বিশেষ জ্ঞাতব্য ২ :
এ মাসআলায়ও মুযাফফর বিন মুহসিন তার ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)এর ছালাত’ গ্রন্থে অনেক ভুল ও অসত্য তথ্য পেশ করেছেন। সকলের অবগতির জন্য সেগুলো তুলে ধরা হলো।
১. তিনি সুরা ফাতিহা না পড়ার প্রথম দলিল হিসাবে আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীসটিতে আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা জেহরি ছালাতে সালাম ফিরিয়ে বললেন, এই মাত্র আমার সাথে তোমাদের কেউ কি ক্বিরাআত পড়ল? জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি পড়েছি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের সাথে কুরআন নিয়ে ঝগড়া করতে চাই না। উক্ত কথা শুনার পর লোকেরা জেহরী ছালাত সমূহে ক্বিরাআত পড়া হতে বিরত থাকল।
এ হলো মুযাফফর সাহেবের অনুবাদ। এখানে তিনি একটি বাক্যের অনুবাদে মারাত্মক ভুল করেছেন। বাক্যটি হলো, قال إني أقول ما لي أنازع القرآن। এর সঠিক অনুবাদ হবে: তিনি বললেন, আমি (মনে মনে) বলছি, কুরআন পাঠে আমার সঙ্গে টানাটানি হচ্ছে কেন? অর্থাৎ আমি কুরআন পাঠ করতে চাচ্ছি অথচ কুরআন যেন পঠিত হতে চাচ্ছে না। উল্লেখ্য, এখানে مالي প্রশ্নবাচক, আরأنازع শব্দটি কর্মবাচ্য। القرآن হলো তার দ্বিতীয় মাফউল বা কর্ম। (দ্র. মাজমাউল বিহার, نزع শব্দে)
অথচ মুযাফফর সাহেব এ বাক্যটির অনুবাদ করেছেন এইভাবে, তিনি বললেন, আমি তোমাদের সাথে কুরআন নিয়ে ঝগড়া করতে চাই না।
হাদীসটি উল্লেখ করার পর মুযাফফর সাহেব মন্তব্য করেছেন, হাদীছটি যঈফ।
কিন্তু তার এ দাবী সঠিক নয়। বরং এ হাদীসটি সহীহ। এর বিশুদ্ধতা নিয়ে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের কারো কোন দ্বিমত নেই। দ্বিমত রয়েছে শেষ বাক্যটি (অর্থাৎ উক্ত কথা শোনার পর লোকেরা … বিরত থাকেন) নিয়ে। শেষ বাক্যটি কী আবু হুরায়রা রা.এর বক্তব্য, নাকি ইমাম যুহরীর? হাদীসটি যঈফ বললে পাঠক পুরো হাদীসটিকেই যঈফ মনে করে ভুল করতে পারেন। শেষ বাক্যটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী, যুহলী, ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান, ইবনে হিব্বান, বায়হাকী ও খতীব বাগদাদী প্রমুখের মত হলো, এটা ইমাম যুহরীর বক্তব্য, আবু হুরায়রা রা.এর বক্তব্য নয়। এর পেছনে তাঁদের যুক্তি হলো, এক বর্ণনায় মা’মার বলেছেন, قال الزهري فانتهى … যুহরী বলেছেন, লোকেরা … কিরাআত পড়া বন্ধ করে দিল। একইভাবে ইমাম আওযাঈর বর্ণনায়ও এসেছে, যুহরী বলেছেন, মুসলিমরা এ ব্যাপারে উপদেশ গ্রহণ করল। জেহরী নামাযে তারা আর কিরাআত পড়ত না।
কিন্তু যারা মনে করেন এটি আবু হুরায়রা রা. এরই বক্তব্য, তাদের যুক্তিগুলোও কম ধারালো নয়। যুক্তিগুলো নিম্নরূপ :
ক. আবু দাউদ শরীফে আছে,
وَقَالَ ابْنُ السَّرْحِ فِى حَدِيثِهِ قَالَ مَعْمَرٌ عَنِ الزُّهْرِىِّ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ فَانْتَهَى النَّاسُ.
ইবনুস সারহ (আহমদ ইবনে আমর) তার হাদীসে উল্লেখ করেছেন, মা’মার যুহরীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, লোকেরা … বন্ধ করে দিল। (হাদীস নং ৮২৬)
খ. ইমাম যুহরীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য শিষ্য হলেন ইমাম মালেক রহ.। তিনি তার মুয়াত্তা গ্রন্থে এ হাদীসটির উপর অনুচ্ছেদ শিরোনাম দিয়েছেন ترك القراءة خلف الإمام فيما جهر فيه যে নামাযে ইমাম স্বরবে কিরাআত পাঠ করে সেই নামাযে মুক্তাদির কিরাআত না পড়া। এরপর ইমাম মালেক বলেছেন, الأمر عندنا أن يقرأ الرجل وراء الإمام فيما لا يجهر فيه الإمام بالقراءة ويترك القراءة فيما يجهر فيه الإمام بالقراءة
অর্থাৎ আমাদের সিদ্ধান্ত হলো যেসব নামাযে ইমাম আস্তে কিরাআত পড়ে সেসব নামাযে মুক্তাদি কিরাআত পড়বে। আর যেসব নামাযে ইমাম স্বরবে কিরাআত পড়ে সেসব নামাযে মুক্তাদি কিরাআত পড়বে না।
এরপর ইমাম মালেক তার অনুচ্ছেদ শিরোনাম ও সিদ্ধান্তের পক্ষে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এর থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, তিনি ঐ বক্তব্যটি আবু হুরায়রা রা.এর বক্তব্য বলেই মনে করতেন।
গ. ইমাম নাসাঈ রহ. হাদীসটির উপর এই অনুচ্ছেদ শিরোনাম উল্লেখ করেছেন: ترك القراءة خلف الإمام فيما يجهر فيه যেসব নামাযে ইমাম জোরে কিরাআত পড়ে সেসব নামাযে মুক্তাদির কিরাআত পাঠ না করা।
বোঝা যায়, তিনিও ঐ বাক্যটি হযরত আবু হুরায়রা রা.এর বলেই মনে করতেন।
ঘ. আবু হুরায়রা রা. এর ফতোয়াও ছিল জেহরি নামাযে মুক্তাদির কিরাআত না পড়া। ইবনুল মুনযির রহ. তার আল আওসাত গ্রন্থে স্বীয় সনদে আবু হুরায়রা রা. ও আয়েশা রা. উভয় থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা বলেছেন, اقرأ خلف الإمام فيما يخافت به (১৩১৩) যে নামাযে আস্তে কিরাআত পড়া হয় সেই নামাযে তুমি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়। (নং ১৩১৩)
ইমাম বায়হাকীও তার সুনানে কুবরায় স্বীয় সনদে ঐ দুই সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
انهما كانا يأمران بالقراءة وراء الإمام إذا لم يجهر
তাঁরা দুজনই ইমামের পেছনে সেই নামাযে কিরাআত পড়তে বলতেন যে নামাযে ইমাম স্বরবে কিরাআত পাঠ করে না। (হা. নং ২৯৫০)
এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, আবু হুরায়রা রা. এ মতটি ঐ দিনের ঘটনা থেকেই গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তাঁর মাযহাবই বলে দিচ্ছে, ঐ বক্তব্যটি তারই।
ঙ. কোন কোন বর্ণনায় এটি মা’মার (যুহরীর শিষ্য) এর বক্তব্য হিসাবেও উদ্ধৃত হয়েছে। তাই বলে কি বলতে হবে এটা মা’মারেরই বক্তব্য, ইমাম যুহরীর নয়?
