নব্য ফিতনা সালাফিয়্যা। ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে ফায়সালা।
নোটঃ ০১.
https://mbasic.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1938014229847346
____________
লা-মযহাবী ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজেদের দেশে ধর্মীয় কর্তব্য পালনরত সুন্নী ব্যক্তিগণের প্রতি কালিমা লেপনের এবং হেয় প্রতিপন্নকরণের সুযোগ সন্ধান প্রতিনিয়তই করে থাকে। তারা সুন্নীদের বইপত্র পড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং আহলে সুন্নতের শিক্ষাসমূহ বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরণের চালবাজীর আশ্রয় নিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এই ফকিরের নাম (হুসাইন হিলমী ইশিক) উল্লেখ করে জনৈক লা- মযহাবী ব্যক্তি বলেছে, “ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে একজন রসায়নবিদ বা ওষুধ বিজ্ঞানীর কাজ কী? তার উচিৎ তার নিজের জ্ঞানের শাখায় কাজ করে যাওয়া এবং আমাদের কাজে নাক না গলানো”। কী চরম অজ্ঞতাপ্রসূত ও আহাম্মকিপূর্ণ ধারণা! সে ধরে নিয়েছে যে, একজন বিজ্ঞানীর কোনো ধর্মীয় জ্ঞান থাকতেই পারে না।
অথচ সে এই সত্যটি সম্পর্কে অনবগত যে, মুসলমান বিজ্ঞানীগণ খোদাতা’লার সৃষ্টিসমূহকে প্রতিটি মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করেন এবং সৃষ্টিতে প্রদর্শিত সৃষ্টার ত্রুটিবিহীন গুণাবলী উপলব্ধি করেন; আর খোদাতা’লার অসীম ক্ষমতার তুলনায় সৃষ্টিসমূহের অক্ষমতা দর্শন করে তাঁরা প্রতিনিয়ত অনুধাবন করেন যে, আল্লাহপাক অন্যান্য কোনো কিছুরই মত নন এবং তিনি সকল ত্রুটি-বিচ্যুতিরই ঊর্ধ্বে। বিখ্যাত জার্মান পরমাণু পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক তাঁর ‘ডার ষ্ট্রম’ পুস্তকে এটা খুব সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ লা- মযহাবী অজ্ঞ লোকটি তারই মত কোনো গোমরাহ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রামাণ্য দলিল ও গদির ওপর নির্ভর করে এবং সম্ভবতঃ সউদী আরব হতে সরবরাহকৃত স্বর্ণের মোহাচ্ছন্ন হয়ে ভাবছে যে, ধর্মীয় জ্ঞান বুঝি তারই একচেটিয়া কারবার।
হাঁ, আমি (হোসাইন হিলমী ইশিক) ত্রিশ বছর যাবত রসায়ন-কৌশল ও ওষুধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে আমার দেশের খেদমত করে এসেছি। কিন্তু একই সাথে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সাত বছর ধরে দিন-রাত পরিশ্রম করে আমি একজন মহান ইসলামী আলেমের দেয়া এজাযত দ্বারা ধন্য হই। ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিশালতার মাঝে আমি নিজের অক্ষমতা পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। এই উপলব্ধির কারণে আমি প্রকৃত অর্থেই একজন বান্দা হবার চেষ্টা করেছি। আমার সব চেয়ে বড় ভয় ও দুশ্চিন্তা আমার সনদ এবং এজাযতের মোহে না পড়ে যাই এবং নিজেকে এসব বিষয়ে ‘সবজান্তা’ না ভেবে বসি। আমার ভীতির নিদর্শন আমার সকল পুস্তকেই বিরাজমান। আমার কোনো বইতেই আমি আমার ধ্যান-ধারণা কিংবা অভিমত উপস্থাপন করার সাহস প্রদর্শন করিনি। আমি আমার ছোট ভাইদের কাছে সব সময়ই আহলে সুন্নতের আলেমগণের মহামূল্যবান লেখনীসমূহ আরবী ও ফারসী হতে অনুধাবন করে উপহার দিতে চেষ্টা করেছি – যে সমস্ত লেখনী সমঝদারগণ শ্রদ্ধা করেন। আমার এ ভয়ের কারণে বহু বছর আমি বইপত্র লেখার সাহসই করিনি।
“যখন ফিতনা প্রকাশ হবে কিংবা আমার সাহাবীদেরকে বিদআতী ব্যক্তিবর্গ সমালোচনা করবে তখন যেন জ্ঞান শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম সত্য প্রকাশ করে। যদি সে এ রকম কাজ না করে, তবে তার ওপর আল্লাহ তা’লা, ফেরেশতাকুল ও মনুষ্যজাতির লা’নত তথা অভিসম্পাত! আল্লাহ পাক তার কোনো কাজ কিংবা ন্যায়-নিষ্ঠাই আর কবুল করবেন না” – এই হাদীসটি দেখার পর আমি গভীর চিন্তা শুরু করলাম। একদিকে আহলে সুন্নতের জ্ঞান বিশারদগণের ধর্মতত্ত্ব ও তাঁদের সময়কার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান- বিষয়ক উপলব্ধি ও মানসিক পরিপক্কতা সম্পর্কে এবং তাঁদের এবাদত ও তাকওয়া সম্পর্কে জানতে