মুহাম্মদ ইয়াহইয়া বিন সিদ্দিক (প্রশ্নকারী)
বাঁশের পাতা, তালোড়, দুপচাঁচিয়া, বগুড়া।
উত্তরঃ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] ইসলামী শরিয়তে নতুন কিছুই নয়। বরং আল্লাহ্ প্রদত্ত সকল দ্বীন আর শরিয়তেই ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীর শুভাগমনের আনন্দপূর্ণ আলোচনা ছিল এবং রয়েছে। পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, পূর্বেকার নবী-রাসূলগণের শরিয়তে ভবিষ্যৎকাল জ্ঞাপন ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয়েছে অর্থাৎ এ রকম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী দুনিয়ায় শুভাগমন করবেন এখন অতীতকাল জ্ঞাপন ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়। যেহেতু মিলাদুন্নবী [ﷺ]-এর উৎপত্তি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাজার হাজার যুগ পূর্বেই সকল নবী ও রাসূলগণের রূহ মোবারককে একত্রিত করে করেছেন। যেমন পবিত্র ক্বোরআনুল করীমে আহকামূল হাকেমীন আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু সূরা আলে ইমরানের ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন-
[ واذاخذ الله ميثاق النبيين لما اتيتكم من كتاب وحكمة ثم جائكم رسول مصدق لما معكم لتومنن به ولتنصرنه ط قال أقررتم واذخذتم على ذالكم اصرى ط قالوا أقررنا قال فاشهدوا وانا معكم من الشهدين- فمن تولى بعد ذالك فاولئك هم الفسقون-]
অর্থাৎ এবং হে আমার প্রিয় হাবীব! [ﷺ] আপনি স্বরণ করুন, যখন আল্লাহ্ তা’আলা নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গিকার নিয়েছিলেন, আমি যদি তোমাদেরকে আসমানী কিতাব ও হিকমত প্রদান করি, অতপর যদি তাশরীফ নিয়ে আসেন তোমাদের নিকট আমার সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরু দায়িত্ব তথা অঙ্গিকার গ্রহণ করলে? নবীগণ সবাই আরজ করলেন, ‘আমরা স্বীকার করলাম। এরশাদ করলেন- তোমরা একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও। আমি (আল্লাহ) নিজেও তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলাম। সুতরাং যে কেউ এরপর (এ অঙ্গিকার হতে) ফিরে যাবে, তবে তারা ফাসিক।
এ আয়াতে পাক থেকে তিনটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়-প্রথমত হুযূর করীম [ﷺ]-এর শুভামনের তথা মিলাদুন্নবীর আলোচনা স্বয়ং মহা রাব্বুল আলামীন করেছেন। দ্বিতীয়ত রাব্বুল আলামীন বরকতময় কাজের সূচনাও মহা বরকতময় সত্তাগণকে সাথে নিয়ে করেছেন এবং তৃতীয়ত উক্ত আয়াতে সম্মানিত নবী ও রাসূলগণ হতে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে ফলে তাঁদের উম্মতদেরকেও এ উত্তম কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
[তাফসীরে নুরুল ইরফান কৃত: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহ.]