হাফেয ইবনুল কায়্যিম তার তাহযীবে মুখতাসার-ই-আবু দাউদ গ্রন্থে এ কথাটি সুন্দর করে বলেছেন,
وأي تناف بين الأمرين بل كلاهما صواب قاله أبو هريرة كما قال معمر وقاله الزهري كما قال هؤلاء وقاله معمر أيضا كما قال أبو داود (عن مسدد) فلو كان قول الزهري له علة في قول أبي هريرة لكان قول معمر له علة في قول الزهري
অর্থাৎ দুটি বক্তব্যের মধ্যে কী বৈপরীত্ব? দুটিই তো সঠিক হতে পারে। কথাটি আবু হুরায়রা রা.ও বলেছেন, যেমনটি মামার বর্ণনা করেছেন। আবার যুহরীও বলেছেন, যেমনটি তারা বলেছেন। একইভাবে মামারও বলেছেন, যেমনটি (মুসাদ্দাদের সূত্রে) আবু দাউদ উল্লেখ করেছেন। মামারের বক্তব্য হওয়াটা যদি যুহরীর বক্তব্য হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়, তবে যুহরীর বক্তব্য হওয়াটা হযরত আবু হুরায়রার বক্তব্য হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে কেন?
মুসনাদে আহমাদের টীকায় আল্লামা আহমদ শাকের ও ইবনুল কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ ওয়া জুহুদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ওয়া উলূমিহা গ্রন্থে ড. জামাল ইবনে মুহাম্মদ ইবনুল কায়্যিমের এই বক্তব্য পছন্দ ও সমর্থন করেছেন।
যদি ঐ বাক্যটি ইমাম যুহরীর বলেও ধরে নেয়া হয়, তাতেও সমস্যার কিছু থাকে না। ইমাম যুহরী অনেক সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন, তাই এ ধরনের উক্তি তিনি হয়তো কোন সাহাবীর কাছ থেকে শুনেই বলে থাকবেন। অথবা কোন শীর্ষ তাবেঈ থেকে শুনে বলেছেন। মুযাফফর বিন মুহসিন ঐ বাক্যটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ অংশটি যুহরীর পক্ষ থেকে সংযোজিত এবং মারাত্মক ভুল।’
এ মারাত্মক ভুলের কথা তিনি কোথায় পেলেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। প্রথমত এটা ‘যুহরীর পক্ষ থেকে সংযোজিত’ নিশ্চিত করে এমন কথা বলাও মুশকিল। দ্বিতীয়ত এটা মেনে নিলেও এখানে ভুলেরই কিছু নেই, মারাত্মক ভুল তো দূরের কথা।
আলোচ্য হাদীসের এই শেষ বাক্যটি যুহরীর উক্তি বলে ধরে নিলেও তা হাদীসটির প্রথম অংশ দ্বারা সমর্থিত। কারণ কোন কোন সাহাবীর কিরাআত পাঠ সম্পর্কে রাসূল সা. যখন বিরক্তি ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন তখন সাহাবীগণের পক্ষে কি আর পুনরায় এমন কাজ করা কল্পনা করা যায়? সুতরাং যুহরী যা বলেছেন তা হাদীসটির প্রথমাংশেরই দাবি। এতে তার ভুলই বা কী ঘটল? আর মারাত্মক ভুলই বা কী হলো?
২. এরপর লেখক দ্বিতীয় দলিল হিসাবে আবু হুরায়রা রা.কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি হাদীস পেশ করেছেন। প্রথম হাদীসটির ন্যায় এখানেও আছে : إني أقول مالي أنازع القرآن । তিনি এর তরজমা করেছেন, ‘কুরআনের সাথে আমার ঝগড়া করা উচিত নয়।’ এ তরজমা মারাত্মক ভুল। পেছনে এর শুদ্ধ তরজমা উল্লেখ করা হয়েছে।
৪র্থ নম্বরে লেখক আনাস রা. বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من قرأ خلف الإمام ملئ فوه نارا
লেখকের ভাষায় এর অনুবাদ: ‘যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করবে তার মুখে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে।’
এ হলো লেখকের হাদীস বোঝার অবস্থা। যে ব্যক্তি হাদীসের তরজমাই বোঝে না তার পক্ষে এত লম্ফঝম্ফ কি শোভা পায়?
হাদীসটির সঠিক অনুবাদ হলো, যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়বে তার মুখ আগুনে ভরে যাক।
এরপর লেখক বলেছেন, ডাহা মিথ্যা বর্ণনা। এরপর তিনি ইবনে তাহের পাট্টানীর বরাত দিয়ে এর একজন রাবী মায়মূনকে মিথ্যুক আখ্যা দিয়েছেন।
আমাদের জানামতে কোন যোগ্য হানাফী আলেম এটিকে দলিল হিসাবে পেশ করেন নি। এ যেন জোর করে হানাফীদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া যে, নাও এটিও তোমাদের দলীল, যা জাল ও মিথ্যা।
৫ম নম্বরে লেখক হযরত উমর রা. এর একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, وددت أن الذي يقرأ خلف الإمام في فيه حجر অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়ে তার মুখে যদি পাথর হতো!
