প্রসঙ্গঃ আরাফাতের খুতবা, আরাফাতের মসজিদে নামিরার স্থানে ও মোযদালিফার মাশআরিল হারাম মসজিদের স্থানে দুই নামায একত্রে আদায়; নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতার পুনঃজীবন লাভ ও ইসলাম গ্রহণ, প্রাসঙ্গিক কথা, ইনতিকালের আগাম সংবাদঃ
মক্কাবাসীগণ পূর্ব হতেই হজ্বের মৌসুমে (শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ্ব) আরাফাত ও মিনায় অবস্থান করতো এবং শেরেকী পন্থায় আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতো। নবী করীম [ﷺ]ও নিয়মিতভাবে ঐ সময় আরাফাত এবং মিনায় যেতেন এবং আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। হিজরতের পূর্বে তিনি মিনায় মদীনাবাসীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিতেন। একাধারে তিন বৎসর তিনি হজ্বের মৌসুমে আগত মদীনাবাসী নারী-পুরুষদের সাথে মিনার আকাবায় মিলিত হয়ে হিজরতের কথা পাকাপোক্ত করেছিলেন। তখন মদীনাবাসী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৯০জন। হিজরতের পর তিনি চারবার ওমরাহ ও একবার হজ্ব আদায় করেন।
প্রথমবার ৬ষ্ঠ হিজরীতে ওমরা করতে এসে হোদায়বিয়া হতে ফেরত যান। এটাও ওমরার মধ্যে গণ্য হয়। পরের বৎসর ৭ম হিজরীতে সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ওমরাতুল ক্বাজা পালন করেন। ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর হোনায়ন ও তায়েফ যুদ্ধ শেষে জি’রান নামক স্থান থেকে এহরাম বেঁধে ওমরা আদায় করেন। ৪র্থ ওমরা আদায় করেন বিদায় হজ্বের সাথে।
দ্বিতীয় ওমরাহ্ আদায় করার সময় (৭ম হিজরী) মক্কা শরীফ কোরাইশদের দখলে ছিল। সেসময় কা’বার ভিতরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। এমতাবস্থায় নবী করীম [ﷺ] সাহাবীদেরকে নিয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেন এবং বাইরে নামায আদায় করেন। এতে সাহাবীগণের মনে খট্কা লাগে। নবী করীম [ﷺ] তাঁদেরকে শান্তনা দিয়ে বললেন, “আমাদের নিয়ত হচ্ছে আল্লাহর ঘরের বাইরে তাওয়াফ করা – ভিতরের মূর্তির তাওয়াফ করা নয়। আল্লাহ নিয়ত অনুযায়ী বরকত দেবেন।” (পেটের ভিতরে পেশাব পায়খানা রেখেও নামায পড়া যায়।)
এতে একটি মাসয়ালা জানা হয়ে গেল যে, কোন পবিত্র স্থানে অপবিত্র কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত হলেও উক্ত পবিত্র স্থানের বৈধ অনুষ্ঠানে যোগদান করা উচিত। যদি ওখানকার অন্যায় কাজ বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তবে একারণে মূল বৈধ কাজ বাদ দেয়া যাবে না। যেমন- কোন মাজারে নারী-পুরুষ একসাথে জেয়ারত করলে অথবা শরীয়ত বিরোধী কোন কার্য-কলাপ সেখানে অনুষ্ঠিত হলে এই অযুহাতে মূল জেয়ারত বন্ধ করা যাবে না। কেননা, জেয়ারত করা সুন্নত। শক্তি থাকলে শরিয়ত বিরোধী কার্য-কলাপ বন্ধ করা ওয়াজিব। নতুবা নিজে নিজে জেয়ারত করে চলে আসবে। (শামী, বাহারে শরীয়ত)।
নবম হিজরীতে নবী করীম [ﷺ] নিজে হজ্ব না করে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-কে আমীর বানিয়ে ৩০০ লোক পাঠিয়ে প্রথম হজ্ব পালন করান। সে বছর মুশরিকরাও তাওয়াফ করতে এসেছিলো। তাই হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এর নেতৃত্বে মুসলমানদের হজ্ব ছিলো মুসলমান ও মুশরীকদের মিশ্রিত হজ্ব। মুশরীকগণ তাদের শেরেকী প্রথা অনুযায়ী হজ্ব বা তাওয়াফ করেছিলো এবং মুসলমানগণ ইসলামী কায়দায় হজ্ব আদায় করেছিলেন। এই বৎসরই ছিলো মুশরীকদের শেষ সুযোগ। হযরত আলী (رضي الله عنه)-কে পাঠিয়ে নবী করীম [ﷺ] আরাফা ও মিনায় আল্লাহর ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করেন এই বলে যে, “১০ম হিজরী থেকে মুশরীকদের জন্য হজ্ব ও ওমরায় আগমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।