পেরে আমি আমার ক্ষুদ্রতা দেখতে পাই, অপর দিকে ক্রম-হ্রাসমান পুণ্যবান ব্যক্তিদেরকে আহলে সুন্নতের উলামাগণের বইপত্র পড়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম দেখে এবং অজ্ঞ পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদেরকে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সেজে বিভ্রান্তিকর ও ক্ষতিকর গোমরাহ পুস্তকাদি রচনা করতে দেখে আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হই। হাদীসে বর্ণিত শাস্তি আমাকে ভীত- সন্ত্রস্ত করে তোলে। আমার প্রিয় ছোট ভাইদের জন্যে আমার অনুভূত দয়া ও সহানুভূতিও আমাকে তাদের খেদমতে আসতে বাধ্য করে, যার দরুন আমি আহলে সুন্নতের উলামাগণের বইপত্র হতে অনুবাদ ও প্রকাশনা আরম্ভ করি। অসংখ্য অভিনন্দনসূচক চিঠি যা আমি পেয়েছি, তার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে আমি লা- মযহাবীদের পক্ষ থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও কঠোর সমালোচনাও শ্রবণ করেছি। কিন্তু যেহেতু আমার আল্লাহ তা’লার প্রতি এবং আমার বিবেকের প্রতি আমার এখলাছ (নিষ্ঠা) ও সততা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই, সেহেতু আল্লাহ তা’লার ওপর আস্থা রেখে এবং তাঁর প্রিয় নবী রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) -এর পবিত্র রূহ মোবারক ও আউলিয়া কেরামের রূহ্ মোবারকের তাওয়াসসুল (মধ্যস্থতা) গ্রহণ করে আমি আমার খেদমত অব্যাহত রেখেছি। মিশরের জামে’ আল-আযহার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং একজন মহান হানাফী আলেম শায়খ মোহাম্মদ বখিত আল-মুতি’য়ী হানাফী তাঁর প্রণীত “তাতহিরুল ফুয়াদ মিন দানিসিল এ’তেকাদ” পুস্তকে লিখেছেন:
“সকলের চেয়ে নবী (আলাইহিমুস সালাম)-গণের রুহ মোবারক হলো উচ্চ মকামের এবং পরিপক্ক। তাঁরা ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, উদাসীনতা, একগুঁয়েমি, নফস বা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ, হিংসা- বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, প্রতিশোধপরায়ণতা ইত্যাদি দোষ- ত্রুটি হতে পবিত্র। নবী (আলাইহিমুস সালাম)-গণ আল্লাহ তা’লা কর্তৃক তাঁদের কাছে প্রকাশিত বিষয়াবলী ব্যাখ্যা ও প্রচার করেছেন। দ্বীন ইসলামের শিক্ষাসমূহ অর্থাৎ নবী (আলাইহিমুস সালাম)-গণের প্রচারিত আদেশ-নিষেধসমূহ সবই সত্য। তাঁদের কেউই ভ্রান্তি কিংবা দুর্নীতিপরায়ণ নন। নবীগণের পরে তাঁদের সাহাবীগণই হলেন সবচাইতে উঁচু মর্যাদার অধিকারী ও সবচাইতে পরিপক্ক – কেননা, তাঁরা নবীগণের সান্নিধ্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত, পরিপক্কতাপ্রাপ্ত এবং পরিশুদ্ধতাপ্রাপ্ত। তাঁরা সব সময়ই নবীগণ হতে যা শুনেছিলেন তাই ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁরা যে সকল বিষয় ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছিলেন তার সবই সত্য। তাঁরাও উপরোক্ত ত্রুটি- বিচ্যুতি থেকে পবিত্র। নিজেদের একগুঁয়েমি কিংবা জেদ দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাঁরা একে অপরের বিরোধিতা করেন নি, আর তাঁরা নিজেদের নফসকেও অনুসরণ করেন নি।
সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক আল্লাহ তা’লার দ্বীনকে তাঁর বান্দাগণের কাছে ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে কৃত আয়াত ও হাদীসসমূহের ব্যাখ্যাবলী এবং ইজতেহাদসমূহ হচ্ছে নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) -এর উম্মতের ওপর খোদাতা’লার মহান নেয়ামত এবং নূর নবী রাসূলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) -এর ওপর বর্ষিত তাঁরই খাস বা বিশেষ দয়া। কুরআনুল করীম ঘোষণা করেছে যে, সাহাবায়ে কেরাম অবিশ্বাসী কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কিন্তু পরস্পরের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও সহিষ্ণু; আর তাঁরা নিরলসভাবে নামাজ পড়তেন এবং শুধুমাত্র আল্লাহ পাকের কাছ থেকেই সকল জিনিস ও বেহেশত কামনা কিংবা আশা করতেন। তাঁদের সকল ইজতেহাদ – যেগুলো সম্পর্কে এজমা (ঐকমত্য) হয়েছিল, সেগুলো সঠিক ছিল। তাঁদের সবাইকেই সওয়াব দেয়া হয়েছিল – যেহেতু বাস্তবতা কেবলমাত্র একটাই।