এর অনুবাদেও লেখক ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আমার ইচ্ছা করে ঐ ব্যক্তির মুখে পাথর মারতে, যে ইমামের পেছনে ক্বিরাআত পাঠ করে। (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা./২৮০৬)
এ হাদীসটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য হলো: উক্ত বর্ণনা মুনকার, ছহীহ নয়। কারণ নিম্নের হাদীসটি তার প্রমাণ:
عَنْ يَزِيدَ بْنِ شَرِيكٍ : أَنَّهُ سَأَلَ عُمَرَ عَنِ الْقِرَاءَةِ خَلْفَ الإِمَامِ فَقَالَ : اقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ. قُلْتُ : وَإِنْ كُنْتَ أَنْتَ؟ قَالَ : وَإِنْ كُنْتُ أَنَا. قُلْتُ : وَإِنْ جَهَرْتَ؟ قَالَ : وَإِنْ جَهَرْتُ
একদা ইয়াযীদ ইবনু শারীক উমর রা.কে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ কর। আমি বললাম, যদি আপনি ইমাম হোন? তিনি বললেন, যদিও আমি ইমাম হই। আমি পুনরায় বললাম, যদি আপনি জোরে ক্বিরাআত পাঠ করেন? তিনি বললেন, যদিও আমি জোরে ক্বিরাআত পাঠ করি। (বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, হা./৩০৪৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা যঈফাহ, হা/৯৯২ এর আলোচনা দ্রঃ)
এ হলো লেখকের পুরো বক্তব্য। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. উক্ত বর্ণনা মুনকার, সহীহ নয় বলে লেখক টীকায় ৮৬৫ নম্বর দিয়ে লিখেছেন, আততামহীদ ১১/৫০ পৃ:فمنقطع لا يصح ولا نقله ثقة (এটি সূত্রবিচ্ছিন্ন, সহীহ নয়, কোন বিশ্বস্ত লোক এটি বর্ণনা করেন নি। ) এতে যে কোন পাঠক মনে করতে পারেন, ইবনে আব্দুল বার তামহীদ গ্রন্থে উমর রা.এর হাদীসটি সম্পর্কেই এই মন্তব্য করেছেন। অথচ ব্যাপার তা নয়। তিনি বরং স্পষ্টভাবে সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা.এর হাদীস ও বক্তব্য সম্পর্কে ঐ মন্তব্য করেছেন। তবে লেখক কেন এমন প্রতারণার আশ্রয় নিলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।
দুই. তিনি বলেছেন, “ছহীহ নয়, নিম্নের হাদীসটি তার প্রমাণ।” আর নিম্নের ঐ হাদীসটি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, সনদ ছহীহ। কিন্তু তার এ মন্তব্য তো তাকলীদ বৈ নয়। হাকেম, দারাকুতনী ও বায়হাকী প্রমুখের মত এমনটাই। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এটি সহীহ হওয়া মুশকিল। কারণ জাওয়াব আত তায়মী নামে এর একজন রাবী আছেন।
ইবনে নুমায়র তার সম্পর্কে বলেছেন, ضعيف الحديثতিনি যঈফুল হাদীস ছিলেন। বায়হাকী এখানে তাকে বিশ্বস্ত আখ্যা দিয়ে তার এ হাদীসকে সহীহ বললেও ১০৮২৪ নম্বর হাদীসের পরে তিনি বলেছেন, جواب التيمي غير قوي জাওয়াব আত তায়মী মজবুত রাবী নন। যাহাবী তার সিয়ার গ্রন্থে বলেন, وليس بالقوي في الحديثহাদীসে তিনি মজবুত ছিলেন না। আবুল আরবও তাকে যঈফ রাবীদের তালিকায় উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া এ হাদীসটি একই সনদে বায়হাকীর কিতাবুল কিরাআতে উদ্ধৃত হয়েছে। (হা/১৮৭), সেখানে একথাও আছে যে, উমর রা. বলেছেন, واقرأ فاتحة الكتاب وشيئاতুমি সূরা ফাতিহা ও সেই সঙ্গে আরো কিছু পাঠ কর।
অথচ লা-মাযহাবী বন্ধুরা জাহরী নামাযে এই আরো কিছু পড়ার পক্ষপাতী নন। আর এ কারণেই উমর রা.এর এ হাদীসটির অনুবাদে খুব কৌশলে বলা হয়েছে: তুমি শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ কর। অথচ ‘শুধু’ কথাটি তার বক্তব্যে নেই।
সারকথা, এ বর্ণনাটি সহীহ না হলে এর দ্বারা প্রথম বর্ণনাটিকে নাকচ করে দেওয়ার কোন যুক্তি থাকে না। বিশেষত এ কারণেও যে, এর পক্ষে আরো কিছু বর্ণনার সমর্থন রয়েছে। যেমন, ক. মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বায় সহীহ সনদে নাফি’ ও আনাস ইবনে সীরীন থেকে বর্ণিত, উমর রা. বলেছেন, تكفيك قراءة الإمام ইমামের কিরাআতই তোমার জন্য যথেষ্ট। (হা. ৩৭৮৪)
খ. মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে আছে, মূসা ইবনে উকবা বলেছেন, ان رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبا بكر وعمر وعثمان كانوا ينهون عن القراءة خلف الإمام রাসূল সা., আবু বকর, উমর ও উসমান রা. ইমামের পেছনে কিরাআত পাঠ থেকে নিষেধ করতেন। (হা, ২৮১০) এর সনদে আব্দুর রহমান ইবনে যায়দ আছেন, তিনি যঈফ।
গ. উক্ত গ্রন্থেই আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেছেন ইবনে উয়ায়না থেকে, তিনি আবু ইসহাক শায়বানী থেকে, তিনি জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উমর রা. দৃঢ়ভাবে বলেছেন, তোমরা ইমামের পেছনে কিরাআত পাঠ কোরো না। (হা/২৮০৪)
৫. ষষ্ঠ দলিল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, عن ابن مسعود وددت أن الذي يقرأ خلف الإمام ملئ فوه ترابا
লেখকের ভাষায় এর অনুবাদ হলো, ইবনু মাসউদ রা. বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ে তার মুখে মাটি নিক্ষেপ করতে আমার ইচ্ছা করে।
লেখকের এ অনুবাদও ভুল। সঠিক অনুবাদ হবে, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ে তার মুখ যদি মাটিতে ভরে যেত।
বর্ণনাটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য হলো, বর্ণনাটি যঈফ, ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, এটি মুরসাল। এর দ্বারা দলিল গ্রহণ করা যায় না।
কিন্তু এ বর্ণনাটি সকলের মতে যঈফ নয়। কারণ মুরসাল হাদীস ইমাম আবু হানীফা, মালেক, আহমদ ও পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য। শর্ত হলো, বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত হবে এবং বিশ্বস্ত লোকদের থেকে বর্ণনা করাই তার রীতি হবে। (দ্র. মুকাদ্দামায়ে তামহীদ, রিসালাতু আবী দাউদ ইলা আহলি মাক্কাহ ও আল ফুসূল ফিল উসূল)
এ হাদীসটি আব্দুর রাযযাক উদ্ধৃত করেছেন দাউদ ইবনে কায়স থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে আজলান থেকে, তিনি ইবনে মাসউদ রা. থেকে। এই ইবনে আজলান ও দাউদ উভয়ে বিশ্বস্ত। তবে ইবনে মাসউদ রা.এর সঙ্গে ইবনে আজলানের সাক্ষাৎ ঘটে নি। তিনি নিশ্চয়ই অন্য কারো কাছ থেকে এটি শুনেছেন। এজন্যই এটাকে সূত্রবিচ্ছিন্ন বলা হয়। মুরসাল শব্দটি এখানে মুনকাতে’ (সূত্র বিচ্ছিন্ন) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে তাহাবী শরীফে এর ভিন্ন একটি সনদ রয়েছে, যার সূত্র অবিচ্ছিন্ন। ইমাম তাহাবী বর্ণনা করেছেন আবু বাকরা থেকে, তিনি আবু দাউদ (ইবরাহীম ইবনে দাউদ বুরুল্লুসী) থেকে, তিনি হুদায়জ ইবনে মুআবিয়া থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি আলকামা’র সূত্রে ইবনে মাসউদ রা. থেকে।
এ সনদে শুধু হুদায়জ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে তাকে যঈফ বলেছেন। তবে ইমাম আহমদ বলেছেন, আমি তার সম্পর্কে শুধু ভালই জানি। আবু হাতিম রাযীও বলেছেন, محله الصدق তিনি সত্যনিষ্ঠ পর্যায়ের ছিলেন। ইবনে আদী বলেছেন, আমার মতে তার মধ্যে সমস্যার কিছু নেই।
তাছাড়া ইবনে মাসউদ রা. থেকে এ মর্মে অবিচ্ছিন্ন একাধিক সূত্রে সহীহ হাদীস বিদ্যমান থাকতে লেখক কেন এ মুরসাল বা সূত্রবিচ্ছিন্ন হাদীসটি এনে এর উপর মন্তব্য করে চলে যাচ্ছেন তাও বোধগম্য নয়। তিনি কি এ ধারণাই দিতে চাচ্ছেন যে, এ ব্যাপারে ইবনে মাসউদ থেকে আর কোন সহীহ হাদীস নেই? এ হলে তো পাঠককে ধোঁকা দেওয়া হবে।
এখানে শুধু একটি বর্ণনা তুলে ধরছি।
عن أبي وائل قال : جاء رجل إلى عبد الله فقال : يا أبا عبد الرحمن اقرأ خلف الإمام؟ فقال له عبد الله : إن في الصلاة شغلا وسيكفيك ذاك الإمام
আবু ওয়াইল থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) রা. কে জিজ্ঞেস করল, আমি কি ইমামের পেছনে কিরাআত পাঠ করব? তিনি বললেন, নামাযে গভীর ধ্যান ও মনোযোগ দিতে হয়। ওটার জন্য ইমামই তোমার পক্ষে যথেষ্ট। (ইবনে আবু শায়বা, হা. ৩৮০১; আব্দুর রাযযাক, হা. ২৮০৩; মুয়াত্তা মুহাম্মদ, পৃ. ৯৯)
৬. ৭ম দলিল হিসাবে লেখক সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা.এর হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হলো, সা’দ রা. বলেন, وددت إن الذي يقرأ خلف الإمام في فيه جمرةযে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়ে তার মুখে জ্বলন্ত অঙ্গার হতো। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হা. ৩৭৮২)
এ হাদীসের অনুবাদেও লেখক ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আমার ইচ্ছা হয় তার মুখে আগুনের অঙ্গার ছুড়ে মারতে।
হাদীসটির উপর লেখক মন্তব্য করেছেন, বর্ণনাটি যঈফ ও মুনকার। ইমাম বুখারী বলেন, এর সনদে ইবনু নাজ্জার নামে অপরিচিত রাবী আছে।
ইবনু নাজ্জার কথাটি লেখকের ভুল। সঠিক হবে ইবনে বিজাদ বা ইবনে নিজাদ। দুভাবেই এ নামটি বলা সহীহ। ইমাম বুখারী রহ. যে তাকে অপরিচিত বলেছেন সে কথায় হয়তো তিনি অটল ছিলেন না। কারণ তিনি তার আত তারীখুল কাবীর গ্রন্থে ইবনে বিজাদের নাম মুহাম্মদ ইবনে বিজাদ উল্লেখ করে তার জীবনীতে এমন তথ্য পেশ করেছেন যার দ্বারা তিনি যে মাজহুল বা অপরিচিত ছিলেন তার কোন আভাস পাওয়া যায় না। বুখারী রহ. লিখেছেন, মা’ন ইবনে ঈসা তার নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন, এবং তিনি তার ফুফু আইশা বিনতে সা’দ থেকে হাদীস শুনেছেন। ইবনে আবু হাতিমও তার আল জারহু ওয়াত তাদীল গ্রন্থে অনুরূপ তথ্য পেশ করেছেন। তিনিও তার সম্পর্কে অপরিচিত হওয়ার কোন ইংগিত দেন নি। আর ইবনে হিব্বান তো তার আছ ছিকাত গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করে স্পষ্ট জানান দিয়েছেন, মুহাম্মদ ইবনে বিজাদ বিশ্বস্ত ছিলেন। এ দিকে হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরী তার মারিফাতু উলূমিল হাদীস গ্রন্থে লিখেছেন,وولد سعد بن أبي وقاص إلى سنة خمسين ومأتين فيهم فقهاء وأئمة وثقات وحفاظ اهـ সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা.এর বংশধরদের মাঝে দুইশত পঞ্চাশ হিজরী পর্যন্ত ফকীহ, ইমাম, বিশ্বস্ত ও হাফেজে হাদীস ছিলেন। (পৃ. ৫১)
এসব থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, ইবনে বিজাদ অপরিচিত ছিলেন না। সুতরাং তার এ বর্ণনাটিকে যঈফ বলার সুযোগ কোথায়?
৭. ৮ম দলিলরূপে লেখক উল্লেখ করেছেন, عن علقمة بن قيس قال : لأن أعض على جمرة أحب إليّ من أن أقرأ خلف الإمام
আলকামা বিন কায়েস বলেন, আমার নিকট জ্বলন্ত অঙ্গার কামড়ে ধরা অধিক উত্তম, ইমামের পেছনে কিরাআত পড়ার চেয়ে। আসওয়াদ থেকেও অনুরূপ একটি বর্ণনা আছে।
