উত্তরঃ আমাদের মতে ‘মীলাদ-ই পাক’ অর্থাৎ লোকজন সমবেত হওয়া, যথাসম্ভব ক্বোরআন মজীদের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা, নবী করীম [ﷺ] প্রাথমিক অবস্থাদি, তাঁর পবিত্র জন্মকালীন সময়ের অলৌকিক ঘটনাবলী সম্পর্কিত হাদীসসমূহ এবং শুভজন্মের সময় যেসব নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিলো ওইগুলো বর্ণনা করা অতঃপর লোকজনকে খানা খাওয়ানো, এর উপর অন্য কিছু বর্দ্ধিত না করে মাহফিল ত্যাগ করা, প্রকৃতপক্ষে ‘বিদ্‘আত-ই হাসানাহ্’ (প্রশংসনীয় নব আবিস্কার)। এমন আয়োজনের জন্য সাওয়াব পাওয়া যাবে। কেননা, এ’তে নবী করীম [ﷺ]-এর মহা মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখানো এবং তাঁর বরকতময় জন্মে খুশী প্রকাশ রয়েছে।
সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মীলাদ-ই পাক উদ্যাপনের প্রচলন করেন ইরবিলের বাদশাহ্ মুফাফ্ফর আবূ সা‘ঈদ কোকব্রী ইবনে যায়নুদ্দীন আলী ইবনে বকতগীন, যিনি মহত্বপূর্ণ বাদশাহ্গণ ও দানশীলদের মধ্যে পরিগণিত ছিলেন। তিনি অনেক ভাল কাজ করেছেন। ক্বাসিয়ূনের টিলার উপর অবস্থিত জামে মসজিদটিও তিনি নির্মাণ করেছেন। ইবনে কাসীর তাঁর ইতিহাস (তারীখ)-এ বর্ণনা করেছেন, তিনি (সুলতান) ‘মীলাদুন্নবী [ﷺ]’র মাহফিল করতেন আর এতদুপলক্ষে বিশাল আয়োজন করতেন। তিনি অত্যন্ত নির্ভিক সাহসী, বীরপুরুষ, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্ ছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে দয়া করুন এবং উত্তম ঠিকানা দান করুন!
ইবনে কাসীর আরো লিখেছেন, শায়খ আবুল খাত্তাব ইবনে দাহিয়্যাহ্ তাঁর জন্য মীলাদুন্নবী [ﷺ] বিষয়ের উপর এক বিরাটাকার কিতাব ‘আত্তানভীর ফী মাওলেদিল বশীরিন নাযীর’ রচনা করেন, যার জন্য তিনি তাঁকে এক হাজার দীনার (স্বর্ণমূদ্রা) পুরস্কার দিয়েছিলেন। এ সচ্চরিত্রবান ও উন্নত মনের অধিকারী বাদশাহ্ দীর্ঘদিন যাবৎ রাজ্য পরিচালনা করেন। ৬৩০ হিজরীতে তাঁর ইনতিক্বাল হয়। তখন তিনি ‘আক্কাহ্ (عكه) শহরে ফিরিঙ্গী (ইংরেজ) শত্র“দের অবরুদ্ধ করেছিলেন। সিবত্বে ইবনে জাওযী (আল্লামা ইবনে জাওযীর দৌহিত্র) ‘মিরআতুয্ যামান’-এ লিখেছেন, মীলাদে পাকের এমন এক মাহফিলে সুলতান মুযাফ্ফরের দস্তরখানায় উপস্থিতদের মধ্যে এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, তিনি দস্তরখানার উপর পাঁচ হাজার ছাগলের ভূনাকৃত মাথা, দশ হাজার মোরগ, একলক্ষ মাটির পেয়ালা এবং ত্রিশ হাজার মিষ্টির প্লেট গণনা করেছেন।
তিনি আরো লিখেছেন যে, শীর্ষস্থানীয় আলিমগণ ও সম্মানিত সূফীগণ মীলাদে পাকের মাহফিলে বাদশাহ্র দরবারে তাশরীফ নিয়ে যেতেন, বাদশাহ্ তাঁদের খিদমতে উন্নত মানের বিশেষ পোষাক পেশ করতেন। গোলাম আযাদ করতেন, সূফীদের জন্য যোহর থেকে পরদিন ফজর পর্যন্ত না’ত-গযলের মাহফিলের আয়োজন করতেন, আর গযলের মুর্চ্ছনায় আত্মহারা হয়ে তিনি নিজেও বিভোর হয়ে যেতেন। তিনি প্রত্যেক বছর মীলাদুন্নবী [ﷺ]-এর মাহফিলের জন্য তিনলক্ষ দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) ব্যয় করতেন। তিনি একটি মেহমানখানা নির্মাণ করান। সেটা বংশ ও বর্ণ নির্বিশেষে যে কোন রাজ্য থেকে আগতদের জন্য উন্মুক্ত থাকতো। এ মেহমানখানার জন্য বাদশাহ্ প্রতি বছর একলক্ষ দীনার ব্যয় করতেন। প্রতিবছর দুই লক্ষ দীনারের বিনিময়ে ফিরিঙ্গী (ইংরেজ)দের জেলখানা থেকে মুসলমান বন্দিদের মুক্ত করাতেন। প্রত্যেক বছর হারামাঈন শরীফাঈন ও হেযাযের পথে পানির ব্যবস্থা করতেন। এজন্য ত্রিশ হাজার দীনার ব্যয় করতেন। এ বিরাট অংক ছাড়াও তিনি গোপনে প্রচূর দান-খয়রাত করতেন। বাদশাহ্ মুযাফফর উদ্দীনের স্ত্রী রবী‘আহ্ খাতুন বিনতে আইয়ূব, যিনি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী [رحمه الله عليه]’র সহোদরা ছিলেন, বর্ণনা করেন, বাদশাহ্র কামীজের মূল্য ৫ (পাঁচ) দিরহামেরও কম ছিলো, শক্ত খদ্দর কাপড়ের তৈরী ছিলো। যখন আমি তাঁকে এজন্য বকাবকি করতাম, তখন তিনি বলতেন, ‘‘আমার জন্য পাঁচ দিরহাম মূল্যের কাপড় পরা এবং অবশিষ্ট অর্থ সাদক্বাহ্ করে দেওয়া ফক্বীর-মিসকীনদেরকে কিছু না দিয়ে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া ও মূল্যবান কাপড় পরিধান করা অপেক্ষা উত্তম।’’ ইবনে খাল্লিকান হাফেয আবুল খাত্তাব ইবনে দাহিয়্যাহ্ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, তিনি শীর্ষস্থানীয় আলিম ও প্রসিদ্ধ গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মরক্কো থেকে এসেছিলেন। তিনি ৬০৪ হিজরী সালে ইরবিলে আগমন করেন। তিনি সেখানকার সম্মানিত বাদশাহ্ মুযাফ্ফর উদ্দীন ইবনে যায়নুদ্দীনকে অতি জাঁকজমক সহকারে ঈদে মীলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপন করতে দেখতে পান। সুতরাং তিনি বাদশাহর জন্য ‘আত্তানভীর ফী-মাওলিদিল্ বশীরিন নাযীর’ লিখেন। তিনি নিজেই কিতাবটা পড়ে বাদশাহ্কে শুনিয়েছেন। এজন্য বাদশাহ্ তাঁকে এক হাজার দীনার পুরস্কার দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘‘আমি ৬২৫ হিজরীতে সুলতানকে কিতাবটা ছয়টি মজলিসে পড়ে শুনিয়েছি।’’
কিন্তু মালেকী মাযহাবের পরবর্তী যুগের আলিমদের মধ্যে শায়খ তাজ উদ্দীন ওমর ইবনে আলী লাখমী সিকান্দরী, ওরফে ‘ফা-কিহানী’ দাবী করেছেন যে, ‘মীলাদ-ই পাক উদ্যাপন করা ‘মন্দ বিদ্‘আত’। (না‘ঊযুবিল্লাহ্) এ বিষয়ে তিনি ‘আল-মাওরিদ ফিল কালামি ‘আলা- ‘আমালিল মাওলেদ’ নামের একটি পুস্তিকাও লিখেছেন। উক্ত পুস্তিকা আমি এখানে পূর্ণাঙ্গরূপে উদ্ধৃত করবো, তারপর অক্ষরে অক্ষরে সেটার উপর আলোচনা করবো। সুতরাং উক্ত লেখক ফাকিহানী লিখেছেন-
‘‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে সাইয়্যেদুল মুরসালীন [ﷺ]-এর অনুসরণের দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। আর দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির দিকে হিদায়ত করে আমাদের সাহায্য করেছেন। আর আমাদের জন্য ‘সলফে সালেহীন’ (পূর্ববর্তী বুযুর্গগণ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণকে সহজ করে দিয়েছেন। এমনকি আমাদের হৃদয় ইলম-ই শরীয়ত ও সত্যের পাকাপোক্ত দলীলাদির আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। আর দ্বীনে বিদ্‘আত ও অনর্থক কার্যাদির আবিস্কার করা থেকে আমাদের অন্তরকে পবিত্র করেছেন। আমি আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি হামদ ও শোক্র জ্ঞাপন করছি এজন্য যে, তিনি ইয়াক্বীন বা নিশ্চিত বিশ্বাসের আলো দান করে মজবুত দ্বীনের রশিকে আঁকড়ে ধরার তাওফীক্ব দিয়ে ইহসান ও দয়া করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন সমকক্ষ ও শরীক নেই। এমর্মেও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ [ﷺ] তাঁর খাস বান্দা, রসূল এবং পূর্ব ও পরবর্তী সকল সৃষ্টির সরদার। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর উপর, তাঁর পবিত্র বংশধরের উপর, তাঁর সাহাবীগণের উপর এবং তাঁর পবিত্র বিবিগণ, মু’মিনদের মাতাগণের উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবারিতভাবে নূররাশি বর্ষণ করুন!
আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে- এক বরকতময় দলের পক্ষ থেকে বারংবার ওই জমায়েত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, যা রবিউল আউয়াল মাসে তাঁরা করে থাকেন। আর সেটাকে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ বলা হয়। সেটার পক্ষে শরীয়তে কি কোন দলীল আছে, নাকি এ কাজটা দ্বীনের মধ্যে বিদ্‘আত বা নতুন সৃষ্টি ও নব আবিস্কৃত? তাঁরা এর জবাব বিস্তারিত ও সুস্পষ্টভাবে চেয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলার সামর্থ্যদান ও সাহায্য প্রদানের উপর নির্ভর করে বলছি, ‘‘আমার জ্ঞানে উপরোক্ত মীলাদ উদ্যাপনের পক্ষে কিতাব ও সুন্নাহ্য় কোন দলীল নেই, না এটা উম্মতের খোদাভীরু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও দ্বীনদার (ধর্মপরায়ণ) আলিমদের মধ্যে কারো থেকে উদ্ধৃত; বরং এটা এক এমন বিদ্‘আত, যাকে অকর্মণ্য ও আমলহীন লোকেরা এবং মনের কুপ্রবৃত্তিগুলোর অনুসারীরাই চালু করেছে। পেট পুজারী লোকেরাই এ কাজটি গুরুত্ব ও অনিবার্যভাবে সম্পন্ন করে থাকে। এর প্রমাণ এ যে, যখন আমরা মীলাদের উপর পাঁচটি বিষয়ে বিবেচনা করেছি, এভাবে যে, এটা হয়তো ওয়াজিব হবে, অথবা মুস্তাহাব হবে, অথবা মুবাহ্ হবে কিংবা মাকরূহ্ হবে অথবা হারাম হবে, তখন বুঝা গেলো যে, সেটা ওয়াজিব না হওয়া ইজমা’ মতে প্রমাণিত হয়েছে, আর ‘মানদূব’ বা মুস্তাহাবও হতে পারে না। কেননা, ‘মানদূব’ (মুস্তাহাব) ওই কাজকেই বলা হয়, যা শরীয়তে তলব করা হয়; কিন্তু সেটা বর্জন করলে তিরস্কার কিংবা শাস্তি বর্তায় না। অথচ এ কাজের না শরীয়ত অনুমতি দিয়েছে, না আমার জানা মতে, এটা সাহাবা-ই কেরাম ও দ্বীনদার তাবে‘ঈদের আমল ছিলো। আল্লাহ্ তা‘আলার সামনে এ কাজ সম্পর্কে আমার জবাব এটাই, যদি এ সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘এ কাজ মুবাহ্ হতে পারে না। কেননা, মু’মিনদের এমর্মে ইজমা’ হয়েছে যে, দ্বীনে বিদ্‘আত চালু করা জায়েয (বৈধ) নয়।’ এখন শুধু মাকরূহ ও হারাম- দু’টি বিধান অবশিষ্ট থাকে। এটা বিবেচনায় রেখে এ সম্পর্কে দু’টি পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হবে আর উভয় অবস্থায় মতবিরোধের কথা আসবে।
প্রথমাবস্থা এ যে, কেউ যদি নিজের, নিজের পরিবার-পরিজনের ও সাথী-বন্ধুদের অর্থ ব্যয় করে ‘মীলাদ মাহফিল’-এর আয়োজন করে এবং তাতে পানাহার ব্যতীত অন্য কিছুর ব্যবস্থা না করে, কোন গুনাহ্র কাজও সম্পন্ন না করে, তবুও এটা হবে ‘বিদ্‘আত-ই সাইয়্যেআহ্’ (মন্দ বিদ‘আত), যেমনটি আমি ইতোপূর্বে বলেছি। কেননা, পূর্ববর্তী ইসলামী ফক্বীহ্গণ ও সম্মানিত আলিমদের থেকে এ আমল প্রমাণিত নয়।
দ্বিতীয় অবস্থা এ যে, তাতে যদি গুনাহর কাজ সম্পন্ন করার সাথে সাথে এমন অস্বাভাবিক কাজ গুরুত্ব ও নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন করে যে, চাঁদাদাতারা চাঁদা তো দেয়, কিন্তু তার অন্তর তজ্জন্য প্রস্তুত থাকে না, সে তার সম্পদ হানির জন্য দুঃখবোধ করে। বিজ্ঞ আলিমগণ বলেন যে, কোন ভয় দেখিয়ে ও চাপ সৃষ্টি করে অর্থ উসূল করা তরবারি-উঁচিয়ে অর্থ সংগ্রহের মতোই। বিশেষ করে যখন তাতে উদরভর্তি করা ছাড়াও দফ এবং ধুমধাম সহকারে গানবাদ্য করা হয়, দাড়ি বিহীন (আমরাদ) বালকগণ ও সুন্দরী নারীদের মেলামেশা করা হয়, হেলে দুলে পরস্পর জড়িয়ে ধরে নৃত্য করা হয়, ক্বিয়ামতের ভয়কে ভুলে গিয়ে খেলা-তামাশায় মগ্ন হওয়াও সন্নিবিষ্ট হয়, অনুরূপ, যদি শুধু নারীদের জমায়েত হয়, তাহলে এ আয়োজন হারাম হবে। যখন তারা اِنَّ رَبَّكَ لَبِا الْمِرْصَادِ (নিশ্চয় তোমার রব প্রতিটি কাজ প্রত্যক্ষ করছেন, যাতে তোমাকে সেটার ভাল কিংবা মন্দ পরিণতি দেন) কে ভুলে গিয়ে খুশী ও আনন্দে গানবাদ্য করবে এবং যিক্র ও তিলাওয়াতে নিজ নিজ কণ্ঠস্বরকে উঁচু করবে, তখন তো এটা হারাম হওয়ায় কোন দ্বিমত নেই। কোন ধর্মীয় আহমিকা (মর্যাদাবোধ) সম্পন্ন ব্যক্তি এটা পছন্দ করতে পারে না। অবশ্য যার অন্তর পাপ কার্যাদির স্পর্শের কারণে মৃত হয়ে গেছে, সে তো ওই কাজকে হারাম তো দূরের কথা, ইবাদত বলে মনে করবে। اِنَّا لِلّهِ وَاِنَّا اِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ (অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী), بَدَأَ الْاِسْلاَمُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَمَا بَدَأُ (অর্থাৎ ইসলাম শুরুতে অপরিচিত ছিলো, আর সহসা সেটা আবারও অপরিচিত হয়ে যাবে)। এ প্রসঙ্গে আমাদের শায়খ ক্বুশায়রী অতি উত্তম কবিতা বলেছেন, যা তাঁর পক্ষ থেকে আমাদেরকে প্রদত্ত অনুমতিরই সামিল। তিনি বলেন- ‘‘আমাদের এ দুঃখে ভরা যুগে মন্দকে সবাই জানে, উত্তমকে কেউ জানে না। জ্ঞান সম্পন্নরা নিচে পতিত হয়েছে, অজ্ঞরা তাঁদের পদে আসীন হয়ে গেছে। তারা সত্য থেকে দূরে সিটকে পড়েছে। ফলে তাদের ও পূর্ববর্তী যুগের বুযুর্গদের মধ্যে কোন সম্পর্ক রইলো না। আমি খোদাভীরুদের বলেছি, ‘‘তোমরা এত কষ্ট কেন সহ্য করছো? তোমরা তোমাদের অবস্থাদির পরিবর্তন করছো না। কেননা, তোমরা এ যুগে লোকজনের জন্য নিজেরাই অপরিচিত হয়ে গেছো।’’
ইমাম আবূ আমর ইবনে ‘আলা-ও অতি উত্তম কথাটাই বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘লোকেরা যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন জিনিষগুলোকে অস্বীকার করতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের উপর থাকবে।” তাছাড়া, একথাও গভীরভাবে চিন্তা করারই যে, রবিউল আউয়াল মাস, যাতে সরকার-ই দু’আলম [ﷺ]-এর জন্ম হয়েছে, ওই সাথে তাঁর ওফাত শরীফও হয়েছে, তখন খুশী উদ্যাপন করা শোক প্রকাশ অপেক্ষা উত্তম হলো কিভাবে? আমাদের উপর যা ফরয ছিলো, আমরা তা পালন করেছি। আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে কবূল হবার আশা রাখি।’’
এ পর্যন্ত ফাকেহানীর পূর্ণ বক্তব্য, যা তিনি তাঁর উপরিউক্ত পুস্তকে বর্ণনা করেছেন। সর্বপ্রথম আমি ফাকহানীর বক্তব্য (আমার জানা মতে, এ মীলাদুন্নবী মাহফিলের পক্ষে কিতাব ও সুন্নাহতে কোন প্রমাণ নেই,)কে নিচ্ছি। তার খণ্ডনে বলা যায় যে, ‘না জানা না থাকার প্রমাণ নয়।’ তাছাড়া, হাফেয আবুল ফদ্বল ইবনে হাজর নবী করীম [ﷺ]-এর সুন্নাত থেকে এর একটি প্রমাণ বের করেছেন। আমিও অন্য একটি প্রমাণ বের করেছি, যা আমি একটু পরে উল্লেখ করবো।
বাকী রইলো- তার (ফাকেহানী) অপর বক্তব্য। তাহচ্ছে- ‘এটা এমন এক বিদ্‘আত, যাকে অকর্মন্য, আমলশূন্য লোকেরা এবং মনের কুপ্রবৃত্তিগুলোরও অনুসারীরাই জারী করেছে।’ একথার খণ্ডন এ’যে, পূর্বোল্লিখিত বর্ণনা থেকে একথা প্রকাশ পেয়েছে যে, ‘মীলাদুন্নবী’ [ﷺ] জাঁকজমক সহকারে উদ্যাপন করার প্রচলন দিয়েছেন একজন ন্যায়পরায়ণ জ্ঞানী বাদশাহ্, যিনি মীলাদে পাককে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানসে উদ্যাপন করেছেন। আর আলিমগণ ও নেক্কার বুযুর্গগণ নির্দ্বিধায় তাতে শরীক হতেন। বিশেষ করে ইবনে দাহিয়্যাহ্ তা এতো বেশী পছন্দ করেছেন যে, তিনি এ বিষয়ের উপর তাঁর জন্য একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব সম্মানিত বিজ্ঞ আলিম, (যাঁরা তাতে শরীক হতেন) তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন। সেটাকে জায়েয (বৈধ) বলে জানতেন। তা অস্বীকার বা অপছন্দ করতেন না।