“ এভাবে মক্কা, আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনাকে মুশরীক মুক্ত করে নবী করীম [ﷺ] ১০ম হিজরীতে নিজে হজ্ব আদায় করার ব্যবস্থা করেন। বিলম্বের এটাই মূল কারণ। সংস্কার কাজ করা যে কত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ – হজ্বের এ ঘটনার মাধ্যমেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিবেশ সৃষ্টি না করে প্রথম থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটি হজ্বের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে দুই বৎসর লেগেছিলো।
হজ্বের প্রস্তুতিঃ
নবী করীম [ﷺ] দশম হিজরীর হজ্ব মৌসুমের পূর্বেই ঘোষণা করে দেন যে, এ বৎসর হজ্ব আদায় করবেন। সাহাবীগণ যেন সমবেতভাবে নবী করীম [ﷺ]-এঁর সাথে হজ্বে গমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। সারা আরবে সাজসাজ রব পরে গেল। আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। সকলের মনে বিগত একুশ বৎসরের জুলুম-অত্যাচার, দেশত্যাগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অবশেষে মক্কা বিজয়, কোরাইশদের চরম পরাজয় ও অপমান সব কিছুর ছবি চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠতে লাগলো। মহানবীর [ﷺ] মহান হজ্ব যেন একই সাথে মহা বিজয়-মিছিলে পরিনত হতে লাগলো। চতুর্দিকে প্রস্তুতির ধূম পরে গেল।
কিন্তু এতসব আনন্দ আয়োজনের মধ্যেও যেন বিদায়ের একটি করূণ সূর বেজে উঠলো। মহানবীর [ﷺ] উপর অর্পিত দায়িত্ব যেন চূড়ান্ত সমাপ্তিপথে দ্রুত এগিয়ে চলছে। হজ্বের প্রস্তুতির সাথে সাথে মহা নবী [ﷺ] মহাপ্রয়াণের প্রস্তুতিও মনে মনে গ্রহণ করতে লাগলেন।
দশম হিজরীর যিলক্বদ মাসের ৫ দিন বাকী থাকতে নবী করীম [ﷺ] এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবীর হজ্ব কাফেলা নিয়ে হজ্বে রওয়ানা দিলেন। এবং যিলহজ্ব মাসের চার তারিখে মক্কা মুয়াযযমায় উপস্থিত হলেন। মক্কা মুয়াযযমা নবী করীম [ﷺ]-এঁর আগমনে যেন পূনঃজীবন লাভ করলো। নবী করীম [ﷺ]-এঁর পদধূলিতে মক্কা ভূমি পুনরায় গৌরবান্বিত হলো। একলক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে মক্কাভূমি জান্নাতে রূপান্তরিত হলো। সে বৎসরই মক্কার হাজুন কবরস্থানটি ‘জান্নাতুল মায়াল্লা’ উপাধীতে ভূষিত হলো। মক্কার এই দৃশ্য কেয়ামত পর্যন্ত দ্বিতীয়বার আর দেখা যাবেনা। এই জান্নাতী দৃশ্য কল্পনা করেই রাসূল-প্রেমিকদের হৃদয় হজ্বে গমনের জন্য আকুল হয়ে উঠে।
মদীনা শরীফের মসজিদে নববীতে জোহর নামায আদায় করে তিনি রওয়ানা দেন এবং যুল-হোলায়ফা নামক স্থানে গিয়ে আসরের নামায দুই রাকাত অর্থাৎ কসর আদায় করেন। সেখান থেকেই তিনি ইহরাম পরিধান করে তালবিয়া বা “লাব্বায়িক” দোয়া পাঠ করেন। মদীনা শরীফের ৬ মাইল দূরে যুল-হোলায়ফা মদীনাবাসীদের ইহরামের মীকাত। মক্কা মোয়াযযমার পথে তিনি ৯ দিন সফর করেন। যেখানে যেখানে তিনি অবতরণ করে নামায আদায় করতেন ঐ স্থানগুলোতে পরবর্তীতে মসজিদ তৈরি হয়। সাহাবাগণের যুগে অবশ্য সব মসজিদ তৈরি হয়নি। তবুও তাঁরা যখনই এই পথে মক্কায় গমনাগমন করতেন তখন ঐ পবিত্র স্থানসমূহে বরকতের আশায় নামায আদায় করতেন এবং নবী করীম [ﷺ]-এঁর স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থান হিসেবে ঐ স্থানের তাযীম করতেন। ইবনে কছির (৭৭৪ হিজরী) তাঁর অমরগ্রন্থ ‘আলবেদায়া ওয়ান নেহায়া’তে এই স্থানগুলোর উল্লেখ করে কোন কোন সাহাবী এসব স্থানে নাময আদায় করতেন- তাদের নামও উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, পরবর্তী যুগের জাহেল ও মূর্খ লোকদের অবহেলায় ঐসব স্থানের অনেক স্মৃতি চিহ্নই বিনষ্ট হয়ে যায়।
[পবিত্র স্থানসমূহ সংরক্ষণের গুরুত্ব
