নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র আঙুল থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়া তাঁর মশহুর মোজেজাগুলোর মধ্যে অন্যতম মোজেজা, যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বহু লোকের সামনে সংঘটিত হয়েছিলো। এই ঘটনার বর্ণনা এতো বেশী সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, একে অকাট্য বলে মানতেই হয়। হাতের আঙুল থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়ার মোাজেজা অন্য কোনো নবীর মাধ্যমে হয়েছে বলে শোনা যায় না।
হজরত মুসা (عليه السلام) হাতের লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত করার কারণে পাথর ফেটে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হয়েছিলো। কিন্তু আঙুল থেকে পানি প্রবাহিত হওয়া, পাথর থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ ও বিস্ময়কর। কেনোনা পাথর থেকে পানি বের হওয়া কিছুটা স্বাভাবিকতার অন্তর্ভূত। কিন্তু গোশত এবং হাড় থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। নিঃসন্দেহে উপরোক্ত হাদীছ সাহাবা কেরামের বড় বড় জামাত বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে হজরত আনাস (رضي الله عنه), হজরত জাবের (رضي الله عنه) এবং হজরত ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) এর বর্ণনাও রয়েছে।
হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর হাদীছ বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা বর্ণনা করেন, আমি একদা নবী করীম (ﷺ) কে দেখলাম। তখন ছিলো আসরের ওয়াক্ত। লোকেরা চতুর্দিকে পানির সন্ধান করছিলো। কিন্তু কোথাও পানি পাওয়া যাচ্ছিলো না। রসুলেপাক (ﷺ) এর জন্য একটি পাত্রে করে কিছু পানি আনা হলো। তিনি তাঁর পবিত্র হাত পানির পাত্রের ভিতর রাখলেন এবং মানুষকে হুকুমকরলেন, পাত্র থেকে অজু করো। আমি লক্ষ্য করলাম, রসুলেপাক (ﷺ) এর অঙ্গুলির মাঝখান থেকে ফোয়ারার মতো পানি ঝরছে।
এক বর্ণনায় আছে, আঙুল এবং তার জোড়া থেকে পানি প্রবাহিত হয়েছিলো। সমস্ত মানুষই ওই পানিতে অজু সমাধা করেছিলো। হজরত আনাস (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, কতজন ছিলেন? তিনি বললেন, আমরা তিনশ’। ইবনে শাহীনের হাদীছে হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমরা তবুকের যুদ্ধে রসুলেপাক (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। মুসলমানগণ নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা এবং আমাদের উটেরা সকলেই তৃষ্ণার্ত। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, অল্প কিছু পানি নিয়ে এসো। তাঁরা বিভিন্নমশক থেকে নিংড়িয়ে কয়েক অঞ্জলি পানি একত্রিত করে রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকটে আনলেন। তিনি বললেন, পানি বরতনে ঢেলে দাও। এরপর তিনি তাঁর পবিত্র হাত পানিতে চুবিয়ে দিলেন। হজরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, আমি দেখতে পেলাম, রসুলেপাক (ﷺ) এর আঙুল থেকে পানি ছিটকে পড়ছে। আমরা আমাদের উট ও অন্যান্য পশুকে সেই পানি পান করালাম। আর অবশিষ্ট পানি নিজেদের মশকের মধ্যে ভরে নিলাম।
বায়হাকী হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) কূপের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে এক ব্যক্তি তার ঘর থেকে একটি ছোট্ট পেয়ালা নিয়ে এলো। রসুলেপাক (ﷺ) উক্ত পেয়ালায় হাত রাখলেন। পেয়ালার মধ্যে হাত ঢুকছিলো না। পাত্রটি ছিলো ছোট। মাত্র চারখানা আঙুল পেয়ালার মধ্যে গেলো। কনিষ্ঠাঙ্গুলি রয়ে গেলো বাইরে। দেখা গেলো, আঙুল থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত জাবের (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুদাইবিয়ার দিন আমরা সকলেই তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লাম। রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে একটি মশক। মশকের পানি দিয়ে তিনি অজু করছিলেন। সাহাবা কেরাম রসুল (ﷺ) এর চারিদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি (ﷺ) বললেন, ব্যাপার কী? তোমরা এভাবে দাঁড়িয়েছো কেনো?