“সাহাবায়ে কেরামের পরে শ্রেষ্ঠ ইনসান হলেন সেই সকল মুসলমান যাঁরা সাহাবীদেরকে দেখেছেন এবং তাঁদের সান্নিধ্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এঁদেরকে ‘তাবেউন’ বলা হয়। তাবেউনগণ তাঁদের ধর্মীয় জ্ঞান সাহাবীদের কাছ থেকে হাসিল করেছেন। তাবেউনগণের পরে শ্রেষ্ঠ মুসলমান হলেন তাঁরাই যাঁরা তাঁদেরকে দেখেছেন এবং তাঁদের সোহবত বা সাহচর্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
এঁদেরকে বলা হয় ‘তাবেউত্ তাবেয়ীন’। তাবেউত্ তাবেয়ীনদের পরে কেয়ামত পর্যন্ত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীতে আগমণকারী মুসলমানগণের মধ্যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ হবেন, যাঁরা সালাফে সালেহীন তথা এই তিনটি প্রজন্মকে অনুসরণ করবেন এবং তাঁদের শিক্ষাসমূহ ধারণ করে তাঁদেরকে একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করবেন। সালাফ আস্ সালেহীনের পরে আগত ধর্মীয় কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁর কথা ও কাজ রাসুলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) এবং সালাফ আস্ সালেহীণের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, আর যিনি তাঁদের পথ হতে কখনোই বিশ্বাসে কিংবা কাজে বিচ্যুত হন না এবং যিনি ইসলামের সীমা লংঘন করেন না, তিনি অন্যদের অপবাদ দেয়ার ও হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতাকে কখনোই ভয় পাবেন না। তাদের বিভ্রান্তির বেড়াজালে তিনি আটক হবেন না। তিনি অজ্ঞদের কথায় কানও দেবেন না। তিনি তাঁর আক্কলকে ব্যবহার করবেন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের চার মযহাবের বাইরে যাবেন না। মুসলমানদেরকে একজন জ্ঞানবিশারদের অন্বেষণ করতে হবে এবং তাঁর কাছে তাঁরা যা জানেন না, তা জিজ্ঞেস করে শিক্ষা করতে হবে এবং তাঁদের দ্বারা সম্পাদিত সকল কাজে ও বিষয়াবলীতে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।
কেননা, এই ধরণের জ্ঞানী আলেম-ব্যক্তি আল্লাহ তা’লা কর্তৃক তাঁর বান্দাদেরকে ভুল-ভ্রান্তি হতে রক্ষা করার এবং সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট রূহানী বা আধ্যাত্মিক ওষুধ সম্পর্কে নিজেও জানেন এবং মানুষকেও জানিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, তিনি আত্মার ওষুধ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ও বুদ্ধিহীনদেরকে নিরাময় করবেন। এই আলেম তাঁর সকল কথায়, কাজে এবং বিশ্বাসে ইসলামকে অনুসরণ করবেন। তাঁর উপলব্ধি সব সময়ই সঠিক হবে। তিনি সকল প্রশ্নই সঠিকভাবে উত্তর দেবেন। আল্লাহ তালাও তাঁর সকল কাজকে পছন্দ করবেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর রেযামন্দী হাসিলের পথসমূহ অন্বেষণকারীদেরকে পথপ্রদর্শন করবেন।
তিনি ঈমানদারদেরকে এবং জুলুম-নিপীড়ন ও বালা- মুসীবতে ঈমানের শর্ত পূরণকারীদেরকে রক্ষা করবেন। তিনি তাঁদেরকে নূর (জ্যোতি), পরিত্রাণ ও সুখ-শান্তি অর্জন করতে সাহায্য করবেন। তাঁদের কৃত সকল কর্মেই তাঁরা সুখ-শান্তি পাবেন।
পুনরুত্থান দিবসে তাঁরা আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম), সিদ্দিকীন (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহিম), শুহাদা ও সালেহীনগণের সঙ্গে থাকবেন।
“যে কোনো শতাব্দীতেই যদি কোনো ধর্মীয় ব্যক্তি নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) কিংবা সাহাবায়ে কেরামের আজ্ঞাসমূহ অনুসরণ না করে এবং যদি তার কথা, কাজ ও বিশ্বাস তাঁদের শিক্ষাসমূহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় এবং যদি সে নিজের ধ্যান-ধারণাকে অনুসরণ করে ও ইসলামের সীমা লংঘন করে, আর যদি সে নিজের উপলব্ধি-বহির্ভূত জ্ঞানের ক্ষেত্রে চার মযহাবের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তাকে ধর্মীয় পদে সমাসীন একজন বদমায়েশ ব্যক্তি হিসেবেই গণ্য করা হবে। আল্লাহ তা’লা তার কলবে (অন্তরে) মোহর মেরে দিয়েছেন। তার চোখ সত্য, সঠিক পথটি দেখতে পাচ্ছে না। তার কানও সঠিক কথাটি শুনতে পাচ্ছে না। আখেরাতে তার জন্যে চরম আযাব (শাস্তি) অপেক্ষা করছে। আল্লাহ তাকে পছন্দ করবেন না। এ ধরণের লোকেরা নবী (আলাইহিমুস সালাম)-গণেরও শত্রু বটে।