তার (ফাকেহানী) একথা বলা যে, ‘এ কাজ মুস্তাহাব (মানদূব)ও হতে পারে না, কেননা, ‘মানদূব’ বলে ওই কাজকে, যা শরীয়ত করতে বলেছে।’ এর খণ্ডন এ হতে পারে যে, মুস্তাহাব কাজে ‘চাওয়া’ কখনো ‘নাস’ (ক্বোরআন ও হাদীস) দ্বারা হয়, কখনো ‘ক্বিয়াস’ (অনুমান)-এর মাধ্যমে হয়; যদিও সেটার পরম্পরায় কোন ‘নাস’ এরশাদ হয়নি তবুও এ সম্পর্কে এমন এক ‘ক্বিয়াস’ রয়েছে, যার ভিত্তি পূর্বে উল্লিখিত দু’টি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
তার (ফাকেহানী) একথা বলা যে, ‘সেটা ‘মুবাহ্’ও হতে পারে না, কেননা দ্বীনের মধ্যে বিদ্‘আত মুবাহ্ হয় না।’ তার খণ্ডণ এযে, তার একথা আমরা মানিই না। কেননা, বিদ্‘আত শুধু ‘হারাম’ ও ‘মাকরূহ’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সেটা কখনো মুবাহ্ হয়, কখনো মানদূব, কখনো মুস্তাহাব, এমনকি কখনো ওয়াজিবও হয়। আল্লামা নাওয়াভী তাঁর ‘তাহযীবুল আসমা ওয়াল্ লুগাত’ -এর মধ্যে লিখেছেন- শরীয়তে বিদ্‘আত ওই নবসৃষ্ট ও নব আবিস্কৃত বস্তু বা কাজকে বলা হয়, যা নবী করীম [ﷺ]-এর বরকতময় যুগে ছিলো না। ওইগুলো দু’প্রকার- এক. ‘বিদ্‘আত-ই হাসানাহ্’ ও দুই. ‘বিদ্‘আত-ই ক্ববীহাহ্’ (যথাক্রমে, উত্তম বিদ্‘আত ও মন্দ বিদ্‘আত)। শায়খ ইয্যুদ্দীন ইবনে আবদুস্ সালাম ‘আল-ক্বাওয়া-‘ইদ’ -এ বর্ণনা করেছেন, বিদ্‘আত পাঁচ প্রকার:
১. ওয়াজিব,
২. হারাম,
৩. মুস্তাহাব,
৪. মাকরূহ ও
৫. মুবাহ্।
তিনি আরো বলেন, এগুলো সম্পর্কে জানার উপায় হচ্ছে- আপনি বিদ্‘আতকে শরীয়তের মূলনীতিগুলোর নীরিখে বিচার করুন, যদি সেটা ‘ওয়াজিব হবার নিয়মাবলীর অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে সেটা ‘ওয়াজিব’। হারামের মূলনীতির আওতাভুক্ত হলে ‘হারাম’, মুস্তাহাবের মূলনীতির আয়ত্বে এলে মুস্তাহাব, ‘মাকরূহ’-এর আওতাভুক্ত হলে মাকরূহ্, অন্যথায় ‘মুবাহ্’। তারপর তিনি এ পাঁচ(০৫) প্রকার বিদ্‘আতের উদাহরণ দিয়েছেন। তখন তিনি ‘মুস্তাহাব বিদ‘আত’-এর পরম্পরায় লিখেছেন, এর কয়েকটা উদাহরণ রয়েছেঃ সরাইখানা নির্মাণ করা, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা এবং এমন প্রতিটি কাজ করা, যা নবী করীম [ﷺ]-এর যামানায় ছিলোনা; যেমন- তারাভীহ’র নামাযের জন্য গুরুত্ব সহকারে ব্যবস্থা করা, তাসাওফ ও জদলের সুক্ষ্ম বিষয়াদিতে গভীরভাবে মনযোগ দেওয়া, মাসা-ইল বা সমাধান বের করার মাহফিলসমূহের আয়োজন করাও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত, যদি তাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই হয়ে থাকে।
ইমাম বায়হাক্বী ‘মানাক্বিবে শাফে‘ঈ’তে নিজের সনদ সহকারে ইমাম শাফে‘ঈ [رضي الله عنه] হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নব আবিস্কৃত বিষয়াদি দু’প্রকারঃ এক. যা কিতাব, সুন্নাহ্, আ-সার ও ইজমা’র পরিপন্থী হয়। এ প্রকারের বিষয়াদি ‘বিদ্‘আত-ই দ্বালালাহ্’ (গোমরাহীপূর্ণ বিদ্‘আত) এবং
দুই. যার ভিত্তি কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যা উপরিউক্ত প্রমাণগুলোর মধ্যে কোনটার পরিপন্থী না হয়। এ বিদ্‘আত মন্দ নয়।
যেমন হযরত ওমর [رضي الله عنه] রমযান মাসে তারাভীহ্ সম্পর্কে বলেছেন- نِعْمَتِ الْبِدْعَةُ هذِهِ (এটা কতোই উত্তম বিদ্‘আত) অর্থাৎ এমন এক নতুন উত্তম জিনিষ, যা ইতোপূর্বে ছিলো না। আর যদি এমনটি করেও ফেলা হয়, তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই; এতদ্ভিত্তিতে যার বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম শাফে‘ঈর বক্তব্য এ পর্যন্ত।
এ বর্ণনা থেকে শায়খ তাজ উদ্দীন ফাকেহানীর বক্তব্য ‘এটা (মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান) মুবাহ্ ও জায়েয (বৈধ) হতে পারে না, বরং এটাই হচ্ছে ওই কাজ, যাকে আমরা ‘বিদ্‘আত-ই মাক্রূহাহ্’ বলি’-এর খণ্ডন বলে জানা গেলো।
কেননা, এটা হচ্ছে ওই প্রকার, যাতে কিতাব, সুন্নাহ্, আ-সার অথবা ইজমা’-ই উম্মত- কোনটার বিরোধিতা নেই। সুতরাং এটা ‘বিদ্‘আত-ই মাযমূমাহ্’ (মন্দ বিদ্‘আত) হতে পারে না। যেমন ইমাম শাফে‘ঈ আলায়হির রাহমাতু ওয়ার রিদ্বওয়ান-এর বচনে আছে। এটা ব্যাস্ এমন এক নেক্ কাজ, যা নবী করীমের যুগে ছিলো না। এজন্য পাপ কার্যাদি সম্পন্ন না করে খানা খাওয়ানো, সভা-মাহফিল করা প্রশংসিত ও উত্তম কাজ। ইবনে আবদুস্ সালাম-এর ইবরাত (বক্তব্য) থেকেও একথা প্রকাশ পায় ও প্রমাণিত হয়।
বাকী রইলো ফাকেহানীর বক্তব্য- ‘দ্বিতীয় হচ্ছে-…’। তাহলে এটা নিঃসন্দেহে সঠিক কথা। তবে তা হারাম হওয়া ওইসব হারাম কাজের কারণেই, যেগুলো তাতে ঢুকে পড়ে; মীলাদ শরীফের আয়োজনাদি, খুশী প্রকাশ, সভা-মাহফিল ও জলসা-জুলূস করার কারণে নয়; বরং এ সব (মন্দ) বিষয়াদি যদি জুমার জমায়েতেও পাওয়া যায়, তবুও এ কাজগুলোই মন্দ ও বর্জনীয় হবে; কিন্তু ওইগুলোর কারণে মূল জুমার নামাযের জমায়েতকে মন্দ বলা যেতে পারে না। একথা একেবারে স্পষ্ট। অনুরূপ, আমরা দেখতে পাই, রমযানের রাতগুলোতে যখন লোকেরা তারাবীহ্ নামাযের জন্য সমবেত হয়, তখন ওইসব মন্দ কাজ থেকে কিছু কিছু কাজও সম্পন্ন হয়ে যায়। তাহলে কি এসব মন্দ কাজের কারণে তারাবীহ্ নামাযকেও মন্দ মনে করা হবে? মোটেই না; বরং তার জবাবে বলা হবে- তারাবীহ্ নামায মূলত: সুন্নাত ও মুস্তাহ্সান; কিন্তু ওইসব মন্দ কাজ সমালোচিত ও বর্জনীয়। এমনই অবস্থা মীলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপনেরও। তা উদ্যাপন করা মুস্তাহ্সান ও মুস্তাহাব; কিন্তু অনর্থক কার্যাদি তাতে ঢুকে গেলে ওই অনর্থক কাজগুলোই নিঃসন্দেহে সমালোচিত, বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ হবে।
উক্ত লেখক (ফাকেহানী)-এর সর্বশেষ দলীল এ মর্মে যে, ‘এতদ্সত্ত্বেও যে, যে মাসে নবী করীম [ﷺ]-এর বেলাদত শরীফ হয়েছে, ওই মাসে ওফাত শরীফও হয়েছে।…’ (সুতরাং শোক পালন না করে, শুধু মীলাদ শরীফ কেন?) এর খণ্ডনে বলা হবে- রহমতের নবী [ﷺ]-এর বরকতময় বেলাদত (শুভজন্ম) আমাদের জন্য সর্বাপেক্ষা বড় নি’মাত। তাঁর ওফাত শরীফ আমাদের জন্য সর্বাপেক্ষা বড় কষ্টদায়ক। কিন্তু শরীয়ত তো নি’মাতের শোকরিয়া জ্ঞাপন ও হামদ-সানা করতে এবং মুসীবতে ধৈর্যধারণ, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা ও শোক-দুঃখ গোপন করার শিক্ষা দিয়েছে। যেমন, শিশুর জন্মের সময় আক্বীক্বা করার নির্দেশ দিয়েছে। এটা কোন শিশুর জন্মে খুশী ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই নামান্তর। কিন্তু কারো মৃত্যুর সময় শোক প্রকাশের মাহফিল আয়োজন করা ও এ জন্য খানা খাওয়ানো ইত্যাদির নির্দেশ দেয়নি; বরং আহাজারি ও বিলাপ রোদন করতে নিষেধ করেছে। এ থেকে বুঝা গেলো যে, এ মাসে সরকার-ই দু‘আলম [ﷺ]-এর সৌভাগ্যসমৃদ্ধ জন্মে খুশী প্রকাশ করা মুস্তাহ্সান ও প্রশংসনীয়; তাঁর ওফাত শরীফের জন্য শোক প্রকাশের আয়োজন করা নয়। তিনি ইবনে রজব ‘কিতাবুল্ লাত্বা-ইফ’-এ রাফেযীদের সমালোচনা করেছেন। কেননা, তারা ইমাম-ই আলী-মাক্বাম [رضي الله عنه]’র শাহাদতের কারণে ‘আশূরা দিবস’-এ মাতম করতে আরম্ভ করেছে। তিনি আরো বলেন, মহামহিম আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল [ﷺ] সম্মানিত নবীগণ [عليهم السلام]-এর ওফাতের দিনগুলোতে মাতম করার অনুমতি দেননি; সুতরাং যেসব হযরত তাঁদের তুলনায় কম পর্যায়ের, তাঁদের ওফাত কিংবা শাহাদতের দিনকে মাতমের দিন হিসেবে কিভাবে পালন করা যেতে পারে?
