মদীনায় উপস্থিতি ও বিদায়ের প্রস্তুতি
মদীনায় ১১ হিজরীর প্রথম দিন ছিল পহেলা মুহররম, রোববার। এদিনে নবী করীম [ﷺ] হজ্ব সমাপন করে মদীনা শরীফ এসে পৌঁছেন। এরপর দুই মাস ১২ দিন অর্থাৎ বাহাত্তর দিন পর ইনতেকাল করেন। বিদায়ী হজ্বের সময়েই নবী করীম [ﷺ] সাহাবায়ে কেরামকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, হয়তো আগামী বৎসর আর তোমাদের সাথে হজ্ব করার সুযোগ পাবোনা। আরাফাত ও মীনাতে খুতবার মধ্যে তিনি এ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আরাফাতে ‘আল ইয়াওমা আকমালতু’ আয়াতটি নাযিল হয়। হযরত ওমর, হযরত আবু বকর ও হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنهم) – প্রমুখ সাহাবায়ে কেরামগণ উক্ত আয়াতে নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিদায়ের প্রচ্ছন্ন আবাস পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন।
মিনায় আইয়ামে তাশরীক (৯-১৩ যিলহজ্ব)-এর মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ ১১ তারিখে পূর্ণ সুরা নাসর নাযিল হয়। কোরআন মাযিদ নাযিলের ধারা এই সুরার দ্বারাই সমাপ্ত হয়। এরপর কোন সুরা বা আয়াত নাযিল হয়নি (ইতকান)। কেউ কেউ বলেন, এরপর একটি মাত্র আয়াত নাযিল হয়েছিলো উক্ত আয়াতটি সুরা বাকারার ২৮১নং আয়াত। ‘ওয়াত্তাক্কু ইয়াওমান……….’। সুরা নাসর নাযিল হওয়ার সাথে সাথে সূক্ষ্মদর্শী সাহাবীগণের বুঝতে আর বাকী রইলো না যে নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ৬৩ বৎসর বয়স এমন কিছু নয়। তবুও আল্লাহর ইচ্ছা – এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ইসলামকে পূর্নাঙ্গ করে দিলেন। ২৩ বৎসরের মধ্যেই তিনি ৩০ পারা কোরআন মজিদ নাযিল সমাপ্ত করে দিলেন।
অন্যান্য নবীগণের নিকট আসমানী কিতাবসমূহ লিখিত আকারে একদিনে নাযিল হয়েছিল। কিন্তু কোরআনই এর ব্যতিক্রম। ২৩ বৎসরে কোরআন মাজিদ নাযিল হয় এবং জিবরাঈল (عليه السلام) পাঠ করে শুনিয়েছেন নবী করীম [ﷺ]-কে। নবী করীম [ﷺ] নিজের জবানে তা পাঠ করে শুনিয়েছেন উম্মতকে। কালাম হলো আল্লাহর, আর জবান হলো রাসূলুল্লাহ [ﷺ] এঁর। রাসূল পাক [ﷺ] এঁর জবানে আল্লাহপাক কালাম করেছেন ২৩ বৎসর পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন তিনি (রসূল) আপন ইচ্ছায় নিজের পক্ষ হতে বানানো কথা বলেন না। বরং যা বলেন, তা ওহী ব্যতিত আর কিছুই নয়। তা তাঁর প্রতি গোপনে অবতীর্ণ হয় (সুরা আন নাজমঃ ৩)। ২৩ বৎসর পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা এভাবে নিজের বাণী আপন হাবিবের পবিত্র জবান দিয়ে প্রকাশ করেছেন। অন্যকোন নবীর মুখে এভাবে আল্লাহ তায়ালা আপন বাণী প্রকাশ করেন নি। এটা নবীজী [ﷺ] এঁর একক বৈশিষ্ট্য। আল্লাহপাক হযরত মূসা (عليه السلام)-এঁর সাথে কথা বলেছেন খেজুর গাছের মাধ্যমে। কিন্তু তৌরত নাযিল করেছেন একত্রে লিখিত আকারে।