তারা মনে করে থাকে যে, তারা সঠিক পথের ওপরই কায়েম আছে। তাই তারা নিজেদের কাজকে পছন্দ করে থাকে। অথচ তারাই হলো শয়তানের অনুসারী। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই চৈতন্য ফিরে পায় এবং সঠিক পথ অনুসরণ করে। তাদের কথাবার্তা শিষ্ট ও দরকারি এবং আনন্দদায়ক মনে হলেও তাদের চিন্তাধারা ও পছন্দ হলো বদ। তারা আহাম্মক ও উজবকদেরকে ধোকা দিয়ে গোমরাহী এবং ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। তাদের কথাকে তুষারের মত শুভ্র ও নির্মল মনে হলেও সত্যরূপী সূর্যের সামনে ওগুলো গলে যেতে বাধ্য। ধর্মীয় পদে সমাসীন এসব বদমায়েশ লোক যাদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ তা’লা মোহর মেরে দিয়েছেন এবং ময়লা বানিয়ে দিয়েছেন তাদেরকে ‘ আহল্ আল্ বিদআত’ কিংবা ‘লা-মাযহাবী’ বলা হয়। এসব লোকের আকিদা-বিশ্বাস ও আমল কুরআনুল করীম, হাদীস শরীফ কিংবা এজমাউল উম্মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সত্য, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা অন্যদেরকেও ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাদেরকে যারা অনুসরণ করবে তারাও জাহান্নামী হবে। সাহাবীদের সময় এবং তাঁদের পরবর্তীকালে আগত দ্বীনি কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে ওই ধরনের গোমরাহ ব্যক্তি বহু ছিল। মুসলমানদের মধ্যে তাদের উপস্থিতি অনেকটা দেহের মধ্যে গ্যাংরিন রোগের উপস্থিতির মতই। যদি এই রোগটি দূর করা না যায়, তাহলে দেহের অন্যান্য অংশও এই বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ পায় না। এই সকল গোমরাহ লোকেরা হলো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষদের মতই। তাদের সংস্পর্শে যারা আসবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদেরকে তাদের থেকে দূরে সরে থাকতে হবে, যাতে করে আমরা তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হই”। (শায়খ মোহাম্মদ বখিত আল মুতিয়ী হানাফী কৃত তাতহিরুল ফুয়াদ মিন দানিসিল এ’তেকাদ)।
ধর্মীয় পদে সমাসীন গোমরাহ ও বদমায়েশ লোকদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল ইবনে তাইমিয়া।
তার লিখিত বই পুস্তকে, বিশেষ করে তার ‘আল ওয়াসিতা’ পুস্তকে সে এজমা আল্ মুসলেমীনকে অগ্রাহ্য করেছে, কুরআনুল করীম ও হাদীস শরীফের সুস্পষ্ট ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে এবং সালাফে সালেহীনগণের পথকে অনুসরণ করেনি। তার ত্রুটিপূর্ণ মস্তিষ্ক ও দুষ্ট চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে সে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল। তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল সত্য। কিন্তু তার জ্ঞানের কারণেই গোমরাহী তাকে গ্রাস করে। সে তার নিজস্ব চাহিদানুযায়ী চলা শুরু করে। সত্য, সঠিক আদর্শের নামে সে তার মহাভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ধ্যান-ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস পেয়েছিল।
মহান আলেম হযরত ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী আল মক্কী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) তাঁর “ফতোয়ায়ে হাদীসিয়া” গ্রন্থে লিখেছেন :
“আল্লাহ্তা’লা ইবনে তাইমিয়াকে গোমরাহী ও চরম ক্ষতি প্রদান করেন। তিনি তাকে বধির ও অন্ধ বানিয়ে দেন। বহু উলামা জানিয়েছেন যে, তার কাজগুলো ছিল দূষণীয় এবং কথাগুলো ছিল মিথ্যা। তাঁরা এটা দলিল দ্বারা প্রমাণ করেছেন।
যাঁরা মহান ইসলামি উলামায়ে কেরাম হযরতুল আল্লামা আবু হাসান তাকিউদ্দীন সুবকী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) ও তাঁর পুত্র তাজউদ্দীন সুবকী এবং ইমাম ইযয্ ইবনে জামা’আ-র কেতাবপত্র পড়েছেন এবং যাঁরা ইবনে তাইমিয়ার খন্ডনে তারই সময়কার শাফেয়ী, মালেকী ও হানাফী উলামায়ে কেরামের মৌখিক এবং লিখিত প্রত্যুত্তরসমূহ অধ্যয়ন করেছেন, তাঁরা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে আমরাই সঠিক।