নবী-রাসূল-অলী-আবদাল ও গাউছ-কুতুবগণের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করা ইসলামকে সতেজ রাখার একটি প্রকৃষ্ট উপায়। এটা ইসলামী ঐতিহ্যের প্রমাণ ও প্রতীক। যেখানে মহান সাধকগণের মাযার ও স্মৃতিচিহ্ন বিদ্যমান, সেখানে ইসলামের জোশ ও প্রেরণা উজ্জীবিত। উদাহরণ স্বরূপঃ মদীনা মোনাওয়ারা, বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ, সিরহিন্দ শরীফ, বেরেলী শরীফ, সিলেট, দিল্লী, পাকপত্তন, কালিয়ার শরীফ, কাচওয়াছা ফয়যাবাদ, ছিরিকোট, লাহোর, পানিপথ- ইত্যাদি স্থানের পবিত্র রওযা ও মাযারসমূহ। এসব মাযার ইতিহাসের জ্বলন্ত স্বাক্ষী ও মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতীক। এগুলো হলো প্রেরণার উৎস। মাযার সমূহ ধ্বংস করার অর্থ – গোটা মুসলিম জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা। সৌদী সরকার তাই করেছে, তারা ইসলামী ঐতিহ্য হত্যাকারী।
বর্তমান সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আযিয ১৯২৫-২৬ সালে মক্কা, মদীনা, তায়েফ ইত্যাদি স্থানের সাহাবীগণের, নবী পত্নীগণের ও বিবি ফাতিমার (رضي الله عنهم) মাযারসমূহ ধূলিস্যাত করে দিয়েছে। এতে করে দিনদিন সৌদি আরবের প্রকৃত ইসলামী প্রেরণা হ্রাস পাচ্ছে এবং বেদ্বীন আমেরিকার গোলামে তারা পরিণত হচ্ছে। ওহাবী রাজতন্ত্র যেদিন খতম হবে, সেদিন স্মৃতিচিহ্ন, স্মৃতিসৌধ ও মাযারসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত কিছু কিছু সৌদি ওলামা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন।
মক্কা-মদীনার সুন্নী ওলামাগণ কোনঠাসা অবস্থায় আহাজারী করছেন। সৌদী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৯৯৪ সালে সৌদী সরকার অনেক আলেম-ওলামাকে জেলে পাঠিয়েছে। উলামা ও মসজিদের ইমামগণ দিনদিন সোচ্চার হয়ে উঠছেন। কমিউনিজম শত বৎসরের মাথায় এসে ভেঙ্গে পড়েছে। ওহাবীজমও শত বৎসরের মাথায় এসে ভেঙ্গে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। বর্তমানে (২০০৭) ৮৩ বৎসর চলছে।]
মক্কায় উপস্থিতি ও তাওয়াফ
নবী করীম [ﷺ] যিলহজ্ব চাঁদের ৪ তারিখ রোববার সকালে সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنهم)-দের নিয়ে মক্কা-মোয়াযযমায় প্রবেশ করে খানায়ে কা’বার তাওয়াফ করেন এবং সাফা-মারওয়ার সাঈ সমাপ্ত করেন – যারা প্রথমে শুধু ওমরাহ্ করার নিয়তে এহরাম বেঁধেছিলেন, তাদের এহরাম খুলে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। এটাকে হজ্বে তামাত্তু বলা হয়। ঐ দিনই তিনি মক্কা-মোয়াযযমার পূর্বপ্রান্তে বাত্হা বা আবতাহ নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করতে লাগলেন। এ জন্য হুযুর [ﷺ]-কে আবতাহীও বলা হয়। ৭ তারিখ বুধবার পর্যন্ত তিনি ঐ স্থানেই অবস্থান করেন। এই সময় বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها) ও উম্মুল মোমেনীনগণ হুযুর [ﷺ]-এঁর সাথে ছিলেন।
হযরত আলী (رضي الله عنه) ছিলেন ইয়ামেন দেশে গভর্ণর হিসাবে। নবী করীম [ﷺ]-এঁর নির্দেশে হযরত আলী (رضي الله عنه) ইয়ামেন থেকে এসে তাঁর সাথে আবতাহ নামক স্থানে মিলিত হন। য্বিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখ বৃহস্পতিবার হজ্বের উদ্দেশ্যে তিনি মীনায় গমন করেন এবং যোহর থেকে ৫ ওয়াক্ত নামায সেখানে আদায় করেন।
আরাফায় গমন ও উকুফ পালন, হজ্বের ভাষণ প্রদানঃ
