এক রাকাত বিতর পড়া
ইমাম ইবনুছ ছালাহ বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলই এক রাকাত বিতর পড়েছেন এর কোন প্রমাণ নেই। [আততালখীছুল হাবীর ২/৩১ কাশফুস সিতর পৃ.৩৮] (টীকা-১) ইমাম তাহাবী রহ. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুধু এক রাকাত বিতর বিষয়ে কিছু বর্ণিত হয়নি। [শরহু মাআনিল আসার হা.১৬০৯] ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ. শুধু এক রাকাত বিতর পড়াকে মাকরুহ বলেছেন। [আল-আউসাত:ইবনুল মুনযির ৫/১৮৪, মাসাইলে আহমদ: ইবনে হানী ১/৯৯]
কেবল হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রা. এর একটি বর্ণনায় রয়েছে: “যে চায় এক রাকাতও বিতর পড়তে পারবে”। ইমাম নাসায়ী হাদীসটি বর্ণনা করেই বলেন: এ ক্ষেত্রে মওকুফ বর্ণনাটিই সঠিক হওয়ার অধিক উপযুক্ত। [সুনানুল কুবরা হা.১৪০৬] বরং অধিকাংশ ইমাম এটিকে মউকুফ্ তথা সাহাবীর কথা বলে আখ্যায়িত করেছেন। [আততালখীছুল হাবীর ২/৩৭] তাছাড়া এ হাদীসের একটি বর্ণনায় রয়েছে:ومن شاء أومأ إيماء ‘যার ইচ্ছা এক রাকাত পড়ে নেবে, আর যার ইচ্ছা ইশারা করে নেবে’। [সুনানে নাসায়ী হা. ১৭১৩ এর সনদ সহীহ, সুনানে নাসায়ী কুবরা হা. ১৪০৬, সহীহ ইবনে হিব্বান হা.২৪১১ আসসুনানুল কুবরা ও সুনানে সগীর:বাইহাকী হা. ৪৭৭৯-৮০ ও মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা.৪৬৩৩]
তাহলে কি এক রাকাতও না পড়ে কেবল ইশারা করে নিলে বিতর আদায় হয়ে যাবে? এ কারণে আমাদের ধারণামতে এ বর্ণনাটি মুতাশাবিহ (রহস্যাবৃত) এবং আমলযোগ্য নয়। এর প্রকৃত রহস্য আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
সাহাবীগণের এক রাকাতে বিতর পড়া বিষয়ক কয়েকটি বর্ণনা:
১ . হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছের এক রাকাত বিতর পড়ার কথা শুনে ইবনে মাসউদ রা. বলেন: “এক রাকাত বিতর কখনো যথেষ্ট হবে না”। [কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদীনা, ১/১৯৩, ১৯৭ তাবারানী: মাজমাউজ যাওয়াইদ, হা. ৩৪৫৭ হাইছামী বলেন: এর সনদ হাসান মুয়াত্তা মুহাম্মদ হা.২৬৪]
ইমাম মালেক সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাছ ও উসমান রা. এর এক রাকাত বিতর প্রসঙ্গে বলেন: (وقال مالك بن انس ومن اخذ بقوله ليس العمل عندنا على ان يوتر بواحدة ليس قبلها شفع) : যে তাঁর কথা গ্রহণ করে তার জানা দরকার যে, আমাদের এতদঅঞ্চলে তথা মদীনায় দুই রকাত যুক্ত করা ছাড়া শুধু এক রাকাতে বিতর আদায় করার উপর কোন আমল নেই। [কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলুল মদীনা. ১/১৯৩]
২. হযরত মু‘আবিয়া রা. এক রাকাত বিতর পড়লে এক বর্ণনা অনুযায়ী ইবনে আব্বাস রা. এর কড়া সমালোচনা করেন। [তহাবী হা.১৭৫০] তাছাড়া উপরোক্ত উভয় বর্ণনাতেই হঠাৎকরে এক রাকাত বিতর পড়তে দেখে উপস্থিত তাবেয়ীগণ বিস্মিত হয়ে সাথে সাথে প্রশ্ন তুলেছেন। এতেও প্রমাণ হয়: এভাবে কেবল এক রাকাত বিতর সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেন না ।
৩. হযরত উসমান রা. এক রাকাত বিতর পড়ার বিষয়টি ছিল অনিচ্ছাকৃত। এখানেও ঘটনা বর্ণনাকারী হযরত আব্দুর রহমান আত্তাইমী রা. একরাকাত বিতর পড়তে দেখে অবাক হন। পরক্ষণেই বলেন:(أوهم الشيخ) তিনি হয়ত ভুলে গেছেন। [তহাবী পৃ.২০৬]
৪. আর ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাসের যে ‘মরফু’ রেওয়ায়াতে: একরাকাত পড়তে হুকুম করা হয়েছে মূলত সেগুলোতে শুধুই এক রাকাতকে পৃথক পড়তে বলা হয়নি। একই হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনাই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট রয়েছে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: “নবীজীর “صل ركعة واحدة” “একরাকাত পড়ে নাও” -ধরণের আদেশ দ্বারা তিন রাকাত বিতরকে সালামের মাধ্যমে পৃথক করে পড়া এক সাথে পড়ার চেয়ে উত্তম হওয়ার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু এধরণের শব্দ থেকে মাঝের বৈঠকে সালাম ফেরানোর বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। এও সম্ভাবনা আছে: “এক রাকাত পড়ে নাও” কথার মর্ম হলো: পূর্ববর্তী দুই রাকাতের সাথে মিলিয়ে তিন রাকাত বিতর পড়ে নাও। [ফাতহুলবারী ২/৫৯৩ বাবু মা জাআ ফিল বিতরি]
তাই হাদীস শাস্ত্রের দিকপাল ইমাম মালেক রহ. তাঁর সুপ্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাছের এক রাকাত বিতর পড়ার কথা উল্লেখপূর্বক বলেন:
وليس على هذا العمل عندنا ولكن أدنى الوتر ثلاث
“আমাদের মদীনায় এর উপর আমল নাই। বরং সর্বনিম্ন বিতর তিন রাকাত”। [মুয়াত্তা মালেক:বাবুল আমরি বিল বিতরি হা.৪০৭]
দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক ছাড়া তিন রাকাত বিতর
কোন কোন ভায়েরা বলে থাকেন: বিতর তিন রাকাত পড়লেও দুই রাকাতের পর বসবেই না। অথচ একেত এর পক্ষে সহীহ ও স্পষ্ট কোন বর্ণনাই পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত তিন রাকাত বিতরের উল্লিখিত সকল দলিল থেকেই একথা প্রমাণিত হয় যে, দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক হবে কিন্তু সালাম ফেরাবে তিন রাকাত পূর্ণ করে। কিছু কিছু দলিল এ বিষয়ে একেবারেই সুস্পষ্ট।
তবে শুধু হযরত আয়শা থেকে সা‘দ ইবনে হিশামের বর্ণনার একটিতে রয়েছে: “يوتر بثلاث لا يقعد إلا فى آخرهن” “নবীজী তিন রাকাত বিতর পড়তেন, শেষ রাকাতের আগে বসতেন না”। মুসতাদরাকে হাকেমের এ বর্ণনা থেকে মনে হয় তিন রাকাত বিতর-এ মাঝে বৈঠক করবে না। বাহ্যত এটি এক বৈঠকে তিন রাকাত বিতর পড়ার একটি স্পষ্ট দলিল মনে হলেও মূলত এটি কেবলই বিভ্রান্তি মাত্র। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরিশিষ্টে করা হয়েছে।