পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর সৃষ্টির চৌদ্দ হাজার বৎসর পূর্বে, (পৃথিবীর হিসাবে পাঁচশত এগার কোটি বৎসর) নবী করিম [ﷺ] নূর হিসেবে আল্লাহর সান্নিধ্যে বিদ্যমান ছিলেন। তারপর হযরত আদম (عليه السلام)-এর সাথে সেই নূর পৃথিবীতে আগমন করেন এবং হযরত শিষ, হযরত ইদ্রিস, হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল (عليهم السلام) প্রমূখ পয়গাম্বর ও নেককারগণের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হতে হতে অবশেষে হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه)-এর ললাটে স্থান লাভ করেন। হযরত ইসমাইল ও হযরত আব্দুল্লাহ ছিলেন যবীহুল্লাহ। নবী করিম [ﷺ] স্বয়ং শুকরিয়া আদায় করে বলতেন- “আমি দুই যবীহুল্লাহর সন্তান।”
হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه)-এঁর বয়স যখন চব্বিশ বৎসর, তখন পিতা তাঁকে বিবাহ করানোর উদ্দেশ্যে পাত্রীর অনুসন্ধানে বের হন। পথিমধ্যে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল-এর বোন ফাতেমা ওরফে উম্মে কিতাল হযরত আব্দুল্লাহ’র ললাটে নূর লক্ষ্য করে স্বেচ্ছায় বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ পিতার সম্মানে ঐ প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
ঐ দিনই মদিনাবাসী এবং মক্কায় প্রবাসী ওহাব ইবনে আবদে মুনাফ-এঁর ভাগ্যবতী কন্যা বিবি আমেনার সাথে হযরত আব্দুল্লাহর বিবাহ সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য যে, মদিনার বনী আদি বংশের জাহরা গোত্রে আব্দুল মোত্তালেবও বিবাহ করেছিলেন এবং সেই ঘরে আবু তালেব, হযরত হামজা, হযরত আব্বাছ ও নবী করিম [ﷺ]-এঁর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। সেই গোত্রেরই কন্যা ছিলেন বিবি আমেনা (رضي الله عنها)। সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ও নবী করিম [ﷺ] উভয়েরই মাতুলালয় ছিল মদিনা।
রজব মাসের প্রারম্ভে এই শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং ঐ দিনেই মিনার নিকটে শিয়াবে আবি-তালেব নামক স্থানে স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাৎ হয়। ঐ দিনেই হযরত আব্দুল্লাহর (رضي الله عنه) ললাট মোবারক হতে নবুয়তের পবিত্র নূর মা আমেনার (رضي الله عنها) গর্ভ মোবারকে সরাসরি স্থানান্তরিত হয় (মাওয়াহেব ও বেদায়া-নেহায়া)। পহেলা রজব শুক্রবার রাতে নবী করিম [ﷺ]-এঁর পবিত্র নূর (মাটি নয়) মায়ের রেহেমে স্থানলাভ করেন বলে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া ও আনওয়ারে মুহাম্মদীয়া গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। ইবনে ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বিবি আমেনা (رضي الله عنها)-এঁর সুত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঐ রাত্রেই বিবি আমেনাকে স্বপ্নযোগে জানিয়ে দেয়া হয় – “তুমি এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানবকে ধারণ করেছো। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর নাম রাখবে মুহাম্মদ [ﷺ] বা বারংবার প্রশংসিত।”
হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) রেওয়ায়াত করেন যে, “ঐ রাত্রেই কোরেশদের গৃহপালিত পশুগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, আজ সমগ্র পৃথিবীর চেরাগ, আল্লাহর প্রিয় রাসুল [ﷺ] মাতৃগর্ভে এসেছেন। আল্লাহর কুদরতে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে একটি নৈসর্গিক আনন্দের ঢেউ খেলে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন খুশী হতে পারেনি অভিশপ্ত শয়তান।” (আনওয়ারে মুহাম্মদীয়া)।
আজও মানবরূপী কিছু শয়তান মীলাদুন্নবীর শুভদিনে খুশী হতে পারে না। তারা এই আনন্দময় দিবসে মীলাদুন্নবীর বিরুদ্ধে নব-আবিষ্কৃত সিরাতুন্নবী নামে লোক দেখানো পৃথক মাহফিল করে, মীলাদুন্নবীর তাৎপর্য্যপূর্ণ ঘটনাবলীর সমালোচনা করে এবং মীলাদুন্নবী [ﷺ] মাহফিল ও অনুষ্ঠানকে বিদ’আত বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। অথচ মীলাদুন্নবীর প্রথা সুন্নাতসম্মত একটি প্রথা। এই প্রথাকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে একটি ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে পক্ষকালব্যাপী সিরাতুন্নবী নামে অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। ইসলামী ফাউন্ডেশনের জেলা অফিসগুলোকেও সরকারী মীলাদুন্নবীর পরিবর্তে সিরাতুন্নবী অনুষ্ঠান পালন করতে বাধ্য করা হয়। এভাবে তারা বাংলাদেশে একটি ওহাবী নেটওয়ার্কের অধীন কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এই গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রত্যেক মু’মিন মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহর শোকর – আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের আন্দোলনের ফলে ১৯৯৭ ইং হতে ঈদে মীলাদুন্নবী চালু হয়েছে এবং এখনও (২০০৭ইং) চালু আছে।
বিবি আমেনা (رضي الله عنها)-এর সাথে পরিণয়ের পরদিন হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনকালে পথে ফাতেমা ওরফে উম্মে কিতালের সাথে সাক্ষাত হয়। এবার মহিলা হযরত আব্দুল্লাহকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে সে জবাবে বলে –
قد فارقك النور الذي كان معك بالأمس، فليس لي بك اليوم حاجة -نما أردت أن يكون النور فى فأبى الله (مواهب)
অর্থঃ- “গতকাল তোমার ললাটে যে নূর ছিল, আজ সে নূর তোমার থেকে বিদায় নিয়েছে। সুতরাং আজ তোমাকে আমার আর কোন প্রয়োজন নেই। আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল সেই নূর আমার মধ্যে স্থানান্তরিত হোক। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না, তাই তিনি অন্যত্র স্থানান্তরিত করেছেন।” (মাওয়াহেবে লাদুনিয়া)।
একজন সাধারণ মহিলা হয়েও উম্মে কিতাল নবী করিম [ﷺ]-কে নূর হিসেবে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হলো। কিন্তু হতভাগা ওহাবীরা তাঁকে প্রত্যক্ষ করল মাটির মানুষ হিসেবে। আব্দুল কাহ্হার সিদ্দিকী নামে আওর মোহাম্মদীয়া বাতিল তরিকার জনৈক পীর তার অসিয়ত ও নছিয়ত নামায় নবী করিম [ﷺ]-কে সাধারণ মানুষ প্রমাণ করার জন্য লিখেছে “নবী পাক [ﷺ] পিতার নাপাকী থেকে মায়ের নাপাকীর সাথে মিশে আবার নাপাক জায়গার ভিতর দিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন।” নাউযুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ!