নবী করীম [ﷺ] মক্কার হিসাব মতে ৯ য্বিলহজ্ব শুক্রবার সকাল বেলা মীনা থেকে পূর্ব দিকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সাথে একলক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামও মীনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। লক্ষ কন্ঠের গগণবিদারী লাব্বায়িক ধ্বনীতে দুপাশের পর্বতমালা কেঁপে উঠলো। নবী করীম [ﷺ] আরাফাতে পৌছে মসজিদে নামীরার স্থানে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ (খুতবাহ প্রদান) করেন। উক্ত ভাষণে তিনি ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব, আরব-আজমের ভেদা-ভেদহীন সমাজ ব্যবস্থা, সুদ হারাম, পরস্পর খুন-খারাবীর উপর নিষেধাজ্ঞা, নারীদের ইজ্জত-সম্ভ্রম রক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা – ইত্যাদি বিষয়ে এক নীতি-নির্ধারণী সারগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণকেই হজ্বের খুতবা বা বিদায়ী ভাষণ বলা হয়। যোহর নামাযের পূর্বে এই খুৎবা দেয়া হয়। অতঃপর তিনি জাবালে রহমতের পাদদেশে দোয়া-মোনাজাতে মশগুল হয়ে পড়েন। সেদিন তিনি মুসাফির হিসাবে যোহর ও আসর নামায একসাথে পরপর আদায় করেন, জুমা পড়েন নি। এই ব্যবস্থাকে ‘জময়ে তাকদীম’ বলা হয়। কিয়ামত পর্যন্ত আরাফাতের দিন শুধু মসজিদে নামিরার জমাতে এই নিয়ম চালু থাকবে। কিন্তু তাঁবুতে পড়লে যোহর ও আছর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পড়তে হবে।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই কোরআন মজিদের ঐতিহাসিক আয়াতটি নাযিল হয়। আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াতে এরশাদ করেন-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا
“আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করলাম। আর আমার নেয়ামতও তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে তোমাদের জন্য পছন্দ করলাম” (সূরা মায়েদাহ)। আয়াত হিসাবে এই আয়াতটিই সর্বশেষ নাযিল হয়। এরপর মীনাতে নাযিল হয় সর্বশেষ পরিপূর্ণ সুরা আন-নাসর।
আরাফাতে উক্ত আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে সাহাবীগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দিক, হযরত ওমর ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنهم) নীরবে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা বললেন - এই আয়াতে নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিদায়ের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতও রয়েছে। সুতরাং আমরা নবী করীম [ﷺ]-এঁর বিদায়-আশংকায় কাঁদছি।
উক্ত আয়াতে নবুয়তধারার পরিসমাপ্তি এবং দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা সম্মন্ধে আল্লাহপাক যে শুভ সংবাদ দিয়েছেন- তা কত গুরুত্বপূর্ণ, জনৈক ইয়াহুদী পাদ্রীর উক্তিতে তা পরিষ্ফুট হয়ে উঠেছে।
হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এর খেলাফতকালে উক্ত ইয়াহুদী পাদ্রী তাঁর দরবারে এসে বললো, “হে আমীরুল মো’মেনীন” আপনারা আপনাদের কোরআনে এমন একটি আয়াত পাঠ করেন যদি সেই আয়তটি আমরা ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের উপর অবতীর্ণ হত তাহলে আমরা ঐদিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে পালন করতাম। হযরত ওমর (رضي الله عنه) জিজ্ঞাস করলেন, সেই আয়াতটি কী ? ইয়াহুদী বললো, “আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম…” আয়াতটি। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন, উক্ত আয়াতটি যেদিনে, যে তারিখে ও যে সময় নাযিল হয়েছিলো তা আমার স্পষ্ট স্মরণ আছে। দুই ঈদের দিনে অর্থাৎ আরাফাতের দিনে ও জুমার দিনে, বিকাল বেলায়, নবী করীম [ﷺ]-এঁর উপর উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো। (বুখারীঃ আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৩, ৪২৫১, ৪৬০৬, তাওহিদ ফাঃ ৪৫; মুসলিম ৪৩/১ হাঃ ৩০১৭; মুসলিমঃ ইফাবাঃ ৭২৪৪, ৭২৪৫, ৭২৪৬; তিরমিজি ৩০৪৩, ৪৪০৭, ৪৬০৬, ৭২৬৮) অর্থাৎ হজ্ব ও জুমার দিন আমাদের নিকট ঈদের দিন। পবিত্র তারিখে, পবিত্র দিনে, পবিত্র স্থানে ও পবিত্র ক্ষণেই উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছে।