“তাসাউফের জ্ঞান বিশারদদের প্রতি ইবনে তাইমিয়া কুৎসা রটনা করে এবং ইবলিসী পন্থায় অপবাদ দেয়। উপরন্তু, সে ইসলামের স্তম্ভ হযরত আলী (কঃ) ও হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে আক্রমণ করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। তার কথাবার্তা সীমা লংঘন করে ও আদবের খেলাপ হয়ে দাঁড়ায় এবং সে উঁচু পাহাড়ের দিকেও ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে দেয়। সে সঠিক পথের মনীষীদেরকে অজ্ঞ- মূর্খ ও বেদআতী-গোমরাহ্ হিসেবে হেয় প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হয়।
“ইবনে তাইমিয়া বলেছে, ’ইসলামের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ গ্রীক দার্শনিকদের বিভ্রান্তিকর গোমরাহ ধ্যান- ধারণা তাসাউফের মহান ব্যক্তিত্বদের বইপত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে।’ সে এ কথা প্রমাণের জন্যে তার মহাভ্রান্ত চিন্তাধারা দ্বারা উঠে পড়ে লেগেছিল! যেসব যুবক সত্য সম্পর্কে অনবহিত, তারা তার আবেগপূর্ণ ও ধোকাপূর্ণ কথাবার্তায় পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সে বলেছে:
‘তাসাউফপন্থীগণ বলেন, তাঁরা লওহ্ আল মাহ্ফুজ দেখতে পান। ইবনে সিনার মত কিছু দার্শনিক এটাকে আন্ নফস্ আল ফালাকিয়্যা আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলেন যে, যখন মানবের রূহ বা আত্মা পূর্ণতা অর্জন করে, তখন আত্মাটি নফস্ আল্ ফালাকিয়্যা কিংবা আল্ আক্কল্ আল্ ফা’য়াল-এর সাথে ঘুমন্ত কিংবা জাগ্রতাবস্থায় মিলিত হয়; আর যখন কোনো ব্যক্তির রূহ এ দুটোর সাথে মিলিত হয়, যা পৃথিবীতে সকল জিনিস সংঘটিত হবার কারণস্বরূপ, তখন তিনি এগুলোর মধ্যে বিরাজমান বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত হতে শুরু করেন। এ সকল কথা গ্রীক দার্শনিকরা বলেনি।
এগুলো পরবর্তীকালে আগত ইবনে সীনা ও অনুরূপ ব্যক্তিবর্গের কথা। ইমাম আবু হামিদ আল গাযযালী, সুফী মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী এবং আন্দালুসীয় দার্শনিক কুতুবুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে সাব’ইনও এ ধরণের মন্তব্য করেছেন। এগুলো হলো দার্শনিকদের উক্তি।
ইসলামে এসব জিনিসের কোনো অস্তিত্বই নেই। এইসব উক্তি দ্বারা তাঁরা সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছেন। তাঁরা শিয়া, ইসমাইলীয়া, কারামতী ও বাতিনী সম্প্রদায়ের মত মূলহিদ (ধর্মচ্যুত) হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা আহলে সুন্নতের উলামাবৃন্দ, মুহাদ্দিসগণ ও ফুযাইল ইবনে আয়াযের মত তাসাউফের সুন্নী ব্যক্তিত্বদের অনুসৃত সঠিক পথকে পরিহার করেছেন। একদিকে তাঁরা দর্শন শাস্ত্রে ডুব দিয়েছেন, আর অপরদিকে তাঁরা মু’তাযিলা ও কোরামিয়ার মত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
তাসাউফপন্থীদের মধ্যে তিনটি শ্রেণী রয়েছে।
প্রথম শ্রেণীটি হাদীস ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে আছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীটি কোরামিয়া সম্প্রদায়ের মত গোমরাহ্। আর তৃতীয় শ্রেণীটি হলো ইখওয়ান আস সাফা’র বইপত্র এবং আবুল হাইয়্যানের কথার অনুসারী। ইবনুল আরবী ও ইবনে সাব’ইন এবং অনুরূপ ব্যক্তিবর্গ দার্শনিকদের কথাকে গ্রহণ করে তাসাউফের পণ্ডিতদের মন্তব্যে রূপান্তরিত করেন। ইবনে সিনার ‘আখির আল ইশারাত আলা মাকামিল আরেফিন’ গ্রন্থটিতে এ ধরণের বহু মন্তব্য আছে। ইমাম আল্ গাযযালীও তাঁর পুস্তকাদিতে এ ধরণের বহু বক্তব্য রেখেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘আল কেতাবুল মাদনুন’ ও ‘মেশকাত আল আনওয়ার’ পুস্তকে। বস্তুতঃ তাঁর বন্ধু আবু বকর ইবনে আল আরবী তাঁকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন এ কথা বলে যে, তিনি দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু তিনিও ইমাম সাহেবকে বাঁচাতে পারেননি। অপর পক্ষে, ইমাম গাযযালী বলেছেন যে দার্শনিকরা কাফের (অবিশ্বাসী)। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি সহীহ আল বুখারী (হাদীস গ্রন্থ) অধ্যয়ন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, এর দরূন তিনি তাঁর পূর্ব লিখিত ধ্যান-ধারণা বর্জন করেছিলেন। আর কেউ কেউ বলেছেন যে, ইমাম গাযযালীকে হেয় করার জন্যে ওই সকল বক্তব্য তাঁর নামে আরোপ করা হয়েছিল! ইমাম গাযযালীর ব্যাপারে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা রয়েছে।
