সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর হুকুম পালন করা, তাঁর শরীয়ত পালন করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা মানব জাতির উপর যেমন ফরজ করে দেয়া হয়েছে, তেমনি প্রাণীকুলকেও রসুলেপাক (ﷺ) এর ফরমাবরদার বানিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষের মধ্যে ইমানদারগণই সৌভাগ্যের রাজটিকা লাভ করেছে এবং তা হয়েছে নবী করীম (ﷺ) এর আনুগত্যের মাধ্যমেই। আল্লাহ্তায়ালা এজাজ এবং অস্বাভাবিকতার ভিত্তিতে প্রাণীকুলকেও তাঁর হাবীব (ﷺ) এর অনুগত করে দিয়েছেন। মুহাক্কেক এবং আহলে বাতেল সকলেই বলে থাকেন, নবী করীম (ﷺ) এর নবুওয়াত ও রেসালত সমস্ত প্রাণীকুল, উদ্ভিদরাজি, জড়পদার্থ তথা সমস্ত মাখলুকাতের প্রতিই সম্বন্ধিত। কিন্তু প্রাণীকুল যেহেতু জ্ঞানের সীমানা এবং আদেশ নিষেধের দায়বদ্ধতার বাইরে, তাই তাদের থেকে নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি ইমান, বিশ্বাস ও আনুগত্য ব্যতীত রেসালতের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদানের আর কোনো নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না। অবাধ্য ও গোনাহ্গার হিসেবেও তাদেরকে চিহ্নিত করা যায় না।
একটি উটের ঘটনা এই মর্মে উল্লেখ করা যেতে পারে। উটটি নবী করীম (ﷺ) এর কাছে এসে মাথা নত করে সেজদা করেছিলো এবং তাঁর নিকট অভিযোগ পেশ করেছিলো।
হাদীছখানা হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে। আনসার গোত্রের প্রত্যেকেই উট পালন করতো। এক বাড়িওয়ালা নবী করীম (ﷺ) এর কাছে নিবেদন করলেন, আমার একটি উট রয়েছে যার পিঠে করে আমি পানি এনে থাকি। উটটি বড় বেয়াড়া হয়ে গিয়েছে। বোঝা বহন করতে চায় না। আর এদিকে আমার খেজুর বাগান পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে।
এ কথা শুনে নবী করীম (ﷺ) সাহাবা কেরামকে সঙ্গে নিয়ে উটটির কাছে গেলেন। তিনি বাগানে পৌঁছলেন এবং একস্থানে দাঁড়িয়ে গেলেন। বাগানের এক কোণে বসা ছিলো উটটি। আনসারী লোকটি বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ্! এটাই আমার উট, যে কুকুরের মতো মানুষকে কামড়াতে চায়। আমার ভয় হচ্ছে, না জানি আপনাকেও সে কামড়ে দেয়। তিনি বললেন, আমার ব্যাপারে ভয় কোরো না। রসুলেপাক (ﷺ) উটের সামনে গেলেন। উটটি তাঁকে দেখামাত্র মাথা ওঠালো এবং তাঁর সামনে গিয়ে কদম মোবারকের কাছে মাথা নত করে সেজদা করলো।
রসুলেপাক (ﷺ) উটটির মাথার পশম ধরে টান দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিলেন। সাহাবা কেরাম নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! এটি একটি জানোয়ার, তার কোনো জ্ঞানবুদ্ধি নেই। এই প্রাণীটি আপনাকে সেজদা করেছে। তবেতো আমরাও আপনাকে সেজদা করতে পারি।
রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করলেন, কোনো মানুষের জন্য এটা উচিত নয় যে, সে অন্য একজন মানুষকে সেজদা করবে। মানুষের জন্য মানুষকে সেজদা করা বৈধ হলে আমি নারী জাতিকে তাদের স্বামীগণকে সেজদা করতে বলতাম। এই হাদীছখানা ইমাম আহমদ এবং নাসায়ী বর্ণনা করেছেন।
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, তখন রসুলেপাক (ﷺ) বলেছিলেন, আসমান ও যমীনের মধ্যে নাফরমান জ্বীন ও মানুষ ব্যতীত অন্য কারো এটা অজানা নয় যে, আমি আল্লাহ্র রসুল। অন্য এক হাদীছে এসেছে, লোকেরা উটটিকে জবেহ্ করতে চেয়েছিলো, তখন উটটি রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে নালিশ করেছিলো। এক হাদীছে এসেছে, উটটি রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে হাজির হয়ে তার গর্দান রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে নত করে তার নিজের ভাষায় ফরিয়াদকরেছিলো। তা দেখে রসুলেপাক (ﷺ) তার মাথার চুল ধরে টেনে খাড়া করলেন এবং তার মালিককে বললেন, উটটি আমার কাছে বিক্রি করে দাও। লোকটি বললো, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি আপনার খেদমতে হাজির। তবে উটটি যে আমার পরিবারের প্রয়োজন মেটায়। জীবিকার জন্য এ উটটি ছাড়া আমার আর কিছু নেই।
রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, উটটি অভিযোগ করছে, তুমি তাকে দিয়ে বেশী কাজ করাও, আর খেতে দাও কম। তুমি তার অধিকারের দিকে খেয়াল রেখো। এই হাদীছটি বিভিন্ন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সবগুলো বর্ণনাই সহীহ্।
হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) হজরত আবু বকর (رضي الله عنه) ও হজরত ওমর (رضي الله عنه)কে সঙ্গে নিয়ে জনৈক আনসারীর বাগানে গেলেন। সেখানে একটি বকরী ছিলো। বকরীটি রসুলেপাক (ﷺ) কে সেজদা করলো। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরাই তো আপনাকে সেজদা করার অধিকার রাখি বেশী। তিনি (ﷺ) বললেন, এক মানুষের জন্য আরেক মানুষকে সেজদা করা বৈধ নয়।
একবার একটি উট নবী করীম (ﷺ) এর নিকটে এসে তার কাওমের লোকদের সম্পর্কে অভিযোগ করে বললো, তারা এশার নামাজ আদায় না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ভয় হচ্ছে, না জানি আল্লাহ্তায়ালা তাদের উপর আযাব নাযিল করে দেন।
রসুলেপাক (ﷺ) তাদেরকে ডেকে এনে বলে দিলেন, তারা যেনো এশার নামাজ আদায়ের পূর্বে শয্যা গ্রহণ না করে। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বলেন, আমাদের ঘরে একটি বকরী ছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) আরাম করার জন্য যখন আমার ঘরে তশরীফ আনতেন, তখন বকরীটি নিশ্চিন্তে আরামের সাথে চুপচাপ পড়ে থাকতো। আর তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলে পেরেশান হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি শুরু করে দিতো।
এক বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ﷺ) যখন উট কোরবানী করতে উদ্যত হতেন, তখন উটগুলো একে অপরকে সরিয়ে দিয়ে রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে দাঁড়িয়ে যেতো। একটি বকরীর দুধ শুকিয়ে গিয়েছিলো। তিনি (ﷺ) সেই বকরীর স্তনে হাত লাগানো মাত্রই তার স্তন দুধে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো। তিনি বকরীটির দুধ দোহন করে নিজেও পান করেছিলেন এবং হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه)কেও পান করিয়েছিলেন। উম্মে মা’বাদের এই বকরীর বিখ্যাত ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ হিজরতের বর্ণনায় আসবে ইনশাআল্লাহ্।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]