(বিঃদ্রঃ) কিছু জাহেল লোক বলে, দুই ঈদ ছাড়া শরীয়তে তৃতীয় কোন ঈদ নেই। জানা উচিত জুমা এবং আরাফাতের দিনও ঈদের দিন। এভাবে মীলাদুন্নবীর দিনও ঈদের দিন। ঈদের দিন নয়টি। (১) ঈদে রমাদ্বন (২) ঈদে কোরবান (৩) ঈদে জুমুয়া (৪) ঈদে আরাফাহ (৫) ঈদে লাইলাতুল বারায়াত (৬) ঈদে লাইলাতুল ক্বদর (৭) ঈদে আশুরা (৮) ঈদে নুযুলে মায়েদা (৯) ঈদে মীলাদুন্নবী বা ঈদে ইয়াওমে বেলাদাত (সূত্র: গুনিয়াতুত্বালেবীন, মাওয়াহিব, মাদারিজ-ইত্যাদি)।
মোজদালেফায় রাত্রি যাপনঃ
আরাফাতের ময়দানে নবী করীম [ﷺ] সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করেন। দিনের মধ্যাহ্ন হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে হাজীগণের অবস্থান করাকে ‘উকুফ’ বলা হয়। এই কাজটি হজ্বের ফরয। এই সামান্য সময় অবস্থানের ফলে আল্লাহ তায়ালা জীবনের সমস্ত গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন। সূর্য ডুবে হলুদ রং অপসারিত হওয়ার পর নবী করীম [ﷺ] কাছওয়া নামক উটে আরোহণ করেন এবং পিছনে পালিত পুত্রের সন্তান ওসামা ইবনে জায়েদকে (رضي الله عنه) বসান। এই কাছওয়া উটটি হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) হিযরতের সময় ক্রয় করে নবী করীম [ﷺ]-কে দান করেছিলেন। এই উটে সাওয়ার হয়েই নবী করীম [ﷺ] হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন বলে একটি হাদিস এসেছে। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) কর্তৃক ক্রয়কৃত অন্য উটটির নাম ছিলো – আদবা; এটিতে চড়ে হাশরে যাবেন বিবি ফাতিমা (رضي الله عنها)। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর অবদানকে রাসূলে মকবুল [ﷺ] এভাবেই সম্মানিত করেছেন।
নবী করীম [ﷺ] সকল সাহাবীকে মুজদালীফার দিকে রওয়ানা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং পথিমধ্যে মাগরীব নামায না পড়ার কথা বলে দিলেন। কেননা, আরাফাত ও মুজদালিফার মধ্যখানে আব্রাহার হস্তি বাহিনীর উপর আল্লাহ তায়ালা গজব নাযিল করেছিলেন। মোযদালিফায় এসে নবী করীম [ﷺ] ঐ স্থানে অবস্থান করলেন – যেখানে হযরত আদম (عليه السلام) ও বিবি হাওয়া (عليه السلام) প্রথম বাসর রাত্রি যাপন করেছিলেন – খোলা আকাশের নিচে। এখানে উল্লেখ্য যে, আরাফাহ ও মুযদালিফা এই দুইটি স্থান আদি পিতা-মাতার স্মৃতিবিজড়িত স্থান। হাজীগণ আরাফাত ও মুযদালিফায় গমন করে আদি পিতা-মাতার স্মৃতি স্মরণ করে এবং কিছুক্ষণ পিতৃস্থানে অবস্থান করে। তদ্রূপ মীনা হলো, হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ও হযরত ইসমাঈল (عليه السلام)-এঁর কঠিন পরীক্ষাস্থল। এখানে এসে হাজীগণ আল্লাহার পথে আত্মত্যাগের শিক্ষাগ্রহণ করেন। মূলতঃ পূর্ণহজ্ব ক্রিয়াটিই নবীগণের সম্পাদিত ক্রিয়া-কলাপের অনুষ্ঠান ও অনুকরণ ব্যতিত আর কিছুই নয় – এটাই ইবাদত বলে গণ্য। এখানে তিনি এক আযানেই মাগরিব ও এশার নামায একসাথে পরপর আদায় করেন। এটাকে জময়ে তাখীর বলে। হজ্বের দিন আরাফা ও মুযদালিফা ছাড়া অন্য কোন স্থানে দুই নামায একসাথে পড়ার বিধান নেই। এটাই হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত।
মীনায় গমন ও চারদিন অবস্থান
মোযদালিফায় রাত্রি যাপন করে ৭০টি করে কংকর সংগ্রহ করে ১০ তারিখ প্রত্যুষে ফজর নামায আদায় করে নবী করীম [ﷺ] সাহাবায়ে কেরাম সমবিভ্যাহারে মিনার দিকে রওনা হন। এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গী। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনীত হচ্ছে- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! হে আল্লাহ, আমরা তোমার ডাকে হাজির! কি আবেগময় দৃশ্য! এভাবে কাফেলা মিনায় গিয়ে পৌঁছলো। এ সফরে নবী করীম [ﷺ] উটের পিঠে তুলে নিলেন ফযল ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-কে।