সাহাবাগণ নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমাদের কাছে অজু করা বা পান করার মতো পানি নেই।
রসুলেপাক (ﷺ) একথা শুনে তাঁর হাত মোবারক মশকের ভিতর ঢুকিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঝর্ণার মতো পানি বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। আমরা পান করলাম। অজুও করলাম। হজরত জাবের (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনারা কতোজন ছিলেন? তিনি বললেন, আমরা একলাখ হলেও আমাদের জন্য সেই পানি যথেষ্ট হতো। তবে আমাদের লোকসংখ্যা ছিলো দেড় হাজার। সহীহ্ মুসলিম শরীফে হজরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, আমরা বওয়াতের যুদ্ধে ছিলাম। তখন আমাদের মশকে ছিলো সামান্য কয়েক ফোঁটা পানি। সেটুকু নিংড়িয়ে একটি পেয়ালার মধ্যে জমা করা হলো। রসুল (ﷺ) তাঁর আঙুলসমূহ পেয়ালায় রেখে দিলেন। দেখা গেলো, আঙুলের মাঝখান দিয়ে পানি উছলে বেরিয়ে আসছে। অতঃপর রসুল (ﷺ) লোকদেরকে পানি পান করতে বললেন। সকলেই খুব তৃপ্তির সাথে পানি পান করলো। শেষে যখন রসুল (ﷺ) তাঁরহাত মোবারক পেয়ালা থেকে বের করলেন, দেখা গেলো, পেয়ালাটি তখনো পানিতে ভরপুর। এই হাদীছখানা ইমাম আহমদ, বায়হাকী এবং ইবনে শাহীন হজরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।
হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, আমরা একবার নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। আমাদের কাছে পানি ছিলো না। রসুল (ﷺ) বললেন, কারও কাছ থেকে কিছু পানি নিয়ে এসো। আমরা কিছু পানি নিয়ে রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে এলাম। পানিটুকু তিনি একটি বরতনে রাখলেন এবং নিজের হস্ত মোবারক সেই পানিতে ডোবালেন। এই হাদীছসমূহ বিভিন্ন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন সবাই। নতুবা প্রতিবাদ হতো, যা ছিলো সাহাবা কেরামের সাধারণ অভ্যাস।
বিধান এই যে, খবরে ওয়াহেদ (একক বর্ণনা) যদি সাহাবা কেরামের জামাতের সামনে বর্ণনা করা হয়, আর তাঁরা চুপ থাকেন, তখন সকলেই উক্ত খবরে ওয়াহেদের বর্ণনাকারী হয়ে যান। নবী করীম (ﷺ) এর অঙ্গুলি মোবারক থেকে পানি প্রবাহিত হওয়া সম্পর্কে হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকেও হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। হাদীছগুলো শোনার পর একটি প্রশ্নের অবতারণা হয় যে, প্রথমে পেয়ালায় পানি সঞ্চিত করে তারপর সেখানে হাত মোবারক প্রবেশ করানোর মাহাত্ম্য কী? প্রথমেই তো পানি প্রবাহিত করাতে পারতেন। এই প্রশ্নের জবাবে উলামা কেরাম বলেন, এক্ষেত্রে নবী করীম (ﷺ) আল্লাহ্তায়ালার দরবারের আদব রক্ষা করেছেন। কেনোনা কেবল আল্লাহ্তায়ালাই অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে কোনোকিছুকে অস্তিত্ববান করেন। এই অলৌকিকত্বে আল্লাহ্তায়ালার সমতুল্য কেউ নয়। রসুলেপাক (ﷺ) এর হাত ছিলো কয়েকফোঁটা পানিতে সিক্ত। সেই পানিটুকুর স্রষ্টা আল্লাহ্তায়ালা। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ্তায়ালার সৃষ্টিক্ষমতাই ছিলো রসুলেপাক (ﷺ) এর অবলম্বন। তার সঙ্গে ছিলো প্রার্থনা, যার বরকতে সংঘটিত হয়েছে মোজেজা।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]