এরপর লেখক মন্তব্য করেছেন, এর সনদ যঈফ ও ত্রুটিপূর্ণ। বুকাইর ইবনু আমের নামে একজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে।
এখানে তিনটি কথা। এক. বুকাইর ইবনে আমেরের কারণে লেখক এ বর্ণনাটিকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন। অথচ বুকাইর সকলের মতে যঈফ ছিলেন না। ইবনে সা’দ তাকে বিশ্বস্ত আখ্যা দিয়েছেন। ইজলী তার সম্পর্কে বলেছেন, لا بأس به তার মধ্যে সমস্যার কিছু নেই। ইমাম আহমদ এক বর্ণনামতে তাকে যঈফ আখ্যা দিলেও অন্য বর্ণনায় বলেছেন, صالح الحديث ليس به بأس তিনি সঠিক হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, তার মধ্যে সমস্যার কিছু নেই। ইবনে আদী বলেছেন, لم أجد له متنا منكرا আমি তার কোন আপত্তিকর হাদীস পাইনি। ইবনে মাঈন, আবু যুরআ ও একটি বর্ণনামতে ইমাম আহমদ তাকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন। এ ধরনের বর্ণনাকারীর হাদীসকে ঢালাওভাবে যঈফ বলে দেওয়া ন্যায় ও ইনসাফের কথা হতে পারে না।
দুই. আলকামা’র এ বর্ণনাটিকে যদি যঈফ ধরে নেওয়াও হয় তথাপি একথা প্রমাণিত হবে না যে, আলকামা এমন কথা বলেন নি। কারণ এ মর্মে তার থেকে ভিন্ন সনদে আরো বর্ণনা রয়েছে। যেমন, কিতাবুল আছারে ইমাম মুহাম্মদ বর্ণনা করেছেন, ইমাম আবু হানীফা থেকে, তিনি হাম্মাদ থেকে, তিনি ইবরাহীম নাখায়ীর সূত্রে আলকামা থেকে, এভাবে আব্দুর রাযযাক রহ. তার মুসান্নাফে মা’মার থেকে, তিনি আবু ইসহাকের সূত্রে আলাকামা’র অনুরূপ মর্মের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।
তিন. লেখক বলেছেন, আসওয়াদ থেকেও অনুরূপ একটি বর্ণনা আছে। কিন্তু এটি সহীহ না যঈফ সে প্রসঙ্গ তিনি উল্লেখ করেন নি। অথচ মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বায় উদ্ধৃত এ বর্ণনাটির সকল রাবী বিশ্বস্ত, বুখারী মুসলিমের রাবী।
৮. ৯ম দলিলরূপে লেখক উল্লেখ করেছেন, قال حماد : وددت أن الذي يقرأ خلف الإمام ملئ فوه سكرا
লেখকের অনুবাদ হলো, হাম্মাদ বলেন, আমার ইচ্ছা হয় ঐ ব্যক্তির মুখে মদ নিক্ষেপ করি যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়ে।
এখানেও লেখক নিক্ষেপ করার ভুল অর্থ করেছেন। সঠিক অর্থ হবে, যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিরাআত পড়ে তার মুখ যদি মাদকে পূর্ণ হতো।
এ বর্ণনাটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য হলো, যঈফ। ইমাম বুখারী বলেন, এ সমস্ত বর্ণনা যাদের নামে বর্ণনা করা হয়েছে, তাদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হয় নি।
লেখক এখানে না বুঝেই ইমাম বুখারী রহ.এর বক্তব্য জুড়ে দিয়েছেন। বুখারী রহ. হাম্মাদের বর্ণনাটি সম্পর্কে উক্ত মন্তব্য করেন নি। বরং যায়দ ইবনে ছাবিত রা.এর একটি মারফূ বর্ণনা সম্পর্কে মন্তব্যটি করেছেন। সামনে ১১ নং দলিলে মাওকূফরূপে লেখক এটি উল্লেখ করেছেন।
৯. ১০ম দলিল হিসাবে লেখক উল্লেখ করেছেন, عن محمد بن عجلان قال قال علي رض : من قرأ مع الإمام فليس على الفطرة
আলী রা. বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে কিরাআত পাঠ করে সে (ইসলামের) ফিতরাতের উপর নেই। (সঠিক অনুবাদ হবে, স্বাভাবিক নিয়মের উপর নেই।)
এ বর্ণনাটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য হলো, বর্ণনাটি ছহীহ নয়। ইমাম বুখারী বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়। কারণ মুখতার অপরিচিত। সে তার পিতা থেকে শুনেছে কি না তা জানা যায় না। ইবনু হিব্বান তাকে বাতিল বলেছেন।
বড়ই আশ্চর্য, লেখক এখানে ভিন্ন একটি সূত্র সম্পর্কে করা ইমাম বুখারী ও ইবনে হিব্বানের মন্তব্য দুটি ইবনে আজলানের সূত্রে উদ্ধৃত বর্ণনাটির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। অথচ মুহাম্মদ ইবনে আজলানের সূত্রে মুখতার নামে কোন রাবী নেই, তার পিতারও উল্লেখ নেই। ইবনে আজলান থেকে এটি বর্ণনা করেছেন দাউদ ইবনে কায়স, আর দাউদ থেকে বর্ণনা করেছেন আব্দুর রাযযাক। (দ্র. মুসান্নাফ, হাদীস ২৮০৬)
এর আরেকটি সূত্র আছে মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বায় (হা. ৩৮০২)। ইবনে আবু শায়বা বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবনে সুলায়মান আল আসবাহানী থেকে, তিনি ইবনে আবু লায়লার সূত্রে হযরত আলী রা. থেকে। এতেও মুখতার নামের কেউ নেই। এর আরো দুটি সূত্র আছে মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে। (হা. ২৮০১, ২৮০৪) সেখানেও মুখতার নামের কেউ নেই। আসলে ইমাম বুখারীর মন্তব্যটি যে সূত্র সম্পর্কে, সেখানে মুখতার নামক রাবী আছেন। আর লেখক গড়ে সব সূত্র সম্পর্কেই ঐ মন্তব্যটি জুড়ে দিয়েছেন।
এরপর লেখক জ্ঞাতব্য শিরোনামে লিখেছেন, উক্ত বর্ণনাগুলো ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়ার বিরুদ্ধে পেশ করা হয়। যদিও তাতে সূরা ফাতিহার কথা নেই। জেহরী ছালাতে সূরা ফাতিহার পরের সাধারণ ক্বিরাআত পড়ার কথা বলা হয়েছে।
লেখক তার এ দাবির পক্ষে হাদীসের কোন দলিল পেশ করতে পারেন নি। টীকায় শুধু ইমাম বুখারীর মতটি উল্লেখ করে দিয়েছেন। ইমাম বুখারীর মত দিয়েই যদি ঐ দাবি প্রমাণিত হয়, তবে ইমাম আবু হানীফার মত দিয়ে ভিন্ন মতটি প্রমাণিত হবে না কেন?