মিনায় পৌঁছেই তিনি জামরাতুল উলা বা বড় শয়তানকে ৭টি কঙ্কর মেরে তাঁবুতে ফিরে আসেন। হযরত ইসমাঈল (عليه السلام) কে যে জায়গায় কোরবানীর জন্য শোয়ানো হয়েছিল – সে স্থানটির নাম মাযবাহ। সেখানে নবী করীম [ﷺ] সাহাবীগণকে নিজেদের কোরবানী করার নির্দেশ দেন। সাহাবীগণ (رضي الله عنه) কোরবানী কাজ সমাধা করে ইহরাম খুলে ফেলেন। হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ও হযরত ইসমাঈল (عليه السلام)-এঁর কোরবানী অনুষ্ঠানের প্রতি তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন, নিজেদের কোরবানী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ঐদিনই তিনি সাহাবীগণসহ মক্কায় গমন করে তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করে পুনঃ মিনায় এসে রাত্রিযাপন করেন। এটাই প্রকৃত সুন্নত। ১১, ১২ ও ১৩ জ্বিলহজ্ব তিনদিন তিনটি জামারায় পাথর নিক্ষেপ করলেন- প্রতিটিতে পর পর ৭টি করে ২১টি। এভাবে ১ম দিনে ৭টি, ২য় দিনে ২১টি, ৩য় দিনে ২১টি এবং ৪র্থ দিনে ২১টি মোট ৭০টি পাথর নিক্ষেপ করলেন শয়তানের উদ্দেশ্যে। কেয়ামত পর্যন্ত এই পাথর নিক্ষেপ একটি ওয়াজিব ইবাদতে পরিণত হয়ে গেল। নবীগণের অনুকরণের নামই ইবাদত। হাজীগণকে ১২ তারিখ পর্যন্ত তিনদিনে ৪৯টি কংকর মারতে হয়। ঐ দিন কোন কারণে সন্ধ্যার পূর্বে মিনা হতে বের হতে না পাড়লে ১৩ তারিখে আবারো ২১টি কংকর মারতে হবে।
মাজবাহে গিয়ে কোরবানীর কাজ শেষ করে মাতা হলক করে ইহরাম খুলে নবী করীম [ﷺ] সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ঐ দিনই ১০ই জিলহজ্ব তারিখে বাইতুল্লাহ যিয়ারত করতে গেলেন এবং তাওয়াফ যিয়ারত শেষে পূণরায় মিনায় ফিরে আসেন। এই তাওয়াফকে তাওয়াফে যিয়ারত বলা হয় এবং এটি হজ্বের শেষ ফরজ। হজ্বের ফরজ তিনটি, যথাঃ- (১) ইহরাম (২) উকুফে আরাফাহ (৩) তাওয়াফে যিয়ারত। নবী করীম [ﷺ] হজ্বের সম্পূর্ণ বিধান নিজের আমলের মাধ্যমে উম্মতের সামনে পেশ করেছেন। এজন্য হজ্ব এত মর্যাদাপূর্ণ।
মিনাতে অবস্থানকালেই সুরা নাছর অবতীর্ণ হয়। এতে নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইন্তেকালের পূর্বাভাস বিদ্যমান। উক্ত সুরা নাযিলের পর মিনার খুতবায় নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেন – “সম্ভবতঃ এ বৎসরের পর তোমাদের সাথে আর হজ্ব করতে পারবোনা।” এখানে পরিষ্কারভাবে নবীজী এঁর ইলমে গায়েবের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৩ই যিলহজ্ব তারিখে ২১টি পাথর নিক্ষেপ শেষে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।
হাজুন কবরস্থানকে জান্নাতুল মায়াল্লা ঘোষণা- নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতার পুনঃজীবন লাভ ও ইসলাম গ্রহণঃ
নবী করীম [ﷺ] হজ্বের এক পর্যায়ে হাজুন নামক কবরস্থানে গমন করেন। এটি মক্কার সর্বসাধারণের কবরস্থান। এখানেই শায়িত আছেন ইসলামের প্রথম পূণ্যবতী মহিলা উম্মুল মো’মেনীন হযরত খাদিজাতুল কোবরা (رضي الله عنها)। তিনি ধন-সম্পদ জীবন-মরণ সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দ্বীনের খেদমত করেছেন। এমন আত্মত্যাগী নারী দ্বিতীয়জন আর নেই। যখন তিনি ইন্তেকাল করেন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বৎসর। তখন নবী করীম [ﷺ]-এঁর বয়স হয়েছিল ৫০ বৎসর। তিন বৎসর নির্বাসন জীবন শেষ করে নবুয়তের দশম সালে সবেমাত্র মুক্ত আলোতে নিঃশ্বাস নিবেন এবং স্বামীর সুখ দুঃখের সঙ্গিনী হবেন- এমন সময়ই তিনি রমযান মাসে ইনতিকাল করলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর চাচা আবু তালেবও এ সময়েই ইন্তিকাল করেন। নবী করীম [ﷺ] সেই বৎসরকে (নবুয়তের দশম সাল) শোকের বৎসর বলে আখ্যায়িত করেন। বিবি খাদিজার (رضي الله عنها) এঁর ইনতিকালের সময় পর্যন্ত জানাযা নামাযের হুকুম নাযিল হয়নি। তাই জানাযার নামাযও হয়নি। নবী করীম [ﷺ] অন্যান্য দোয়া-দরূদ পড়ে বিবি খদিজার (رضي الله عنها) কে কবরে সোপর্দ করেন।