এভাবে অনেক আয়াতে পাকে ঈদে মিলাদুন্নবীর [ﷺ]’র উৎস ও নির্দেশ খুজে পাওয়া যায়। নমুনা স্বরূপ কিছু আয়াতে করীমা সূরার নাম ও আয়াত নম্বরসহ তুলে ধরা হল। যথা:
ক. সূরা মায়েদার ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-
[ قد جاء كم من الله نور ]
অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে মহা নূর তথা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল শুভাগমন করেছেন।
খ. সূরা আলে ইমরান ১৬৪ নম্বর আয়াত-
[ لقد منَّ الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم يتلوا عليهم اياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وان كانوا من قبل لفى ضلال مبين-]
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনগণের উপর বড় দয়া করেছেন যেহেতু তাদের মধ্যে তাঁদের তথা বনি আদম হতে মহান রাসূল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন তাদেরকে পুতঃপবিত্র করবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করবেন যদিও তারা তার আগমনের পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।
গ. সূরা নিসার ১৭০ নম্বর আয়াতে এরশাদ হচ্ছে-
[ يا ايهاالناس قد جاءكم الرسول بالحق من ربّكم فامنوا خيرا لكم الاية-]
অর্থাৎ হে লোক সকল! তোমাদের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ মহান রাসূল শুভাগমন করেছেন তোমাদের রবের পক্ষ হতে সত্য নিয়ে, সুতরাং তোমরা তাঁর উপর ঈমান গ্রহণ কর, এটা তোমাদের জন্য অনেক উত্তম ও কল্যাণকর।
ঘ. সূরা নিসা ১৭৪ নম্বর আয়াত আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন-
[ يا ايها الناس قدجاءكم برهان من ربكم- الخ]
অর্থাৎ হে লোক সকল! তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ হতে অকাট্য দলিল (হুযূর পুরনূর ﷺ) আগমন করেছেন।
ঙ. সূরা তাওবা ১২৮ নম্বর আয়াত-
[ لقد جائكم رسول من انفسكم عزيز عليه ما عنتم حريص عليكم بالمؤمنين رؤف رحيم-]
অর্থাৎ নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদের বংশ হতে মহান রাসূল শুভাগমন করেছেন। তোমাদের কষ্ট তাঁর জন্য অনেক ভারী ও দুঃখ তোমাদের মঙ্গলকামনাকারী ও বড় কাণ্ডারী এবং ঈমানদারগণের জন্য বড়ই দয়াবান।
চ. সূরা আম্বিয়া ১০৭ আয়াত-
[ وما ارسلنك الا رحمة للعلمين-]
অর্থাৎ আমি (আল্লাহ্) আপনাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছি সমগ্র কায়েনাতের জন্য রহমত বানিয়ে (তথা রহমত বিতরণকারী হিসেবে)।
ছ. সূরা আহযাব শরীফের ৪৫ নম্বর আয়াত-
[ يا ايها النبى انا رسلنك شاهدا ومبشرًا ونذيرًا وداعيا الى الله باذنه وسراجا ميرًا-]
অর্থাৎ হে আমার প্রিয় নবী (সরকারে দু’আলম ﷺ) নিশ্চয় আমি আপনাকে (পৃথিবীতে) প্রেরণ করেছি সাক্ষী দাতা তথা হাজির নাজির। জান্নাতের শুভসংবাদ দাতা, জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী। আল্লাহ্ তা’আলার দিকে তার হুকুমে (আল্লাহর বান্দাগণকে) আহ্বানকারী এবং আলোক প্রদীপ হিসেবে।
এ ধরণের অসংখ্য আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন স্বীয় হাবীবে পাক, সাহেবে লাওলাক, সাইয়ারে আফলাক, রাসূলে মুয়াজ্জম, নূরে মুজাস্সাম, রাহমাতুল্লিল আলামীন, খাতামুন্ নবীয়্যীন হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ [ﷺ]- এর ধরাধামে তাশরীফ আওয়ারী তথা শুভাগমনের সুন্দর আলোচনা করে ঈদে মিলাদুন্নবীর শুভ সূচনা করেছেন। সূরা আলে ইমরানে ১০৩ নম্বর আয়াতে করীমায় আরো ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ্ পাকের সে মহান অনুগ্রহ ও নেয়ামতুল্লাহ্ (তথা রাসূলে আকরাম [ﷺ]’কে) স্মরণ কর যা তোমাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা এমন এক সময়ে দান করেছেন, যখন তোমরা পরস্পর শত্র“ ছিলে। তাঁর সে নেয়ামতের বদৌলতে তিনি (আল্লাহ্ তা’আলা) তোমাদের সাথে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। ফলে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ অথচ তোমরা জাহান্নামের গর্তের একেবারে কিনারায় পতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলে। তিনি তাঁর সে নেয়ামতের বদৌলতে তোমাদেরকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দান করেছেন। এভাবেই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হও।’’