অহি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সকলেই বুঝে ফেললেন যে, সময় ঘনিয়ে এসেছে। সকলের মনে এক আশঙ্কা বিরাজ করছিলো। একদিন হযরত ওমর (رضي الله عنه) হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করলেন- আল্লাহ তায়ালা এই সুরায় মহান বিজয়দানের কথা বলেছেন এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণের কথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এরপরই বলেছেন- ‘হে রাসূল! এখন আপনি শুধু আপনার প্রতিপালকের তাসবীহ্ পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করুন। নিশ্চয়ই তিনি তাওবাহ্ ক্ববুল কারী।” এখানে দেখা যাচ্ছে নবী করীম [ﷺ]-এঁর আসল কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু দোয়া ও ইসতেগফার করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ। সুতরাং হুযুর [ﷺ]-এঁর সময় যে শেষ হয়ে আসছে এতেই ষ্পষ্ট বুঝা যায়। ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এঁর এ কথা শুনে হযরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন, আপনি যা বুঝেছেন আমিও তাই অনুমান করছি। তাবরানী শরীফে উল্লেখ আছে- যখন নবী করীম [ﷺ] বিদায় হজ্ব শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তণ করেন তখন একদিন মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে এক ভাষণে আল্লাহর প্রশংসা ও সানা পাঠ করে বললেন “হে লোক সকল! আবু বকর কখনো আমাকে কষ্ট দেয়নি। তোমরা তাঁর একাজের স্বীকৃতি দিও। হে উপস্থিত লোক সকল! আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, যুবায়ের, আবদুর রহমান এবং প্রথম দিকে হিজরতকারীগণের প্রতি আমি সন্তুষ্ট। তোমরা তাঁদের অবদানের প্রতি স্বীকৃতি দিও। হে লোক সকল! তোমরা আমার সাহাবী ও শ্বশুরদ্বয়ের ব্যপারে এবং আমার বন্ধুদের ব্যপারে আমার কথার সম্মান রক্ষা করো। হে লোক সকল! তোমরা মুসলমানের ব্যপারে তোমাদের মুখকে সংযত রাখো। তাদের কেউ মারা গেলে তার সম্পর্কে ভালো বলবে।” (সূত্র : বেদায়া-নেহায়া)
এভাবে তিনি হৃদয় বিদারক ভাষণ দিয়ে পূর্বাভাস দিতে লাগলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শিয়ারা হুযুরের দুই শ্বশুর ও এক জামাতার বিরুদ্ধে গালি-গালাজ ও তাওরিয়া করে থাকে। একারণেই তারা আহলে বাইআতের মোহাব্বাতের দাবীদার হওয়া সত্বেও গোমরা ও পথভ্রষ্ট এবং বাতিল ফেরকার অন্তর্ভুক্ত। শিয়ারা ৫জন ছাড়া সব সাহাবীদের বিরোধী।
হুযুর [ﷺ] আরও বললেন,
حَيَاتِي خَيْرٌ لَكُمْ تُحَدِّثُونَ وَيُحَدَّثُ لَكُمْ، فَإِذَا أَنَا مُتُّ كَانَتْ وَفَاتِي خَيْرًا لَكُمْ، تُعْرَضُ عَلَيَّ أَعْمَالُكُمْ فَإِنْ رَأَيْتُ خَيْرًا حَمِدْتُ اللَّهَ، وَإِنْ رَأَيْتُ غَيْرَ ذَلِكَ اسْتَغْفَرْتُ اللَّهَ لَكُمْ
“আমার হায়াত মউত – উভয়ই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কেননা, আমার জীবদ্দশায় তোমাদের উপর কোন দূর্ঘটনা ঘটলে আমি সাথে সাথেই সমাধান দিয়ে থাকি। আর আমার তিরোধানের পর তোমাদের যাবতীয় আমলনামা আমার দৃষ্টিতে পেশ করা হয়। ভাল দেখলে আল্লাহর প্রশংসা করি, মন্দ দেখলে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করি।” (সূত্র: মুসনাদে বাযযার, হাদীস নং ১৯২৫/ ইবনে সা‘দ, তবাকাতে কুবরা, ২য় খণ্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা/ দাইলামী, ১ম খণ্ড, ১৮৪ পৃষ্ঠা; মওয়াহিব, মাদারিজ, আদিল্লাতু আহলিছ ছুন্নাহ