এরপর নবী করীম [ﷺ] তায়েফে গিয়ে অত্যাচারিত হলেন। সর্বশেষ হিজরত করতে বাধ্য হলেন। মদীনার জীবনে চাপিয়ে দেয়া চুয়াত্তরটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। ৮ম হিজরীতে মক্কাভূমি পুনরুদ্ধার হলো। এভাবে ১৩টি বৎসর পার হয়ে গেল। একলক্ষ চব্বিশ হাজার সাহাবী নিয়ে এখন (দশম হিজরী) তিনি হজ্বে আগত। তাঁর অঙ্গুলী হেলনে এখন মক্কা মোয়াযযমা পরিচালিত। কিন্তু সব থাকা সত্বেও যেন অনেক কিছুই নেই। পিতা ইনতিকাল করেন মাতৃগর্ভে থাকতে। মাতা ইনতিকাল করেন ৬ বছরের শিশুকালে। দাফন হলেন মদীনা থেকে মক্কায় আসার পথে আবওয়া নামক স্থানে। পিতার কবর মদীনাতে মাতার কবর মক্কা মদীনার মাঝপথে বিবি খাদিজা শুয়ে আছেন হাজুন গোরস্থানে। একথা স্মরণ করে হুযুরের হৃদয় হাহাকার করে উঠলো।
নবী করীম [ﷺ]-এঁর বর্তমান বিজয়ীবেশ এবং ভক্ত অনুরক্তের এই বিশাল সমাবেশ তাঁরা কেউ দেখে যেতে পারলেন না। সব কিছু পেয়েও যেন তিনি অনেক কিছুই হারিয়েছেন। একে একে সব স্মৃতি নবী করীম [ﷺ]-এঁর স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগলো। তিনি চলে গেলেন প্রিয় সহধর্মীনি বিবি খাদিজা (رضي الله عنها) এঁর মাজার যিয়ারতে হাজুন নামক গোরস্থানে। তার মন আজ ভারাক্রান্ত। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন তাঁর পিতা-মাতা – হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) ও বিবি আমেনা (رضي الله عنها) জীবিত হয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত। এবার আল্লাহ তায়ালা নবীর সম্মানে তাঁর পিতা-মাতাকে জীবিত করে তাঁর সামনে উপস্থিত করে দিলেন। তাঁরা উভয়ই কালেমা শরীফ পাঠ করে মুসলমান সাহাবী হলেন। এবং আল্লাহর নির্দেশে পূনরায় মৃত্যুবরণ করলেন। যদিও তাঁরা পূর্ব হতেই মিল্লাতে ইব্রাহীমের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং মু’মিন হানিফ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তবুও নবীজি [ﷺ] এঁর সম্মানে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে পুনঃজীবিত করে মুসলমান ও সাহাবী হবার সুযোগ করে দিলেন। এখন থেকে তাঁরা সরাসরি মুসলমান ও সাহাবী নামে অভিহিত। হযরত ঈসা (عليه السلام) মৃতকে জীবিত করতেন। এটা নবীদের মো’জেজা। নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাতেও অনেক মৃত ব্যক্তি জীবন লাভ করেছে। যেমন- তাঁর পিতা-মাতা, জাবেরের দুই পুত্র। এক মুহাজীর মহিলার একমাত্র মৃতপুত্র গোসল ও কাফনের পর নবীজি [ﷺ] এঁর দোয়ায় পুনঃজীবন লাভ করেছেন। মহিলার এই পুত্র পরে বিবাহ সাদী করেছেন এবং হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এঁর খেলাফত কালে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। (প্রমাণপঞ্জীঃ ফতোয়ায়ে শামী, হাফেয নাসিরুদ্দীন বাগদাদী, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) বর্ণিত হাদিস, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে নাঈমী, শানে হাবীব, আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের, আল্লামা সোহায়লী প্রভৃতি)।
নবী করীম [ﷺ] হাজুনে গিয়েছিলেন কাঁদতে কাঁদতে কিন্তু প্রত্যাবর্তণ করলেন হাসতে হাসতে। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) বর্ণনা করেন – নবী করীম [ﷺ] আমাকে উটের লাগাম ধরে দাঁড়াতে বলে হাজুনে তাশরীফ নিয়ে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নবী করীম [ﷺ] হাসতে হাসতে প্রত্যাবর্তণ করলেন। আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি পিতা-মাতার জীবিত হয়ে আগমন এবং নূতন করে ইসলাম গ্রহণ ইত্যাদি ঘটনা খুলে বললেন। (বেদায়া ও নেহায়া ৬ষ্ঠ খন্ড, তাফসীরে রুহুল বায়ান ১ম খন্ড- ২১৬ পৃষ্ঠা)।