মালেকী আলেম মোহাম্মদ মাযারী যিনি সিসিলিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং আন্দালুসীয় পণ্ডিত তরতুসী এবং ইবনুল জাওযী ও ইবনে ঊক্কাইল এবং অন্যান্যরা এ রকম বহু মন্তব্য করেছেন।’ (ইবনে তাইমিয়ার উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো)।
“ইবনে তাইমিয়া হতে উদ্ধৃত তার উপরোক্ত ধারণাসমূহ সুস্পষ্টভাবে আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে তার বদ চিন্তাই প্রতিভাত করে। এমনকি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শ্রেষ্ঠজনদের প্রতিও সে এরকম অপবাদ দিয়েছে। সে আহলে সুন্নতের অধিকাংশ উলামাকে গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইত্যবসরে সে যখন মহান ওলী ও কুতুবুল আরেফীন হযরত আবুল হাসান শাযিলীকে তাঁর ‘হিযবুল কবীর’ ও ’হিযবুল বখর’ গ্রন্থ দুটোর জন্যে গালাগালি করছিল এবং মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী, উমর ইবনে ফরিদ ও হাল্লাজ হুসেইন ইবনে মনসুরের মত মহান সুফীদেরকে অপবাদ দিচ্ছিল, তখন তার সময়কার উলামাবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে ফতোওয়া জারি করেন যে সে একজন গুনাহগার ও গোমরাহ ব্যক্তি।
“৭০৫ হিজরীতে ইবনে তাইমিয়াকে লিখিত একটি চিঠি ঘোষণা করে: ‘হে আমার মুসলিম ভ্রাতা, যে নাকি নিজেকে একজন বড় আলেম ও সময়ের ইমাম মনে করছ। আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবেসেছিলাম। তোমার বিরুদ্ধাচরণকারী উলামাদেরকে আমি স্বীকৃতি দিতাম না। কিন্তু তোমার প্রতি ভালবাসার পরিপন্থী তোমার কিছু কথা আমাকে বিস্মিত করেছে। সূর্যাস্তের পরে যে রাত শুরু হয়, তা কি কোনো জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি সন্দেহ করেন? তুমি বলেছিলে যে, তুমি সঠিক পথের পথিক এবং ’আল আমরু বিল মা’রূফ ওয়ান নাহী আনিল মুনকার’ (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা) পালন করছ। আল্লাহ তা’লাই ভাল জানেন তোমার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (নিয়্যত) কী। তবে মানুষের এখলাস তথা নিষ্ঠা তার কর্ম দ্বারা উপলদ্ধি করা যায়। তোমার কর্ম তোমার মিষ্টি কথার পর্দাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। যারা নিজেদের কুপ্রবৃত্তি (নফসানীয়াত)-কে অনুসরণ করে এবং যাদের কথা নির্ভরযোগ্য নয়, তাদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত হয়ে তুমি কেবলমাত্র তোমার সময়ে জীবিতদেরকেই হেয় প্রতিপন্ন করনি, বেসালপ্রাপ্তদেরকেও কুফরীর অপবাদ দিয়েছ। সালাফ আস্ সালেহীনের উত্তরসূরীদেরকে আক্রমণ করে তৃপ্তি না পেয়ে তুমি সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জনদেরকেও গালমন্দ করতে কুণ্ঠিত হওনি। তুমি ধারণা করতে পার তোমার কী অবস্থা হবে যখন ওই সকল মহান ব্যক্তিত্ব পুনরুত্থান দিবসে তাঁদের হক তথা অধিকার দাবি করবেন?
সালেহীয়্যা নগরীতে জামে’ আল্ জাবাল মসজিদের মিম্বরে তুমি বলেছ যে, হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)- এর কিছু ভুল মন্তব্য এবং কিছু গুনাহ-খাতা আছে। গুনাহ-খাতাগুলো কী ছিল? সালাফ আস্ সালেহীন কর্তৃক কোন্ কোন্ গুনাহ-খাতা তোমার কাছে বর্ণিত হয়েছে তা জানতে পারি কি? তুমি বলেছ যে, হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাকি তিন শতাধিক ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল।
যদি ধরা হয় যে, হযরত আলী (কঃ)-এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল, তাহলে কি তোমার ক্ষেত্রে একটিও সঠিক হবে?