১০. ১১ তম দলিলরূপে লেখক বলেছেন, عن زيد بن ثابت قال : من قرأ خلف الإمام فلا صلاة له
যায়েদ বিন ছাবিত বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিছু পড়বে তার ছালাত হবে না।
এ বর্ণনাটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য হলো, বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। এর সনদে আহমদ ইবনু আলী ইবনু সালমান মারূযী নামে একজন রাবী আছে। সে হাদীস জাল করত। ইবনু হিব্বান বলেন, এই হাদীছের কোন ভিত্তি নেই।
আসলে লেখকের উচিৎ ছিল লেখার পূর্বে কোন বক্তব্য বোঝার ন্যূনতম যোগ্যতাটুকু অর্জন করা, শাস্ত্রীয় বিষয়ের কথা আর বললাম না। যে তিনটি হাদীস গ্রন্থের বরাত তিনি টীকায় উল্লেখ করেছেন, তার কোনটিতেই ঐ আহমদ ইবনে আলী নেই। তিনটি গ্রন্থে এর সনদ বা সূত্র নিম্নরূপ :
হযরত যায়দ ইবনে ছাবিত রা. থেকে বর্ণনা করেছেন তাঁরই নাতি মূসা ইবনে সা’দ, (তাকে মূসা ইবনে সাঈদও বলা হয়), তার থেকে বর্ণনা করেছেন উমর বা আমর ইবনে মুহাম্মদ, তার থেকে বর্ণনা করেছেন দাউদ ইবনে কায়স (তিনি হলেন দাউদ ইবনে সা’দ ইবনে কায়স), ও ওয়াকী। দাউদ থেকে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন ইমাম মুহাম্মদ (পৃ. ১০২) ও আব্দুর রাযযাক (হা. ২৮০২)। আর ওয়াকী থেকে উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আবু শায়বা (হা. ৩৮০৯)।
এ হাদীসটি দুভাবে বর্ণিত হয়েছে।
ক. মাওকূফ বা যায়দ রা.এর বক্তব্যরূপে। এটিই উপরের তিনটি হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।
খ. মারফূ বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসাবে। এ বর্ণনাটি মারফূ হওয়া প্রমাণিত নয়। এর সনদেই ঐ আহমাদ ইবনে আলী নামক হাদীস জালকারী রাবী আছে। আর এ মারফূ হাদীসটি সম্পর্কেই আলবানী সাহেব জাল বলে মন্তব্য করেছেন। লেখক এখানে হাদীস উল্লেখ করেছেন মাওকূফটি, বরাতও দিয়েছেন মাওকূফ বর্ণনার। আর এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন মারফূ বর্ণনার আলোচনা। মাওকূফ বর্ণনাটির রাবীগণ সকলেই বিশ্বস্ত। একথা আলবানী সাহেবও স্বীকার করেছেন। (যঈফা, হাদীস ১১) তবে তিনি শুধু বায়হাকীর কিতাবুল কিরাআতের উপর নির্ভর করার কারণে একটু জটিলতায় পড়েছেন।
১১. ১২ তম দলিলরূপে লেখক উদ্ধৃত করেছেন হযরত জাবের রা.এর হাদীস। হাদীসটি নিম্নরূপ :
عن جابر بن عبد الله يقول : من صلى ركعة لم يقرأ فيها بأم القرآن فلم يصل إلا أن يكون وراء الإمام
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলতেন, যে ব্যক্তি এক রাকআত ছালাত আদায় করল (সঠিক অনুবাদ হবে, যে ব্যক্তি নামাজের কোন একটি রাকাত আদায় করল) অথচ সূরা ফাতিহা পড়ল না, তার ছালাত হবে না। তবে ইমামের পিছনে থাকলে হবে।
এ বর্ণনা সম্পর্কে লেখক মন্তব্য করেন, বর্ণনাটি যঈফ। ইমাম দারাকুতনী বলেন, এটা বাতিল বর্ণনা। মালেক থেকে বর্ণিত হয় নি। মূলত ‘তবে ইমামের পিছনে থাকলে হবে’ এ অংশটুকু ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া বর্ণনাটি মাওকূফ।
এখানেও লেখক পূর্বের দলিলটির মতো একই কা- ঘটিয়েছেন। এ বর্ণনাটিও মারফূ ও মাওকূফ দুভাবেই আছে। দারাকুতনীর মন্তব্যটি মারফূ বর্ণনা সম্পর্কে। লেখক মাওকূফ বর্ণনাটি উল্লেখ করে এর সঙ্গে দারাকুতনীর মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন।
মাওকূফ বর্ণনাটির সনদ সহীহ, এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। ইমাম তিরমিযী স্পষ্টভাবে এটিকে সহীহ বলেছেন। মুয়াত্তা মালেকেও অত্যন্ত মজবুত সনদে এটি উদ্ধৃত হয়েছে। এ বর্ণনাটির কারণেই ইমাম মালেক সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না ও ইমাম আহমাদ প্রমুখ অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও ফকীহ বলেছেন, ইমামের পেছনে কিরাআত পড়া জরুরী নয়।
মারফূ বর্ণনাটি খিলাঈ রাহ. উদ্ধৃত করেছেন তার আল ফাওয়াইদ গ্রন্থে। এর সনদও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এর সনদে শুধু একজন রাবী আছেন, যাকে নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি হলেন ইয়াহয়া ইবনে সালাম। আবু যুরআ রাযী তার সম্পর্কে বলেছেন, لا بأس به ربما وهم তার মধ্যে সমস্যার কিছু নেই, তবে মাঝে মধ্যে তিনি ভুল করে বসেন। আবু হাতেম রাযী বলেছেন, صدوق তিনি সত্যনিষ্ঠ। ইবনে হিব্বান তাকে ছিকাত গ্রন্থে উল্লেখ করে বুঝিয়েছেন, তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। তবে তিনিও বলেছেন,ربما أخطأ মাঝেমধ্যে তিনি ভুলের শিকার হন। ইবনুল জাযরী বলেছেন, كان ثقة ثبتا ذا علم بالكتاب والسنة ومعرفة اللغة তিনি বিশ্বস্ত ও সুদৃঢ় ছিলেন। কুরআন-সুন্নাহ ও আরবীভাষা সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞাত ছিলেন। আবুল আরাব তাবাকাত গ্রন্থে লিখেছেন, وكان من الحفاظ ومن خير خلق الله তিনি ছিলেন হাফেজে হাদীস ও উৎকৃষ্টতম মানুষ। হাফেজ যাহাবী তাকে সিয়ার গ্রন্থে আল ইমামুল আল্লামা উপাধি যোগে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তার এ বর্ণনা কেউ উদ্ধৃত করলে প্রতারণা হবে কেন?
১২. ১৩ তম দলিলটি লেখক এভাবে উল্লেখ করেছেন,
عن ابن عباس عن النبي صلى الله عليه وسلم : تكفيك قراءة الإمام خافت أو جهر
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ইমামের কিরাআতই তোমার জন্য যথেষ্ট। ইমাম আস্তে পড়েন আর জোরে পড়েন।
এটি সম্পর্কে লেখক মন্তব্য করেছেন, বর্ণনাটি যঈফ। এর মধ্যে আছেম নামে একজন রাবী আছে। ইমাম দারাকুতনী বলেন, সে নির্ভরযোগ্য নয়।
কিন্তু আসেম সম্পর্কে দারাকুতনীর মন্তব্যই শেষ কথা নয়। মা’ন ইবনে ঈসা ও মুহাম্মদ ইবনুল মুছান্না দুজন দারাকুতনীর বহুপূর্বে তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। একারণে ইবনে হাজার তার তাকরীব গ্রন্থে তাকে যঈফ আখ্যা না দিয়ে বলেছেন, صدوق يهم তিনি সত্যনিষ্ঠ, কখনো সখনো ভুল করে বসেন।
এরপর লেখক বলেছেন, এ বর্ণনাগুলো কোন নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয় নি। বর্ণিত হয়েছে মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায়, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, মুয়াত্তা মুহাম্মদ ও তাহাবী প্রভৃতি গ্রন্থে।
হ্যাঁ, এতক্ষণে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। এসব হাদীসগ্রন্থ নির্ভরযোগ্য নয় তার প্রমাণ কি? তবে কি লা-মাযহাবী বিরোধী হাদীস উদ্ধৃত হওয়ায় এগুলো অনির্ভরযোগ্য হয়ে গেল? ইবনে আবূ শায়বা তো বুখারী-মুসলিমের উস্তাদ, তার সূত্রে তারা অনেক হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। এমনিভাবে আব্দুর রাযযাক বুখারী-মুসলিমের দাদা উস্তাদ, তার সূত্রেও তারা অনেক হাদীস এনেছেন। তাহলে তাদের কিতাব অনির্ভরযোগ্য হলো কিরূপে?
