেয়া) কোনো ভাই বা বোনের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন না; তিনি ছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তান এবং তাঁর খানদান তাঁরই কাছে এসে শেষ হয়। এভাবে তিনি এক অনন্য খানদানে বেলাদত-প্রাপ্ত হয়েছিলেন যা আল্লাহতা’লা (তাঁরই) নবুয়্যতের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার জন্যে এরাদা (ঐশী ইচ্ছে) করেছিলেন, যে নব্যুয়ত সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী।
আপনারা যদি মহানবী (দ:)-এর উচ্চ বংশমর্যাদা ও তাঁর পবিত্র বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তবে আপনারা তাঁর মহাসম্মানিত পূর্বপুরুষদের ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। কেননা, তিনি হচ্ছেন আন্ নবী (দ:), আল-আরবী (দ:), আল-আবতাহী (দ:), আল-হারাআমী (দ:), আল-হাশেমী (দ:), আল-কুরাইশী (দ:), হাশেমী সন্তানদের সেরা, সেরা আরব গোত্রগুলোর মধ্য হতে পছন্দকৃত, সেরা বংশোদ্ভূত, সর্বশ্রেষ্ঠ খানদানে আগত, সেরা বর্ধনশীল শাখা, সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ, সেরা উৎস, সবচেয়ে মজবুত ভিত, সুন্দরতম বাচনভঙ্গির অধিকারী, সবচেয়ে বোধগম্য শব্দচয়নকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ নির্ণায়ক মানদণ্ড, সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গ, পিতামাতার দু’দিক থেকেই সবচেয়ে সম্মানিত আত্মীয়স্বজন, এবং আল্লাহতা’লার জমিনে সবচেয়ে সম্মানিত ভূমি (আরবদেশ) হতে আগত। তাঁর অনেক মোবারক নাম রয়েছে, যার সর্বাগ্রে হলো মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, যিনি আবদুল্লাহ’র পুত্র। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে রয়েছেন তাঁরই দাদা আবদুল মোত্তালিব, যাঁর নাম শায়বাত আল-হামদ; হাশেমের পুত্র আমর, আবদ মানাআফের পুত্র আল-মুগীরা, কুসাইয়ের পুত্র মোজাম্মী’, কিলাআবের পুত্র হাকীম, মুররার পুত্র, (কুরাইশ গোত্রীয়) কাআবের পুত্র, লু’আইয়ের পুত্র, গালিবের পুত্র, ফিহর-এর পুত্র, যাঁর নাম কুরাইশ, মালেকের পুত্র, আল-নাযহিরের পুত্র, যাঁর নাম কায়েস, কিনানার পুত্র, খুযায়মার পুত্র, মুদরিকার পুত্র, ইলিয়াসের পুত্র, মুদারের পুত্র, নিযারের পুত্র, মাআদ্দ-এর পুত্র, আদনানের পুত্র।
ইবনে দিহিয়া বলেন, “উলেমাবৃন্দ (এ ব্যাপারে) একমত এবং জ্ঞানীদের এই ঐকমত্য একটি প্রামাণ্য দলিল যে মহানবী (দ:) তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম আদনান পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন এবং এর ওপরে আর যাননি।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন যে সাইয়্যেদুনা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহী ওয়া সাল্লাম তাঁর পূর্বপুরুষদের বংশপরম্পরা উল্লেখ করার সময় কখনোই আদনানের পুত্র মা’আদ্দ-এর ওপরে যেতেন না, বরঞ্চ এ কথা বলে শেষ করতেন, “বংশ বর্ণনাকারীরা (উদ্ভববিজ্ঞানীরা) মিথ্যে বলেছে।” এ কথা তিনি দু’বার বা তিনবার বলতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “আদনান ও হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর মধ্যে ত্রিশজন পূর্বপুরুষের নাম অজ্ঞাত রয়েছে।”
কাআব আল-আহবার (রহ:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর নূর (জ্যোতি) আবদুল মোত্তালিবের কাছে পৌঁছুবার কালে তিনি পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন; ওই সময় এক রাতে তিনি কা’বা ঘরের বহিঃপ্রাঙ্গনে ঘুমিয়েছিলেন। (সকালে) জেগে উঠলে তাঁর চোখ দুটো কালো সুরমামাখা ও চুল তেলমাখা এবং পরনে সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ জামাকাপড় দেখা যায়। কে এ রকম করেছেন, তা না জানার দরুন তিনি বিস্মিত হন। তাঁর পিতা তাঁকে হাত ধরে দ্রুত কুরাইশ বংশীয় গণকদের কাছে নিয়ে যান। তারা তাঁর পিতাকে বলেন পুত্রকে বিয়ে দিতে। তিনি তা-ই করেন। আবদুল মোত্তালিবের শরীর থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ মেশকের গন্ধ বের হতো, আর তাঁর ললাট হতে উজ্জ্বল প্রভা ছড়াতো নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। কখনো খরা দেখা দিলে কুরাইশ গোত্র তাঁকে ‘সাবীর’পর্বতে নিয়ে যেতো এবং তাঁরই অসীলায় আল্লাহর দরবারে বৃষ্টি প্রার্থনা করতো। আল্লাহ পাক-ও তাদের প্রার্থনার জবাব দিতেন এবং নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে
ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাতিরে বৃষ্টি বর্ষণ করতেন।”
ইয়েমেনী রাজা আবরাহা যখন পবিত্র কা’বা ঘর ধ্বংসের অভিপ্রায়ে মক্কা শরীফ অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং এর খবর কুরাইশ গোত্রের কাছে পৌঁছে, তখন আবদুল মোত্তালিব তাদের বলেন, “সে (বাদশাহ) এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছুবে না, কারণ এটি মহান প্রভুর সুরক্ষায় আছে।” মক্কা মোয়াযযমার পথে বাদশাহ আবরাহা কুরাইশ গোত্রের অনেক উট ও ভেড়া লুঠপাট করে; এগুলোর মধ্যে ছিল আবদুল মোত্তালিবের মালিকানাধীন চার’শ মাদী উট। এমতাবস্থায় তিনি সওয়ারি হয়ে অনেক কুরাইশকে সাথে নিয়ে ’সাবীর’ পর্বতে আরোহণ করেন। সেখানে নূরে মোহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর কপালে অর্ধ চন্দ্রাকারে দৃশ্যমান হয় এবং সেটির আলোকোচ্ছ্বটা পবিত্র (কা’বা) ঘরে প্রতিফলিত হয়। আবদুল মোত্তালিব তা দেখার পর বলেন, “ওহে কুরাইশ গোত্র, তোমরা এখন ফিরে যেতে পারো, কেননা কা’বা এখন নিরাপদ। আল্লাহর কসম! এই কিরণ (নূর) যখন আমাকে ঘিরে রেখেছে, তখন কোনো সন্দেহ নেই যে বিজয় আমাদেরই হবে।”
কুরাইশ গোত্রীয় মানুষেরা মক্কায় ফিরে গেলে আবরাহা রাজার প্রেরিত এক ব্যক্তির সাথে তাদের দেখা হয়। আবদুল মোত্তালিবের চেহারা দেখে ওই ব্যক্তি ভাবাবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং তাঁর জিহ্বা তোতলাতে থাকে; তিনি মুর্ছা যান, আর তাঁর কণ্ঠ থেকে জবেহকৃত বৃষের আওয়াজ বেরুতে থাকে। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি আব্দুল মোত্তালিবের পায়ে পড়ে যান এ কথা বলে, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি সত্যিসত্যি কুরাইশ গোত্রের অধিপতি।”
বর্ণিত আছে যে আবদুল মোত্তালিব যখন বাদশাহ আবরাহার মুখোমুখি হন, ওই সময় বাদশাহর সেনাবাহিনীতে সর্ববৃহৎ সাদা হাঁতিটি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে উট যেভাবে হাঁটু গেড়ে নত হয় ঠিক সেভাবে নত হয়ে যায় এবং সেজদা করে। আল্লাহতা’লা সেই প্রাণিকে বাকশক্তি দেন এবং সে বলে, “ওহে আবদুল মোত্তালিব, আপনার ঔরসে নূর (-এ-মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।” রাজা আবরাহার বাহিনী কা’বা ঘর ধ্বংস করার জন্যে অগ্রসর হলে ওই হাঁতি আবারো হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারা সেটিকে দাঁড় করানোর জন্যে মাথায় বেদম প্রহার করে, কিন্তু সেটি তা করতে অস্বীকার করে। তারা হাঁতিটিকে ইয়েমেনের দিকে মুখ করালে সেটি উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর আল্লাহতা’লা বাদশাহর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমুদ্র হতে এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেন, যেগুলোর প্রত্যেকটি তিনটি করে পাথর বয়ে আনে: একটি পাথর ঠোঁটে, অপর দুটি দুই পায়ে। এই পাথরগুলো আকৃতিতে ছিল মশুরি ডালের দানার সমান। এগুলো সৈন্যদেরকে আঘাত করামাত্রই তারা মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকে। ফলে সৈন্যরা ভয়ে রণভঙ্গ দেয়। এমতাবস্থায় আবরাহা এক কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার হস্তাঙ্গুলির ডগা এক এক করে পড়ে যেতে থাকে। আর তার শরীর থেকে রক্ত ও পুঁজ-ও বের হয়। অবশেষে তার হৃদযন্ত্র চৌচির হয়ে সে মারা যায়।
এই ঘটনাটি-ই আল্লাহতা’লা উল্লেখ করেছেন তাঁর পাক কালামে, যেখানে মহানবী (দ:)-কে সম্বোধন করে তিনি এরশাদ ফরমান, “হে মাহবূব! আপনি কি দেখেননি আপনার রব্ব (খোদাতা’লা) ওই হস্তী আরোহী বাহিনীর কী অবস্থা করেছেন?” [সূরা ফীল, ১ম আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]। এই ঘটনা আমাদের সাইয়্যেদুনা হযরতে মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামের উচ্চমর্যাদার এবং তাঁর রেসালাত ও তা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন করে। এতে আরও ফুটে ওঠে তাঁরই উম্মতকে প্রদত্ত সম্মান ও তাঁদের প্রতি (খোদার) হেফাযত (সুরক্ষা), যার দরুন সমস্ত আরব জাতিগোষ্ঠী তাঁদের কাছে সমর্পিত হন এবং তাঁদের মহত্ত্ব ও বিশিষ্টতায় বিশ্বাস স্থাপন করেন। এটি এ কারণেই সম্ভব হয়েছে যে আল্লাহ পাক তাঁদেরকে হেফাযত করেছেন এবং দৃশ্যতঃ অজেয় আবরাহা বাদশাহর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদেরকে সমর্থন যুগিয়েছেন।