ইমাম তিরমিযীর যুগ পর্যন্ত বুকে হাত বাঁধার প্রচলন ছিল না
ইমাম তিরমিযী র. হযরত হুলব রা. এর হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন,
والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم يرون أن يضع الرجل يمينه على شماله في الصلاة ورأى بعضهم أن يضعهما فوق السرة ورأى بعضهم أن يضعهما تحت السرة وكل ذلك واسع عندهم
অর্থাৎ সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের আলেমগণের আমল ছিল এ হাদীস অনুযায়ী। তাঁরা মনে করতেন, নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে। তাঁদের কেউ কেউ মনে করতেন নাভির উপরে রাখবে, আর কেউ কেউ মনে করতেন নাভির নীচে রাখবে। তাঁদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটিরই অবকাশ আছে।
লক্ষ করুন, সাহাবী, তাবেয়ী ও তিরমিযী র.এর যুগ পর্যন্ত আলেমগণকে তিনি দুভাগ করেছেন। এক ভাগের মত ছিল নাভির নীচে হাত বাঁধা, আরেক ভাগের মত ছিল নাভির উপরে হাত বাঁধা। বুকের উপর হাত বাঁধার আমল কোথায়? একইভাবে ইবনুল মুনযির র.ও তাঁর আল আওসাত গ্রন্থে উপরোক্ত দুই ধরনের আমল ও মতের কথাই উল্লেখ করেছেন।
বুকের উপর হাত বাঁধা যে পূর্বসূরিগণের আমল ছিল না তা আলবানী সাহেবের নিম্নোক্ত কথা থেকেও স্পষ্ট হয়। ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে তিনি বলেছেন,
وأسعد الناس بهذه السنة الصحيحة الإمام إسحاق ابن راهويه فقد ذكر المروزي في ( المسائل ): ( كان إسحاق يوتر بنا . . . ويرفع يديه في القنوت ويقنت قبل الركوع ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين). )২/৭১)
অর্থাৎ এই সহীহ সুন্নতটির উপর আমল করে সর্বাধিক ধন্য হয়েছিলেন ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াই। মারওয়াযী তার মাসাইলে উল্লেখ করেছেন, ইসহাক র. আমাদেরকে নিয়ে বেতের পড়তেন। …… আর কুনুতে হাত তুলতেন। রুকুর পূর্বে কুনুত পড়তেন। এবং উভয় হাত বুকের উপর বা বুকের নীচে রাখতেন। (ইরওয়া, ২/৭১)
এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, পূর্বসূরিগণের মধ্যে তিনি শুধু ইসহাক র.কেই এর উপর আমলকারী পেয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, এই মারওয়াযী হলেন ইসহাক ইবনে মানসুর আল কাওসাজ। তারই রচিত ‘মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাক’ গ্রন্থ থেকেই উদ্ধৃত অংশটুকু সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন আলবানী সাহেব। (দ্র. আলমাসাইল, নং ৩৫৪৬, ৩৫৪৭)
মারওয়াযীর এই গ্রন্থের বরাতেই আমরা ইসহাক র.এর এই বক্তব্য উল্লেখ করেছি যে নাভির নীচে হাত বাঁধার হাদীস অধিক শক্তিশালী ও বিনয়ের নিকটতর। (টীকা-১)তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি নাভির নীচেই হাত বাঁধতেন। এ কারণে মাসাইলে ইমাম আহমাদ ও ইসহাক গ্রন্থটির টীকাকার বলেছেন, ‘আলবানীর উদ্ধৃত কথাটির অর্থ এই নয় যে, ইসহাক র. নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধতেন। বরং এর অর্থ হলো, তিনি দোয়ায়ে কুনুত পড়ার সময় যে হাত ওঠাতেন তা বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।’ (দ্র. ৩৫৪৭ নং এর টীকা)
এ ব্যাখ্যাটি এজন্যও জরুরী যে, এতে দু’টি বক্তব্যের মধ্যে সুন্দরভাবে সমন্বয় সাধিত হয়। একটি হাদীসে এই ব্যাখ্যার সমর্থনও পাওয়া গেছে। হাদীসটি ইবনে আবূ শায়বা রহ. তার মুসান্নাফে উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটিতে হযরত আবূ হুরায়রা রা. তাকবীরে তাহরীমার সময় মানুষের হাত তোলার বিভিন্ন অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন,
منكم من يقول هكذا ورفع سفيان (بن عيينة) يديه حتى تجاوز بهما رأسه ومنكم من يقول هكذا ووضع يديه عند بطنه ومنكم من يقول هكذا يعني حذو منكبيه (رقم ২৪২২)
অর্থাৎ তোমাদের কেউ এমন করে, সুফিয়ান (ইবনে উয়ায়না) হাত তুলে মাথার উপর নিয়ে গিয়ে দেখালেন। আর কেউ এমন করে, সুফিয়ান পেট পর্যন্ত হাত তুললেন, আর কেউ এমন করে অর্থাৎ কাঁধ পর্যন্ত হাত তোলে। (হা. ২৪২২) এখানে وضع يديه عند بطنه পেট বরাবর হাত তোলার কথা বলা হয়েছে। হাত বাঁধার কথা বলা হয়নি। তেমনি ইসহাক রহ. সম্পর্কে যে বলা হয়েছে, ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين এর অর্থ হবে, তিনি কুনুতের সময় উভয় হাত বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।
তাছাড়া ঐ উদ্ধৃতিতে ‘বুকের উপর রাখতেন’ শুধু এতটুকু বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, বুকের উপর বা নীচে রাখতেন। নীচে রাখলে তো আলবানী সাহেবের মতলব প্রমাণিত হয় না।
এটাও কম আশ্চর্যের নয় যে, আলবানী সাহেব ইসহাক র.এর ঐ স্পষ্ট বক্তব্যটি উল্লেখ না করে কুনুতে হাত বাঁধার: যা আসলে হাত তোলার: একটি অস্পষ্ট বক্তব্যের উদ্ধৃতি টেনেছেন।
উল্লেখ্য, হাত বাঁধার যে সহীহ নিয়ম পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি, সে নিয়মে হাত বাঁধলে বুকের উপর রাখা প্রায় অসম্ভব।
আরেকটি কথা, লা-মাযহাবী ভাইয়েরা যেভাবে হাত বাঁধেন, তাতে বুকের উপরে বাঁধা হয় না, হয় বুকের নীচে। আমি তাদের একজনকে বিষয়টি বলেছিলাম। তিনি আমার সামনে হাত বেঁধে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। শেষে বললেন, এটাতো কখনোই চিন্তা করিনি। আমি বললাম, এবার চিন্তা করুন। হাদীস বলবেন বুকের উপর হাত বাঁধার, আর আমল করবেন বুকের নীচে হাত বাঁধার, তা হয় না।