ইমাম তাহাবীর কিতাবটিই বা কিভাবে অনির্ভরযোগ্য হয়ে গেল? লেখকের যদি নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভর কিতাবের সংজ্ঞা ও মানদ- জানা না থাকে, তবে তার উচিৎ ছিল এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আর যদি জানা থাকে, তবে জেনেবুঝে কলমের ভুল ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিৎ ছিল।
তাছাড়া প্রথম দলিলটি লেখক নিজেই আবু দাউদ ও তিরমিযীর বরাতে উল্লেখ করেছেন। জাবের রা.এর বর্ণনাটিও তিরমিযী, মুয়াত্তা মালেক প্রভৃতি কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে। যায়দ ইবনে ছাবিত রা.এর একটি বর্ণনাও মুসলিম শরীফের বরাতে আমাদের এই গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। ইবনে উমর রা.এর বর্ণনাও সহীহ সূত্রে মুয়াত্তা মালেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তাহলে লেখকের এ ঢালাও মন্তব্যের মতলব কি?
এরপর লেখক আরো লিখেছেন, ইমাম তিরমিযী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক মন্তব্য করেন, আমি ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ করি এবং অন্য মানুষেরাও করে। কিন্তু কুফাবাসী করে না।
এখানে লেখক সত্য গোপন করেছেন। ইবনুল মুবারকের মন্তব্যটি ইমাম তিরমিযী روي عن ابن المبارك (ইবনুল মুবারক থেকে বর্ণিত আছে) শব্দ দ্বারা পেশ করেছেন। ইবনুল মুবারক পর্যন্ত এর কোন সনদ তিনি উল্লেখ করেন নি। একই শব্দ দিয়ে ইমাম তিরমিযী যখন ২০ রাকাত তারাবীহ সম্পর্কে বলেছেন, روي عن عمر وعليউমর ও আলী রা. থেকে এটা বর্ণিত হয়েছে, তখন এই লা-মাযহাবী বন্ধুটি তারাবীহর রাকআত সংখ্যা পুস্তিকায় খুব জোর দিয়ে দাবী করেছেন, এটা তাদের থেকে দুর্বলভাবে প্রমাণিত। আর তিরমিযী এই দুর্বলতার প্রতিرُوي শব্দ দিয়ে ইংগিত করেছেন। (পৃ. ৫৭) সেই একই শব্দ এখানে এসে নিজের মতলবের বেলায় সবল হয়ে গেল কিভাবে তা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। এর চেয়ে বড় কথা হলো, ইবনুল মুবারকের মন্তব্যটির শেষের একটি বাক্য ইমাম তিরমিযী উল্লেখ করলেও এই লেখক গোপন করে গেছেন। কারণ বাক্যটি তার মতের উপর কুঠারাঘাত করে। ঐ বাক্যে ইবনুল মুবারক রহ. বলেছেন, وأرى أن من لم يقرأ صلاته جائزة অর্থ : আমি মনে করি, যে ব্যক্তি কেরাআত পড়বে না তার নামায জায়েয ও সঠিক হবে। তাছাড়া ইবনুল মুবারকের মত হলো, জাহরী নামাযে মুকতাদী সূরা ফাতেহা পাঠ করবে না। সিররী নামাযে করবে। (তাও করা ফরজ-ওয়াজিব নয়, না করলেও নামায হয়ে যাবে।) দেখুন, আবু নাসর মারওয়াযী কৃত ইখতিলাফুল ফুকাহা, নং ২২।
এবার দেখুন, ইবনুল মুবারকের মত নিয়ে লা-মাযহাবীদের খুশি হওয়ার কী আছে?
ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়ার ছহীহ হাদীছসমূহ শিরোনামে লেখক তিনটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীসগুলো সম্পর্কে লেখকের দাবীর কিছু পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো।
১.উবাদা ইবনে সামিত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার নামায হয় না।
এর উপর ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদ নির্ধারণ করেন, প্রত্যেক সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য ক্বিরাআত (সূরা ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফর অবস্থায় হোক, জেহরী ছালাতে হোক বা সির্রী ছালাতে হোক।
এ হলো লেখকের দলিল। অর্থাৎ এ হাদীসটি মুক্তাদী সম্পর্কেও কি না, সে কথার দলিলরূপে তিনি ইমাম বুখারীর মতামত উল্লেখ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ এ হাদীসের মর্ম সম্পর্কে কী বলেন, সেটা লেখক বিবেচনায় আনেন নি। অন্যান্য মুজতাহিদ ইমামগণ কী বলেন, তারও কোন উল্লেখ তিনি করেন নি।
বড়ই আফসোস, রাসূল সা. এর সাহাবী হযরত জাবের রা. বলেছেন, এ হাদীস মুক্তাদী সম্পর্কে নয়। ইমাম বুখারী বলেছেন, মুক্তাদী সম্পর্কেও। লেখক সাহাবীর কথা বাদ দিয়ে ইমাম বুখারীর কথা গ্রহণ করেছেন।
ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ তিনজনই হযরত জাবের রা.এর ব্যাখ্যা গ্রহণ করে বলেছেন, মুক্তাদির জন্য সূরা ফাতিহা পড়া জরুরী নয়। লেখক এটা বিভ্রান্তিকর বলে চরম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এরপর এদিক সেদিকের নানা কথা বলে পরিশেষে লিখেছেন, ‘এজন্য ইমাম বুখারীসহ অন্যান্য প্রায় সকল মুহাদ্দিছ জামাআতে পড়ার পক্ষেই উক্ত হাদীছ পেশ করেছেন।’
এ দাবী লেখকের মিথ্যাচার বৈ নয়। তিনি নিজেও তা জানেন। এজন্য প্রায় সকল মুহাদ্দিছ বললেও টীকায় বরাত দিয়েছেন শুধু ইবনে মাজা’র।
ইমাম তিরমিযী তো মুক্তাদির কিরাআত পড়ার অনুচ্ছেদ থেকে ৪৮/৪৯ অনুচ্ছেদ পূর্বে এই হাদীসটি উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই হাদীসের সঙ্গে মুক্তাদির দূরতম সম্পর্কও নেই।
যদি ধরেও নিই, এই হাদীসে মুক্তাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তথাপি রাসূল সা. যেহেতু বলেছেন ইমামের পড়াই মুক্তাদির পড়া বলে বিবেচিত হবে, তাই মুক্তাদি চুপ থাকলেও ধরা হবে সেও পড়েছে। আলবানী সাহেবের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি গ্রন্থের (বঙ্গানুবাদ) টীকায় লা-মাযহাবী বন্ধুরা কত সুন্দর লিখেছেন, ‘অতঃপর গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, ইমামের সরবে কিরাআত কালে মুক্তাদীর পাঠ না করে চুপ থেকে শুনার নির্দেশ ও সূরা ফাতিহা পাঠ ছাড়া ছলাত হয় না এর মাঝে কোন দ্বন্দ্ব নেই। বরং দু’হাদীছের মর্ম একই। কারণ একাগ্রতার সাথে চুপ থেকে শুনলেই মনে মনে পড়া হয়ে যায়। (সম্পাদক) (পৃ. ৮৪)
