তখন ফেরেশতারা সবাই একসঙ্গে [আদম (আ.)-এর সামনে] সিজদা করে। [সুরা : হিজর, আয়াত : ৩০ (পঞ্চম পর্ব)]
তাফসির : আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে ফেরেশতারা বিনা বাক্যে একযোগে হজরত আদম (আ.)-এর সামনে সিজদাবনত হন। এ সিজদার মাধ্যমে মানবীয় মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাহলে ফেরেশতা সৃষ্টির হেকমত ও রহস্য কী? আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় এ পৃথিবীর সব কিছু সংঘটিত হয়।তিনি মহাক্ষমতাবান ও পরাক্রমশালী। কিন্তু দুনিয়া হলো ‘দারুল আসবাব’ বা কারণ-উপকরণ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্র। কারণ-উপকরণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ দুনিয়ার জীবন। কোনো মাধ্যম ও অবলম্বনের সূত্র ধরে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার কার্যাবলি সম্পাদন করেন।পরিভাষায় একে বলা হয় ‘আদাতুল্লাহ’ বা আল্লাহর চিরাচরিত রীতি। তবে তিনি কখনো কখনো আসবাব ও উপকরণ ছাড়াও অনেক কিছু প্রকাশ করেন, যাতে মানুষ আল্লাহর অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে। যেমন—সাধারণ নিয়ম অনুসারে মা-বাবার মাধ্যমেই সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-কে মা-বাবা ছাড়া, হজরত হাওয়া (আ.)-কে মা ছাড়া, হজরত ঈসা (আ.)-কে বাবা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন।
নিয়ম ও মাধ্যম বহির্ভূত আল্লাহর এই কার্যাবলিকে ‘কুদরতুল্লাহ’ বা আল্লাহর শক্তি-সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ বলা হয়। এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকা সামনে রেখে বলা যায়, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান হওয়া সত্ত্বেও ফেরেশতাদের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করান। এটা ইহকালে তাঁর আদাত বা চিরাচরিত নীতির অংশ। ফেরেশতা সৃষ্টির অন্যতম হেকমত ও রহস্য হলো, পার্থিব কাজে আল্লাহর সরাসরি হস্তক্ষেপের পরিবর্তে কোনো উপকরণের মাধ্যমে তা সংঘটিত করা। ইহকালে আল্লাহর এ নীতির আলোকে তিনি তাঁর বান্দাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ইবাদত-বন্দেগি সংরক্ষণ করার জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের ওপর নিযুক্ত রয়েছে তত্ত্বাবধায়করা (ফেরেশতারা), যারা সম্মানিত লেখক। তারা তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।’ (সুরা : ইনফিতার, আয়াত : ১০-১২)
ফেরেশতারা আল্লাহর সর্ববৃহৎ সৃষ্টি। এ বিশ্ব চরাচরের তিনিই মালিক। তিনি রাজাধিরাজ। আসমান ও জমিনের পূর্ণ মালিকানা ও রাজত্ব শুধু তাঁরই। তাঁর রাজত্বের বাইরে কোনো কিছু নেই। তাঁর রয়েছে রাজদরবার। রয়েছে রাজসিংহাসন। পবিত্র কোরআন বিষয়টিকে ‘আরশ’ ও ‘কুরসি’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘‘…তাঁর ‘কুরসি’ আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত…।’’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৫)
সেই রাজদরবারের হুকুম তামিল করেন ফেরেশতারা। সেই রাজদরবারে গুণগান ও প্রশংসাগীতিতে নিমগ্ন থাকেন ফেরেশতারা। তাঁরা আল্লাহর রাজদরবারের সৌন্দর্য। আল্লাহর রাজসিংহাসন বহন করেন সম্মানিত ফেরেশতারা। ইরশাদ হয়েছে, ‘(কিয়ামতের দিন) ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে। সেদিন আটজন ফেরেশতা তোমার রবের আরশকে ধারণ করবে তাদের ঊর্ধ্বে।’ (সুরা : হাক্কাহ, আয়াত : ১৭)
ফেরেশতা সৃষ্টির আরো একটি হেকমত হলো, তাঁরা মানবজাতির সামনে অনুকরণীয় আদর্শ। মানুষের বোঝার সুবিধার্থে মহান আল্লাহ জোড়ায় জোড়ায় সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। যেমন—রাত-দিন, ওপর-নিচ, ডান-বাম, ভালো-মন্দ, আলো-আঁধার, মিঠা-তিতা, গরম-ঠাণ্ডা, সূর্য-চন্দ্র, আসমান-জমিন ও জীবন-মৃত্যু।
মানুষের বিপরীতে মহান আল্লাহ ফেরেশতা ও শয়তান সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতারা পাপাচার করতেই জানেন না। সব সময় তাঁরা পুণ্যময় কাজে নিমগ্ন থাকেন। আর শয়তান সর্বদা শয়তানি ও পাপাচারে লিপ্ত থাকে। শয়তানের জাতিসত্তায় আছে অপরাধপ্রবণতা। এর বিপরীতে মানুষকে স্বাধীন সত্তায় সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ পাপও করতে জানে, পুণ্যও করতে পারে। ফেরেশতা ও শয়তান—এই দুই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে বিশেষ হেকমতে, যাতে মানুষ সতর্ক হতে পারে।
গ্রন্থনা : মাওলানা কাসেম শরীফ