এখন আমি তোমার বিরুদ্ধাচরণ করবো। আমি মুসলমানদেরকে তোমার বদমায়েশী থেকে রক্ষা করতে তৎপর হবো। কেননা, তুমি সীমা লংঘন করেছ। তোমার যুলুম-অত্যাচার জীবিত ও বেসালপ্রাপ্তদেরকে স্পর্শ করেছে।
মু’মিনদেরকে তোমার শয়তানী হতে দূরে সরে থাকতে হবে।’
(ইবনে তাইমিয়াকে লেখা চিঠির উদ্ধৃতি শেষ হলো)।
“সালাফ আস্ সালেহীনের সাথে ইবনে তাইমিয়া যেসব বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো আল্লামা তাজউদ্দীন সুবকী তালিকাভুক্ত করেছেন। তালিকা নিম্নরূপ:
১/ সে বলেছে, তালাক (ইসলামী পন্থায়) প্রকৃত হয় না, (যদি কোনোক্রমে হয়ে যায়) শপথের জন্যে কাফ্ফারা দেয়া অবশ্য কর্তব্য। ইবনে তাইময়ার পূর্বে আগত কোনো ইসলামি আলেমই বলেননি যে, কাফফারা দিতে হবে।
২/ সে বলেছে, হায়েজ (ঋতু শ্রাব) সম্পন্ন নারীকে প্রদত্ত তালাক প্রকৃত হয় না, তার পবিত্রতার সময় প্রদত্ত তালাকও প্রকৃত হয় না।
৩/ সে আরো বলেছে, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে তরককৃত নামাযের কাযা (পূরণ) পড়া অপরিহার্য নয়।
৪/ তার মন্তব্য, ‘হায়েয সম্পন্ন নারীর জন্যে কাবা শরীফের তাওয়াফ করা মোবাহ (অনুমতিপ্রাপ্ত)। সে যদি তা করে, তবে তাকে কাফফারা দিতে হবে না।’
৫/ ইবনে তাইমিয়া বলেছে, ‘তিন তালাকের নামে প্রদত্ত এক তালাক এক তালাকই থাকবে।’ অথচ এ কথা বলার আগে সে বহুবার বলেছে যে এজমা আল মুসলিমিন এ রকম নয়।’
৬/ সে বলেছে, ‘ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কর (ট্যাক্স) তাদের জন্যে হালাল যারা তা দাবি করে’।
৭/ ইবনে তাইমিয়ার অভিমত হলো, ‘যখন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়, তখন তা যাকাত হয়ে যায়, যদিও তা যাকাতের নিয়্যতে দেয়া না হয়’।
৮/ সে বলেছে, ‘একটি ইঁদুর কিংবা একটি বিড়াল যদি (হাউজের) পানিতে মরে পড়ে থাকে তাতেও পানি নাজস্ বা অপবিত্র হবে না’।
৯/ সে আরো বলেছে, ‘জুনুব বা স্ত্রী সহবাসের পর নাপাক ব্যক্তি রাতের গোসল ছাড়াই নফল নামায পড়তে পারবে। এটা অনুমতিপ্রাপ্ত’।
১০/ সে বলেছে, ‘ওয়াকিফ তথা ওয়াকফ প্রদানকারী ব্যক্তির
আরোপিত শর্তাবলী অবিবেচনাযোগ্য। যা শাফেয়ীদের জন্যে উৎসর্গিত তা হানাফীদের জন্যে খরচ করা হয়’।
১১/ সে বলেছে, ‘যে ব্যক্তি এজমা আল্ উম্মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে, সে অবিশ্বাসী (কাফের) কিংবা পাপী (ফাসিক) হয় না’।
১২/ ইবনে তাইমিয়া মত প্রকাশ করেছে, ‘আল্লাহ্ তা’লা হলেন মহল্ল-ই-হাওয়াদিস (সৃষ্টির উৎপত্তিস্থল) এবং তিনি সমাবিষ্ট অণুর দ্বারা তৈরি’।
১৩/ সে আরো বলেছে, ‘কুরআনুল করীম আল্লাহ পাকের যাত বা সত্তার মধ্যে সৃষ্ট হয়েছে’।
১৪/ সে বলেছে, আলম তথা সৃষ্টি জগত তার প্রজাতি নিয়ে চিরন্তন থাকবে’।
১৫/ ইবনে তাইমিয়ার ধারণা হলো, ‘আল্লাহ্ তা’লাকে ভাল জিনিস সৃষ্টি করতে হয়’।
১৬/ সে বলেছে, ‘আল্লাহ পাকের দেহ ও দিক আছে; তিনি তাঁর স্থান পরিবর্তন করেন এবং তিনি আরশের মতই বড়’।
১৭/ সে বলেছে, ‘জাহান্নাম চিরস্থায়ী নয়। এটাও বিলীন হয়ে যাবে’।
১৮/ ইবনে তাইমিয়া নবী (আলাইহিমুস সালাম)-গণের ত্রুটি-বিচ্যুতিহীনতার প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
১৯/ সে বলেছে, ‘রাসুলূল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) অন্যান্য সাধারণ মানুষ হতে ভিন্ন কিছু নন। তাঁর মধ্যস্থতায় দোয়া করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়’।
২০/ ইবনে তাইমিয়া মত প্রকাশ করেছে, রাসুলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) – কে যেয়ারত করার নিয়্যতে মদীনা শরীফ যাওয়া পাপ’।
২১/ সে বলেছে, ‘মহানবীর (صلى الله عليه و آله وسلم) রওযায়ে আকদসে শাফায়াত (সুপারিশ) প্রার্থনা করতে যাওয়া হারাম’।
