সন্ধ্যা বেলা। এখনি মাগরিবের আজান হবে। রিসিপশনে বসে আছি। হঠাৎ রিক্সায় করে একজন বৃদ্ধকে আসতে দেখলাম ই.ডি. স্যারের সাথে। ততক্ষণে রোগী যে সেটা বুঝে গেছি। তাকিয়ে রইলাম। মাত্র রিক্সা থেকে নেমে ভিতরে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধ তখনই মাগরিবের আজান হলো।
প্রবেশ করা মাত্রই আর কোনো কথা নেই। নামাজ সময় মতো পরতেই হবে। আমাদেরকে বলছেন- ‘আমার অজু আছে। নামাজ ফরতাম। এখটুতা জাগা দেখাই দেউক্কা।’ একজন স্টাফ ওপরে নিয়ে জায়গা দেখিয়ে দিলেন। এক রুমে নামাজ পড়লেন। আমিও আমার রুমে পরে নিলাম। নামাজ শেষ হলে বিভিন্ন টেস্ট করানোর পর আমার রুমে নিয়ে বসালাম। ভাবলাম গরমটা তীব্র, হয়তো এসি রুমে বসলে ভাল লাগবে। এসি টা অন করে দিলাম।
সাধারণত রোগীকে ইউ.এস.জি. এর সময় না হলে রুমে ঢুকাই না। মাসীকে দিয়ে পানি আনালাম। ইউ.এস.জি এর আগে প্রচুর পানি খেতে হয়। ওনাকে পানি খেতে দিলাম আর আমি সামনের চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইলাম। প্রত্যেকটা চুমুকে আলহামদুলিল্লাহ বলছেন। চুমুকের শুরুতে বিসমিল্লাহ তো আছেই। এন্ট্রির ইনভয়েস দেখে জানলাম বয়স ৭০ বছর। তারপর চা আনতে পাঠালাম। যখন চা দেয়া হলো তখন চা টা হাতে পাওয়া মাত্র আল্লাহর কাছে মন থেকে কত যে শুকরিয়া। যারা ওনাকে খাওয়াচ্ছে তাদের জন্য কত যে দোয়া…
আমি স্বভাবতই বৃদ্ধদের সাথে কথা বলতে ভালবাসি। তাদের সাথে আড্ডা, কথা-বার্তা অনেক ভালো লাগে। কথা বলা শুরু করলাম…
-কোথা থেকে এসেছেন?
-ইন বেরাইতাম আইছি। বাড়ি বরলেখা, ফুত্রার বাসাত আইসি। আইয়া দুফুরে খাইছি। ফরে তান লইয়া আইছইন। (তিনি বললেন)
-সমস্যা কি আপনার?
-ওফর তাকি ফরি গেছলাম। অখন বুকর ওবাইদি বেদনা খরে। ঘুমাইলে খরেদি (পিছন দিকে) বেদনা খরের। (অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে দেখাচ্ছেন তিনি)। ঘুম খম অয়। আজানর লগে লগে ঘুম ছুটি যায়। মন খরি এখটু দূরুদ ফরমু নে। সময়ও ফাই না। আজান অই যায়।
-বললাম, আল্লাহর অনেক রহমত আছে আপানদের ওপর। কোনো ফোন নেই। ব্যবহার করেন না। এলার্ম এরও প্রয়োজন নেই। তারপরও ফজরের সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায়। আর আমাদের এত কিছু থাকার পরও কানের কাছে এলার্ম বাজতে থাকে। কিন্তু ওঠতে পারি না! পানি খেলেন, চা খেলেন প্রতি চুমুকে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। আর আমরা তো একবার বলতেই ভুলে যাই!
-অয় বাবা! আল্লাহয় অততা দিছইন, আল্লাহর শুকরিয়া না খরলে খার খরতাম।
কিছুক্ষণ পর আবার নিজ থেকেই বলে উঠলেন।
-খষ্ট লাগের রে বা। মানুষে কোনতা ছাইলে দিতাম ফারি না। দিলে (অন্তর) তো খয় সব দিলাই। দিয়া খুশি খরিলাই। কিন্তু ফারিয়ার না।
-দোয়া করিয়েন আমার জন্য?
-খরি রে বাবা। নামাজ ফরিয়া হাত তুললে খেওরে বাদ রাখি নায়। সবর লাগি দোয়া খরি।
এসব কথা তিনি বলতে লাগলেন। অনেক সময় কথা হলো ওনার সাথে। বললাম একটা ছবি নেই?
-বললেন, আইচ্ছা। সোজা অইয়া বওয়া লাগব নি?
-বললাম জ্বী। একটু হাসি দিন। তারপর একটা ছবি নিয়ে রাখলাম। সব টেস্ট করার পর রিপোর্ট রেডি হলো। তিনি বিদায় নিলেন।
এতগুলো কথা কেন শেয়ার করলাম? জানি অনেকের কাছেই বোরিং লাগবে। আসলে লাগাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। আমি এমন কোনো লেখক না যে আমার লেখা পড়লে মনে প্রশান্তি চলে আসবে। যাইহোক! বৃদ্ধ লোকটির কিছু দিক ফলো করুন।
প্রথমত খুবই সরল। যেহেতু আগেকার মানুষ। আর সরলতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। তারপর কথায় কথায় আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। কেমন ঈমানের দৃঢ়তা! প্রত্যেকটা মূহুর্তে তারা আল্লাহকে অনুভব করেন, আল্লাহর কাছেই সব চান। অবশ্যই যৌবনে তারা আল্লাহর রাহে চলার চেষ্টা করেছেন।
যার দরুন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সুন্দর বৃদ্ধকাল দিয়েছেন। ইবাদত করার তৌফিক দিয়েছেন। আল্লাহু আকবার। নামাজের কেমন পাবন্দি! প্রত্যকে সালাত সময়মতো। দেখে মুগ্ধ হই।
মানুষকে সাহায্য করার কেমন মানসিকতা। যার জন্য আফসোস করেন এই বৃদ্ধ বয়সেও। আর টাকা থাকার পরও আজ মানুষকে সাহায্য করতে আমাদের হাত কাপে!
আর আমরা কোন জগতে আছি। এত আপডেটেড সবকিছু। সবকিছুই আছে। শুধু নেই আল্লাহ। আল্লাহকেই আমরা ভুলে গেছি। এই আগেকার মানুষদের সাথে থাকলে কথা-বললে এজন্যই ভালো লাগে। আল্লাহ তায়ালা এই মানুষগুলোকে ভালো রাখুন। তাদের দোয়া আমাদের নসিব করুন।