ইমাম আবূ আবদুল্লাহ্ ইবনুল হাজ্জ্ তাঁর কিতাব ‘আল মাদ্খাল’-এ মীলাদ-ই পাক সম্পর্কে অত্যন্ত শানদার আলোচনা করেছেন, যার সারকথা হলো- ওই মাহফিল-ই মীলাদের চিহ্নগুলো (যেমন- জমায়েত, জুলূস, জলসা, না’রা ও পতাকা উড্ডয়ন) প্রকাশ করা এবং আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা প্রশংসাযোগ্য। আর তাতে যদি কোন মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা সন্নিবিষ্ট হয়, তবে তা মন্দ ও বর্জনীয়। নিম্নে আমি তাঁর বক্তব্যটা বিস্তারিতভাবে পেশ করছি-
ইবনুল হাজ্জ্ ‘ফাস্লুন্ ফিল মাওলেদ’ (মীলাদ শরীফ শীর্ষক পরিচ্ছেদ)-এ বলেছেন, তাদের প্রচলনকৃত বিদ্‘আতগুলো (নব আবিস্কৃত কাজগুলো)’র মধ্যে একটি হলো রবিউল আউয়াল মাসে ‘মীলাদ-ই পাক’ উদ্যাপন করা, যাকে তাঁরা মহা ইবাদত মনে করেন; অথচ তাতে অনেক কিছু হারাম ও অবৈধ (না-জায়েয) কাজও সন্নিবিষ্ট হয়েছে, যেমন বাদ্যযন্ত্র (সেতার, তবলা ও সারঙ্গী ইত্যাদি), যেগুলোকে তারা সামা’র যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আর ওইগুলোর সাথে সাথে মন্দ কার্যাদিতে মশগুল হয়ে যায়। বিশেষ করে, যেগুলোকে আল্লাহ্ তা‘আলা ফযীলত ও মহত্ব দান করেছেন, সেগুলোতে মন্দ ‘বিদ্‘আত ও হারাম কার্যাদি সম্পন্ন করে; যখন সামা’ নিঃসন্দেহে ওই রাত ছাড়া অন্য সময়েও জায়েয নয়, তখন তা এ বরকতময় রাতে কিভাবে জায়েয হতে পারে? যে মাসের রয়েছে মহত্ব ও ফযীলত, যাতে আল্লাহ্ তা‘আলা রহমত-ই আলম [ﷺ]কে প্রেরণ করেছেন। বুঝা গেলো যে, বাদ্যযন্ত্র ও সামা’র সাথে এ বুযুর্গ মাসের কোন সম্পর্ক নেই, যাতে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘ইয্যাত দু’জাহানের সরদার [ﷺ]’কে সৃষ্টি করে আমাদের উপর মহা অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং আমাদের উচিৎ হচ্ছে- বেশী পরিমাণে ইবাদত ও দান-খায়রাত করে এ মহা নি’মাতের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা; যদিও নবী করীম [ﷺ] এ মাসে অন্য মাসের তুলনায় বেশী ইবাদত করেননি। এর কারণও শুধু এ-ই যে, তিনি আপন উম্মতকে দয়া করেছেন, স্নেহ প্রদর্শন করেছেন।
কেননা, তিনি উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাবার আশঙ্কায় অনেক কাজ বাদ দিয়েছেন; কিন্তু যখন তাঁর থেকে সোমবার রোযা পালনের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তখন তিনি এ মাসের ফযীলতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আর বলেছেন- ذَالِكَ يَوْمٌ وُلِدْتُّ فِيْهِ (সেটা আমার জন্মের দিন)। এ দিনের ফযীলত এ মাসের ফযীলতের পরিচায়ক। সুতরাং আমাদের উচিৎ হচ্ছে আমাদের এ মাসের প্রতি এমন সম্মান দেখানো, যেমন সম্মান দেখানো সেটার প্রাপ্য, অন্যান্য বরকতময় মাসগুলোর মতো এ মাসের প্রতি তা’যীম বা সম্মান দেখানো। কেননা, এ মাসও ওইসব মাসের অন্যতম। যেমন হুযূর [ﷺ] এরশাদ ফরমান-
[ اَنَا سَيِّدُ وُلْدِ اَدَمَ وَلاَ فَخْرَ‘ ادَمُ وَمَنْ دُوْنَه تَحْتَ لِوَائِى ]
(অর্থাৎ আমি গর্ব-অহংকার ছাড়াই বলছি যে, আমি আদম সন্তানদের সরদার।) হযরত আদম [عليه السلام] এবং তাঁর পরবর্তী সমস্ত লোক ক্বিয়ামতের দিনে আমার পতাকার নিচে থাকবে। আর স্থান ও কালের ফযীলতের ভিত্তি হচ্ছে ওইগুলোতে সম্পন্নকৃত ইবাদতসমূহ, যেগুলো আল্লাহ্ তা‘আলা ওইগুলোর সাথে, অর্থাৎ ওই কাল ও স্থানগুলোর সাথে নির্দিষ্ট করেছেন। কেননা, একথা সর্বজন বিদিত যে, স্থান ও কালের মহত্ব (বুযুর্গী)তো (কখনো) ওইসব সত্তা থেকে হয় না বরং সেগুলোর এসব বুযুর্গী ওইগুলোর অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যাদি (অথবা সম্পর্ক ইত্যাদি)’র কারণেই অর্জিত হয়ে থাকে, যেগুলোর সাথে এ স্থান ও কাল নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। এখন আপনারা ওইসব বৈশিষ্ট্য ও বরকতরাজি দেখুন, যেগুলো আল্লাহ্ তা‘আলা রবিউল আউয়াল মাস ও সোমবারের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন।
আপনি কি দেখেননি যে, সোমবার রোযা রাখলে বড় ফযীলত রয়েছে? কেননা, আক্বা-ই দু‘আলম [ﷺ]-এর বেলাদত শরীফ এ দিনে হয়েছে। সুতরাং যখন এ মাস আসে, তখন এ মাসের উপযোগী সম্মান প্রদর্শন ও গুরুত্ব প্রদান করা, আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করা উচিৎ। কারণ, তাঁর পবিত্র অভ্যাস ছিলো যে, তিনি ফযীলতমণ্ডিত সময়গুলোতে বেশী ইবাদত করতেন এবং অধিক পরিমাণে দান-খায়রাত করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস [رضى الله عنهما] বলেন,
[ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَجْوَد النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ اَجْوَدَ مَا يَكُوْنُ فِىْ رَمَضَانِ ]
অর্থাৎ ‘‘রসূলুল্লাহ্ [ﷺ] সর্বাপেক্ষা বেশী দানশীল ছিলেন; বিশেষ করে রমযান মাসে আরো বেশী দান করতেন।’’ সুতরাং আমাদেরও উচিত হচ্ছে যথাসম্ভব এ সময়গুলোর প্রতি সম্মান দেখানো। আর যদি কেউ বলে, ‘সরকার-ই দু’ আলম [ﷺ] যে সময়গুলোর প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, ওইগুলো সম্পর্কে আমরা জানি, কিন্তু এ মাসের প্রতি হুযূর [ﷺ] তো কোন বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন নি!’
