নূরনবী ﷺ
তায়েফ গমন
পঁচিশতম অধ্যায়ঃ তায়েফ গমনঃ
প্রসঙ্গঃ চরম অত্যাচারের বিনিময়ে হেদায়াতের দোয়া- নূহ (عليه السلام)-এঁর সাথে তুলনা- জ্বীনদের ইসলাম গ্রহণ
হযরত খাদিজা (رضي الله عنها) ও চাচা আবু তালেবের ইনতিকালের পর কোরাইশদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এমতাবস্থায় নবী করীম [ﷺ] ধাত্রীমা বিবি হালিমা সা’দিয়া (رضي الله عنها)-এঁর দেশ তায়েফে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গমন করেন। সাথে ছিলেন পালিত পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه)। উদ্দেশ্য ছিল - তায়েফ যেহেতু দুধ মাতার দেশ, হয়তো তারা নবীজীর প্রতি কিছুটা নমনীয় হবে। কিন্তু তাদের অমানুষিক ব্যবহার ও অত্যাচার কোরাইশদের অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে যায়। নবী করীম [ﷺ] বনী ছকিফের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু তারা অভদ্রভাবে নবীজীর আহ্ববান প্রত্যাখ্যান করে।
শুধু তাই নয় – তারা তাদের দুষ্ট ছেলেদেরকে এবং দাসশ্রেণীর লোকদেরকে নবীজীর পিছনে লেলিয়ে দিল। ঐসব দুষ্ট ছেলের দল নবীজীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো এবং নবীজীর বদন মোবারকে পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলো। নবীজীর পবিত্র দেহ থেকে রক্তের ধারা বইতে লাগলো। প্রবাহিত পবিত্র রক্ত জুতা মোবারকে ঢুকে কদম মোবারকের সাথে লেগে যেতো। পাথর নিক্ষেপের ফলে শরীর মোবারক নিস্তেজ হয়ে আসলে তিনি মাটিতে বসে পড়তেন।
বদমাইশ ছেলের দল পুনরায় তাঁকে দুই বাহু ধরে তুলে দিত। যখন তিনি চলতে শুরু করতেন, তখন পুনরায় তারা পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করতো এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। পালিত পুত্র যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه) নবীজীকে [ﷺ] রক্ষা করতে গিয়ে পাথরের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যান। মক্কায় হযরত ফাতেমা (رضي الله عنها) পিতার চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেন।
বোখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে- “ওহোদের যুদ্ধের পর হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে আরয করলেন – ইয়া রাসুলাল্লাহ! ওহোদের চেয়েও অধিক কষ্টকর কোন ঘটনা কি আপনার জীবনের উপর দিয়ে গিয়েছিল? উত্তরে নবী করীম [ﷺ] বলললেন- “আয়েশা, তায়েফবাসীদের অত্যাচার ছিল আমার জীবনের কঠিনতম বিপদ। আমি অত্যাচারিত হয়ে যখন তায়েফ থেকে ফেরত আসছিলাম এবং মক্কা থেকে একদিনের রাস্তার মাথায় ‘করনুছ ছা’লিব’ নামক স্থানে (ইয়েমেন ও নজদবাসী হাজীদের মীকাত) পৌঁছলাম, তখন দেখি- আমার মাথার উপর মেঘের ছায়া এবং হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) বলছেন, “ঐ মেঘমালা থেকে দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা ইসমাঈলকে আপনার নির্দেশ পালনের জন্য পাঠিয়েছেন।” নবীজী বলেন- পর্বতের দায়িত্বে নিয়োজিত উক্ত ফেরেশতা আমাকে ছালাম দিয়ে আরয করলো- “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি নির্দেশ করলে এখনই আমি তায়েফের ‘আখশাবাইন’ নামক দুটি পর্বতকে তাদের উপর নিক্ষেপ করে তাদেরক ধ্বংস করে দেবো। এটাই আল্লাহর পক্ষ হতে আমার প্রতি নির্দেশ।” শত্রুকে ধ্বংস করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও নবী করীম [ﷺ] বললেন- “না, বরং আমার একান্ত ইচ্ছা – তাদের বংশধরেরা অন্ততঃ ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহর ইবাদত করুক এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকুক।”
