জোরে আমীন বলার হাদীস : একটু পর্যালোচনা
জোরে আমীন বলা সম্পর্কিত হাদীসগুলি সম্পর্কে মূল কথা হলো, যেটি সহীহ, সেটি সুস্পষ্ট(صريح) নয়। আর যেটি সুস্পষ্ট সেটি সহীহ নয়। যেমন:
১.বুখারী ও মুসলিম প্রভৃতি গ্রন্থে اذا امن الامام فامنواহাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছ্।ে এ বাক্যটির একটি অর্থ হলো, ইমাম যখন আমীন বলবে তখন তোমরাও আমীন বলবে। এ অর্থে ইমাম বুখারীসহ অনেকেই এটি দ্বারা ইমামের জোরে আমীন বলা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রথমতঃ হাদীসটির শুধু এই একটি অর্থই নয়, আরো অর্থের অবকাশ আছে। অনেকে হাদীসটির অর্থ করেছেন, ইমাম যখন আমীন বলতে ইচ্ছে করবে তখন তোমরা আমীন বলবে। যেহেতু ইমাম, মুকতাদী ও ফেরেশতার আমীন বলা এক সঙ্গেই হওয়া কাম্য। তাই ইমাম যখন আমীন বলতে যাবে তখন যদি মুকতাদী আমীন বলা শুরু করে, তবেই একসঙ্গে হওয়া সম্ভব। অন্যথায় ইমামের আমীন বলা শুনে যদি মুকতাদী আমীন বলতে যায় তবে একসঙ্গে বলা হবে না।
এ অর্থে হাদীসটি জোরে আমীন বলার কোন প্রমাণই হয় না। দ্বিতীয়তঃ যদি প্রথম অর্থটিই ধরা হয়, তবুও জোরে আমীন বলার ব্যাপারে এর নির্দেশনা সুস্পষ্ট নয়। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে যখন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এসময় ইমামও আমীন বলে, তখন ইমাম যখন আমীন বলে কথাটির অর্থ দাঁড়াবে সূরা ফাতেহা শেষ করে ইমামতো আমীন বলবে, এসময় তোমরাও আমীন বলবে। এই কারণেই বুখারী, মুসলিম ও মুয়াত্তা মালেক প্রভৃতি গ্রন্থে এ হাদীসের শেষে ইবনে শিহাব যুহরী র. এর একথাটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এসময় আমীন বলতেন। প্রণিধানযোগ্য যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি হর-হামেশাই জোরে আমীন বলতেন তবে যুহরী র. এর একথা পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলো কেন?
২. আবূ হুরায়রা রা. থেকে একটি হাদীস সহীহ ইবনে খুযায়মায় (৫৭১) সহীহ ইবনে হিব্বানে (১৮০৬) বায়হাকী (২৪২২) সুনানে দারাকুতনীতে(১/৩৩৫) উদ্ধৃত হয়েছে। উক্ত হাদীসে বলা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেহা শেষ করে উচ্চস্বরে আমীন বলতেন। এ হাদীসটি সহীহ নয়। এর সনদে ইয়াহ্ইয়া ইবনে উছমান সমালোচিত রাবী। তাঁর উস্তাদ ইসহাক ইবনে ইবরাহীম যুবায়দীও দুর্বল রাবী। আবূ দাউদ র. ও নাসাঈ র. তাঁকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। হিম্সের মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে আওফ আত্ তায়ী র. তাকে মিথ্যুক আখ্যা দিয়েছেন। হাকেম র. মুস্তাদরাক গ্রন্থে (৮১২) ও বায়হাকী আল মারিফা গ্রন্থে (৩১৭৫) এটিকে সহীহ বলেছেন এবং দারাকুতনী র. সুনান গ্রন্থে হাসান আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ইলাল গ্রন্থে দারাকুতনী র. এর সনদে ও মতনে এখতেলাফ উল্লেখ করে বলেছেন والمحفوظ عن الزهرى اذا امن الامام فأمنوا অর্থাৎ আবূ হুরায়রা রা. থেকে যুহরী র. এর সঠিক বর্ণনাটি হলো ইমাম যখন আমীন বলেন তোমরাও তখন আমীন বলো। (দ্র.আছারুস-সুনান,পৃ. ১২১,১২২)
উল্লেখ্য, সহীহ ইবনে খুযায়মার টীকায় আলবানী সাহেবও এটিকে যয়ীফ বা দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। (হাদীস নং ৫৭১)