এর জবাব এ যে, (এটা এজন্য নয় যে, এ মাসের উত্তম নয়; বরং) তিনি তাঁর মহান অভ্যাস অনুসারে উম্মতের জন্য সহজপন্থা ও নম্রতা চাইতেন; বিশেষ করে ওই কাজে, যা তাঁর ব্যক্তি-সত্তার সাথে খাস হতো। যেমন- হুযূর [ﷺ] মদীনা মুনাওয়ারাকে মক্কা মুর্কারমার মতো ‘হেরম’ সাব্যস্ত করেছেন; কিন্তু উম্মতের প্রতি দয়া ও স্নেহ প্রদর্শন করে সেখানে শিকার করলে ও গাছ কাটলে ‘দম’ ওয়াজিব (অপরিহার্য) করেননি। এ কারণে যে, তিনি উম্মতের জন্য সহজ করার নিমিত্তে কোন কোন আমল বাদ দিতেন।
এতটুকু আলোচনার পর প্রমাণিত হলো যে, সাদক্বাহ্-খায়রাত ও অন্যান্য নেক কাজ অধিক পরিমাণে সম্পন্ন করার মাধ্যমে এ মাসের প্রতি সম্মান দেখানো উচিৎ। যদি এটাও করতে না পারো, তাহলে কমপক্ষে হারাম কার্যাদি থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবে। আর এ বরকতময় মাসের সম্মানার্থে পাপ কার্যাদি থেকে পৃথক থাকবে। যদিও হারাম কার্যাদি সম্পন্ন করা এটা ব্যতীত অন্যান্য মাসেও নিষিদ্ধ; কিন্তু রমযান ইত্যাদির মতো এ মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এসব কাজ থেকে বিরত থাকা আরো বেশি প্রয়োজন। সুতরাং এ মাসে ভিত্তিহীন নব আবিস্কৃত কার্যাদি (বিদ্‘আত) ও অনর্থক কার্যাদি আবিস্কার, মন্দ ও বর্জনীয় বিদ্‘আতের স্থানগুলো ও সমস্ত অনুচিত কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কিন্তু বর্তমান যুগে কিছু লোক এর বিপরীতটুকুই করে বসে। অর্থাৎ যখনই এ মাস আসে, তখন তারা দফসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারে গানবাদ্যে মশগূল হয়ে যায়। আরো দুঃখের বিষয় হচ্ছে এসব গানবাদ্যকে তারা ভাল ও পুণ্যময় কাজ বলে মনে করে। তাও এভাবে যে, মীলাদ শরীফ উদ্যাপনের কাজ ক্বোরআন-ই পাকের তিলাওয়াত দ্বারা আরম্ভ করে। তারপর এমন লোকের তালাশ করে যার কণ্ঠস্বর মুর্চ্ছনাময়, সুরেলা ও চিত্তাকর্ষক হয়। তারপর তার কণ্ঠে গান শুনে। বস্তুত এতে অনেক অপকার রয়েছে; বরং অনেকে তো এমনও করে বসে যে, সুন্দর ও সুকণ্ঠী যুবকদের আকর্ষণীয় কণ্ঠে হেলে দুলে গজল ইত্যাদি পড়িয়ে থাকে, যাতে লোকেরা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় এবং অগণিত মন্দ কাজের জন্ম দেয়; যা বেশীর ভাগ সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও ঝগড়া-বিবাদের কারণ হয়। এমনকি তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের পরিবেশও তৈরী হয়ে যায়। মীলাদ-মাহফিলের মধ্যে উল্লেখিত অপকারগুলো তখনই সৃষ্টি হয়, যখন তাতে দফ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহকারে তথাকথিত সামা’ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়। যদি এসব অনর্থক কাজ থেকে বিরত থেকে মীলাদ শরীফের নিয়্যতে লোকজনকে ডেকে সমবেত করা হয় এবং খানা খাওয়ানো হয়, তবুও এটা বিদ্‘আত বা নব আবিস্কৃত। কেননা, এটা দ্বীনের মধ্যে নতুন কাজের সংযোজন। তাছাড়া, এটা ‘সলফে সালেহীন’ (পূর্ববর্তী বুযুর্গগণ)-এর আমল থেকেও হুবহু প্রমাণিত নয়; না ওই সব হযরত থেকে মীলাদ উদ্যাপনের নিয়্যত করার বর্ণনাও উদ্ধৃত হয়েছে; অথচ পূর্ববর্তী বুযুর্গদের অনুসরণ করা উত্তম। আর যেহেতু আমরা তাঁদের অনুসারী, সেহেতু তাঁরা যেসব কাজ যেভাবে করেছেন, সেসব কাজ সেভাবে অর্থাৎ কলুষমুক্তভাবে করাই আমাদের উচিৎ। তাঁর বক্তব্য এ পর্যন্ত।
ইবনুল হাজ্জ-এর উপরিউক্ত বক্তব্যের সারকথা হলো তিনি মীলাদ শরীফ উদ্যাপনকে মন্দ বলেননি, বরং ওইসব হারাম কাজ ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছেন, যেগুলো তাতে ঢুকে পড়েছে। তাঁর বক্তব্যের প্রথমভাগেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এ মুবারক মাসে অধিক পরিমাণে নেক কাজ ও দান-খায়রাত করা উচিৎ। আর বিভিন্নভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য চেষ্টা করা চাই। বস্তুতঃ এটাই তো মীলাদুন্নবী উদ্যাপন, যাকে আমরা পুণ্যময় মনে করি। কারণ তাতেও ক্বোরআন তিলাওয়াত ও খানা খাওয়ানো ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছু করা হয় না। এসব কাজ উত্তম, পুণ্যময় ও আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মাধ্যম হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই।’ আর শেষভাগে তিনি যা বলেছেন- ‘তাহলেও এটা বিদ্‘আত’ বা নব আবস্কিৃত; তা হয়তো তাঁর পূর্বোল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীত অথবা সেটার অর্থ ‘বিদ্‘আত-ই হাসানাহ্’ (উত্তম বিদ্‘আত) বলে ধরে নিতে হবে; যেমনটি ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অথবা একথা বলা হবে যে, এ কাজতো পুণ্যময়; কিন্তু মীলাদের নিয়্যতে করা বিদ্‘আত, যার দিকে তিনি তাঁর বক্তব্য ‘মীলাদের নিয়্যত করা বিদ্‘আত’ দ্বারা ইঙ্গিত করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ওইসব হযরতের মধ্যে কারো থেকে মীলাদের নিয়্যত করার কথা উদ্ধৃত হয়নি, তা থেকে এ কথা প্রকাশ পায় যে, তাঁরা শুধু মীলাদের নিয়্যতকে অপছন্দ করেছেন, দাওয়াত ও জমায়েতকে নয়। কিন্তু সুক্ষ্ম-বিশ্লেষণে একথা তাঁর প্রথম কথার বিপরীত। কেননা, তিনি এ বরকতময় মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদত ও দান-খায়রাত করতে উৎসাহিত করেছেন। আর একথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এসব ইবাদত ইত্যাদি সাইয়্যেদুল মুরসালীন (রসূলকুল সরদার) [ﷺ]-এর বেলাদত শরীফের খুশীতে আল্লাহ্ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবেই করা হয়। শেষ পর্যন্ত মীলাদ শরীফের নিয়্যত করার অর্থও তো এটাই। তারপর এজন্য উৎসাহিত করা সত্ত্বেও সেটার মন্দ সমালোচনা তিনি কীভাবে করতে পারেন?
বাকী রইলো নিয়্যত ব্যতীত কোন কাজ করা। তাহলে প্রথমতঃ এটার কল্পনাও করা যায় না। যদি এটা মেনেও নেওয়া হয়, তবে এটাকে না ইবাদত বলা যাবে, না সেটার জন্য কোন সাওয়াব পাওয়া যাবে। কেননা, নিয়্যৎ ব্যতীত কোন আমল সাওয়াব পাবার উপযোগীই হয় না। তাছাড়া, এখানে নিয়্যতও শুধু এটাই যে, এ মুবারক মাসে সরকারে দু’আলম [ﷺ]-এর পবিত্র বেলাদত শরীফের জন্য আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যাতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। নিঃসন্দেহে এ নিয়্যত মুস্তাহাব ও প্রশংসিত। চিন্তা করুন!
একটু সামনে গিয়ে আল্লামা ইবনুল হাজ্জ বলেন, কিছুলোক মীলাদ-এ পাক শুধু তা’যীমের নিয়্যতে নয়; বরং এজন্য করেন যে, যে অর্থ তাঁরা অনুষ্ঠানাদি এবং খুশীর সময় ও স্থানগুলোতে লোকজনকে দিয়েছেন, তা যেন ফেরৎ পাওয়া যায়। কিন্তু সরাসরি চাওয়াকে লজ্জার কারণ মনে করে, এ কারণে মীলাদ- মাহফিলের আয়োজন করে, যা অর্থকড়ি ফেরৎ পাবার কারণ হয়ে যায়। এতে অনেক অপকার রয়েছে। তন্মধ্যে এটাও রয়েছে যে, সেটাকে ‘নিফাক্ব’ (মুনাফিক্বী) বলা যেতে পারে। কেননা, মনের গোপন কথার বিপরীত প্রকাশ করার নামই হচ্ছে-মুনাফিক্বী। তার অবস্থা থেকে প্রকাশ পায় যে, আখিরাতের সাওয়াবের আশায় মীলাদে পাক আয়োজন করেছে; কিন্তু অন্তরে সম্পদ আহরণের নিয়্যত বা উদ্দেশ্য থাকে। কেউ কেউ মাল-সামগ্রী আহরণ, নিজের প্রশংসা করানো ও লোকজনকে নিজের সহযোগী ও সমর্থক বানানোর জন্য মীলাদ-মাহফিলের কথা প্রচার করে। এ পদ্ধতিটাও মন্দ হওয়া অস্পষ্ট নয়।…সমাপ্ত।
এটাও তাঁর পূর্ববর্তী উক্তির মতোই। কারণ, তাতেও নিয়্যত মন্দ হবার কারণে আয়োজন মন্দ হবার বিষয় প্রকাশ পেয়েছে, মূল মীলাদের কারণে নয়।