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নূহ্ (عليه السلام) তাঁর গোটা কওমকে বদদোয়া করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক নবীদের আব্দার রক্ষা করেন। তাই তিনি নূহ নবীর কথায় মহা প্লাবন দিয়ে দুনিয়া ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু আমাদের নবীজীর শত্রুদেরকে স্বয়ং আল্লাহ ধ্বংস করার প্রস্তাব পাঠালেন- কিন্তু রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন এতে রাজী হলেন না। সোবহানাল্লাহ ! অবশেষে গযবের ফেরেশতা ইসমাঈল (عليه السلام) ফিরে যান। এভাবেই নবীগণের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য হয়। তায়েফে দশদিন অবস্থান করে ফিরতি পথে ওতবা ও শায়বা নামক দুই কোরেশের সাথে তাদের দেয়ালঘেরা আঙ্গুরের বাগানে হুযুর [ﷺ]-এর সাক্ষাৎ হয়। নবী করীম [ﷺ]-এর এই অবস্থা দেখে তাদের মায়া হলো। তারা আপন খৃষ্টান গোলাম আদ্দাছের মাধ্যমে কিছু আঙ্গুর নবীজীর খেদমতে পাঠিয়ে দেয়। হুযুর [ﷺ] ‘বিছমিল্রাহ’ বলে আঙ্গুর ভক্ষণ করতে লাগলেন। আদ্দাছ নবী করীম [ﷺ]-এঁর চেহারা মোবারকের দিকে দৃষ্টি করে বলে উঠলো- এধরণের কালাম তো এদেশের কারো মুখে এতদিন শুনিনি। নবী করীম [ﷺ] তার পরিচয় জিজ্ঞাসার করে জানলেন, সে ইরাকের মুছেল শহরের নাইনিওয়া অঞ্চলের একজন খৃষ্টান অধিবাসী। নবী করীম [ﷺ] তার দেশের পরিচয় জেনে বললেন, “ও! তুমি হযরত ইউনুছ (عليه السلام)-এঁর দেশের লোক?” আদ্দাছ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো- “কিভাবে আপনি হযরত ইউনুছ (عليه السلام) কে চিনেন?” হুযুর [ﷺ] বললেন- “তিনিও আমার মত একজন নবী ছিলেন।” একথা শুনে আদ্দাছ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। সাথে সাথে কলেমা শরীফ পড়ে সে মুসলমান হয়ে গেল এবং নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাত ও কদম চুম্বন করলো। আপন জাতি তায়েফবাসীগণ নবীজীকে প্রত্যাখ্যান করলো- অথচ অপরিচিত একজন বিদেশী লোক নবীজীকে চিনে মুসলমান হয়ে গেল। একেই বলে “বাতির নীচে অন্ধকার!”
[এ সময়ই নাখলা নামক স্থানে রাত্রিবেলা নামাযের মধ্যে নবী করীম [ﷺ]-এঁর কোরআন তিলাওয়াত শুনে নাসিবাইনের সাতজন জ্বীন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো। তায়েফের ঘটনা থেকে এই শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে যে, সত্য প্রচারের জন্য চরম বিরোধিতার মুখেও অসীম ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে এবং সফলতার জন্য আল্লাহর দরবারে সাহায্য চাইতে হবে। আল্লাহর অন্য কৌশলে সফলতা দান করবেন।]
এই সফর থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই নবুয়তের দ্বাদশ সালে রজব মাসের ২৭ তারিখ সোমবার পবিত্র মি’রাজের ঘটনা সংঘটিত হয়। মনে হয়- ভবিষ্যতের কর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে একান্তে গোপন আলোচনার জন্যই আল্লাহ তায়ালা আপন হাবীব [ﷺ]-কে নিজেই নিভৃতে ডেকে নিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে স্বশরীরে মি’রাজে নিয়ে গেলেন রাত্রির কিয়দাংশে- তাঁর কুদরতি নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য।” (সুরা বনী ইসরাঈল ১ম আয়াত)। আরও এরশাদ করেন- “তাঁর সাথে গোপন আলাপ করেছেন” (সূরা নজমঃ ১০)। এই গোপন আলাপের কতটুকুই বা আমরা জানি? ঐ গোপন আলাপের নামই ইলমে গায়েব, ইলমে আছরার ও ইলমে হাক্বায়িক।