৩. ইবনে উমর র. হতে দারাকুতনীর সুনানে পূর্বোক্ত বক্তব্যের মতোই আরেকটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। (দ্র, ১ম খ, ৩৩৫পৃ,) এর সনদে একজন বর্ণনাকারী আছেন বাহর আস সাক্কা (بحر السقاء), দারাকুতনী র. হাদীসটি উল্লেখ করে নিজেই বলেছেন, বাহর আস সাক্কা যঈফ।
৪. হযরত আলী রা. থেকে এ মর্মে একটি হাদীস সুনানে ইবনে মাজা’য় (৮৫৪) ও মুজামে আওসাতে (৫৫৫৯) উদ্ধৃত হয়েছে। সেটিও যঈফ। এর সনদে মুহাম্মদ ইবনে আবী লায়লা আছেন। তিনি সমালোচিত। তথাপি ইবনে মাজার বর্ণনায় জোরে আমীন বলার কথা নেই। আওসাতের বর্ণনায় আছে, কিন্তু এর সনদ অত্যন্ত দুর্বল। এর একজন বর্ণনাকারী দেরার ইবনে সুরাদকে ইবনে মাঈন ও ইবনে হিব্বান মিথ্যুক বলেছেন। বুখারী ও নাসাঈ বলেছেন, মাতরুকুল হাদীস অর্থাৎ তার হাদীস বজর্নযোগ্য। আবু হাতিম রাযী বলেছেন, তাকে প্রমাণরূপে পেশ করা উচিত নয় ।
৫. আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত সুনানে ইবনে মাজা’য় উদ্ধৃত অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে, লোকেরা আমীন বলা ছেড়ে দিয়েছে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেহা শেষ করার পর এমনভাবে আমীন বলতেন যে, প্রথম কাতারের লোকেরা তা শুনে ফেলতো, ফলে মসজিদ আমীন ধ্বনীতে গুঞ্জরিত হয়ে উঠতো। (হাদীস ৮৫৩), আবু ইয়ালা (৬২২০)।
এ হাদীসটিও সহীহ নয়। এর সনদে আবূ হুরায়রা রা. এর চাচাত ভাই আছেন, যার সম্পর্কে ভাল-মন্দ কিছুই জানা যায় না। তাঁর শাগরেদ বিশর ইবনে রাফে চরম দুর্বল। ইবনে হিব্বান র. তাঁর সম্পর্কে লিখেছেনيروى الموضوعات كأنه المتعمد لها :অর্থাৎ তিনি জাল হাদীস বর্ণনা করতেন, মনে হয় যেন তিনিই এগুলির আবিস্কারক। আলবানী সাহেব নিজেও এটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলেছেন। (দ্র, যয়ীফে আবূ দাউদ)
আবূ দাউদ শরীফেও একই সূত্রে এটি উদ্ধৃত হয়েছে। তবে সেখানে ‘ফলে মসজিদ আমীন ধ্বনীতে গুঞ্জরিত হয়ে উঠতো’ কথাটি নেই। (হাদীস নং ৯৩৪)
৬. উম্মুল হুসাইন (ام الحصين) রা. থেকে মুসনাদে ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইতে (২৩৯৬) এবং তাবারানীর আল কাবীরে (৩৮৩) উদ্ধৃত হাদীসে বলা হয়েছে তিনি মহিলাদের কাতারে থেকেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমীনের আওয়ায শুনতে পেয়েছেন। আরো দ্র. মুসনাদে আবু ইয়ালা (৩১৩), শারহু মুশকিলিল আছার, (৫৪০৭)। এ হাদীসটিও সহীহ নয়। এর সনদে ইসমাঈল ইবনে মুসলিম মক্কী আছেন, তিনি যঈফ বা দুর্বল। তাছাড়া আবু ইয়ালা ও তাহাবীর বর্ণনায় শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, রাসূল সা. ফাতেহা শেষে আমীন বলেছেন। তাঁর শোনার কথা বর্ণিত হয় নি।
৭. আতা র. থেকে বায়হাকী র. উল্লেখ করেছেন যে, তিনি দু’শো সাহাবীকে পেয়েছেন যারা ইমামের সূরা ফাতেহা পাঠ শেষে জোরে আমীন বলতেন।
এ হাদীসটিও সহীহ নয়। কেননা হাসান বসরী র. ছিলেন আতার চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু তিনিও একশো বিশজনের বেশী সাহাবীর দেখা পাননি। মুজাহিদ র. এর অবস্থাও তাই। তাহলে আতা কি করে এত সাহাবীর দেখা পেলেন? অধিকন্তু আতা র. থেকে এটি বর্ণনা করেছেন খালেদ ইবনে আবী আইয়্যুব। তিনি মাজহুল বা অজ্ঞাত-অখ্যাত বর্ণনাকারী। মাজহুল ব্যক্তির হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।