তখন থেকে নবী করীম [ﷺ] ‘হাজুন’ কবরস্থানের নাম রাখলেন ’জান্নাতুল মোয়াল্লা’ এবং মদীনা শরীফের ‘বাক্বীউল গারকাদ’ কবরস্থানের নাম রাখলেন ’জান্নাতুল বাক্বী’। হুযুরের রওযা মোবারক ও মিম্বার শরীফের মধ্যবর্তী স্থানের নাম রাখলেন “রিয়াজুল জান্নাহ।” দুনিয়ার এই তিনটি জান্নাত পরকালের ৮টি জান্নাতের সাথে যোগ হবে বলেও কোন কোন বর্ণনায় এসেছে (সূত্র : মাওয়াহিব, শানে হাবীব)। নবীজীর রওযা মোবারক হচ্ছে আরশে মোয়াল্লার চেয়েও উত্তম।
নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতার পুনঃজীবন লাভের রেওয়ায়াত সম্পর্কে বিখ্যাত মোহাদ্দেছ হাফেয সামছুদ্দিন দামেস্কী একটি আরবী কবিতায় মন্তব্য করেছেনঃ
حبا الله النبى مزيد فضل+ على فضل وكان به رؤفا ـ
فاحياله امه وكزا اباه + لا يمان به فضلا لطيفا ـ
فسلم فالقديم به قادرا + وان كان الحديث به ضعيفا ـ
(روح البيان)
মর্মার্থঃ আল্লাহ তায়ালা আপন হাবীবের প্রতি অতি মেহেরবান ও স্নেহময়। তিনি আপন হাবীবকে মর্যাদার উপর আরো মর্যাদাশালী করেছেন। তিনি আপন হাবীবের প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাঁর পিতা-মাতাকে পুনঃজীবিত করেছেন। হে শ্রোতা! তুমি নতশীরে হাদীসখানা মেনে নাও। হাদীস শাস্ত্রের কঠোর নীতিমালা অনুযায়ী অত্র হাদীসের সনদ যদিও কিছুটা দুর্বল, কিন্তু মৌলিক হাদীসখানা (মতন) দুর্বল নয়। আর তাঁর পিতা-মাতাকে জীবিত করা আল্লাহর শক্তির বাইরেও নয়। (তাফসীরে রুহুল বয়ান সূত্রে)
এখানে আল্লামা দামেস্কী হাদীস বর্ণনাকারীর কারণে রেওয়াতটিকে তৃতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ দুর্বল পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে একটি সূত্র আছে – “যদি একটি দুর্বল রেওয়ায়াত বিভিন্ন সূত্রে গৃহীত ও বর্ণিত হয় তাহলে তা আর দুর্বল থাকে না – বরং শক্তিশালী হয়ে হাসান পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যায়। হাদীস বিশারদ আলেম মাত্রই এই সূত্রটি জানেন।
নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতার ইসলাম গ্রহণ ও পুনঃজীবন লাভ-এঁর বর্ণনাটি মূলে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) কর্তৃক বর্ণিত এবং পরবর্তী যুগে এসে বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাবে হাদীসের ইমামগণ তা বর্ণনা করেছেন। যা আমি কিছু পূর্বেই যথাস্থানে উল্লেখ করেছি। সুতরাং নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতাকে কুফরী অবস্থায় মারা গিয়েছেন বলে দাবী করে তারা ভ্রান্ত ধারণায় নিঃপতিত। এরা রসূল-বিরোধী দল।
ওহাবী গোমরাহ আলেমগণ তাদের দলীল হিসাবে বলেন- ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله عليه) নাকি তার ফিকহে আকবর কিতাবে লিখেছেন – ان ابوى النبي ما ماتا على الكفر
অর্থঃ “ নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতা কুফরী অবস্থায় ইনতিকাল করেছেন।”
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফিকহে আকবর-এর পুরাতন পান্ডুলিপিতে এবারত ছিল এরূপঃ (ما সহ)
ما ان ابوى النبي ما ماتا على الكفر “ নবী করীম [ﷺ]-এঁর পিতা-মাতা কুফরী অবস্থায় ইনতিকাল করেন নি।”
পরবর্তীকালে পান্ডুলিপি নকল করতে গিয়ে (ما) “না” বোধক প্রথম অক্ষরটি বাদ পড়ে যায় – যার কারণে “না” বোধক বাক্যটি “হ্যাঁ” বোধক বাক্যে পরিণত হয়ে যায়। আর এতেই এক (ما) ‘মা’ খসে পড়ার কারণে সব ভুলের জন্ম হয়।
আল্লাহ আমাদেরকে সত্য উৎঘাটনের তৌফিক দিন।
(সূত্রঃ আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতি কৃত- ( هداية الغبي فى اسلام ابوى النيى)