এমন অশালীন ও অসভ্য উক্তি একজন অমুসলিমও কোনদিন করে নি। আল্লাহ এসব দুষমনে রাসুলের সংশ্রব থেকে মুসলমানদের রক্ষা করুন। উক্ত অর্বাচীন পীর নবী করিম [ﷺ]-কে মাটির মানুষ বলেও উল্লেখ করেছে। আমি ১৯৯৫ ইংরেজিতে দৈনিক ইনকিলাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, কিন্তু সে তাতে আসেনি।
পিতার ইন্তিকাল:
হযরত বিবি আমেনা (رضي الله عنها) নূরনবীকে গর্ভে ধারণ করার দুই মাস পরেই হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া গমন করে সেখান হতে ফেরার পথে মদিনায় মাতুলালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই ইনতিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! তাঁকে “দারুন নাবেগা” নামক মহল্লায় (বর্তমান মসজিদে নববীর ভিতরে) দাফন করা হয় (বেদায়া)। এভাবে শিশুনবী [ﷺ] জন্মের পূর্বেই ইয়াতিমে পরিণত হন। গর্ভের প্রায় নয় মাস অতিক্রান্ত হবার পর রবিউল আউয়াল মাসের দ্বাদশ তারিখ সোমবার সোবহে সাদেকের সময় দিবা-রাত্রির সন্ধিক্ষণে জগতকে আলোকিত করে ধরাধামে শুভাগমন করেন আল্লাহর প্রিয় হাবীব শেষনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
বেলাদতের তারিখ ও দিনের সমাধানঃ
আজকাল এক শ্রেণীর লোক বলে বেড়ায় নবী করিম [ﷺ]-এঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নাকি মতভেদ রয়েছে। সুতরাং ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখটি যে ঠিক – তা কী করে বলা যাবে?
এর জবাবে আমরা বলবো – যদি সহীহ বর্ণনায় এই তারিখটি সুপ্রমাণিত হয়, তাহলে কি তারা এই দিনটি মীলাদুন্নবী দিবস হিসেবে পালন করতে রাজী আছেন? না, তা কখনও আশা করা যায় না। আপনারা দিবস পালন করুন আর নাই করুন, নবী করিম [ﷺ] যে এই তারিখেই জন্ম গ্রহণ করেছেন – তার অকাট্য প্রমাণ নিন।
আপনাদেরই গুরু ইবনে কাছির তার বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থের ২য় খন্ডের ২৬০ পৃষ্ঠায় (পুরাতন) এবং হাফেয আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ (ওফাত ২৫৩ হি:) সহীহ সনদে হযরত জাবের ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে আফফান ও সায়ীদ ইবনে মীনা’র সহীহ সনদ সূত্রে হুযুর আকরাম [ﷺ]-এঁর জন্মতারিখ ও ইনতিকাল তারিখ সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখিত হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন-
عن عفان عن سعيد بن ميناء عن جابر وابن عباس أنهما قالا: ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم عام الفيل يوم الاثنين الثاني عشر من شهر ربيع الأول، وفيه بعث، وفيه عرج به إلى السماء، وفيه هاجر، وفيه مات -ماذا هو المشهور (البداية والنهاية ج ٢ صفت ٠ ٢٦)
অর্থঃ- “হযরত আফফান থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত সায়ীদ ইবনে মীনা থেকে, তিনি হযরত জাবের (رضي الله عنه) ও হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। জাবের ও ইবনে আব্বাস (رضي الله عنهما) বলেন- “নবী করিম [ﷺ] হস্তীবাহিনী বর্ষে সোমবার দিনে ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন, এই দিনেই তিনি নবুয়তের দায়িত্ব পেয়েছেন, এই দিনেই তিনি হিজরত করেছেন এবং এই দিনেই ওফাত পেয়েছেন।” ইবনে কাছির বলেন – “এটাই প্রসিদ্ধ ও মশহুর মত”(বেদায়া ও নেহায়া ২য় খন্ড ২৬০ পৃষ্ঠা)।
সুতরাং তাদের নেতার কথা মান্য করা তাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।