আর প্রিয়নবী [ﷺ]-এর শুভাগমন ঈদ তথা খুশী-আনন্দ প্রকাশ করার জন্য মহান আল্লাহ্ পবিত্র ক্বোরআনে সরাসরি নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন-
[ قل بفضل الله وبرحمنه فبذالك فليفرحوا هو خير ممّا يجمعون-]
অর্থাৎ “(হে হাবীব) আপনি আমার বান্দাদের বলুন! আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত প্রাপ্তিতে তারা যেন অবশ্যই আনন্দ-খুশী উদ্যাপন করে। তা তাদের সমস্ত সঞ্চয়কৃত ইবাদত-বন্দেগীও ধন-দৌলত হতে অধিক শ্রেয় ও উত্তম।”
[সূরা ইউনুস: আয়াত ৫৮]
উক্ত আয়াতে করীমায় ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) সহ অনেক তাফসীর বিশারদগণ আল্লাহর রহমত হতে রাহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলে আনোয়ার [ﷺ] মুরাদ নিয়েছেন।
[তাফসীরে দূররে মনসূর]
সুতরাং উক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ্ পাক তাঁর অনুগ্রহ ও দয়ার মূর্তিপ্রতিক প্রিয় রাসূলের শুভাগমনে খুশী তথা আনন্দ উদযাপনের নির্দেশ দিয়ে মূলত মিলাদ ও ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] পালন করার নির্দেশ দান করেছেন মুমিন মুসলমানদের প্রতি। বলা বাহুল্য, ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপন স্বয়ং আল্লাহরই নির্দেশ এবং ক্বোরআনই এর প্রকৃত উৎস তথা ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপন করা মূলত সুন্নাতে ইলাহী। আর মুমিন মুসলমানরা তারই নির্দেশ ও সুন্নাতে ইলাহী পালন করছে মাত্র। তদ্রুপ নূরানী জগতের ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে প্রিয় নবী [ﷺ]-এর মিলাদ তথা মক্কা নগরীতে মা-আমেনার ঘরে শুভাগমনের মুহূর্তে জুলুস সহকারে হামদ-সালাম, তাকবির-তাসবীহ এবং অনেক শান মানের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপন করেছেন। যুগেযুগে সম্মানিত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং হক্কানী ইমাম ও অলি-আবদালগণ বৈধ পন্থায় পবিত্র গম্ভীর পরিবেশে বিশেষত প্রিয় রাসূলের শুভাগমনের মাস রবিউল আউয়াল শরীফে ক্বোরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত, জিকির-আজকার, বয়ান-তাফসীর, দরূদ-সালাম পাঠ, জশনে জুলুস, দান খায়রাত, দোয়া-মুনাজাত ও খানা-পিনা তথা তবারুক বিতরণের মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপন করেছেন মর্মে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছেন।
বিশ্বখ্যাত তাফসীর, হাদীস ও ফিকহের জলিলুল কদর ইমামগণ ও ইসলামী স্কলারগণ তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিশ্বে ও আশেকানে মোস্তফা তথা সুন্নি মুসলমানগণ উক্ত ইমাম ও অলিগণের অনুসরণে বিশেষত মাহে রবিউল আউয়ালে ভাব-গম্ভীর পরিবেশে নেহায়ত আদব ও ইহতেরামের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ]-এর উদ্যাপনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছেন ও শান্তি-রহমত বরকত কামনা করে দোয়া-মুনাজাতের ব্যবস্থা করছেন। এ বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য ও কটূক্তি কোন ঈমানদার করতে পারে না তবে মুনাফিক, নাস্তিক ও খোদাদ্রোহী ও নবীদ্রোহী তথা ইসলামের দুশমনরাই একমাত্র ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে পারে।
[আল্ মাওয়াহেবুল লাদুনিয়া কৃত: ইমাম আহমদ কস্তালানী রহ., আন নেমতুল কোবরা আলাল আলম কৃত: ইমাম ইবনে হাজর মক্কী রহ., আল্ হাবীলিল্ ফতোয়া কৃত: ইমাম জালাল উদ্দীন সুযূতী রহ., মা’ছাবাতা বিস্সুন্নাহ্ কৃত: শেখ আবদুল হক দেহলভী রহ., মাসিক তরজুমানে আহলে সুন্নাত বিগত রবিউল আউয়াল সংখ্যা, বাগে খলিল ১ম খণ্ড ও যুগজিজ্ঞাসা ইত্যাদি]
।।।
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান আলকাদেরী
প্রধান ফকিহ্-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।
মাসিক তরজুমান-Monthly Tarjuman (প্রশ্ন-উত্তর বিভাগ)
প্রকাশনায় : আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট
৩২১ দিদার মার্কেট, দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম।