প্রসঙ্গঃ আযরাঈল ও জিবরাঈলের আগমন
আল্লাহর যখন ইচ্ছা হলো নবী করীম [ﷺ]-কে আপন সান্নিধ্যে তুলে নিবেন, তখন হযরত আযরাঈলকে বললেন, “তুমি উত্তম সুরতে আমার প্রিয় হাবীবের খেদমতে হাযির হয়ে প্রথমে আমার সালাম দিয়ে বলবে যে, তুমি তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছো এবং তাঁর অনুমতি পেলেই তাঁর রুহ্ মোবারক কবয করবে।”
হযরত আযরাঈল (عليه السلام) নির্দেশ মোতাবেক উত্তম সুরত ধারণ করে হযরত আয়শার (رضي الله عنه) হুযরার দরজায় এসে দাঁড়ালেন এবং নবীপরিবারবর্গকে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থণা করলেন। এই আওয়াজ হুযুর পাক [ﷺ]-এঁর কর্ণে প্রবেশ করা মাত্র তিনি হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) কে আগন্তুকের পরিচয় জানার জন্য পাঠালেন। হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) ফিরে এসে বললেন- “দরজায় এক ভয়ংকর রূপি ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। নবী করীম [ﷺ] বললেন-
هذا هادم اللذات ـ هذامخمد الصوت ـ هذا ملك الموت
“মা ফাতেমা! ইনি মানুষের সমস্ত স্বাদ, আহলাদ হরণকারী, ইনি মানুষের কণ্ঠরোধকারী ইনি মালাকুল মউত।”
অতপর তিনি আযরাঈল (عليه السلام) কে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। হযরত ফাতিমা (رضي الله عنها) মানুষের বেশে আযরাঈলকে দেখে নিলেন। এরপর অদৃশ্যভাবে আযরাঈল (عليه السلام) ভিতরে এসে নবী করীম [ﷺ]-কে সালাম দিলেন এবং বললেন-
“আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতিত যেন আপনার রূহ মোবারক কবজ না করি। একথা শুনে হুযুর [ﷺ] বললেন – তুমি বস, আমার ভাই জিবরাঈল আসুক। আযরাঈল বসে রইলেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) এসে বললেনঃ-
“আল বেদয়া; ইয়া রাসূলাল্লাহ! বিচ্ছেদের সময় সমাগত প্রস্থানের সময় নিকটবর্তী, আপনার প্রভু আপনার দীদারে অপেক্ষমান।” নবী করীম [ﷺ] বললেন- “হে ভাই জিবরাঈল! আযরাঈল আমার রূহ কবজ করার অনুমতি চাচ্ছে। আমি ২৩ বছর যাবত আমার উম্মতের দেখাশুনা করেছি এবং তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিয়েছি। আমার পর উম্মতের জিম্মাদার কে হবেন?” এ কথা শুনে জিবরাঈল (عليه السلام) অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আবার মূহুর্তের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে বললেন – “আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়ে বলেছেন, আপনার পর তিনিই আপনার উম্মতের জিম্মাদার হবেন। কোরআন মজিদে তো আল্লাহপাক আপনাকে রাযী ও সন্তুষ্টু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন (সুরা দোহা!) অতএব আপনি সন্তুষ্টু চিত্তে রাজী হন।”
এসময় নবীজীর সম্মানে ইসমাঈল ফেরেশতা এক হাজার কোটি ফেরেশতা নিয়ে হাযির হলেন (বায়হাকী)। অতপর নবী করীম [ﷺ] আযরাঈল (عليه السلام) কে রূহ কবজ করার অনুমতি প্রদান করলেন। যখন ইনতেকাল-ক্রিয়া শুরু হয়, তখন নবী করীম [ﷺ] আযরাঈল (عليه السلام) কে বললেন, “আর একটু সহজভাবে জান কবজ করো।” আযরাঈল (عليه السلام) বললেন- আল্লাহর সমস্ত প্রাণীকূলের মধ্যে আপনার রূহ মোবারকই সবচেয়ে সহজভাবে কবজ করার জন্য আমি নির্দেশ পেয়েছি। নবী করীম [ﷺ] উম্মতের মৃত্যুর কষ্ট স্মরণ করে বলে উঠলেন – তাহলে আমার উম্মতের মউতের সমস্ত কষ্টই আমাকে দিয়ে দাও।”
একথা বলেই নবী করীম [ﷺ] মেসওয়াক করা অবস্থায় বিবি আয়শা (رضي الله عنها)-এর বুকে মাথা মোবারক এলিয়ে দিয়ে উচ্চারণ করলেনঃ-
“আল্লাহুম্মা বির রাফীক্বিল আ’লা” – “আমার প্রিয়তম বন্ধুর সান্নিধ্যে – হে আল্লাহ!” এ কথা বলেই তাঁর পবিত্র রূহ আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন এবং তিনি বেছাল প্রাপ্ত হন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এদিকে চাশতের নামাযের সময় দুপুরের পূর্বেই নবী করীম [ﷺ] শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং রফীকে আ’লার সাথে মিলিত হন।
সালেম ইবনে ওবায়েদ (رضي الله عنه) নামে জনৈক সাহাবী নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইনতেকালের সংবাদ নিয়ে সানাহ গমন করেন এবং হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-কে সংবাদ দেন। সংবাদ পেয়ে তিনি ছূটে আসেন এবং হুযরায় প্রবেশ করে নবী করীম [ﷺ]-এঁর চেহারা মোবারকের কাপড় সরিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি তিনবার হুযুরের ললাটে চুম্বন করেন (বেদায়া-নেহায়া)।
[আল্লাহপাক এরশাদ করেন- “তোমরা শহিদগণকে মুখে মৃত বলোনা। অথবা তাদেরকে মৃত বলে অন্তরে ধারণাও করোনা। বরং তাঁরা জীবিত কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারোনা” (সুরা বাকারা ও সুরা আলে-ইমরান)। বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শহীদগণের মর্যাদা তৃত্বীয় স্তরের। দ্বিতীয় স্তর ছিদ্দিকগণের এবং প্রথম স্তর হচ্ছে আম্বিয়ায় কেরামের। তাছাড়া পূর্বেই দলীলসহ উল্লেখ করা হয়েছে যে তাঁর মৃত্যুর খয়বরের ইহুদী রমণীর দেয়া বিষের বিষক্রিয়া হয়েছিলো। ফলে তিনি শাহাদাতের উপর ইনতিকাল করেন। তাহলে তাঁদের জীবিত থাকার বিষয়টি প্রশ্নাতীত ব্যপার। শহিদগণ শাহাদাতের পর পূনরায় জীবন লাভ করেন। নবীগণও পূনরায় জীবন লাভ করেন। (দেখুন- ইমাম সুবকী (رحمة الله عليه)-এর গ্রন্থ শিফাউস সিকাম”)]
নির্ভরযোগ্য বর্ণনামতে সময়টি ছিলো দ্বি-প্রহরের পূর্বে চাশত-এর নামাযের সময়। দিনটি ছিলো সোমবার। মাস ছিলো-রবিউল আউয়াল। তারিখ ছিলো- প্রসিদ্ধ ও অধিকাংশ বর্ণনাকারীদের মতে -১২ই রবিউল আউয়াল। (বেদায়া ও নেহায়া- ইবনে কাসির ৫ম খন্ড পৃষ্ঠা-২৬৫, ছাপাখানা মাকতাবাতুল মা’রেফ ১৯৮৮ ইং) কাজী আয়ায শিফা শরীফে নবীজীর বৈশিষ্ট অধ্যায়ে বর্ণনা করেন মউত ও মউতের সময়কে নবী করীম [ﷺ]-এঁর এখতিয়ারাধীন করা হয়েছে। অন্য কাউকে এ বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়নি। আল্লাহপাক এরশাদ করেন – হে প্রিয় রাসূল, আপনার ইনতিকাল হবে এক প্রকার (ক্ষনিকের জন্য) এবং অন্যদের মৃতু হবে অন্য প্রকার” (২৩ পারা শেষ আয়াত)।
আল্লামা তাকিউদ্দিন সুবুকী (رحمة الله عليه) “শিফাউস সিকাম” গ্রন্থে বলেন- হুযুর [ﷺ]-এঁর দাফনের পর আল্লাহ তায়ালা তার রূহ মোবারক দেহ মোবারকে ফেরত পাঠিয়ে দেন। তাই তিনি কেয়ামত পর্যন্ত হায়াতুন্নাবী। কাজেই তার মৃত্যু দিবস পালন করা অবৈধ।