শায়খুল ইসলাম যুগশ্রেষ্ঠ হাফেয-ই হাদীস আবুল ফাদ্বল ইবনে হাজর [رحمه الله عليه]’কে মীলাদুন্নবী [ﷺ] সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বলেন, ‘মীলাদুন্নবী উদ্যাপন মূলতঃ এমন বিদ্‘আত, যা ইসলামের প্রথম তিন যুগ (ক্বুরূন-ই সালাসাহ্)’র মাশাইখ থেকে উদ্ধৃত হয়নি। এতদ্সত্ত্বেও তাতে কিছু কল্যাণও রয়েছে। কিছুটা অকল্যাণকর বিষয়ও পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং যদি মন্দ বিষয়গুলো থেকে বিরত রয়ে মীলাদ-ই পাক উদ্যাপন করা হয়, তবে তা বিদ্‘আত-ই হাসানাহ্; অন্যথায় ‘বিদ্‘আত-ই সাইয়্যোহ্’।
আল্লামা ইবনে হাজর আরো বলেন, আমি এ বিষয়টি (মিলাদুন্নবী উদ্যাপন)’র বৈধতা ‘সহীহাঈন’ (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)-এর মধ্যে উল্লিখিত একটি প্রমাণিত মূলনীতি থেকে বের করেছি। তা হচ্ছে- নবী করীম [ﷺ] মদীনা মুনাওয়ারাহ্য় তাশরীফ আনার পর তিনি ইহুদীদেরকে আশূরার দিন রোযা রাখতে দেখেছেন। তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন ইহুদীরা বললো, ওই দিনে ফির‘আউন ও তার সৈন্যবাহিনী পানিতে ডুবে ধবংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। আর হযরত মূসা [عليه السلام] তার যুল্ম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এজন্য আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে রোযা পালন করি।
এ থেকে বুঝা গেলো যে, কোন নির্দিষ্ট দিনে নি’মাত অর্জন কিংবা মুসীবত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা চাই। আর ওইদিনের মতো দিন যখন আসবে তখন ওই কৃতজ্ঞতা পুনরায় প্রকাশ করা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা‘আলার শোক্র ইবাদতের মাধ্যমেই জ্ঞাপন করা যেতে পারে; অর্থাৎ নামায, রোযা, সাদ্ক্বাহ্ ও তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে। বাস্তবিকপক্ষে রহমতে আলম [ﷺ]-এর বেলাদত শরীফ অপেক্ষা বড় কোন্ নি’মাত হতে পারে? সুতরাং যথাযথ ও উত্তম পন্থা হচ্ছে- হুযূর-ই আক্রামের বেলাদত শরীফের দিনে মীলাদুন্নবী উদ্যাপন করা, যাতে আশূরার দিনে হযরত মূসা [عليه السلام]-এর ঘটনার অনুরূপ হয়। আর যদি এ ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত না করে এ মাসে যে কোন দিনেই মীলাদ শরীফের আয়োজন করা হয় তবুও তাতে কোন ক্ষতি নেই; বরং কেউ কেউ এতে আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যে, বছরের যে কোনদিনই মীলাদ শরীফের আয়োজন করা যায়; যদিও সেটা আশূরার দিনের অনুরূপ হবে না।
উপরিউক্ত বক্তব্য শুধু মীলাদ মাহফিল আয়োজন করা সম্পর্কেই ছিলো। বাকী রইলো এ প্রশ্ন যে, এতে কী কী করা যাবে? এর জবাবে, উচিত তো হবে এযে, এটা এমন সব কাজ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে, যেগুলো দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলার শোকরিয়া আদায় করা প্রতীয়মান হয়, যেমন ক্বোরআন তিলাওয়াত করা, খানা খাওয়ানো, দান-সাদ্ক্বাহ্ করা, হুযূর [ﷺ]-এর শানে না’ত পড়া এবং এমনসব ক্বসীদা পাঠ করা, যেগুলো শুনলে মন দুনিয়া থেকে দূরে চলে যায় এবং আখিরাতের জন্য পুন্যময় কাজের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এতদ্ব্যতীত ওইসব গজল পাঠ ও আনন্দ-আহলাদ, যা এ খুশীর জন্য শোভা পায় এবং বৈধ পন্থায় হয়, তাহলে তাতেও কোন ক্ষতি নেই। আর যদি হারাম ও মাকরূহ হয় অথবা অধিকতর উত্তমপন্থার বিপরীত (خلاف اولى) হয়, তাহলে তা থেকে বিরত থাকাও জরুরী।…সমাপ্ত।
এ প্রসঙ্গে আমি (ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূত্বী)ও মীলাদের (বৈধতার) জন্য একটি মূলনীতি বের করেছি। তাহচ্ছে- ইমাম বায়হাক্বী হযরত আনাস [رضي الله عنه] থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম [ﷺ] নুবূয়ত প্রকাশের পর নিজের আক্বীক্বা করেছেন, অথচ তাঁর দাদা জনাব আবদুল মুত্তালিব তাঁর বেলাদত শরীফের সপ্তম দিনে তাঁর আক্বীকা করেছিলেন। আর আক্বীক্বা দ্বিতীয়বার করা যায় না। সুতরাং এটা (হুযূর-ই করীম নিজের আক্বীক্বা করা)’র কারণ এটা বলা যাবে যে, তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার এ শোক্র আদায় করার জন্য তা করেছেন যে, তিনি তাঁকে ‘রাহমাতাল্লিল আ-লামীন’ (সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত) করেছেন এবং উম্মতের জন্য তাঁর বেলাদত শরীফের উপর আল্লাহর শোকর আদায় করাকে শরীয়তসম্মত করার জন্য পুনরায় আক্বীক্বা করেছেন। যেমন তিনি সশরীরে নিজের উপর দুরূদ পড়তেন। সুতরাং আমাদেরও উচিত হবে মীলাদে পাকে লোকজনকে জমায়েত করে, তাদেরকে খানা খাইয়ে এবং অন্যান্য বৈধপন্থায় খুশী প্রকাশ করে মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলার শোক্র আদায় করা।
ইমামুল র্ক্বোরা (ক্বারীগণের ইমাম) হাফেয শামসুদ্দীন ইবনে জাযারী তাঁর কিতাব ‘আরফুত্ তা’রীফ বিল মাওলেদিশ্ শরীফ’ (عرف التعريف بالمولِدِالشريف)-এ লিখেছেন, আবূ লাহাবকে কেউ স্বপ্নে দেখে বললেন, ‘‘তোমার কী অবস্থা? তখন সে জবাবে বললো, ‘‘জাহান্নামে জ্বলছি; কিন্তু প্রত্যেক সোমবার রাতে আমার শাস্তি লঘু করা হয়।’’ আর সে আঙ্গুলের মাথার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, এতটুকু পানি পাওয়া যায়, যা আমি চুষে থাকি। এটাও এ কারণে যে, যখন আমার ক্রীতদাসী সুয়াইবাহ্ আমাকে নবী করীম [ﷺ]-এর জন্মের সুসংবাদ শুনিয়েছিলো, তখন আমি তাকে আযাদ করে দিয়েছিলাম। আর সে তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলো।
উল্লেখ্য, আবূ লাহাবের মতো কাফির, ক্বোরআনে যার সমালোচনা করা হয়েছে, সেও হুযূর [ﷺ]-এর পবিত্র বেলাদতে খুশী প্রকাশ করার কারণে জাহান্নামে আরাম ও শান্তি পায়, তাহলে তাঁর মু’মিন একত্ববাদী গোলামের কী অবস্থা হবে? নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে উঁচু জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে এর প্রতিদান দেবেন।
হাফেয শামসুদ্দীন ইবনে নাসির উদ্দীন দামেস্কী আপন কিতাব ‘মাওরেদুস্ সাদী ফী- মওলেদিল হাদী’তে লিখেছেন, একথা বিশুদ্ধ রেওয়ায়ত থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, আবূ লাহাব থেকে সোমবার আযাব লঘু করা হয়।, কেননা সে তাঁর বেলাদতের খুশীতে সুয়াইবাহকে আযাদ করেছিলো। তারপর তিনি (লেখক) একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছেন, যার অনুবাদ নিম্নরূপ-
‘‘যখন চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে অবস্থানকারী কাফির, যার মন্দ হবার বর্ণনায় ‘সূরা তাব্বাত ইয়াদা-’ অবতীর্ণ হয়েছে, সেও হুযূর [ﷺ]-এর বেলাদতের খুশী উদ্যাপনের কারণে প্রত্যেক সোমবার জাহান্নামের শাস্তিতে লঘুতা ও আরাম পেতে পারে, তাহলে ওই বান্দার অবস্থা কেমন হবে, যে সমগ্র জীবন হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা আলায়হিত্ তাহিয়্যাতু ওয়াস্ সানার জন্মে খুশী উদ্যাপন করছে এবং আল্লাহর একত্ব স্বীকার করতে করতে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে?
কামাল আওফাভী ‘আত্ব ত্বা-লিউস্ সা‘ঈদ’-এ লিখেছেন, আমাদের ন্যায়পরায়ণ বন্ধু নাসির উদ্দীন মাহমূদ ইবনে ‘ইমাদ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, আবূ ত্বাইয়্যেব মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম সাবতী মালেকী, যিনি ক্বওস (قُوْص) -এ তাশরীফ এনেছিলেন এবং বা-আমল আলিম ছিলেন, যখন ১২ রবিউল আউয়াল ‘মাকতাব’ (মাদরাসা)-এর পাশ দিয়ে যেতেন তখন বলতেন, ‘‘হে ফক্বীহ্! এটা খুশীর দিন। ছাত্রদেরকে ছুটি দিয়ে দিন!’’ সুতরাং আমরা সেদিন ছুটি পেয়ে যেতাম। এটা একথার প্রমাণ যে, তিনি এ খুশী উদ্যাপনকে কবূল করেছেন; এটা অপছন্দ বা অস্বীকার করেননি। আর এ আলিম-ই দ্বীন মালেকী মাযহাবের বহু বড় ফক্বীহ্ ও জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। অত্যন্ত মুত্তাক্বী বা খোদাভীরু ছিলেন। আবূ হাইয়্যান প্রমুখ তাঁর নিকট ইলম হাসিল করেছেন। তাঁর ওফাত ৬৯৫ হিজরীতে হয়েছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