২২/ সে আরো বলেছে, তওরাত ও ইনজিল শব্দসম্ভারে পরিবর্তিত হয় নি, বরং অর্থে পরিবর্তিত হয়েছে।
“কিছু ওলামা বলেছেন যে, উপরোক্ত মন্তব্যগুলো অধিকাংশ ইবনে তাইমিয়ার ছিলা না, কিন্তু ‘খোদা তা’লার দিক আছে এবং তিনি সমাবিষ্ট অণুর দ্বারা তৈরি’ মর্মে ইবনে তাইমিয়ার মন্তব্যকে কেউই অস্বীকার করেন নি। তবে সে যে এলম-এ সমৃদ্ধ ছিল, তা সর্বসম্মতভাবে ঘোষিত হয়েছিল। যে ব্যক্তির ফেকাহ, জ্ঞান, ইনসাফ ও বিচার-বুদ্ধি আছে, তার উচিৎ প্রথমে কোনো বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করা এবং তারপর বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। বিশেষ করে কোনো মুসলমানের কুফরী কিংবা ধর্মচ্যুতি অথবা তাঁকে হত্যা করার বিষয়টি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের এবং সতর্ক দৃষ্টির দাবি রাখে”। (ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী কৃত ফতোয়ায়ে হাদিসিয়ার উদ্ধৃতি এখানে সমাপ্ত হলো)
সম্প্রতি ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করা একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। গোমরাহ্ লোকেরা তার গোমরাহ্ লেখনীকে বিশেষ করে তার আল- ওয়াসিতা পুস্তককে সমর্থন করছে এবং সেগুলোকে পুর্নমূদ্রণ করছে। আল- ওয়াসিতা পুস্তকটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআনুল করীম, হাদীস শরীফ ও এজমা আল্ মুসলিমিনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ধ্যান-ধারণায় পরিপূর্ণ। পাঠকদের মধ্যে এটা বিরাট ফিতনা ও বিভক্তি সৃষ্টি করে এবং মুসলমান ভ্রাতাদের মধ্যে বৈরিতার জন্ম দেয়।
সৌদী নজদী ওহাবীরা এবং তাদের ফাঁদে পতিত অন্যান্য মুসলিম দেশের ধর্মীয় পদে সমাসীন অজ্ঞ ওহাবী- মওদূদীপন্থী লোকেরা ইবনে তাইমিয়াকে নিজেদের জন্যে ব্যানার বানিয়ে নিয়েছে। তারা তাকে “মহান মুজতাহিদ” ও “শায়খুল ইসলাম” ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করছে। তারা তার গোমরাহ্ চিন্তাধারা ও নীতিভ্রষ্ট লেখনীকে ঈমান এবং আকিদা-বিশ্বাসের নামে আঁকড়ে ধরছে। মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি ও ইসলামের মধ্যে অন্তর্ঘাত-সৃষ্টিকারী এ ভয়াবহ ধারাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে আমাদেরকে এর দলিলভিত্তিক খণ্ডনকারী সুন্নী উলামাগণের মহামূল্যবান বইপত্র পাঠ করতে হবে। তাঁদের এ সকল লেখনীর মধ্যে মহান ইমাম ও গভীর জ্ঞানী আলেম হযরতুল আল্লামা তাকিউদ্দীন সুবকী রচিত “আশ্ শিফাউস্ সিকাম ফি যেয়ারতী খাইরিল্ আনাম” নামক আরবী গ্রন্থটি ইবনে তাইমিয়ার গোমরাহ্ ধ্যান- ধারণাকে সমূলে উৎপাটিত করেছে, তার ফিতনাকে দমন করেছে এবং তার একগুঁয়েমি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে। এটা ইবনে তাইমিয়ার বদ উদ্দেশ্য ও মহাভ্রান্তির প্রসার রহিত করেছে। এই মহামূল্যবান বইটি সম্প্রতি হাকিকাত কিতাবেভী (ইস্তাম্বুল) হতে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
(সমাপ্ত)
__________
তুরস্কের প্রথিতযশা আলেম ও লেখক আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশিক (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি)। তাঁর এ প্রবন্ধ ‘নব্য ফিতনা: সালাফিয়্যা’- এর অনুবাদ প্রকাশ করতে পেরে আমি (অনুবাদক কাজী মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন হুসাইন) মহান আল্লাহ্ তা’লার দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার পীর ও মুরশীদ, চট্টগ্রাম বোয়ালখালিস্থ আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আলহাজ্জ সৈয়দ এ.জেড.এম. সেহাবউদ্দীন খাদেল সাহেব কেবলা (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) – এর অসীলায় মহান আল্লাহ তা’লা এ প্রকাশনাকে কবুল করে নিলেই আমার শ্রম সার্থক হবে, আমীন!