২.২য় নম্বরে লেখক মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীস উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. নবী সা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যে ব্যক্তি কোন ছালাত আদায় করল, অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার ছালাত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। এ কথাটি তিনি তিন বার বলেছেন। তখন আবু হুরায়রা রা.কে জিজ্ঞেস করা হল, আমরা যখন ইমামের পেছনে থাকি? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি চুপে চুপে পড়।
এ বর্ণনাটি সম্পর্কে তিনটি কথা।
এক. اقرأ بها في نفسك বাক্যটির অর্থ যেমন ‘তুমি চুপে চুপে পড়’ হয়, তেমনি ‘তুমি মনে মনে পড়’ও হয়। ইবনে আব্দুল বার রহ. এই দ্বিতীয় অর্থই গ্রহণ করেছেন। এমতাবস্থায় এটি মুখে পড়ার স্পষ্ট প্রমাণ হয় না।
দুই. এটি হযরত আবু হুরায়রা রা.এর নিজস্ব মত ও ইজতিহাদ। তার প্রমাণ, এরপর তিনি এমন কথা সরাসরি রাসূল সা. থেকে বর্ণনা না করে একটি হাদীসে কুদসী উল্লেখ করেছেন, যেখানে সূরা ফাতিহার গুরুত্ব প্রকাশ করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি সূরা ফাতিহাকে আমার মধ্যে ও আমার বান্দার মধ্যে দুভাগে ভাগ করেছি। (আলহাদীস)
সুতরাং আবু হুরায়রা রা.এর মতটি দলিল হতে পারলে ইবনে মাসউদ, যায়দ ইবনে ছাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও জাবের রা. প্রমুখের ফাতিহা না পড়ার মত দলিল হতে পারবে না কেন?
তিন. এটি সিররী নামায সম্পর্কে। কারণ জাহরী নামায সম্পর্কে আবু হুরায়রা রা. নিজেই বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপত্তির কারণে সাহাবীগণ কিরাআত পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে এমন একটি ফতোয়াও উদ্ধৃত রয়েছে। ১৫২ নং পৃষ্ঠায় এসব তুলে ধরা হয়েছে।
দুই নং হাদীসটি উল্লেখ করার পর লেখক বলেন, উক্ত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম-মুক্তাদি সকলেই সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। সূরা ফাতিহা শুধু ইমামের জন্য নয়। কারণ আল্লাহর বান্দা শুধু ইমাম নন, মুক্তাদিও আল্লাহর বান্দা।
কিন্তু মুক্তাদিও যে আল্লাহর বান্দা এমন মোটা কথা ইমাম আবু হানীফা, মালেক ও আহমদ কেউ বুঝলেন না, হযরত জাবের রা. ও অন্যান্য সাহাবীগণও বুঝতে পারলেন না: এমন কথা কি কেউ কল্পনা করতে পারে?
ইমামের পড়াই যখন মুক্তাদির পড়া বলে গণ্য হয়, তখন ইমাম-মুক্তাদি সকল আল্লাহর বান্দাই কি পড়ার মধ্যে শরিক হচ্ছে না?
৩.৩য় নম্বরে লেখক আবু দাউদের বরাতে রিফাআ ইবনে রাফে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উক্ত হাদীসে রাসূল সা. নামাযে ত্রুটিকারী জনৈক ব্যক্তিকে বলেছেন, যখন তুমি কেবলামুখী হবে তখন তাকবীর দিবে। অতঃপর সূরা ফাতিহা পড়বে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আরো কিছু অংশ পাঠ করবে। (হা. ৮৫৯)
পাঠক এ কথা জেনে অবশ্যই আশ্চর্য হবেন যে, এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন ইমাম বুখারী (হা. নং ৭৫৭, ৭৯৩, ৬২৫১, ৬৬৬৭), ইমাম মুসলিম (হা. নং ৩৯৭), ইমাম তিরমিযী (হা. ৩০২, ৩০৩), আবু দাউদ (হা. নং ৮৫৬-৮৬১), নাসাঈ (হা. ৮৮৪) ও ইবনে মাজাহ (হা. ১০৬০) প্রমুখ। তন্মধ্যে শুধু আবু দাউদের ৮৫৯ নং বর্ণনায় এসেছে, ‘অতঃপর তুমি সূরা ফাতিহা পড়বে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আরো কিছু অংশ পাঠ করবে।’ এছাড়া সকল বর্ণনায় এসেছে, ثم اقرأ ما تيسر معك من القرآنঅতঃপর তুমি কুরআনের যে অংশই সহজ লাগে পাঠ কর।
হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয়টি কিতাবে বহুসূত্রে বর্ণিত এই বাণীটি পরিহার করে লেখক আবু দাউদের একটি মাত্র বর্ণনাকে নিজের মতলব হাসিলের জন্যই এখানে উদ্ধৃত করেছেন। আবু দাউদের এ বর্ণনাটিকে আলবানী সাহেব হাসান বলেছেন। আমাদের দৃষ্টিতে অন্য সকল সহীহ বর্ণনার বিরোধী হওয়ার কারণে এটি শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা।
খুব সম্ভব এই লেখকই ইন্টারনেটে আমাদের ইকামত সম্পর্কিত মাসআলার জবাব দিতে গিয়ে নসীহত করেছেন বুখারী-মুসলিমের হাদীস থাকতে অন্য হাদীস গ্রহণ না করতে। অথচ সেখানে পেশকৃত আমাদের হাদীসগুলো সহীহসূত্রে বর্ণিত। আর এখানে তিনি বুখারী-মুসলিমের হাদীস বাদ দিয়ে শায একটি বর্ণনাকে গ্রহণ করলেন। তাহলে কি নসীহতটি একান্ত আমাদের জন্য?
আসল কথা কি, বুখারী-মুসলিমের বর্ণনাটি গ্রহণ করলে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা যে ফরজ বলে তারা বলে থাকেন সে কথা আর প্রমাণিত থাকে না। সে কারণেই হাদীসটির প্রসিদ্ধ এ বাক্যটি বাদ দিয়ে শুধু আবু দাউদের বরাতে উদ্ধৃত বাক্যটি দলিলরূপে পেশ করা হয়েছে।
তাছাড়া এ হাদীসে মুক্তাদির কোন প্রসঙ্গ নেই। এখানে রাসূল সা. একজন বেদুইন সাহাবীকে নামায শেখাচ্ছিলেন, যিনি তাঁর সামনে নামায পড়ছিলেন এবং বারবার ভুল করছিলেন। সুতরাং এ হাদীসে মুক্তাদির প্রসঙ্গ টেনে আনার কোন অর্থ হয় না।