___________
ইবনুল হাজ্জ বলেছেন, যদি একথা বলা হয় যে, সরকার-ই আবাদক্বরার [ﷺ]-এর বেলাদত (জন্ম) শরীফ রবিউল আউয়াল মাসে হয়েছে। তাও সোমবার কেন হয়েছে? রামযানুল মুবারকে, যাতে ক্বোরআন মজীদ নাযিল হয়েছে এবং যাতে ‘লায়লাতুল ক্বদর’ রয়েছে, তাতে কিংবা মর্যাদাবান অন্য কোন মাসে, অথবা ১৫ই শা’বান কিংবা জুমু‘আহ্র দিনে অথবা রাতে কেন হলো না? তাহলে এসব প্রশ্নের জবাব চারভাবে দেওয়া যায়-
এক.হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা সোমবার গাছ সৃষ্টি করেছেন। এতে একথার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জীবিকা, ফলমূল ইত্যাদি, যেগুলো দ্বারা মানুষের লালন-পালন হয়, যেগুলো খেয়ে সে জীবিত থাকে, যেগুলোকে তাদের হৃদয় পছন্দও করে, ওই দিনেই তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন।)
দুই.রবী’ (ربيع) শব্দের মধ্যে তার সম্পর্ক উৎসমূল (অর্থাৎ বসন্তকাল)-এর সাথে পাওয়া যায়। আবূ আবদুর রাহমান সক্বলী বলেন, প্রত্যেকে তাঁর নামের একটা হিস্সা পায়।
তিন.রবী’ (বসন্তকাল) হচ্ছে মাঝারি ও সর্বাপেক্ষা উত্তম তথা মনোরম মৌসুম। তাঁর শরীয়তও মধ্যম মানের তথা সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সহজ।
চার.মহামহিম আল্লাহ্ হুযূর-ই আক্রামের মাধ্যমে ওই সয়মকে মর্যাদাবান করেছেন, যাতে তাঁর বেলাদত (জন্ম) শরীফ হয়েছে। যদি তাঁর পবিত্র জন্ম রমযান ইত্যাদি সময়গুলোতে হতো, তাহলে এ মর্মে সন্দেহ থাকতো যে, তিনি ওইসব সময়ের কারণে সর্বাধিক ফযীলতমণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন কিনা।
টিকাঃ
_____
‘ইরবিল’ ‘ইসমিদ’-এর সমুচ্চরিত শব্দ। ইরাকের মসূল অঞ্চলের এক বড় শহর, যা সুলতান মুযাফ্ফর কোকবরী আবাদ করেছিলেন। [সূত্র. হামভী, মু’জামুল বুলদান, বৈরুত দার-ই সাদির থেকে ১৯৫৭ সালে মুদ্রিত]
. সুলতান মুযাফ্ফর উদ্দীনের জীবনী জানার জন্য দেখুন: ইবনে খাল্লিকান (ওফাত-৬৮১হি.) কৃত ‘ওয়াফিয়্যাতুর আ’ইয়ান ওয়া আবনাইয্ যামান’। নিরীক্ষণ-মুহাম্মদ মুহি উদ্দীন আবদুল হামীদ, কায়রো, মাকতাবুন্ নাহ্দ্বাতিল মিস্রিয়্যাহ্: ১৯৪৮ হিজরীতে মুদ্রিত, ইবনে কাসীর কৃত ‘আল বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ’, মিশর, মাত্ববা‘আতুস্ সা‘আদাহ্। ইবনে খাল্লিকান সুলতানের তিন পৃষ্ঠা ব্যাপী আলোচনা করেছেন; পাঁচ পৃষ্ঠা ব্যাপী সুলতানের মীলাদ শরীফ উদ্যাপনের বর্ণনা অতি উত্তমরূপে দিয়েছেন। ইবনে খাল্লিকান বলেছেন, সুলতানের ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ [ﷺ] উদ্যাপনের শান-শওকত বর্ণনাতীত।
. ‘ক্বাসিয়ূন’ দামেস্ক শহরের সাথে সংলগ্ন একটি পাহাড়; যার চূড়ার এক প্রান্তে সূফী ও বুযুর্গদের প্রসিদ্ধ কবরস্থান রয়েছে, যাতে শায়খ-ই আকবার মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী (রাওয়াহাল্লাহু রূহাহু)’র মাযার শরীফও রয়েছে। এ কবরস্থানের পাশেই সুলতান মুযাফ্ফর এ জামে মসজিদ নির্মাণ করান। এ পাহাড়ে একটি গূহা আছে, যার নাম ‘মুগারাতুদ্দাম’ (রক্তিম গূহা)। কথিত আছে যে, এখানেই ক্বাবীল হাবীলকে হত্যা করেছিলো। [দেখুন হামভীর মু‘জামুল বুলদান]
. তিনি হলেন ইসমাঈল ইবনে ওমর ইবনে কাসীর আবুল ফিদা ইমামুদ্দীন শাফে‘ঈ দামেস্কী, হাফেয, মুফাস্সির ও ইতিহাসবিদ। ওফাত-৭৭৪ হিজরী। তাঁর বিস্তারিত জীবনীর জন্য দেখুন- কাশ্ফুয্ যুনূন ‘আন আসা-মিল কুতুব ওয়াল ফুনূন, মু’জামুল মুআল্লিফীন, আল-আ’লাম, শাযরাতুয্ যাহাব ফী আখবারি মান যাহাব, আদ্ দুরারুল কামিনাহ্ ইত্যাদি।
. ‘শায়খ ইবনে দাহিয়্যাহ্’ স্পেনে ৫৪৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস শরীফ, নাহ্ভ, অভিধান, কাব্য রচনা, ও আইয়্যামে আরব ইত্যাদি জ্ঞানগত বিষয়ে দক্ষতাসম্পন্ন ছিলেন। ৬৩৩হিজরীতে ইন্তিক্বাল করেন। [সূত্র. ওয়াফিয়্যাতুল আ’ইয়ান]
. ওয়াফিয়্যাতুল আ’ইয়ানে’-এ এর নাম ‘কিতাবুত্ তানভীর ফী- মাওলিদিস্ সিরাজিল মুনীর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
. জর্ডানের নিকটে সিরিয়ার উপকূলে অবস্থিত এ প্রাচীন শহর এবং কিল্লা অত্যন্ত ঐতিহাসিক গুরুত্বের দাবীদার। হযরত ওমর [رضي الله عنه]’র খিলাফতামলে, খুব সম্ভব ১৫ হিজরী সনে, এটা প্রথমবার বিজিত হয়েছে। ৪৯৭ হিজরীতে এটা ক্রুসেড যোদ্ধারা পুনরায় দখল করে নেয়। ৫৮৩ হিজরীতে সালাহ্ উদ্দীন আইয়ূবী সেটা দ্বিতীয়বার দখল করে নেন; কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেটা পুনরায় ক্রসেডারদের দখলে চলে যায়। [সূত্র. মু’জামুল বুলদান]
. ইবনে কাসীর- আল বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্।
. ওফিয়্যাতুল আ’ইয়ান।
. তিনি মিশরের আলেক্সান্দ্রিায়ার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি মালেকী ফিক্বহ্সহ ইসলামী আরবী বিষয়াদিতে কয়েকটা কিতাবও লিখেছেন। ‘ইল্মে নাহ্ভ’-এ অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ৭৩৭হিজরীতে মারা যান। সূত্র. আল-আ’লাম।
. সূরা ফজর: আয়াত-১৪।
. সূরা বাক্বারা: আয়াত-১৫৬।
. সহীহ্ মুসলিম: কিতাবুল ঈমান: বাবু বয়ানি আন্নাল ইসলামা বাদাআ গারীবান, হযরত ইবনে ওমর [رضى الله عنهما] থেকে বর্ণিত, হাদীস নং-২০৮, ২০৯, সুনান-ই ইবনে মাজাহ্, কিতাবুল ফিতান: বাবু বদইল ইসলামি গরীবান, হযরত আবূ হোরায়রা, আনাস ইবনে মালিক ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ [رضي الله عنهم] থেকে বর্ণিত, হাদীস নং ৩৯৭৬, ৩৯৭৭, ৩৯৭৮, মুসনাদ-ই আহমদ, মুসনাদুল মুকাস্সিরীন: হাদীস নং ৮৬৯৩।
.ইমাম আবূ আমর ইবনুল ‘আলা হলেন তামীমী বসরী। তিনি সাহিত্য ও অভিধানের ইমাম। তিনি সাতজন প্রসিদ্ধ ক্বারীর অন্যতম। মক্কা মুকাররামায় পয়দা হন। বসরায় লালিত হন। কূফায় ১৫৪ হিজরীতে ইনতিক্বাল করেন। দেখুন: যারক্বানী ও আ’লাম।
. অর্থাৎ কেউ যদি কোন জিনিষ সম্পর্কে না জানে, তবে এর এ অর্থ নয় যে, ওই জিনিষের অস্তিত্বই নেই। আর এটাও নবী-ই করীমের সুন্নাহ্ থেকে প্রমাণিত।
. ইয়াহিয়া ইবনে শরফ হাওরানী নাওয়াভী শাফে‘ঈ আবূ যাকারিয়া মুহি উদ্দীন। তিনি সিরিয়ায় হাওরানের নিকটে ‘নাওয়া’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই ৬৭৬ হিজরীতে ওফাত পান। তিনি ‘শরহে মুসলিম’ ও ‘বুস্তানুল আরেফীন’ ইত্যাদি কয়েক ডজন কিতাব প্রণয়ন করেন। [সূত্র. যারকলী, ‘আল-আ’লাম]
. দেখুন- ইমাম নাওয়াভীর ‘তাহ্যীবুল আসমা ওয়াল লুগাত’। বিদ্‘আত শব্দের মূল অক্ষরগুলো হচ্ছে- ب د ع ; বৈরুত, দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ্।
. সুলতানুল ওলামা ইয্যুদ্দীন ইবনে আবদুস্ সালাম, আবুল ক্বাসেম ইয্যুদ্দীন সালামী ও দামেস্কী। ওফাত-৬৬০ হিজরীতে। তিনি গায্যালী ও রাযীর সাথে পরিগণিত। কোন কোন জ্ঞানী ব্যক্তির মতে, তিনি ইজ্তিহাদের মর্যাদায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন, সেখানে লালিত হন। তিনি মিশরেও বিচারকের পদে আসীন হন। [আল-আ’লাম]
. এটা মানে তাঁর, দ্বীনের রহস্যাদি সম্বলিত বহুল আলোচিত কিতাব- ‘ক্বাওয়াইদুল আহকাম ফী- ইসলাহিল আনাম’।
. আবূ বকর আহমদ ইবনে হোসাঈন বায়হাক্বী। তিনি নিশাপুরের নিকটে ‘বায়হাক্ব’ নামক স্থানে ৩৮৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪৮৫ হিজরীতে ইনতিক্বাল করেন। ইমাম জুয়াইনী বলেছেন, কোন শাফে‘ঈ এমন নেই, যার উপর ইমাম শাফে‘ঈর অনুগ্রহ ও উপকার নেই, বায়হাক্বী ব্যতীত; শাফে‘ঈ মাযহাবের প্রতি সমর্থন ও সাহায্যে তাঁর প্রচুর লেখনী (কিতাবাদি)’র কারণে খোদ্ ইমাম শাফে‘ঈর উপর ইমাম বায়হাক্বীর ইহসান রয়েছে। ইমাম যাহাবী বলেন, যদি বায়হাক্বী ইচ্ছা করতেন, তাহলে নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে নিজেই নিজের ‘ফিক্বহী মাযহাব’ কায়েম করতে পারতেন। তিনি কম বেশী এক হাজার কিতাব লিখেছেন।
[সূত্র. তাক্বিউদ্দিন দামেস্কী, তাবক্বাতুশ্ শাফে‘ইয়্যাহ্, দা-ইরা-ই মা‘আরিফি ওসমানিয়্যাহ্, যারকালী ও আল আ’লাম]
. ইমাম মালিক, মুআত্তা; বাবু বদ‘ই ক্বিয়ামি লায়ালী রমদ্বান, বোখারী, প্রমুখ ‘ت’ ব্যতীত (نعم) বর্ণনা করেছেন, দেখুন- সহীহ্ বোখারী: কিতাবু সালাতিত্ তারাবীহ্, বাবু ফাদ্বলি মান ক্বা-মা রামাদ্বান।
. মানাক্বিবে শাফে‘ঈ, শায়খ আবদুল্লাহ্ হারারীর বরাতে, আর রাওয়া-ইহুয্ যাকিয়্যাহ্ ফী মাওলেদে খায়রিল বারিয়্যাহ। বৈরুতে দারুল মাশারী’ কর্তৃক ১৯৯৭ ইংরেজিতে মুদ্রিত)
. অর্থাৎ যদি মীলাদ মাহফিলগুলোতে কিছু হারাম কাজ ঢুকে পড়ে
. তিনি হলেন আবদুর রহমান ইবনে আহমদ আবুল ফারাহ্ যায়নুদ্দীন বাগদাদী, অতঃপর দামেস্কী। হাফেয-ই হাদীস, জামে‘-ই তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাকারী। ওফাত-৭৯৫ হিজরীতে। [সূত্র. যারকালী, আল-আ’লাম]
. তিনি হলেন- মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনুল হাজ্ব। আবূ আবদুল্লাহ্ মালেকী, ‘আবদারী ফাসী। ওফাত ৭৩৭ হিজরীতে, মরক্কোবাসী আরবী। তিনি মালেকী মাযহাবের এক প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ আলিম-ই দ্বীন ছিলেন। ‘মারাক্বিশ’ থেকে হিজরত করে মিশর এসেছিলেন এবং এখানকার হয়ে রয়ে যান। শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ৮০ বছর বয়সে কায়রোতে ইনতিক্বাল করেন। [সূত্র. যারকালী, আল-আ’লাম]
. অর্থাৎ ‘মাদ্খালুশ্ শর‘ইশ শরীফ’। আল্লামা ইবনে হাজর আস্ক্বালানী এ কিতাবকে অতীব উপকারী বলে মন্তব্য করেছেন।
. সহীহ্ মুসলিম: কিতাবুস্ সওম: বাবু ইস্তিহবা-বিস্ সিয়া-মি মিন কুল্লি শাহ্রিন ওয়া সওমু আশূরা ওয়াল ইসনাঈনি ওয়াল খামীস, মুসনাদ-ই ইমাম আহমদ এবং সুনান-ই বায়হাক্বী।
. সুনান-ই তিরমিযী: কিতাবু তাফসীরিল ক্বোরআন, হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী [رضي الله عنه] থেকে বর্ণিত হাদীস। হাদীস নং ৩০৭৩, তাঁরই থেকে ‘কিতাবুল মানাক্বিবে বর্ণিত হাদীস। হাদীস নং ৩৫৪৮, মুসনাদ-ই আহমদ, মুসনাদে বনী হাশেম, হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীস। হাদীস নং- ২৪১৫।
. সহীহ্ বোখারী শরীফ: কিতাবুস্ সওম: বাবু আজওয়াদু মা-কা-নান্নাবিয়্যু [ﷺ], হাদীস নং ১৭৬৯, কিতাবু ফাদ্বা-ইলিল ক্বোরআন, হাদীস নং- ৪৬১৩। সামান্য পার্থক্য সহকারে এ হাদীস কিতাবু বদ‘ইল ওহী, কিতাবুল মানাক্বিব ও কিতাবুল আদব ইত্যাদিতেও আছে। সহীহ্ মুসলিম। কিতাবুল ফাদ্বা-ইল, বাবু কা-নান্নাবিয়্যু সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আজওয়াদান্না-সি, হাদীস নং ৪২৬৮ এবং সুনানে নাসাঈ; কিতাবুস্ সিয়াম, হাদীস নং ২০৬৮।
. অর্থাৎ এ মাসও যদি উত্তম হতো তাহলে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও সেটার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
. তিনি হলেন- আবুল ফাদ্বল শিহাব উদ্দীন আহমদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাজর আস্ক্বালানী। (আসক্বালান বর্তমান ফিলিস্তীনের একটি শহর) তিনি কায়রোয় ৭৭৩হিজরী/১৩৭২খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীস শরীফ ও ইতিহাসের মহা মর্যাদাবান ইমাম ছিলেন। কাব্য রচনা ও আরবী সাহিত্যে তিনি দক্ষহস্ত ছিলেন। মিশর, সিরিয়া, হেজায ও ইয়ামনের বিজ্ঞ আলিমদের নিকট ইলমে হাদীস অর্জন করেন। তাঁর যুগে তিনি এ ইলম শরীফের শিক্ষার্থীদের মিলনকেন্দ্র ও ইসলামের মহান হাফেয ছিলেন। মিশরে তিনি প্রধান বিচারকের পদও অলংকৃত করেন। তাঁর অতি উল্লেখযোগ্য রচনা হচ্ছে- ‘ফাত্হুল বারী’, তাহযীবুত্ তাহযীব, তাক্বরীবুত্ তাহযীব, ইসাবাহ্, আদ্দুরারুল কামিনাহ্ ফিল আ’ইয়ানিল মিআতিস্ সা-নিয়াহ্, বুলূগুল মোরাম, নুয্হাতুন নযর ফী- তাওযী-হি নুখ্বাতিল ফিক্র, আল ইহকাম লি বয়ানি মাফিল ক্বোরআন মিনাল আহকাম ইত্যাদি। তাঁর শীষ্য ইমাম সাখাভী তাঁর একটি বিরাটাকার জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেটার নাম ‘আল-জাওয়াহির ওয়াদ্ দুরার ফী- তারজামাতি শায়খিল ইসলাম ইবনে হাজর’। ৮৫২হিজরী/১৪৪০খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে তাঁর ওফাত হয়। [সূত্র. খায়রুদ্দীন যারকালী ও আল-আ’লাম]
. সহীহ্ বোখারী শরীফ: কিতাবুস্ সওম: বাবু সিয়ামি ইয়াউমি আশূরা, হাদীস নং ১৮৬৫, সহীহ্ মুসলিম: কিতাবুস্ সিয়াম: বাবু সাওমি ইয়াওমি আশূরাঃ হাদীস নং ১৯১১, সুনানে আবূ দা‘ঊদ; কিতাবুস্ সাওম: বাবুন ফী সওমি ইয়াউমে আশূরা, হাদীস নং ২০৮৮, সুনানে ইবনে মাজাহ্, কিতাবুস্ সওম বাবু সিয়ামি ইয়াউমি আশূরা, হাদীস নং ১৭২৪।
. শামসুদ্দীন ইবনে জযরী আর আবদুল্লাহ্ শাফে‘ঈ, ওফাত ৬৬০ হিজরী। [সূত্র. যরকলী, আল- আ’লাম] . এ বর্ণনা সহীহ্ বোখারী শরীফে রয়েছে। হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়র বলেন, হযরত সুয়াইবাহ্ আবূ লাহাবের ক্রীতদাসী ছিলেন, যাঁকে আবূ লাহাব আযাদ করে দিয়েছিলো। অতঃপর তিনি হযরত নবী করীম [ﷺ]কে দুধ পান করিয়েছেন। যখন আবূ লাহাব মৃত্যুমুখে পতিত হলো, তখন তার কোন নিকটাত্মীয় তাকে স্বপ্নে অতিমাত্রায় মন্দ অবস্থায় দেখেছিলেন, আর জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী পেয়েছো? আবূ লাহাব বলেছিলো, তোমাদের নিকট থেকে কবরে আসার পর আমি কোন শান্তি পাইনি, এতদ্ব্যতীত যে, সুয়াইবাহকে আযাদ করার কারণে এ (আঙ্গুল) থেকে কিছু পানি পান করা যায়। দেখুন সহীহ্ বোখারী: কিতাবুন্ নিকাহ্: বাবু ইয়াহ্রিমু মিনার রাদ্বা-‘আতি মা-ইয়াহ্রিমু মিনান্ নাসাবি। হাদীস নং ৪৭১১, ইমাম ইবনে হাজার এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম সুহায়লী থেকে বর্ণনা করেছেন, আবূ লাহাবকে স্বপ্নে হযরত আব্বাস [رضي الله عنه] দেখেছিলেন, যাঁকে আবূ লাহাব বলেছিলো, তোমাদের নিকট থেকে আসার পর আমি কোন আরাম পাইনি, এতদ্ব্যতীত যে, প্রত্যেক সোমবার আমার শাস্তি লঘু করা হয়। হযরত আব্বাস বলেছেন, তা এজন্য যে, হুযূর-ই করীম সোমবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন সুয়াইবাহ্ আবূ লাহাবকে তাঁর জন্মের সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন। সুতরাং সে তাকে আযাদ করে দিয়েছিলো। দেখুন: ফাত্হুল বারী, শরহে সহীহ্ বোখারী, ১৩০১ হিজরীতে মুদ্রিত।
. ইমাম ইবনে নাসির উদ্দীন, মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর ইবনে আবদুল্লাহ্ ক্বায়সী দামেস্কী শাফে‘ঈ। ওফাত ৮৪২ হিজরী। তিনি ৭৭৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জ্ঞানগত মহত্বের কারণে দামেস্কের ‘দারুল হাদীসিল আশরাফিয়্যাহ্’য় ‘শায়খুল হাদীস’-এর পদে আসীন হন। কয়েক ডজন অতি উপকারী কিতাবের প্রণেতা ছিলেন তিনি। হাফেয ইবনে ফাহ্দ মক্কী তাঁর খুব প্রশংসা করেছেন। দেখুন: ‘লাহযুল আলহায, ইবনে ফাহাদ, ওফাত ৮৭১হি. দামেস্ক, ১৩৪৭হিজরীতে আত্তাওফীক্ব প্রেস কর্তৃক মুদ্রিত।
. (ক্বাফ) ق -এ পেশ সহকারে পঠিত। মিশরের এক প্রাচীন ক্বিবতী শহর। অতীতে সা‘ঈদ-ই মিশরের রাজধানী ছিলো। দেখুন- ‘মু’জামুল বুলদান’।
. মুহাম্মদ ইবনে ইয়ূসুফ ইবনে আলী গারনাত্বী আন্দালূসী (গ্রানাডা, স্পেনবাসী), আমীর উদ্দীন, আবূ হাইয়্যান, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, অভিধানবিদ, সাহিত্যিক, কায়রোতে ৭৩৫হিজরীতে ওফাত বরণ করেন। দেখুন: ‘আল-আ’লাম।